প্রেম ফুরোয় না
"হ্যালো। কোথায় আছিস তুই"-চিন্তিত স্বরে প্রশ্ন সৈকতের।
ফোনের ওপার থেকে শ্রীতমার জবাব-" এখনও অফিসেই আছি।"
"রাত ন টা বেজে গেছে, খেয়াল আছে তো?"
শ্রীতমা কাগজ গুলো গোছাতে গোছাতে দেয়ালের ঘড়ির দিকে চেয়ে বলল-"তাইতো। খেয়ালই নেই। আসলে কাজের এত চাপ........."
"তুই এখনো ওখানে কী যে করছিস সেটাই তো বুঝতে পারছি না।"
"কেন?"
"অফিস তো আটটায় বন্ধ হয়ে যায়।"
শ্রীতমা হাসল-"আরে আটটা আবধি তো কাস্টমার সার্ভিস ছিল। এবার একটু অফিসের কাজ গুলো....."
"তাহলে তুই অফিসেই বসে থাক।" ফোন কেটে দিল সৈকত।
"হ্যালো। আমার কথাটা তো শোনো..........রাগ করে ফোন কেটে দিল। পাগল লোক একটা।
আরো কিছু কাজ সেরে, নিজে ড্রাইভ করে শ্রীতমা যখন বাড়ি ফিরল, তখন ঘড়ির কাঁটা সবে সাড়ে দশটা অতিক্রম করেছে।
বাড়ি ঢুকেই দেখল শ্বশুর মৈনাক আর শ্বাশুড়ি সুমিত্রা বসে বসে টিভি দেখছে। এটা রোজই হয়। তবে অন্য দিন সৈকত থাকে।
শ্রীতমাকে দেখে সুমিত্রা বলল-" আজ এত দেরি? "
"হ্যাঁ মা। আজ একটু বেশি দেরি হয়ে গেল।"-শ্রীতমা বলল।
" আরে আবার বসছ কেন? তাড়াতাড়ি চেঞ্জ করে এসো। খেতে হবে না?
শ্রীতমা উঠে পড়ল। মৈনাক বলল- "এভাবে আর কদিন চলবে বৌমা? নিজের শরীরটার তো যত্ন নিতে হবে।"
"বাবা, এখন একটু কাজের প্রেসার বেশি হচ্ছে। তাই ফিরতে দেরি হচ্ছে। পরে ঠিক হয়ে যাবে।"
সুমিত্রা বলল- "তুই দাঁড়াচ্ছিস কেন আবার?"
শ্রীতমা চলে গেল।
শ্রীতমা খাবার টেবিলেও দেখল সৈকত নেই। বলল-"মা সৈকত খাবে না?"
"না কোন বন্ধুর বাড়িতে নেমন্তন্ন ছিল। ওখানেই খেয়ে এসেছে।"
সুমিত্রার কথাতে মনে পরে গেল শ্রীতমার। আজ ওদের দুজনের সৈকতের বন্ধুর বাড়িতে নেমন্তন্ন ছিল। শ্রীতমারও যাওয়ার কথা ছিল। কিন্তু মনে ছিল না। যদি মনে থাকত তাহলে কাজ গুলো অন্য কাউকে দিয়ে যাওয়া হতো।
রাত সাড়ে এগারোটা নাগাদ শ্রীতমা ঘরে এলো। কিন্তু, সৈকতের দেখা নেই। খাটেও নেই, সোফাতেও নেই। ব্যালকনি থেকে গিটারের মিষ্টি সুর ভেসে আসছে। ব্যালকনির পর্দা সরাতেই দেখল সৈকত। ব্যালকনির রেলিঙের ধারে দাঁড়িয়ে, স্তব্ধ শহরের দিকে চেয়ে গিটার বাজাচ্ছে।
আবছা আলো আর গিটারের সুর মিলে মিশে এক মায়াবী পরিবেশের সৃষ্টি হয়েছে। শ্রীতমা সেখানেই নীরবে দাঁড়িয়ে আর সৈকত শ্রীতমার থেকে পিছন ফিরে গিটার বাজিয়েই চলেছে। শ্রীতমার উপস্থিতি টের পায়নি।
কতক্ষন শ্রীতমা এভাবে অভিভূতের মতো দাঁড়িয়ে ছিল খেয়াল নেই। চমক ভাঙল গিটারের সুর থামার সাথে। সৈকত গিটার থামিয়ে সামনের দিকে ঝুঁকে চোখ মুছল। শ্রীতমারও খেয়াল ছিল না নিজের অজান্তেই কখন চোখ থেকে এত জল গড়িয়ে পরেছে।
চোখ মুছে শ্রীতমা ধীরে ধীরে এগিয়ে গিয়ে সৈকতের কাঁধের উপর হাত রাখল।
সৈকত চমকে উঠে বলল-"তুই চলে এসেছিল? "
"অনেক্ষণ আগে এসেছি। তোর গিটার শুনছিলাম।"
সৈকত শ্রীতমার হাতটা সরিয়ে দিয়ে বলল-"অনেক রাত হয়েছে। ঘুমোগে যা। কাল আবার তোর অফিস আছে।"
"তুই ঘুমোবি না?"
"আমি?" হাসল সৈকত-"ঘুম আসছে না আমার। তুই যা, আমি পরে আসছি।"
"আমার উপর রাগ করেছিস তুই, তাই না?"
"আমি কেন রাগ করতে যাব?"
"আসলে আজ একটু বেশি কাজের ... .." "আমি তো তোর কাছে কোনো কৈফিয়ত চাইনি।"-বসে পড়ল সৈকত।
শ্রীতমার আজ অনেক কথা বলার ছিল। কিন্তু কিছুই বলা হলো না। কিছুক্ষণ চুপচাপ দাঁড়িয়ে থেকে ঘরে এসে শুয়ে পড়ল।
ঘুম আসতে চাইছে না। মনে পড়ছে পুরোনো দিনের কথা। দীর্ঘ চার বছর প্রেমের পর ওদের বিয়ে সম্পূর্ণ হয়েছে। যদিও বিয়ে টা সহজ ছিল না। শ্রীতমার বাবা সৌমেনবাবু রাজিই ছিলেন না। সৈকতের বিশাল ব্যাবসা, বিপুল সম্পত্তিতেই আপত্তি ছিল ওনার। উনি চাইতেন ওনার সমতুল্য পরিবারে শ্রীতমার বিয়ে দিতে, যাতে কেউ কোনোদিন শ্রীতমার অমর্যাদা না করতে পারে।
কিন্তু মৈনাক-সুমিত্রার মিষ্টি ব্যাবহার আর সৈকত ওনার মন জয় করে নিয়েছিল। আর সত্যি বলতে কী সৈকতের মতো ছেলে দুটো খুঁজে পাননি সৌমেনবাবু।
সৈকতের শ্রীতমার সাথে মানানসই সুন্দর চেহারা বা বড়োলোক বলে নয় , অমন অনেকেই হয়। কিন্তু এত সোজা সরল, এত কম বয়সে বুদ্ধিমান যুবক কমই দেখেছেন সৌমেনবাবু। তাই আর না করতে পারেন নি।
বিয়ে তো ছয় মাসও পূর্ণ হয়নি, এরই মধ্যে এত দূরত্ব? শুধুমাত্র কী শ্রীতমার কাজের জন্য?
মৈনাক চ্যাটার্জীর এত বড় ব্যাবসা। এখনো একা হাতে সামলাতে হয়। সৈকততো কোনোদিন অফিস মুখো হয় না। শ্রীতমার তো ব্যাপরই আলাদা। সব কিছু ছেড়ে ছুড়ে বেসরকারি ব্যাংকে কাজ করে। শ্রীতমা নিজেও বোঝে কাজটা ছেড়ে দেওয়া উচিত। কিন্তু দু বছর ধরে কাজ করার জায়গার মায়া কিছুতেই কাটাতে পারে না।
ভাবতে ভাবতেই ঘুমিয়ে পরে শ্রীতমা।
(২)
তারপরেও কেটে গেছে অনেক গুলো দিন। শ্রীতমার কাজের চাপও কমে না, তাড়াতাড়ি বাড়ি ফেরাও হয় না। শ্রীতমার কাজের রুটিনের কোনো পরিবর্তন নেই। কিন্তু আশ্চর্য রকম ভাবে বদলে যায় সৈকত।
শ্রীতমার ছুটির দিন গুলোতেও সৈকতের চুলের টিকি দেখা যায় না। রোজ রাতের বেলা কখন বাড়ি ফেরে কেউ জানে না। এক ছাদের তলায় থেকেও দু একবারই হয়তো দুজনের সামনা সামনি দেখা হয় মাত্র।
একদিন সন্ধ্যেবেলায় শ্রীতমা নিজে থেকে সৈকতকে ফোন করল। সৈকত তখন নদীর ধারে একটা বেঞ্চের উপর বসে ছিল একাই। একে সন্ধ্যেবেলা, তার উপর শীতকাল। আশে পাশে কেউ নেই। হঠাৎ শ্রীতমার ফোন দেখে অবাক হয়ে বলল-"কী হয়েছে? "
"কী আবার হবে? কী করছো এখন?"
"কেন কী দরকার সেটা তো বল।"
"তুই সবসময় এরকম কেন করছিস বলতো? একটুও কী ভালো করে কথা বলা যায় না?"
