...

2 views

১ মে=‘মান্না ডে’ (দ্বিতীয় পর্ব)
(পূর্ব প্রকাশিতের পর)


সুধীন দাশগুপ্ত তাঁকে দিয়ে গাইয়েছেন অবিস্মরণীয় কিছু গান, যেমনঃ 'ওগো তোমার শেষ বিচারের আশায় আমি বসে আছি' (ডাক হরকরা), 'হয়তো তোমারই জন্য' ও 'জীবনে কি পাবো না' (সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়ের লিপে, 'তিন ভুবনের পারে' ছবিতে), 'এই শহর থেকে আরও অনেক দূরে' ও 'আমি শ্রী শ্রী ভজহরি মান্না' ('প্রথম কদমফুল' ছবিতে যথাক্রমে সৌমিত্র ও শমিত ভঞ্জর লিপে)। তরুণ মজুমদারের 'আগমন' ছবিতে আশা ভোঁসলের সঙ্গে মান্না দে গাইলেন বাউলাঙ্গের 'ভালোবাসার এই কী রে খাজনা!'

কিশোর কুমারের সঙ্গে যথাক্রমে 'পড়োসান' ও 'শোলে' ছবির ডুয়েট দুটিতেও মান্না দে সমুজ্জ্বল!—'এক চতুর নর' এবং 'ইয়ে দোস্তি হম্ নহীঁ তোড়েঙ্গে'। কমেডিয়ান মেহমুদের লিপে 'ভূত বাংলা' ছবিতে গাইলেন 'আও ট্যুইস্ট করেঁ'। 'তিসরি কসম' ছবিতে গাইলেন 'চলত্ মুসাফির মোহ্ লিয়া রে পিঞ্জরেওয়ালি মুনিয়া'; 'মেরা নাম জোকার' ছবিতে গাইলেন 'এ ভাই জরা দেখ্ কে চলো'; 'দিল্ হী তো হ্যায়' ছবিতে তাঁর অন্যতম স্মরণীয় ক্লাসিক্যাল গান 'লগা চুনরি মেঁ দাগ, ছুপাউঁ ক্যায়সে'; 'সীমা' (১৯৫৫) ছবিতে বলরাজ সাহনির লিপে 'তু পেয়ার কা সাগর হ্যায়'; 'মশাল' (১৯৫০) ছবিতে অশোক কুমারের জন্য শচীন দেব বর্মণের সুরে 'উপর গগন বিশাল'; 'বোম্বাই কা বাবু' (১৯৬০) ছবিতে দেব আনন্দের লিপে ও শচীন দেব বর্মণের সুরে 'তাক্ ধুম তাক্ ধুম বাজে'; শচীন দেব বর্মণের সুরে যথাক্রমে 'তলাশ' ছবিতে 'তেরে ন্যায়না তলাশ কর জিসে' এবং 'মেরি সুরত তেরি আঁখে' ছবিতে 'পুছোঁ ন ক্যায়সে ম্যাঁয় রয়ন বিতাই' (অশোক কুমারের লিপে, নজরুল গীতি 'অরুণকান্তি কে গো যোগী ভিখারী'-র সুর অবলম্বনে)—মান্না দে-র গাওয়া প্রতিটি গানের ভ্যারাইটি ও রেঞ্জ তর্কাতীত!

