...

0 views

এক রহস্যময় স্টেশন
লেখক : সায়ন পাত্র

স্টেশনে নাকি ভুতের আড্ডা। কথাটা শুনে অবাক হলেন না ? আবার হয়তো অনেকের হাসিও পাচ্ছে। ঠিকই শুনেছেন। ঘটনাটা ঘটেছিল আজ থেকে সাত বছর আগে যখন আমার পোস্টিং হয় রায়নগর স্টেশনে। সেই ঘটনাটাই আমি আজ আপনাদের সঙ্গে সেয়ার করতে চলেছি ?

রায়নগর স্টেশনটা মশাগ্রাম থেকে বাঁকুড়া যাওয়ার পথে অন্যতম স্টেশন। অনেক পুরানো স্টেশন। তবে আশে পাশে তেমন কোন বসতি নেই। শুনেছি এই স্টেশনে নাকি কি সব ভুতুড়ে কান্ড ঘটে। তিন চারটে লাশও নাকি পাওয়া গেছে। তাই কারোর পোস্টিং হলে কোনো স্টেশন মাস্টারি এক্সেপ্ট করেনা। কিন্তু আমার বাপু ওসব ভুত বিশ্বাস হয় না। আমার কাছে যখন মনজিতবাবুর চিঠি এসেছিল তার ঠিক এক সপ্তাহের মধ্যে আমি জিনিসপত্র গুছিয়ে চলে গিয়েছিলাম। আগের স্টেশন মাস্টার আমাকে দেখে বললো, " তুমি তো বোধ হয় নতুন নয় এই কাজে? তবে তোমাকে একটা সাবধান করে যাচ্ছি এই স্টেশনটে একটু সাবধানে থেকো। সন্ধের পর থেকে একদম বেরুবে না। এখানে প্রচুর শেয়ারের উপদ্রব। প্রতিদিন জল আর খাবার ট্রেনের চালক অরবিন্দু তোমাকে দিয়ে দেবে।" আমি ঠিক মতো আমার কাজ বুঝে নিলাম। শেষে একবার ওনাকে জিঞ্জেস করলাম, " আচ্ছা আপনি এখানে কখনো ভুত দেখেছেন ? " আমার প্রশ্ন শুনে তিনি একটু থতমত খেয়ে বললেন , " নিজের চোখে হয়তো দেখিনি কিন্তু প্রায় ভুতুড়ে আওয়াজ শুনেছি। গত সপ্তাহে সকালে উঠে দেখি একখা লাস স্টেশনে পড়ে ছিল। প্রায় অর্ধেকের উপর শিয়ালে খেয়ে ফেলেছে। পুলিশ এসেছিল কিন্তু মৃত্যুর কোনো কারন উদ্ধার করতে পারেনি। তাই আমি মনজিতবাবুর কাছে আবেদন জানিয়েছিলাম। উনি আমাকে খুব ভালো ভাবেই চেনেন। জাগ্গে তোমাকেও বলে রাখি তুমিও এখানে বেশিদিন টিকতে পারবে না। " তবে ওনার কথা শুনে মনে হচ্ছিল যে উনি কিছু একটা লুকাচ্ছেন। আবার কোথাও যেন একটা মনে হচ্ছিল তিনি খুবই ভয়ে ভয়ে থাকতেন এখানে। সেদিন মোটামুটি রাতে ঘুমটা ভালই হয়েছিল। পরের দিন ঠিক আটটার দিকে আমি অরবিন্দুদার কাছ থেকে জল আর চালের দুটো বস্তা আর কিছু খাবার জিনিস নিয়ে নিলাম। তবে এই স্টেশনে ততটা ভিড় নেই। কিছু চাষি আর ব্যবসায়ী মানুষ নামে এখানে। এক ভদ্রলোক আমাকে বলেছিল এখান থেকে সাথে তিন ঘণ্টা হাঁটার পর গ্রাম। দিন তিনেক পর আমি তখন সন্ধেবেলায় ভাত খাচ্ছি। আচমকা একটা শব্দ উঠলো। ঠিক যেন অনেকগুলো শিয়াল মিলে কোনো কিছু টেনে ফেলে দিলো। আমি জানালা দিয়ে মুখ বাড়াতেই যা দেখলাম নিজের চোখকে বিশ্বাস করতে পারলাম না। এক মহিলার রক্তাক্ত দেহ কতো গুলো শিয়াল টানতে টানতে নিয়ে যাচ্ছে। পরেরদিন আমি অরবিন্দুদাকে সবটা জানালাম। তিনি বললেন, " নিজের ভালো চাও তো এখানে থেকো না। মনজিতবাবুকে বলো অন্য কোথাও বদলি করে দিতে। কোনো স্টেশন মাস্টারই এক মাসের বেশি টিকতে