"কী মুশকিল। তুই তো কোনোদিন নিজে থেকে এরকম সময়ে ফোন করিস না। তাই অবাক লাগছে।"
"আমার বর কে কখন ফোন করব না করব সবই আমার ব্যাপার। তোর কী এখন কোনো কাজ আছে?"
"না।"
"তাহলে চল রেস্টুরেন্ট। একেবারে ওখানে ডিনার করে বাড়ি ফিরব।"
"তোর কাজ হয়ে গেছে?"
"হ্যাঁ। চলে আয় আমি পাঁচ মিনিটেই পৌঁছে যাব।"
"দেখছি।"
"দেখছি না। তোকে আসতেই হবে।"
শ্রীতমার কথা না রাখার মতো সাহস সৈকতের কোনোদিন ছিল না। বলল-"আচ্ছা। আসছি।"
শ্রীতমা রেস্টুরেন্টের বাইরেই দাঁড়িয়ে ছিল। সৈকত বাইকটা গ্যারেজে রেখে শ্রীতমার সামনে দাঁড়াতেই শ্রীতমা বলল-"বাবা হিরো একেবারে। তা কত গুলো মেয়ে প্রেমে পড়ল তোর।"
"ফালতু বকিস না। তুইই প্রথম তুইই শেষ।"
"সত্যি? আমার তো সারাদিন চিন্তার শেষ নেই...না জানি আমার বরটা কোন পেত্নির সাথে ঘুরছে।" শ্রীতমা হাসল।
সৈকতের বাঁদিকের বুকটা কেমন ব্যাথা করে উঠল। বলল-"তোকে হাসলে খুব সুন্দর লাগে।"
"আমি জানি। আমি সুন্দর বলেই তো তুই প্রমে পড়েছিস । আর ওভাবে দেখতে হবে না, আশপাশের লোকে দেখছে। খিদে পেয়েছে চল, কিছু খায়।"
শ্রীতমার পিছন পিছন সৈকত রেস্টুরেন্টে ঢুকল। ফাঁকা একটা টেবিল দেখে বসতেই শ্রীতমা বলল-"তুই হাঁদারাম নাকি রে?"
সৈকত বলল-"কেন?"
"এতদিন পর একসাথে রেস্টুরেন্টে এলাম। দু টো প্রান খুলে কথা বলব। তা না পাবলিক প্লেসে বসছে। চল ওইদিকের কোনে দিয়ে বসি।"
শ্রীতমা খাবারের অর্ডার দিয়ে সৈকতের হাতটা শক্ত করে ধরে বলল-" কী হয়েছে তোর।"
সৈকত হাতটা ছাড়ানোর চেষ্টা করল কিন্তু পারল না। বলল-" কী হবে আমার?"
"তাহলে আমাকে এড়িয়ে চলছিস কেন?"
"কোথায়?"
"সব সময়ই। এমনকি আমার সাথে ভালো করে কথা পর্যন্ত বলিস না।"
অস্বস্থিতে পড়ল সৈকত-"আমি ঠিক আছি।"
"একটুও ঠিক নেই। তোকে আমার থেকে বেশি কেউ চেনে না। তুইও না।"
ওয়েটার খাবার দিয়ে গেল। সৈকত বিরিয়ানির প্লেটে চামচ গুঁজে বলল-" বললাম তো ঠিক আছি। কেন জোর করছিস?"
"আচ্ছা। আমার চোখের দিকে তাকিয়ে বল যে তুই ঠিক আছিস তাহলে আমি আর কিছু বলবো না।"
সৈকত শ্রীতমার চোখের দিকে তাকালো। সেই চোখ, সৈকতের বেঁচে থাকা না থাকা সব যার কাছে। হাজার কষ্টের মাঝে যে চোখের দিকে তাকালে সব দুঃখ কষ্ট উধাও হয়ে যায়, সেই চোখের দিকে তাকিয়ে সৈকত কী করে মিথ্যে কথা বলবে? বলল-"আমার খুব ভয় করে রে।"
"কিসের ভয়?"
"তোকে হারিয়ে ফেলার।"
শ্রীতমা হেসে ফেলল-"দূর পাগল। আমি কেন তোর কাছ থেকে হারিয়ে যাব? তাহলে আমি বাঁচাতে পারব?"
সৈকত গম্ভীর হয়ে বলল-"তুই সারাদিন অফিসে থাকিস, ঠিক মতো খাওয়া দাওয়া করিস না, নিজের খেয়াল রাখিস না। তোর যদি কিছু হয়ে যায় তাহলে আমি কী নিয়ে বাঁচব?"
"কে বলেছে তোকে যে আমার সারাদিন শুধু কষ্টই হয়। যখন লোক গুলো কাঁচের ওপার থেকে চেক গুলো এগিয়ে দিয়ে বলে-ম্যাডাম আমার চেকটা ক্লিয়ার করে দিন। আমি টাকা গুলো যখন ওদের হাতে দিই, তখন টাকা গুনতে গুনতে ওদের মুখে এক তৃপ্তির হাসি থাকে। ওদের খুশি দেখে ভুলে যায় নিজেকে। আরো আরো বেশি তাড়াতাড়ি কাজ করতে থাকি। কখন যে দিন শেষ হয়ে যায় বুঝতেই পারি না।"
"কিন্তু তোর খুশি, তোর মুখের হাসি?"
শ্রীতমা কিছুক্ষণ চুপ থেকে বলল-" তুই এমন বলছিস যেনো, আমিই একমাত্র লোক যে এই কাজ করছি।"
"না আসলে তা নয়। সব ব্যাংকের সব স্টাফই দায়িত্বের সাথে, সিরিয়াসলি কাজ করে। কিন্তু তুই একবার কেবিনে বসে পড়লে সব কিছু ভুলে যাস। কম্পিউটারের সাথে তাল মিলিয়ে কাজ করতে গিয়ে নিজেকে রোবট ভেবে বসিস। এত কাজ করে কী হবে? কী পাবি তুই?"
শ্রীতমা উত্তর দেয় না। সৈকতের হাতটা ছেড়ে দিয়ে অন্য দিকে মুখ ফিরিয়ে নেয়।
সৈকত বলতে থাকে-"তোকে যে কাজ করতেই হবে তার তো কোনো মানে নেই। আমাদের এতো বড় ব্যবসা, সেখানে ডেলি পাঁচ হাজারেরও বেশি ওয়ার্কার কাজ করে। আর তুই অন্য একটা অফিসে........এর কোনো মানে হয় শ্রীতমা? "
শ্রীতমা উঠে পড়ল-"কাজটা আমার কাছে শুধু কাজ না। আমার নেশা বলতে পারিস। তাই কাজ ছাড়ার কথা আমি ভাবতে পারি না। আমি আসছি।"
শ্রীতমা হনহনিয়ে বেড়িয়ে গেল। সৈকতও পিছন পিছন দৌড়ে এসে হাত ধরে বলল-"আমি তোকে কাজ ছাড়ার কথা বলিনি। তুই শুধু নিজের খেয়াল......"
"হাত ছাড়। বাড়ি যাব।"
"আমিও তো যাবো, আমার সঙ্গেই চল।"
"আমি আমার গাড়ী নিয়ে এসেছি। আমি চলে যেতে পারব।" এক ঝটকায় হাত ছাড়িয়ে নিয়ে শ্রীতমা চলে যায়।
(৩)
শ্রীতমা আজ অফিসে ঢুকতেই একজন পঁচিশ-ছাব্বিশ বছরের মহিলা এগিয়ে এসে বলল-"নমস্কার ম্যাডাম। আমার নাম মানসী। আজ থেকে আমি আপনার অ্যাসিসটেন্ট হিসেবে কাজ করব।"
"অ্যাসিসটেন্ট?"-অবাক হয়ে বলল শ্রীতমা।
" হ্যাঁ। অমিতবাবু বলেছেন।"
আরো অবাক হওয়ার পালা শ্রীতমার। যে লোকটা নিজে কাজে ফাঁকি দিয়ে শ্রীতমাকে দিয়ে বেশি কাজ করায়। শ্রীতমা একটু লেটে আসলে হাজারটা কথা শোনায় সেই অমিতবাবু কিনা শ্রীতমার সুবিধার জন্য অ্যাসিসটেন্ট রেখেছে। ভাবা যায়?