বাংলা বেসিক অ্যালবামের গান, রবীন্দ্রনাথের গান, নজরুল গীতি, ভক্তিগীতি, শ্যামাসঙ্গীত, ভাটিয়ালি, কাওয়ালি, গজল—তিনি গেয়েছেন সব ধরনের গানই। গেয়েছেন বাংলা, হিন্দি, মারাঠি, গুজরাটি, ভোজপুরি, পাঞ্জাবি, কন্নড়, অসমীয়া, মালয়ালম-সহ ১৪ টি ভারতীয় ভাষায়। তাঁর সঙ্গীত-জীবনে তিনজনের অবদান সবথেকে বেশি। কাকা কৃষ্ণচন্দ্র দে, কুমার শচীন দেব বর্মণ এবং শ্রীহেমন্ত মুখোপাধ্যায়। কৃষ্ণচন্দ্র দে তাঁর কাকা, কাকার সঙ্গেই বোম্বে আসা তাঁর। কাকার তত্ত্বাবধানেই গান শেখার হাতেখড়ি, পরে কাকার অনেক গান তিনি গেয়েওছেন, যার মধ্যে 'অন্ধকারের অন্তরেতে অশ্রুবাদল ঝরে' এবং 'ওই মহাসিন্ধুর ওপার হতে' বিশেষ উল্লেখযোগ্য। শচীন দেব বর্মণ তাঁর গানের গুরু, শচীনকর্তাও খুবই স্নেহ করতেন মান্না দে-কে। তাঁর সুরে অসংখ্য স্মরণযোগ্য গান গেয়েছেন মান্না দে। বরাবরের মোহনবাগান-ভক্ত মান্না দে-র সঙ্গে ইস্টবেঙ্গলের সমর্থক শচীনকর্তার খুনসুটিও হত প্রায়ই। আর হেমন্ত মুখোপাধ্যায়ের প্রতি মান্না দে-র ছিল অপরিসীম শ্রদ্ধা। "হেমন্তবাবু স্বর্ণকন্ঠের অধিকারী ছিলেন"—প্রায়শই বলতেন মান্না দে। 'খামোশী' ছবিতে হেমন্তর গাওয়া 'তুম পুকার লো' গানটির প্রসঙ্গে বলতে গিয়ে তিনি হেমন্ত মুখোপাধ্যায়ের কন্ঠকে 'মখমলের মতো' (ভেলভেটি আওয়াজ) বলে বর্ণনা করেছেন। এক সাক্ষাৎকারে এ কথাও তিনি বলেছেন যে, হেমন্ত মুখোপাধ্যায়ের গায়কী তাঁর সবচেয়ে ভালো লাগত। কিন্তু হেমন্তকে নকল করলে তো তাঁর চলবে না, তাই তিনি তাঁর গায়কী একটুখানি পরিবর্তন করে দর্শকদের মনোরঞ্জনের চেষ্টা করেছেন মাত্র।