পারেনি। আর একটা কথা বলি শোনো এই লাসের কথাটা কাউকে বলার প্রয়োজন নেই। নইলে ফালতু কেসে জড়িয়ে যাবে। তাই বলি মনজিতবাবুকে কালি একটা চিঠি করো।" ওনার কথামতো আমি একটা চিঠি পাঠালাম মনজিতবাবুর ঠিকানায়। দুসপ্তাহ কেটে গেল তবুও কোন উত্তর এলো না। এই দুসপ্তাহে আরো একটা লোকের কাটা দেহ লাইনের উপর থেকে পাওয়া গেল। ব্যাপারটা আমার কাছে ক্রমশই উদ্বেগজনক হয়ে উঠলো। কিন্তু এদিকে মনজিতদার কাছ থেকে কোনো উত্তর এখনো পেলামনা। আমার কাটানো তিন সপ্তাহ চার দিন পর আমার জলের ড্রামটা বিকেলে উল্টে যায়। আর অন্য জলের ড্রাম আমার কাছে ছিল না। এক ভদ্রলোক আমাকে বলেছিল এখান থেকে মিনিট কুড়ি গেলে একটা ছোট্টো পুকুর আছে। আমি সাহস করে তাতে একটা বড়ো লাঠি আর একখানা কাটারি নিয়ে রওনা দিলাম জলের জন্য। পুকুরটা কেমন একটা অদ্ভুত মনে হলো। এদিকে জল নিয়ে আসতে আসতে সন্ধে নেমে এলো। হটাৎ কিছুটা দূরে একটা লোক আসছিল। তার হাতে একখানা বড়ো লাঠি আর একটা লন্ঠন। আমাকে দেখে বললো, " এখান থেকে চলে যা, নাহলে তুই বাঁচবি না। আগাম সাবধান করছি। তোক আমি খেয়ে ফেলবো।" লোকটাকে দেখে মনে হলো বেশ কয়েক সপ্তাহ ধরে খেতে পায়নি। আমি ওকে সন্ধায় পেটপুরে খাওয়ালাম। পরেরদিন সকালে দেখি লোকটা আর নেই। সেদিন রাতে দশটা নাগাদ ঘুম টা ভেঙে গেল। একটা ভাঙা গলায় শোনা গেল, " চলে যা, চলে যা বলছি। মরবি , তুই মরবি।" মনে হলো কোনো মানুষের গলা। আর একটা অদ্ভুত কথা মাথাচাড়া দিল। কেউ যেন এই একমাস ধরে আমার থাকায় অশন্তুষ্ট। পরের দিন আমি সেই পুকুরের কাছে গেলাম। ভালো করে খুঁজতে খুঁজতে একটা সুরঙ্গ দেখতে পেলাম। ভেতরে ঢুকতেই আমার চোখ কপালে উঠলো। একটা সোনার খনি। হটাৎ কেউ আসছে বলে মনে হলো। আমি তৎক্ষণাৎ লুকিয়ে পড়লাম। দেখলাম পাঁচটা লোক আসছে। তাদের সমস্ত কথা শোনার পর আমি বুঝলাম কেন এই স্টেশনে ভুতুড়ে কান্ড ঘটে। আর সেদিনের দুটো লাস কেন পড়েছিল সেটাও বুঝতে পারলাম। আর যে লোকটাকে সেদিন পেটপুরে খাওয়ালাম সেও ছিল ওখানে। পুরো বিষয়টা বোঝার পর আমি লুকিয়ে সেখান থেকে চলে গেলাম। পরের দিন আমি অরবিন্দুদার সঙ্গে চলে গেলাম কতুলপুর থানায়। সেখানে থানার হাবিলদার সাহেবকে পুরোটা খুলে বললাম। তিনি পুরো বিষয়টা শোনার পর আমাদের সাথে এলেন এবং ওই পাঁচ জন অপরাধীকে গ্রেফতার করলেন। পরের দিন অরবিন্দুদা আমাকে একটা খবরের কাগজ এনে দেখালেন। তাতে লেখা ছিল, " বর্ধমানের রায়নগর স্টেশনে থেকে কিছু টা দূরে সন্ধান মিলল এক সোনার খনির। এই খনির সঙ্গে জড়িত পাঁচ জন কে গ্রেফতার করেছে কতুলপুর থানার পুলিশ। অপরাধীরা এখন পুলিশ হেফাজতে আছে।" তারই সাথে বড়ো বড়ো অক্ষরে লেখা ছিল " এই খনি উদ্ধারে সাহায্য করেছে রায়নগর স্টেশনের স্টেশন মাস্টার শ্রী বাবলু সামন্ত। তারপর আমি রায়নগরেই থেকে গেছিলাম।


© A school boy