শ্রীতমা আর কথা বাড়াল না। একেই আসতে দেরি হয়েছে। যদি এখনই দেখে ফেলে তাহলে তো হাজার টা কথা শোনাবে। নিজের কাজে মন দিল শ্রীতমা।
শ্রীতমার বেশির ভাগ কাজ মানসী করে দেওয়ায় শ্রীতমার খুব সুবিধে হতো। তাছাড়া মানসী খুবই ফ্রেন্ডলি। শ্রীতমাকে সব সময় হাসি খুশি রাখার চেষ্টা করে।
শ্রীতমা এখন সাড়ে আটটার আগেই বাড়ি পৌঁছে যায়। কিন্তু মৈনাক একমাত্র ছেলেকে ব্যাবসা ঠিক ঠাক বুঝিয়ে দিতে বিদেশে নিয়ে গেছে। সুমিত্রাকে একা বাড়িতে থাকতে হয়। বিকেল বেলা কাজের মেয়েটা চলে যাওয়ার পর একেবারে একা লাগে। কিন্তু শ্রীতমা ফেরার পর ভালোই লাগে। শ্রীতমা সবসময় ফোনে খোঁজ নেয় সৈকতের। তবুও মিস করে খুব।
এভাবেই দিন কাটছিল বেশ। গন্ডগোলটা বাঁধল সৈকতের বাড়ি ফেরার দিন। শ্রীতমা ঠিক করেই রেখে ছিল সৈকত যেদিন বাড়ি ফিরবে সেদিন শ্রীতমাও দুপুরে বাড়ি ফিরে অবাক করে দেবে।
বৃদ্ধ বস মানে অমিতবাবুকে বুঝিয়ে বলল যে ওর সব কাজ মানসী করে দেবে। অমিতবাবু রাজি হয়ে গেলেন।
শ্রীতমার অফিস থেকে বেড়িয়েই খেয়াল হলো, গাড়ীর চাবিটা কেবিনেই ফেলে চলে এসেছে। চাবি আনার জন্য আবার ঘুরতে হলো।
ঘরে ঢোকার আগেই শুনতে পেল মানসী কাউকে ফোন করছে আর বার বার সৈকতের নাম বলছে। ভালো করে শোনার জন্য আড়ালে দাঁড়িয়ে পড়ল শ্রীতমা।
ফোনের ওপারের কথা শোনা না গেলেও মানসীর কথা শোনা যাচ্ছে।
মানসী বলছে-"তোর কাছেই যাবে ও। সেই জন্যই তো ছুটি নিয়েছে। "
..........................ওপারের কথা শোনা গেল না।
"বাবা! সৈকতবাবু সুন্দরী বউকে যেন চোখে হারাচ্ছে। মাত্র পনেরো দিন না দেখতে পেয়ে যে একেবারে বিরহে প্রাণ বাঁচে না এর মতো অবস্থা। এত ভালোবাসা আসে কোথা থেকে রে?"
........................................
"আরে না না, ও কিছু বুঝতে পারেনি। তবে ওই বুড়ো হাবড়া বস টাকে দেখে আমার ভয় হয়। যদি বলে দেয় যে তুই আমাকে এখানে পাঠিয়েছিস।"
................................
"হ্যাঁ। সে তো বটেই।"
...........................
"আচ্ছা সৈকত রাখছি রে। অনেক কাজ দিয়ে গেলো তোর বউ, সেগুলো সামলাতে হবে।"
শ্রীতমা মুহূর্তে সব বুঝে যায়। সোজা অমিতবাবুর কেবিনে ঢুকে বলে-"মানসী কে?"
অমিত চমকে উঠে বলে-"আমি জানি না। হেড অফিস থেকে পাঠিয়েছে।"
"হেড অফিস থেকে? না আমার হাসব্যান্ড?"
অমিত থতমত খেয়ে বলল-"আমি জানি না।"
"আপনি সব জানেন। মানসীকে সৈকত আমার উপর নজর রাখার জন্য পাঠিয়েছে। তাই না?"
অমিত সোজা হয়ে বসে বলল-"সব যখন যেনেই গেছো তখন সব খুলে বলাই ভালো। তোমার কাছের প্রেসার কমানোর জন্য সৈকত মানসীকে পাঠিয়েছে। আর মানসীকে মাইনে দেয় সৈকত।"
"আপনি আমাকে জাননি কেন?"
"আমাকে সৈকত বলতে নিষধ করেছে। তাছাড়া আমার শুধু কাজ নিয়ে কথা, তোমাদের ব্যাপারে নাক গলাতে যাব কেন?"
মানসীকে ডাকতেই মানসী এসে বলল-"আমি সৈকতের ক্লাসমেট ছিলাম। চাকরির একটা দরকার ছিল। কদিন আগে সৈকতের সাথে যোগাযোগ করতেই, ও আমাকে এই কাজটা করতে বলল। বিশ্বাস করো তোমার সাথে আমার বিশ্বাসঘাতকতা করতে ইচ্ছে করেনি। তবুও........" মানসী থামল।
"আপনি এখানে আমার উপর নজর রাখতেন। আর আমি কী করি না করি সব ওকে বলতেন তাই না?"-গলা ধরে এলো শ্রীতমার।
" না। তোমার খেয়াল রাখার জন্য।"
"আমি বাচ্চা মেয়ে নয়। সব বুঝি।"
"তোমার থেকে আমার অভিঞ্জতা বেশি। এমনকি তোমার থেকে আমি দু তিন বছরের বড়ো। তাই নিসন্দেহে বলতে পারি তোমর ভুল হচ্ছে। তুমি যা ভাবছ তা নয়। সৈকত তোমাকে খুব ভালোবাসে।তাই তোমার সব ইচ্ছে গুলোর মর্যাদা দেয়। এমকি এই চাকরিটা পর্যন্ত করতে দিয়েছে। আর তোমার খেয়াল রাখাটাও ওর কর্তব্যের মধ্যে পড়ে।"
"দেখুন। ওর হয়ে কোনো সাফাই আপনার কাছে শুনতে চায় না।"
শ্রীতমা যাওয়ার জন্য পা ফেলেই আবার ঘুরে দাঁড়িয়ে বলল-"আর হ্যাঁ। এসব ব্যাপার যদি আপনি আবার ফোনে বলে দেন, তাহলে কিন্তু ভালো হবে না।"
শ্রীতমা চলে গেল। সৈকত কে আবার ফোন করার মতো সাহস মানসীর ছিল না।
শ্রীতমা বাড়ি ফিরে নিজের ঘরে গিয়ে আলমারি খুলে জামাকাপড় গোছাতে লাগল। বেচারা সৈকত পিছন থেকে এসে জড়িয়ে ধরতেই শ্রীতমা এক ঝটকায় সরিয়ে দিয়ে, গালে একটা কষিয়ে চড় মারলো।
সৈকত গালে হাত দিয়ে বলল- "কী হলো? মারছিস কেন?"
"তোমার লজ্জা করে না? বিশ্বাসঘাতক।" রাগে ফুঁসছে শ্রীতমা।
"কী হয়েছে সেটা তো ............" সৈকতের কথা শেষ হতে না হতেই আবার এক চড় দিয়ে বলল-"তুমি জানো না, তাই না? তুমি আমাকে এতটা সন্দেহ করো যে আমার ওপর নজর রাখতে লোক রেখেছো? এসব দিন দেখার আগে আমার মরে যাওয়া উচিত ছিল। তুমি এতটা নীচ জানতাম না।"
সৈকত বুঝতে পেরে বলে-"পাগলী, আমি তোর ওপর নজর রাখতে কেন যাব? তোর যাতে কোনো অসুবিধে না হয়..........."
"তোমার মিথ্যে কথা তোমার কাছেই রাখো। আমি বাড়ি ছেড়ে চলে যাচ্ছি।"-কেঁদে ফেলল শ্রীতমা।
মাথায় বজ্রাঘাত হলো সৈকতের-" এরকম কেন বলছিস? তুই যত পারিস আমাকে মার। আমার ভুল হয়ে গেছে, আর কখনো হবে না। সরি...." নিজের কান ধরে সৈকত।
শ্রীতমা কোনো কথা শুনলো না। নিজের জামাকাপড় গুলো গুছিয়ে নিয়ে নীচে নামতেই দেখল সুমিত্রা। শ্রীতমাকে দেখে অবাক হয়ে বলল-" কোথায় যাচ্ছিস তুই?"
"আমার নিজের বাড়ি।"
"এই দুপুর বেলায়? কী হয়েছে টা কী?"
"তোমার ছেলেকে জিজ্ঞেস করো।"
সৈকত দৌড়ে এলো-"মা ওকে যেতে দিও না। আটকাও। দেখো আমার কোনো কথা শুনছে না। ভুল বুঝছে আমাকে।"
"কী হয়েছে সেটা তো বল আমাকে।"
সৈকত সবকিছু বলতেই সুমিত্রা হেসে ফেলল। দুজনেই অবাক হয়ে গেল। সুমিত্রা হাসি থামিয়ে বলল-" তোরা পারিসও বটে। আর শ্রীতমা তুই কী পাগল হয়ে গেছিস? জানিসই তো আমার ছেলেটা এরকম। ও নিজেও জানে না কী করলে কী হবে। তুই ঘরে যা।"
" না মা। তুমি তো তোমার ছেলেকে সার্পোট করবেই। আমি বাড়ি ছেড়ে চলে যাচ্ছি। আর ফিরব না দেখো।"-শ্রীতমা কেঁদে ফেলল।
সুমিত্রার মুখের হাসি মিলিয়ে যায়-"এসব কী কথা?" সুমিত্রা শ্রীতমার চোখ মুছিয়ে দিয়ে বলল-"তোর রাগ হয়েছে, যা তুই বাপের বাড়ি। কিন্তু এসব কথা মুখেও আনিস না।"
"থাকব না ওই লোকটার সাথে। আমি আসছি।"
শ্রীতমা চলে গেল। সৈকত ডাকতে লাগল-"যাস না শ্রীতমা।"
সুমিত্রা বলল-" ওকে যেতে দে সৈকত। ও নিজের ভুল বুঝতে পেরে কালই বাড়ি চলে আসবে।"
"কিন্তু মা.............."