মান্না দে-র কথা বলতে গেলে অবধারিত ভাবেই যাঁদের কথা বলতে হয়, তাঁরা হলেন সুধীন দাশগুপ্ত, সলিল চৌধুরী, উত্তম কুমার, হেমন্ত মুখোপাধ্যায়, রাজ কাপুর, বলরাজ সাহনি, পুলক বন্দ্যোপাধ্যায়, গৌরীপ্রসন্ন মজুমদার, নচিকেতা ঘোষ, সুপর্ণকান্তি ঘোষ এবং রাধাকান্ত নন্দী। এঁদের মধ্যে কয়েকজনের কথা আগেই বলেছি। তাই বাকিদের বিষয়েও কিছু কথা বলা উচিৎ মনে করি। পুলক বন্দ্যোপাধ্যায় আর মান্না দে প্রায় হরিহর আত্মা বলা যেতে পারে। কত শত হিট গানেরই না জন্ম দিয়েছেন এই জুটি! এমনকি শেষদিকে পুলক বন্দ্যোপাধ্যায়-লিখিত শ্যামাসঙ্গীতও গেয়েছেন মান্না দে। পুলক বন্দ্যোপাধ্যায়ের রহস্যমৃত্যু (নাকি, আত্মহত্যা?) গভীরভাবে ব্যথা দিয়েছিল মান্না দে-কে। ঘনিষ্ঠদের কাছে বারবার বলতেন যে, পুলকের মতো অমন জীবনীশক্তিতে ভরপুর মানুষ কেন অমনভাবে চলে গেল! 'আমি শ্রী শ্রী ভজহরি মান্না', 'ও কেন অত সুন্দরী হল', 'জড়োয়ার ঝুমকো থেকে', 'ও চাঁদ, সামলে রাখো জোছনাকে', 'হৃদয়ের গান শিখে তো গায় গো সবাই', 'যখন কেউ আমাকে পাগল বলে' কিংবা 'ললিতা, ওকে আজ চলে যেতে বল্ না'—এই প্রতিটি গান সৃষ্টির পিছনে এক একটি ঘটনা রয়েছে, যা পুলক বন্দ্যোপাধ্যায়ের নিজের জীবনের সঙ্গে সম্পর্কিত। একদিন মান্না দে-র বাড়ি গিয়ে পুলকবাবু দেখলেন, রান্না করছেন মান্না দে। ব্যস, সৃষ্টি হয়ে গেল সেই অমর গান—'আমি শ্রী শ্রী ভজহরি মান্না!' একবার কারো বাড়ি চিনতে না পেরে পাশের বাড়ির ডোরবেল বাজিয়েছেন পুলক বাবু। দরজা খুললেন সদ্যস্নাত অপূর্ব সুন্দরী এক মহিলা। পুলক বাবু ভুল বুঝতে পেরে ক্ষমা চেয়ে পাশের বাড়ির দিকে গেলেন। কিন্তু ততক্ষণে তাঁর মনে মনেই রচিত হয়ে গিয়েছিল সে বছরের পুজোর গান—'ও কেন অত সুন্দরী হল!' আবার কোনো এক ব্যাঙ্কোয়েট হলে জনৈক মহিলার কানের দুল খুলে পড়ে গিয়েছিল। পুলকবাবু সেই দুলটি কুড়িয়ে নিয়ে মহিলাকে ফেরৎ দিলেন। সঙ্গে সঙ্গে তৈরি হয়ে গেল 'জড়োয়ার ঝুমকো থেকে' গানটি! প্লেনে এক সুন্দরী এয়ার হোস্টেসের রূপমুগ্ধ পুলকবাবুর কলম সৃষ্টি করল 'ও চাঁদ, সামলে রাখো জোছনাকে' গানটি। মোহনবাগানের খেলা দেখতে গিয়ে বিরতির সময় একটি কাগজ কুড়িয়ে নিয়ে তাতে লিখেছিলেন 'হৃদয়ের গান শিখে তো গায় গো সবাই' গানটি। একদিন গাড়ি করে কলকাতা বিমানবন্দর থেকে ফিরছিলেন মান্না দে। সঙ্গী পুলক বন্দ্যোপাধ্যায়। মান্না দে গাড়ির চালে ঠেকা দিয়ে গুনগুন করে একটা কিছু সুর ভাঁজছিলেন। কৌতুহলী পুলক জিগ্গেস করলেন, "কী গান এটা, মান্নাদা?" মান্না দে বললেন, "এটা একটা কাজরী চৈতীর মতো, কাকার কাছে শুনেছিলাম—'শাম, ঘুঙ্ঘট্ পট্ খোলো..."। শুনেই পুলক বললেন, "একটুখানি চলুন তো, গানটা লিখে নিই।" বলেই গাড়ি নিয়ে চলে গেলেন 'বাণীচক্র' বলে একটা গানের ইস্কুলে। বললেন, "দেখুন, মান্নাদা-কে ধরে নিয়ে এসেছি। একটা ঘর দিন আমাদের, একটা হারমোনিয়াম দিন। আমরা আধঘন্টা নিরিবিলিতে বসে একটু কাজ করব।" এই বলে মাত্র আধঘন্টার মধ্যে রচিত হয়ে গেল সেই গান—'ললিতা, ওকে আজ চলে যেতে বল্ না!' একদিন একটি কাওয়ালি গানের অর্থ বুঝতে না পেরে পুলক বন্দ্যোপাধ্যায় আর মান্না দে-র রসিক আড্ডা থেকে লেখা হয়েছিল 'যখন কেউ আমাকে পাগল বলে' গানটি।

(আগামী পর্বে সমাপ্য)

#vanhelsing

#kaustavmondal

ছবিঃ লেখক

© Van Helsing