"কোনো কিন্তু না। যেমন দোষ করেছিস, তেমন ঠিক করছে।"
(৪)
তারপরেও কেটে গেছে দুটো মাস। শ্রীতমা ফেরেনি সৈকতের কাছে। আসলে নিজের ভুল বুঝতে পেরে গ্লানির শেষ ছিল না শ্রীতমার। সৈকতও রাগ করে কোনোদিন ফোন করেনি বা ওদের বাড়ি যায়নি।
সেদিন অফিসে পৌঁছনোর পর থেকেই শ্রীতমার বাড়ি থেকে বার বার ফোন করছে শ্রীতমাকে। কিন্তু শ্রীতমা ধরতে পারছে না। পাঁজি বসের অর্ডার ওয়ার্ক টাইমে নো কল।
প্রায় পনেরো কুড়ি বার ফোনের পর শ্রীতমা বলল-"স্যার বাড়ি থেকে সবাই বার বার ফোন করছে। মনে হয় কিছু একটা হয়েছে। আমি রিসিভ করছি।"
অমিতবাবু বললেন-"না। আগে কাজ। তারপর ফোন।"
শ্রীতমা অমিতের কথা গ্রাহ্য না করেই , কল রিসিভ করল।
শ্রীতমার মায়ের ফোন-"তুই যত তাড়াতাড়ি পারিস হসপিটালে চলে আয়।"
" কেন?"-আজানা আশঙ্কায় বুকের ভেতর কেঁপে ওঠে শ্রীতমার।
"তোর শ্বশুড় মাশাই এর শরীর খারাপ।"
"কি হয়েছে ওনার?"
"কী জানি। সুমিত্রাদি বলছিল অফিসেই নাকি মাথা ঘুরে পড়ে গেছেন। এখনও ঞ্জান নেই।"
"আচ্ছা। আমি আসছি এখনই।"
শ্রীতমা চেয়ার ছেড়ে উঠতেই অমিত বলল-"কোথায় যাচ্ছ কাজ ছেড়ে।"
"আমার শ্বশুরমশাই খুব অসুস্থ। হসপিটালে ভর্তি আছেন। আমি ওখানেই......."
"আগে কাজ তারপর অন্য কথা।"
"স্যার!" বিস্ময়ে হতবুদ্ধ হয়ে যায় শ্রীতমা।
"অবাক হওয়ার কিছু নেই। এই মুহূর্তে ছুটি দিতে পারব না। আরও দু ঘন্টা কাজ করো তারপর দেখা যাবে।"
"স্যার। আমি সত্যিই কোনোদিন ভাবতেই পারিনি যে আপনি এতটা স্বার্থপর। আজ আমি যাবই, পারলে আটকে দেখান।"
শ্রীতমা দু পা এগোতেই অমিত বলল-" চাকরি চলে যাবে কিন্তু।"
শ্রীতমা দাঁড়িয়ে আই কার্ড ছিঁড়ে ফেলে দিয়ে বলল-"রাখুন আপনার চাকরি। কী ভেবেছেন কী? আপনার এই চাকরি না করলে খেতে পাব না? ভুলে যাবেন না আমি মৈনাক চ্যাটার্জীর পূত্রবধূ। আমাদের দেশ বিদেশের অফিসে আপনার মতো হাজার হাজার লোক কাজ করে। আর কথা বাড়িয়ে লাভ নেই। আসছি স্যার। ভালো থাকবেন।"
রাস্তার মধ্যে আবার মায়ের ফোন এলো-"তুই সোজা বাড়ি চলে যা। তোর শ্বশুরমশাই ওখানেই আছে।"
"কোন বাড়ি?"
"তোর শ্বশুর বাড়ি।"
"কেমন আছেন উনি?"
"এখন ভালোই আছেন। একটু হার্টঅ্যাটাকের মতো হয়েছিল।"
"আচ্ছা। আমি যাচ্ছি।"
শ্রীতমা বাড়ি ঢুকতেই সুমিত্রা জড়িয়ে ধরে কেঁদে ফেলল-"এতক্ষনে তোর আসার সময় হলো?"
"একটু দেরি হয়ে গেল। বাবা কোথায়? কেমন আছেন উনি।"
"নিজের ঘরেই আছেন। এখন একটু ভালো আছেন।"
শ্রীতমা ঘরে গিয়ে দেখল মৈনাক খাটে আধ শোয়া হয়ে হেলান দিয়ে বসে আছে। সৈকত পাশেই চেয়ারে বসে ছিল। শ্রীতমা যেতেই বসার জন্য চেয়ার ছেড়ে দিল।
শ্রীতমা বসে বলল-"কেমন আছেন আপনি?"
"এতক্ষন ভালো ছিলাম না। তুই এসে গেছিস, এবার ভালো থাকব।"-হাসলো মৈনাক।
শ্রীতমাও হেসে ফেলল-" আপনিও না। কী করে হলো এসব?"
"অফিসে কাজ করতে করতে মাথা ঘুরে পড়ে গিয়েছিলাম। আসলে বয়েস হয়েছে, আর কী এসব কাজ আমাকে দিয়ে হয়?"
"ইস, মাথায় অনেক টা কেটে কেটে গেছে তো। কষ্ট হচ্ছে না?"
"না। একটু ব্যাথা করছে। কিন্তু আমার ছেলেটার খুব কষ্ট হয়েছে রে তোকে ছাড়া। দেখ কেমন চোখ মুখ শুকিয়ে গেছে।"
শ্রীতমা তাকাল। সত্যিই সুন্দর মুখের মধ্যে সেই উজ্জ্বলতা আর নেই। শ্রীতমা ভালোই জানত, সৈকতের ভালোবাসা কতটা নিখাদ।
সুমিত্রা ঘরে ঢুকে বলল-"আর এরকম করিস না শ্রীতমা। ওকে এভাবে কষ্ট দিস না। সারাটা জীবন একসাথে থাকিস।"
শ্রীতমার লজ্জায় মাথা ঝুঁকে পড়ল, তবুও বলল-"দূর, তোমাদের ছেলের সাথে কে থাকবে?"
জবাব দিলো সৈকত-"এলি কেন তাহলে?"
"আমি তো বাবা কে একবার দেখতে এসেছিলাম। আবার চলে যাব।"
সৈকত গম্ভীর ভাবে বলল-"বাড়ির বাইরে বেড়িয়ে দেখ একবার। একেবারে ঠ্যাং ভেঙে রেখে দেব।"
সবাই হেসে ফেলল।
রাতের বেলা। সৈকত একাই ব্যালকনিতে দাঁড়িয়ে, চোখে মুখে চিন্তার ছাপ স্পষ্ট।
শ্রীতমা এসে হাতের ওপর হাত রেখে বলল-"আর এত চিন্তা করতে হবে না। আমি কাজটা ছেড়ে দিয়েছি।"
"সত্যি?"
"হ্যাঁ। এবার সবসময় তোর সাথে থাকব।" সৈকতের কাঁধে মাথা রাখল শ্রীতমা।
"খুব ভালো হবে।"
শ্রীতমা খেয়াল করল, তবুও সৈকত মন মরা। বলল-" কী ভাবছিস তুই?"
"বাবা তো সাফ বলে দিল, কাল থেকে অফিসের কোনো কাজ করবে না। সব দায়িত্ব আমার। আমি কী করব বুঝতে পারছি না।"
" সত্যি? "
"কেন তুই শুনিসনি?"
"হ্যাঁ। সে তো খুব ভালো কথা।"
"ভালো কথা?"
"হ্যাঁ। তুই তো লন্ডনে বিজনেস ম্যানেজমেন্ট নিয়ে স্টাডি করেছিস।"
"সেটা ঠিক। তবে ফাইন্যান্সিয়াল দিকটা আমার খুব জটিল লাগে।"
শ্রীতমা সোজা হয়ে সৈকতের চোখে চোখ রেখে বলল- "আমার উপর ভরসা আছে তোর?"
"নিজের থেকেও বেশি।"
"তাহলে আর চিন্তা করিস না। আমি ওই দিকটা সামলে নেব।"
"সত্যি?"-সৈকতের মুখে হাসি ফুটলো।
"হ্যাঁ। আমি আগে যতই ছোটো অফিসে কাজ করি না কেন সেই ফাইন্যান্সিয়াল সার্ভিসই সামলেছি। তুই যদি সঙ্গে থাকিস তাহলে এটাও পারব।"
"তুই আমার কাজে সাহায্য করবি এতে আমার উপকারও হবে আর তোকেও দুচোখ ভরে দেখতে পাব সবসময়। আমাদের মাঝে আর কোনো দূরত্ব থাকবে না।"
"ফালতু বকিস না। মার খাবি।"
"তুই আমাকে বাঁচালি রে।" সৈকত শ্রীতমাকে জড়িয়ে ধরল। বুক চিঁড়ে এক স্বস্তির নিঃশ্বাস পড়ল।
শ্রীতমার মনে হলো আজ নিজেকে আবার নতুন করে খুঁজে পেল। সৈকতের বুকের মধ্যে মুখ গুঁজে
বলল-" আমার একটা শর্ত আছে?"
"কী?"
"আমি যদি অফিসে যায় , তাহলে তোকে কিন্তু সবসময় নিজেকে কন্ট্রোল করতে হবে।"
"চেষ্টা করব। কিন্তু কথা দিতে পারব না। আর....... এটা তো অফিস নয়।"
শ্রীতমা হাসল-"সেটাই আমার দূর্ভাগ্য।"
© Susmita
ফোনের ওপার থেকে শ্রীতমার জবাব-" এখনও অফিসেই আছি।"
"রাত ন টা বেজে গেছে, খেয়াল আছে তো?"
শ্রীতমা কাগজ গুলো গোছাতে গোছাতে দেয়ালের ঘড়ির দিকে চেয়ে বলল-"তাইতো। খেয়ালই নেই। আসলে কাজের এত চাপ........."
"তুই এখনো ওখানে কী যে করছিস সেটাই তো বুঝতে পারছি না।"
"কেন?"
"অফিস তো আটটায় বন্ধ হয়ে যায়।"
শ্রীতমা হাসল-"আরে আটটা আবধি তো কাস্টমার সার্ভিস ছিল। এবার একটু অফিসের কাজ গুলো....."
"তাহলে তুই অফিসেই বসে থাক।" ফোন কেটে দিল সৈকত।
"হ্যালো। আমার কথাটা তো শোনো..........রাগ করে ফোন কেটে দিল। পাগল লোক একটা।
আরো কিছু কাজ সেরে, নিজে ড্রাইভ করে শ্রীতমা যখন বাড়ি ফিরল, তখন ঘড়ির কাঁটা সবে সাড়ে দশটা অতিক্রম করেছে।
বাড়ি ঢুকেই দেখল শ্বশুর মৈনাক আর শ্বাশুড়ি সুমিত্রা বসে বসে টিভি দেখছে। এটা রোজই হয়। তবে অন্য দিন সৈকত থাকে।
শ্রীতমাকে দেখে সুমিত্রা বলল-" আজ এত দেরি? "
"হ্যাঁ মা। আজ একটু বেশি দেরি হয়ে গেল।"-শ্রীতমা বলল।
" আরে আবার বসছ কেন? তাড়াতাড়ি চেঞ্জ করে এসো। খেতে হবে না?
শ্রীতমা উঠে পড়ল। মৈনাক বলল- "এভাবে আর কদিন চলবে বৌমা? নিজের শরীরটার তো যত্ন নিতে হবে।"
"বাবা, এখন একটু কাজের প্রেসার বেশি হচ্ছে। তাই ফিরতে দেরি হচ্ছে। পরে ঠিক হয়ে যাবে।"
সুমিত্রা বলল- "তুই দাঁড়াচ্ছিস কেন আবার?"
শ্রীতমা চলে গেল।
শ্রীতমা খাবার টেবিলেও দেখল সৈকত নেই। বলল-"মা সৈকত খাবে না?"
"না কোন বন্ধুর বাড়িতে নেমন্তন্ন ছিল। ওখানেই খেয়ে এসেছে।"
সুমিত্রার কথাতে মনে পরে গেল শ্রীতমার। আজ ওদের দুজনের সৈকতের বন্ধুর বাড়িতে নেমন্তন্ন ছিল। শ্রীতমারও যাওয়ার কথা ছিল। কিন্তু মনে ছিল না। যদি মনে থাকত তাহলে কাজ গুলো অন্য কাউকে দিয়ে যাওয়া হতো।
রাত সাড়ে এগারোটা নাগাদ শ্রীতমা ঘরে এলো। কিন্তু, সৈকতের দেখা নেই। খাটেও নেই, সোফাতেও নেই। ব্যালকনি থেকে গিটারের মিষ্টি সুর ভেসে আসছে। ব্যালকনির পর্দা সরাতেই দেখল সৈকত। ব্যালকনির রেলিঙের ধারে দাঁড়িয়ে, স্তব্ধ শহরের দিকে চেয়ে গিটার বাজাচ্ছে।
আবছা আলো আর গিটারের সুর মিলে মিশে এক মায়াবী পরিবেশের সৃষ্টি হয়েছে। শ্রীতমা সেখানেই নীরবে দাঁড়িয়ে আর সৈকত শ্রীতমার থেকে পিছন ফিরে গিটার বাজিয়েই চলেছে। শ্রীতমার উপস্থিতি টের পায়নি।
কতক্ষন শ্রীতমা এভাবে অভিভূতের মতো দাঁড়িয়ে ছিল খেয়াল নেই। চমক ভাঙল গিটারের সুর থামার সাথে। সৈকত গিটার থামিয়ে সামনের দিকে ঝুঁকে চোখ মুছল। শ্রীতমারও খেয়াল ছিল না নিজের অজান্তেই কখন চোখ থেকে এত জল গড়িয়ে পরেছে।
চোখ মুছে শ্রীতমা ধীরে ধীরে এগিয়ে গিয়ে সৈকতের কাঁধের উপর হাত রাখল।
সৈকত চমকে উঠে বলল-"তুই চলে এসেছিল? "
"অনেক্ষণ আগে এসেছি। তোর গিটার শুনছিলাম।"
সৈকত শ্রীতমার হাতটা সরিয়ে দিয়ে বলল-"অনেক রাত হয়েছে। ঘুমোগে যা। কাল আবার তোর অফিস আছে।"
"তুই ঘুমোবি না?"
"আমি?" হাসল সৈকত-"ঘুম আসছে না আমার। তুই যা, আমি পরে আসছি।"
"আমার উপর রাগ করেছিস তুই, তাই না?"
"আমি কেন রাগ করতে যাব?"
"আসলে আজ একটু বেশি কাজের ... .." "আমি তো তোর কাছে কোনো কৈফিয়ত চাইনি।"-বসে পড়ল সৈকত।
শ্রীতমার আজ অনেক কথা বলার ছিল। কিন্তু কিছুই বলা হলো না। কিছুক্ষণ চুপচাপ দাঁড়িয়ে থেকে ঘরে এসে শুয়ে পড়ল।
ঘুম আসতে চাইছে না। মনে পড়ছে পুরোনো দিনের কথা। দীর্ঘ চার বছর প্রেমের পর ওদের বিয়ে সম্পূর্ণ হয়েছে। যদিও বিয়ে টা সহজ ছিল না। শ্রীতমার বাবা সৌমেনবাবু রাজিই ছিলেন না। সৈকতের বিশাল ব্যাবসা, বিপুল সম্পত্তিতেই আপত্তি ছিল ওনার। উনি চাইতেন ওনার সমতুল্য পরিবারে শ্রীতমার বিয়ে দিতে, যাতে কেউ কোনোদিন শ্রীতমার অমর্যাদা না করতে পারে।
কিন্তু মৈনাক-সুমিত্রার মিষ্টি ব্যাবহার আর সৈকত ওনার মন জয় করে নিয়েছিল। আর সত্যি বলতে কী সৈকতের মতো ছেলে দুটো খুঁজে পাননি সৌমেনবাবু।
সৈকতের শ্রীতমার সাথে মানানসই সুন্দর চেহারা বা বড়োলোক বলে নয় , অমন অনেকেই হয়। কিন্তু এত সোজা সরল, এত কম বয়সে বুদ্ধিমান যুবক কমই দেখেছেন সৌমেনবাবু। তাই আর না করতে পারেন নি।
বিয়ে তো ছয় মাসও পূর্ণ হয়নি, এরই মধ্যে এত দূরত্ব? শুধুমাত্র কী শ্রীতমার কাজের জন্য?
মৈনাক চ্যাটার্জীর এত বড় ব্যাবসা। এখনো একা হাতে সামলাতে হয়। সৈকততো কোনোদিন অফিস মুখো হয় না। শ্রীতমার তো ব্যাপরই আলাদা। সব কিছু ছেড়ে ছুড়ে বেসরকারি ব্যাংকে কাজ করে। শ্রীতমা নিজেও বোঝে কাজটা ছেড়ে দেওয়া উচিত। কিন্তু দু বছর ধরে কাজ করার জায়গার মায়া কিছুতেই কাটাতে পারে না।
ভাবতে ভাবতেই ঘুমিয়ে পরে শ্রীতমা।
(২)
তারপরেও কেটে গেছে অনেক গুলো দিন। শ্রীতমার কাজের চাপও কমে না, তাড়াতাড়ি বাড়ি ফেরাও হয় না। শ্রীতমার কাজের রুটিনের কোনো পরিবর্তন নেই। কিন্তু আশ্চর্য রকম ভাবে বদলে যায় সৈকত।
শ্রীতমার ছুটির দিন গুলোতেও সৈকতের চুলের টিকি দেখা যায় না। রোজ রাতের বেলা কখন বাড়ি ফেরে কেউ জানে না। এক ছাদের তলায় থেকেও দু একবারই হয়তো দুজনের সামনা সামনি দেখা হয় মাত্র।
একদিন সন্ধ্যেবেলায় শ্রীতমা নিজে থেকে সৈকতকে ফোন করল। সৈকত তখন নদীর ধারে একটা বেঞ্চের উপর বসে ছিল একাই। একে সন্ধ্যেবেলা, তার উপর শীতকাল। আশে পাশে কেউ নেই। হঠাৎ শ্রীতমার ফোন দেখে অবাক হয়ে বলল-"কী হয়েছে? "
"কী আবার হবে? কী করছো এখন?"
"কেন কী দরকার সেটা তো বল।"
"তুই সবসময় এরকম কেন করছিস বলতো? একটুও কী ভালো করে কথা বলা যায় না?"
"কী মুশকিল। তুই তো কোনোদিন নিজে থেকে এরকম সময়ে ফোন করিস না। তাই অবাক লাগছে।"
"আমার বর কে কখন ফোন করব না করব সবই আমার ব্যাপার। তোর কী এখন কোনো কাজ আছে?"
"না।"
"তাহলে চল রেস্টুরেন্ট। একেবারে ওখানে ডিনার করে বাড়ি ফিরব।"
"তোর কাজ হয়ে গেছে?"
"হ্যাঁ। চলে আয় আমি পাঁচ মিনিটেই পৌঁছে যাব।"
"দেখছি।"
"দেখছি না। তোকে আসতেই হবে।"
শ্রীতমার কথা না রাখার মতো সাহস সৈকতের কোনোদিন ছিল না। বলল-"আচ্ছা। আসছি।"
শ্রীতমা রেস্টুরেন্টের বাইরেই দাঁড়িয়ে ছিল। সৈকত বাইকটা গ্যারেজে রেখে শ্রীতমার সামনে দাঁড়াতেই শ্রীতমা বলল-"বাবা হিরো একেবারে। তা কত গুলো মেয়ে প্রেমে পড়ল তোর।"
"ফালতু বকিস না। তুইই প্রথম তুইই শেষ।"
"সত্যি? আমার তো সারাদিন চিন্তার শেষ নেই...না জানি আমার বরটা কোন পেত্নির সাথে ঘুরছে।" শ্রীতমা হাসল।
সৈকতের বাঁদিকের বুকটা কেমন ব্যাথা করে উঠল। বলল-"তোকে হাসলে খুব সুন্দর লাগে।"
"আমি জানি। আমি সুন্দর বলেই তো তুই প্রমে পড়েছিস । আর ওভাবে দেখতে হবে না, আশপাশের লোকে দেখছে। খিদে পেয়েছে চল, কিছু খায়।"
শ্রীতমার পিছন পিছন সৈকত রেস্টুরেন্টে ঢুকল। ফাঁকা একটা টেবিল দেখে বসতেই শ্রীতমা বলল-"তুই হাঁদারাম নাকি রে?"
সৈকত বলল-"কেন?"
"এতদিন পর একসাথে রেস্টুরেন্টে এলাম। দু টো প্রান খুলে কথা বলব। তা না পাবলিক প্লেসে বসছে। চল ওইদিকের কোনে দিয়ে বসি।"
শ্রীতমা খাবারের অর্ডার দিয়ে সৈকতের হাতটা শক্ত করে ধরে বলল-" কী হয়েছে তোর।"
সৈকত হাতটা ছাড়ানোর চেষ্টা করল কিন্তু পারল না। বলল-" কী হবে আমার?"
"তাহলে আমাকে এড়িয়ে চলছিস কেন?"
"কোথায়?"
"সব সময়ই। এমনকি আমার সাথে ভালো করে কথা পর্যন্ত বলিস না।"
অস্বস্থিতে পড়ল সৈকত-"আমি ঠিক আছি।"
"একটুও ঠিক নেই। তোকে আমার থেকে বেশি কেউ চেনে না। তুইও না।"
ওয়েটার খাবার দিয়ে গেল। সৈকত বিরিয়ানির প্লেটে চামচ গুঁজে বলল-" বললাম তো ঠিক আছি। কেন জোর করছিস?"
"আচ্ছা। আমার চোখের দিকে তাকিয়ে বল যে তুই ঠিক আছিস তাহলে আমি আর কিছু বলবো না।"
সৈকত শ্রীতমার চোখের দিকে তাকালো। সেই চোখ, সৈকতের বেঁচে থাকা না থাকা সব যার কাছে। হাজার কষ্টের মাঝে যে চোখের দিকে তাকালে সব দুঃখ কষ্ট উধাও হয়ে যায়, সেই চোখের দিকে তাকিয়ে সৈকত কী করে মিথ্যে কথা বলবে? বলল-"আমার খুব ভয় করে রে।"
"কিসের ভয়?"
"তোকে হারিয়ে ফেলার।"
শ্রীতমা হেসে ফেলল-"দূর পাগল। আমি কেন তোর কাছ থেকে হারিয়ে যাব? তাহলে আমি বাঁচাতে পারব?"
সৈকত গম্ভীর হয়ে বলল-"তুই সারাদিন অফিসে থাকিস, ঠিক মতো খাওয়া দাওয়া করিস না, নিজের খেয়াল রাখিস না। তোর যদি কিছু হয়ে যায় তাহলে আমি কী নিয়ে বাঁচব?"
"কে বলেছে তোকে যে আমার সারাদিন শুধু কষ্টই হয়। যখন লোক গুলো কাঁচের ওপার থেকে চেক গুলো এগিয়ে দিয়ে বলে-ম্যাডাম আমার চেকটা ক্লিয়ার করে দিন। আমি টাকা গুলো যখন ওদের হাতে দিই, তখন টাকা গুনতে গুনতে ওদের মুখে এক তৃপ্তির হাসি থাকে। ওদের খুশি দেখে ভুলে যায় নিজেকে। আরো আরো বেশি তাড়াতাড়ি কাজ করতে থাকি। কখন যে দিন শেষ হয়ে যায় বুঝতেই পারি না।"
"কিন্তু তোর খুশি, তোর মুখের হাসি?"
শ্রীতমা কিছুক্ষণ চুপ থেকে বলল-" তুই এমন বলছিস যেনো, আমিই একমাত্র লোক যে এই কাজ করছি।"
"না আসলে তা নয়। সব ব্যাংকের সব স্টাফই দায়িত্বের সাথে, সিরিয়াসলি কাজ করে। কিন্তু তুই একবার কেবিনে বসে পড়লে সব কিছু ভুলে যাস। কম্পিউটারের সাথে তাল মিলিয়ে কাজ করতে গিয়ে নিজেকে রোবট ভেবে বসিস। এত কাজ করে কী হবে? কী পাবি তুই?"
শ্রীতমা উত্তর দেয় না। সৈকতের হাতটা ছেড়ে দিয়ে অন্য দিকে মুখ ফিরিয়ে নেয়।
সৈকত বলতে থাকে-"তোকে যে কাজ করতেই হবে তার তো কোনো মানে নেই। আমাদের এতো বড় ব্যবসা, সেখানে ডেলি পাঁচ হাজারেরও বেশি ওয়ার্কার কাজ করে। আর তুই অন্য একটা অফিসে........এর কোনো মানে হয় শ্রীতমা? "
শ্রীতমা উঠে পড়ল-"কাজটা আমার কাছে শুধু কাজ না। আমার নেশা বলতে পারিস। তাই কাজ ছাড়ার কথা আমি ভাবতে পারি না। আমি আসছি।"
শ্রীতমা হনহনিয়ে বেড়িয়ে গেল। সৈকতও পিছন পিছন দৌড়ে এসে হাত ধরে বলল-"আমি তোকে কাজ ছাড়ার কথা বলিনি। তুই শুধু নিজের খেয়াল......"
"হাত ছাড়। বাড়ি যাব।"
"আমিও তো যাবো, আমার সঙ্গেই চল।"
"আমি আমার গাড়ী নিয়ে এসেছি। আমি চলে যেতে পারব।" এক ঝটকায় হাত ছাড়িয়ে নিয়ে শ্রীতমা চলে যায়।
(৩)
শ্রীতমা আজ অফিসে ঢুকতেই একজন পঁচিশ-ছাব্বিশ বছরের মহিলা এগিয়ে এসে বলল-"নমস্কার ম্যাডাম। আমার নাম মানসী। আজ থেকে আমি আপনার অ্যাসিসটেন্ট হিসেবে কাজ করব।"
"অ্যাসিসটেন্ট?"-অবাক হয়ে বলল শ্রীতমা।
" হ্যাঁ। অমিতবাবু বলেছেন।"
আরো অবাক হওয়ার পালা শ্রীতমার। যে লোকটা নিজে কাজে ফাঁকি দিয়ে শ্রীতমাকে দিয়ে বেশি কাজ করায়। শ্রীতমা একটু লেটে আসলে হাজারটা কথা শোনায় সেই অমিতবাবু কিনা শ্রীতমার সুবিধার জন্য অ্যাসিসটেন্ট রেখেছে। ভাবা যায়?
শ্রীতমা আর কথা বাড়াল না। একেই আসতে দেরি হয়েছে। যদি এখনই দেখে ফেলে তাহলে তো হাজার টা কথা শোনাবে। নিজের কাজে মন দিল শ্রীতমা।
শ্রীতমার বেশির ভাগ কাজ মানসী করে দেওয়ায় শ্রীতমার খুব সুবিধে হতো। তাছাড়া মানসী খুবই ফ্রেন্ডলি। শ্রীতমাকে সব সময় হাসি খুশি রাখার চেষ্টা করে।
শ্রীতমা এখন সাড়ে আটটার আগেই বাড়ি পৌঁছে যায়। কিন্তু মৈনাক একমাত্র ছেলেকে ব্যাবসা ঠিক ঠাক বুঝিয়ে দিতে বিদেশে নিয়ে গেছে। সুমিত্রাকে একা বাড়িতে থাকতে হয়। বিকেল বেলা কাজের মেয়েটা চলে যাওয়ার পর একেবারে একা লাগে। কিন্তু শ্রীতমা ফেরার পর ভালোই লাগে। শ্রীতমা সবসময় ফোনে খোঁজ নেয় সৈকতের। তবুও মিস করে খুব।
এভাবেই দিন কাটছিল বেশ। গন্ডগোলটা বাঁধল সৈকতের বাড়ি ফেরার দিন। শ্রীতমা ঠিক করেই রেখে ছিল সৈকত যেদিন বাড়ি ফিরবে সেদিন শ্রীতমাও দুপুরে বাড়ি ফিরে অবাক করে দেবে।
বৃদ্ধ বস মানে অমিতবাবুকে বুঝিয়ে বলল যে ওর সব কাজ মানসী করে দেবে। অমিতবাবু রাজি হয়ে গেলেন।
শ্রীতমার অফিস থেকে বেড়িয়েই খেয়াল হলো, গাড়ীর চাবিটা কেবিনেই ফেলে চলে এসেছে। চাবি আনার জন্য আবার ঘুরতে হলো।
ঘরে ঢোকার আগেই শুনতে পেল মানসী কাউকে ফোন করছে আর বার বার সৈকতের নাম বলছে। ভালো করে শোনার জন্য আড়ালে দাঁড়িয়ে পড়ল শ্রীতমা।
ফোনের ওপারের কথা শোনা না গেলেও মানসীর কথা শোনা যাচ্ছে।
মানসী বলছে-"তোর কাছেই যাবে ও। সেই জন্যই তো ছুটি নিয়েছে। "
..........................ওপারের কথা শোনা গেল না।
"বাবা! সৈকতবাবু সুন্দরী বউকে যেন চোখে হারাচ্ছে। মাত্র পনেরো দিন না দেখতে পেয়ে যে একেবারে বিরহে প্রাণ বাঁচে না এর মতো অবস্থা। এত ভালোবাসা আসে কোথা থেকে রে?"
........................................
"আরে না না, ও কিছু বুঝতে পারেনি। তবে ওই বুড়ো হাবড়া বস টাকে দেখে আমার ভয় হয়। যদি বলে দেয় যে তুই আমাকে এখানে পাঠিয়েছিস।"
................................
"হ্যাঁ। সে তো বটেই।"
...........................
"আচ্ছা সৈকত রাখছি রে। অনেক কাজ দিয়ে গেলো তোর বউ, সেগুলো সামলাতে হবে।"
শ্রীতমা মুহূর্তে সব বুঝে যায়। সোজা অমিতবাবুর কেবিনে ঢুকে বলে-"মানসী কে?"
অমিত চমকে উঠে বলে-"আমি জানি না। হেড অফিস থেকে পাঠিয়েছে।"
"হেড অফিস থেকে? না আমার হাসব্যান্ড?"
অমিত থতমত খেয়ে বলল-"আমি জানি না।"
"আপনি সব জানেন। মানসীকে সৈকত আমার উপর নজর রাখার জন্য পাঠিয়েছে। তাই না?"
অমিত সোজা হয়ে বসে বলল-"সব যখন যেনেই গেছো তখন সব খুলে বলাই ভালো। তোমার কাছের প্রেসার কমানোর জন্য সৈকত মানসীকে পাঠিয়েছে। আর মানসীকে মাইনে দেয় সৈকত।"
"আপনি আমাকে জাননি কেন?"
"আমাকে সৈকত বলতে নিষধ করেছে। তাছাড়া আমার শুধু কাজ নিয়ে কথা, তোমাদের ব্যাপারে নাক গলাতে যাব কেন?"
মানসীকে ডাকতেই মানসী এসে বলল-"আমি সৈকতের ক্লাসমেট ছিলাম। চাকরির একটা দরকার ছিল। কদিন আগে সৈকতের সাথে যোগাযোগ করতেই, ও আমাকে এই কাজটা করতে বলল। বিশ্বাস করো তোমার সাথে আমার বিশ্বাসঘাতকতা করতে ইচ্ছে করেনি। তবুও........" মানসী থামল।
"আপনি এখানে আমার উপর নজর রাখতেন। আর আমি কী করি না করি সব ওকে বলতেন তাই না?"-গলা ধরে এলো শ্রীতমার।
" না। তোমার খেয়াল রাখার জন্য।"
"আমি বাচ্চা মেয়ে নয়। সব বুঝি।"
"তোমার থেকে আমার অভিঞ্জতা বেশি। এমনকি তোমার থেকে আমি দু তিন বছরের বড়ো। তাই নিসন্দেহে বলতে পারি তোমর ভুল হচ্ছে। তুমি যা ভাবছ তা নয়। সৈকত তোমাকে খুব ভালোবাসে।তাই তোমার সব ইচ্ছে গুলোর মর্যাদা দেয়। এমকি এই চাকরিটা পর্যন্ত করতে দিয়েছে। আর তোমার খেয়াল রাখাটাও ওর কর্তব্যের মধ্যে পড়ে।"
"দেখুন। ওর হয়ে কোনো সাফাই আপনার কাছে শুনতে চায় না।"
শ্রীতমা যাওয়ার জন্য পা ফেলেই আবার ঘুরে দাঁড়িয়ে বলল-"আর হ্যাঁ। এসব ব্যাপার যদি আপনি আবার ফোনে বলে দেন, তাহলে কিন্তু ভালো হবে না।"
শ্রীতমা চলে গেল। সৈকত কে আবার ফোন করার মতো সাহস মানসীর ছিল না।
শ্রীতমা বাড়ি ফিরে নিজের ঘরে গিয়ে আলমারি খুলে জামাকাপড় গোছাতে লাগল। বেচারা সৈকত পিছন থেকে এসে জড়িয়ে ধরতেই শ্রীতমা এক ঝটকায় সরিয়ে দিয়ে, গালে একটা কষিয়ে চড় মারলো।
সৈকত গালে হাত দিয়ে বলল- "কী হলো? মারছিস কেন?"
"তোমার লজ্জা করে না? বিশ্বাসঘাতক।" রাগে ফুঁসছে শ্রীতমা।
"কী হয়েছে সেটা তো ............" সৈকতের কথা শেষ হতে না হতেই আবার এক চড় দিয়ে বলল-"তুমি জানো না, তাই না? তুমি আমাকে এতটা সন্দেহ করো যে আমার ওপর নজর রাখতে লোক রেখেছো? এসব দিন দেখার আগে আমার মরে যাওয়া উচিত ছিল। তুমি এতটা নীচ জানতাম না।"
সৈকত বুঝতে পেরে বলে-"পাগলী, আমি তোর ওপর নজর রাখতে কেন যাব? তোর যাতে কোনো অসুবিধে না হয়..........."
"তোমার মিথ্যে কথা তোমার কাছেই রাখো। আমি বাড়ি ছেড়ে চলে যাচ্ছি।"-কেঁদে ফেলল শ্রীতমা।
মাথায় বজ্রাঘাত হলো সৈকতের-" এরকম কেন বলছিস? তুই যত পারিস আমাকে মার। আমার ভুল হয়ে গেছে, আর কখনো হবে না। সরি...." নিজের কান ধরে সৈকত।
শ্রীতমা কোনো কথা শুনলো না। নিজের জামাকাপড় গুলো গুছিয়ে নিয়ে নীচে নামতেই দেখল সুমিত্রা। শ্রীতমাকে দেখে অবাক হয়ে বলল-" কোথায় যাচ্ছিস তুই?"
"আমার নিজের বাড়ি।"
"এই দুপুর বেলায়? কী হয়েছে টা কী?"
"তোমার ছেলেকে জিজ্ঞেস করো।"
সৈকত দৌড়ে এলো-"মা ওকে যেতে দিও না। আটকাও। দেখো আমার কোনো কথা শুনছে না। ভুল বুঝছে আমাকে।"
"কী হয়েছে সেটা তো বল আমাকে।"
সৈকত সবকিছু বলতেই সুমিত্রা হেসে ফেলল। দুজনেই অবাক হয়ে গেল। সুমিত্রা হাসি থামিয়ে বলল-" তোরা পারিসও বটে। আর শ্রীতমা তুই কী পাগল হয়ে গেছিস? জানিসই তো আমার ছেলেটা এরকম। ও নিজেও জানে না কী করলে কী হবে। তুই ঘরে যা।"
" না মা। তুমি তো তোমার ছেলেকে সার্পোট করবেই। আমি বাড়ি ছেড়ে চলে যাচ্ছি। আর ফিরব না দেখো।"-শ্রীতমা কেঁদে ফেলল।
সুমিত্রার মুখের হাসি মিলিয়ে যায়-"এসব কী কথা?" সুমিত্রা শ্রীতমার চোখ মুছিয়ে দিয়ে বলল-"তোর রাগ হয়েছে, যা তুই বাপের বাড়ি। কিন্তু এসব কথা মুখেও আনিস না।"
"থাকব না ওই লোকটার সাথে। আমি আসছি।"
শ্রীতমা চলে গেল। সৈকত ডাকতে লাগল-"যাস না শ্রীতমা।"
সুমিত্রা বলল-" ওকে যেতে দে সৈকত। ও নিজের ভুল বুঝতে পেরে কালই বাড়ি চলে আসবে।"
"কিন্তু মা.............."
"কোনো কিন্তু না। যেমন দোষ করেছিস, তেমন ঠিক করছে।"
(৪)
তারপরেও কেটে গেছে দুটো মাস। শ্রীতমা ফেরেনি সৈকতের কাছে। আসলে নিজের ভুল বুঝতে পেরে গ্লানির শেষ ছিল না শ্রীতমার। সৈকতও রাগ করে কোনোদিন ফোন করেনি বা ওদের বাড়ি যায়নি।
সেদিন অফিসে পৌঁছনোর পর থেকেই শ্রীতমার বাড়ি থেকে বার বার ফোন করছে শ্রীতমাকে। কিন্তু শ্রীতমা ধরতে পারছে না। পাঁজি বসের অর্ডার ওয়ার্ক টাইমে নো কল।
প্রায় পনেরো কুড়ি বার ফোনের পর শ্রীতমা বলল-"স্যার বাড়ি থেকে সবাই বার বার ফোন করছে। মনে হয় কিছু একটা হয়েছে। আমি রিসিভ করছি।"
অমিতবাবু বললেন-"না। আগে কাজ। তারপর ফোন।"
শ্রীতমা অমিতের কথা গ্রাহ্য না করেই , কল রিসিভ করল।
শ্রীতমার মায়ের ফোন-"তুই যত তাড়াতাড়ি পারিস হসপিটালে চলে আয়।"
" কেন?"-আজানা আশঙ্কায় বুকের ভেতর কেঁপে ওঠে শ্রীতমার।
"তোর শ্বশুড় মাশাই এর শরীর খারাপ।"
"কি হয়েছে ওনার?"
"কী জানি। সুমিত্রাদি বলছিল অফিসেই নাকি মাথা ঘুরে পড়ে গেছেন। এখনও ঞ্জান নেই।"
"আচ্ছা। আমি আসছি এখনই।"
শ্রীতমা চেয়ার ছেড়ে উঠতেই অমিত বলল-"কোথায় যাচ্ছ কাজ ছেড়ে।"
"আমার শ্বশুরমশাই খুব অসুস্থ। হসপিটালে ভর্তি আছেন। আমি ওখানেই......."
"আগে কাজ তারপর অন্য কথা।"
"স্যার!" বিস্ময়ে হতবুদ্ধ হয়ে যায় শ্রীতমা।
"অবাক হওয়ার কিছু নেই। এই মুহূর্তে ছুটি দিতে পারব না। আরও দু ঘন্টা কাজ করো তারপর দেখা যাবে।"
"স্যার। আমি সত্যিই কোনোদিন ভাবতেই পারিনি যে আপনি এতটা স্বার্থপর। আজ আমি যাবই, পারলে আটকে দেখান।"
শ্রীতমা দু পা এগোতেই অমিত বলল-" চাকরি চলে যাবে কিন্তু।"
শ্রীতমা দাঁড়িয়ে আই কার্ড ছিঁড়ে ফেলে দিয়ে বলল-"রাখুন আপনার চাকরি। কী ভেবেছেন কী? আপনার এই চাকরি না করলে খেতে পাব না? ভুলে যাবেন না আমি মৈনাক চ্যাটার্জীর পূত্রবধূ। আমাদের দেশ বিদেশের অফিসে আপনার মতো হাজার হাজার লোক কাজ করে। আর কথা বাড়িয়ে লাভ নেই। আসছি স্যার। ভালো থাকবেন।"
রাস্তার মধ্যে আবার মায়ের ফোন এলো-"তুই সোজা বাড়ি চলে যা। তোর শ্বশুরমশাই ওখানেই আছে।"
"কোন বাড়ি?"
"তোর শ্বশুর বাড়ি।"
"কেমন আছেন উনি?"
"এখন ভালোই আছেন। একটু হার্টঅ্যাটাকের মতো হয়েছিল।"
"আচ্ছা। আমি যাচ্ছি।"
শ্রীতমা বাড়ি ঢুকতেই সুমিত্রা জড়িয়ে ধরে কেঁদে ফেলল-"এতক্ষনে তোর আসার সময় হলো?"
"একটু দেরি হয়ে গেল। বাবা কোথায়? কেমন আছেন উনি।"
"নিজের ঘরেই আছেন। এখন একটু ভালো আছেন।"
শ্রীতমা ঘরে গিয়ে দেখল মৈনাক খাটে আধ শোয়া হয়ে হেলান দিয়ে বসে আছে। সৈকত পাশেই চেয়ারে বসে ছিল। শ্রীতমা যেতেই বসার জন্য চেয়ার ছেড়ে দিল।
শ্রীতমা বসে বলল-"কেমন আছেন আপনি?"
"এতক্ষন ভালো ছিলাম না। তুই এসে গেছিস, এবার ভালো থাকব।"-হাসলো মৈনাক।
শ্রীতমাও হেসে ফেলল-" আপনিও না। কী করে হলো এসব?"
"অফিসে কাজ করতে করতে মাথা ঘুরে পড়ে গিয়েছিলাম। আসলে বয়েস হয়েছে, আর কী এসব কাজ আমাকে দিয়ে হয়?"
"ইস, মাথায় অনেক টা কেটে কেটে গেছে তো। কষ্ট হচ্ছে না?"
"না। একটু ব্যাথা করছে। কিন্তু আমার ছেলেটার খুব কষ্ট হয়েছে রে তোকে ছাড়া। দেখ কেমন চোখ মুখ শুকিয়ে গেছে।"
শ্রীতমা তাকাল। সত্যিই সুন্দর মুখের মধ্যে সেই উজ্জ্বলতা আর নেই। শ্রীতমা ভালোই জানত, সৈকতের ভালোবাসা কতটা নিখাদ।
সুমিত্রা ঘরে ঢুকে বলল-"আর এরকম করিস না শ্রীতমা। ওকে এভাবে কষ্ট দিস না। সারাটা জীবন একসাথে থাকিস।"
শ্রীতমার লজ্জায় মাথা ঝুঁকে পড়ল, তবুও বলল-"দূর, তোমাদের ছেলের সাথে কে থাকবে?"
জবাব দিলো সৈকত-"এলি কেন তাহলে?"
"আমি তো বাবা কে একবার দেখতে এসেছিলাম। আবার চলে যাব।"
সৈকত গম্ভীর ভাবে বলল-"বাড়ির বাইরে বেড়িয়ে দেখ একবার। একেবারে ঠ্যাং ভেঙে রেখে দেব।"
সবাই হেসে ফেলল।
রাতের বেলা। সৈকত একাই ব্যালকনিতে দাঁড়িয়ে, চোখে মুখে চিন্তার ছাপ স্পষ্ট।
শ্রীতমা এসে হাতের ওপর হাত রেখে বলল-"আর এত চিন্তা করতে হবে না। আমি কাজটা ছেড়ে দিয়েছি।"
"সত্যি?"
"হ্যাঁ। এবার সবসময় তোর সাথে থাকব।" সৈকতের কাঁধে মাথা রাখল শ্রীতমা।
"খুব ভালো হবে।"
শ্রীতমা খেয়াল করল, তবুও সৈকত মন মরা। বলল-" কী ভাবছিস তুই?"
"বাবা তো সাফ বলে দিল, কাল থেকে অফিসের কোনো কাজ করবে না। সব দায়িত্ব আমার। আমি কী করব বুঝতে পারছি না।"
" সত্যি? "
"কেন তুই শুনিসনি?"
"হ্যাঁ। সে তো খুব ভালো কথা।"
"ভালো কথা?"
"হ্যাঁ। তুই তো লন্ডনে বিজনেস ম্যানেজমেন্ট নিয়ে স্টাডি করেছিস।"
"সেটা ঠিক। তবে ফাইন্যান্সিয়াল দিকটা আমার খুব জটিল লাগে।"
শ্রীতমা সোজা হয়ে সৈকতের চোখে চোখ রেখে বলল- "আমার উপর ভরসা আছে তোর?"
"নিজের থেকেও বেশি।"
"তাহলে আর চিন্তা করিস না। আমি ওই দিকটা সামলে নেব।"
"সত্যি?"-সৈকতের মুখে হাসি ফুটলো।
"হ্যাঁ। আমি আগে যতই ছোটো অফিসে কাজ করি না কেন সেই ফাইন্যান্সিয়াল সার্ভিসই সামলেছি। তুই যদি সঙ্গে থাকিস তাহলে এটাও পারব।"
"তুই আমার কাজে সাহায্য করবি এতে আমার উপকারও হবে আর তোকেও দুচোখ ভরে দেখতে পাব সবসময়। আমাদের মাঝে আর কোনো দূরত্ব থাকবে না।"
"ফালতু বকিস না। মার খাবি।"
"তুই আমাকে বাঁচালি রে।" সৈকত শ্রীতমাকে জড়িয়ে ধরল। বুক চিঁড়ে এক স্বস্তির নিঃশ্বাস পড়ল।
শ্রীতমার মনে হলো আজ নিজেকে আবার নতুন করে খুঁজে পেল। সৈকতের বুকের মধ্যে মুখ গুঁজে
বলল-" আমার একটা শর্ত আছে?"
"কী?"
"আমি যদি অফিসে যায় , তাহলে তোকে কিন্তু সবসময় নিজেকে কন্ট্রোল করতে হবে।"
"চেষ্টা করব। কিন্তু কথা দিতে পারব না। আর....... এটা তো অফিস নয়।"
শ্রীতমা হাসল-"সেটাই আমার দূর্ভাগ্য।"
© Susmita
Related Stories