...

0 views

করম পরব
''আইজ রে করম ঠাকুর,
ঘরে দুয়ারে রে, ঘরে দুয়ারে।
কাইল রে করম ঠাকুর,
সাঁক/কাঁস নদীর পারে।।''

সবুজ আঁচলে মোড়া আমাদের বাংলা । আরো বেশি সবুজ শাল, পিয়াল, কেঁন্দু, মহুয়া, হরিতকী, বহড়া.নানান গাছ - গাছালি ঘেরা সাঁওতাল পরগনা। এককথায় ছোটনাগপুরের কৃষি উৎসব 'করম' উৎসব।এখানকার ছায়ায় ঘেরা গ্রাম - গঞ্জের মানুষদের পূজিত দেবতা হলো করম ঠাকুর। যদিও পূর্ব মধ্য ভারতের আদিম জনগোষ্ঠীর মধ্যে সবচেয়ে বড়ো উৎসব হলো-" করম পরব"। ইহা মূলত কৃষি ভিত্তিক জাতীয় উৎসব। ছোটনাগপুর মালভূমির বিহার, ঝাড়খন্ড, উড়িষ্যা সহ পশ্চিমবঙ্গের মূলত জঙ্গল মহলের বাঁকুড়া,পুরুলিয়া, পশ্চিম মেদিনীপুর, ঝাড়গ্রাম জেলায় ব্যাপক উৎসাহ ও উদ্দীপনার সাথে এই উৎসব পালন করা হয়ে থাকে।

" করম পরব "
" আমার করম, ভাইয়ের ধরম "...
অনেক সময় ভাই -এর মঙ্গল কামনায় দিদির করম উপবাস যাপন। অথাৎ ভাই সারা বছর নিজের কৃষি কর্ম করে থাকে, আর বোন করম উৎসব পালন করে ভাইয়ের কৃষি কর্মের মধ্য দিয়ে উন্নত ফসলের জন্য মঙ্গল কামনাই হলো এই উৎসবের পালনের মূল উদেশ্য। দিদিরা ভাইয়ের মঙ্গল কামনায় "করম পরব" উপবাসের মধ্য করে।



জঙ্গল মহলের শ্রেষ্ট কৃষি ভিত্তিক জাতীয় উৎসব।কচিকাচাদের উৎসাহ ও উদ্দিপনা তুঙ্গে।'করম' কথাটি এসেছে মূলত 'কর্ম' থেকে।'কর্ম' -- অর্থাৎ কোনো কিছু করা।আর এই 'করা' যাঁর দ্বারা সম্পন্ন হয় বা যিনি নিয়ন্ত্রণ করেন, তিনিই করম। কৃষিজীবী মানুষের কৃষিকাজই মূখ্য, তাই 'করম' কৃষি দেবতা, 'করম' গাছে তাঁর অধিষ্ঠান। তাঁর আরাধনাই করম পরব।
কুমারী ছেলে মেয়েরা সারাদিন উপবাস থেকে জাওয়া ডালি নিয়ে নাচ গানের মাধ্যমে দিনটি পালন করে থাকে। গ্রাম বাসীরা বাড়িতে বাড়িতে নতুন শস্য র চারা রোপন করে একটা ঝুড়িতে , সেগুলো সব গ্রামের একটা জায়গায় এনে জড়ো করে এবং ধামসা মাদল বাজিয়ে নাচ গান করে , ছেলে মেয়েরা নির্বিশেষে প্রচুর হাঁড়িয়া খেয়ে নেশা করে দিনের বেলাতেই, কার শস্য (চাল , ডাল, গম ) চারা বেশি পুষ্ট দেখতে হয় এটাই মুখ্য , উদ্দেশ্য যদিও।



সভ্যতার এই উৎসবের শুরু কবে থেকে তার বলা অসম্ভব। তবে মানব সভ্যতায় কৃষিকাজের সূচনা মেয়েদের হাত ধরেই। আদিম গুহাবাসী ছেলেরা যখন শিকারের খোঁজে জঙ্গলে যেত, তখন শিশু,বৃদ্ধ, রুগ্নদের পরিচর্যায় থাকত মেয়েরা । সেই সময়েই তারা লক্ষ্য করে উদ্ভিদ বা গাছপালা বা শস্যের জীবনচক্র দেখেছে । পরীক্ষা নিরীক্ষা করতে কোনো পাথরের পাত্রে মাটি ভরে ছড়িয়ে দেয় সংগৃহীত শস্যদানা। নিয়মিত জল দিয়ে একসময় সেই শস্যের অঙ্কুরোদ্গম ঘটিয়ে চারার বানিয়ে থাকে গুহাবাসী মেয়েরা, হয়তো আয়ত্ত করে ফেলে কৃষিবিদ্যার প্রথম পাঠ। গুহাবাসী মেয়েদের প্রচেষ্টাই এখানকার কৃষিজীবী আদিবাসী বোনেদের 'জাওয়া ডালি'তে।

ভাদ্রমাসের অমাবস্যার পর একাদশতম দিন (পাঁজিতে যা শুক্ল একাদশী নামে চিহ্নিত)
ভাদ্রমাসের একাদশীর পূণ্য তিথিতে "করম পরব" অনুষ্ঠিত হয়ে । ইহা মূলত কুমারী মেয়েরা সারাদিন উপবাস থেকে জাওয়া নাচ ও গীতের মাধ্যমে, করম ডালের পূজা, "কর্মু-ধর্মু " কহিনীর ইতিকথা শ্রবনের মাধ্যমে ভালো শস্য উৎপাদনের মঙ্গল কামনায় দিনটি করম দেবতার সংকল্পে নিবেদিত করে।

'করম পরবে'র ঠিক পাঁচ বা সাত বা নয় দিন আগে কুমারী মেয়েরা নদী, পুকুর বা কোনো জলাশয়ে গিয়ে স্নান করে এক সাথে।বাঁশের টুপা ( ঝুড়ির) বা ডালায় বালি ভরে তাতে পাঁচ বা সাত বা নয় ধরনের শস্য যেমন-ধান, গম, যব, , ছোলা, মটর, মুগ,ভুট্টা কুরত্থি, রমা, বুনে হলুদজল ছিড়িয়ে দেয়। একে 'জাওয়া পাতা' বা 'জাওয়া উঠা' বলা হয়। 'জাওয়া' শব্দটির মানে হলো 'অঙ্কুরিত হওয়া'। বিভিন্ন শস্যের অঙ্কুরোদ্গম ঘটানো হয় এভাবে। তাই একে 'জাওয়া পরব' বলা হয়। জাওয়া পাতার সময় বিভিন্ন গান গাওয়া হয়‌
যেমন--
'' আয় লো সঙ্গতি সবাই জাওয়া পাতাব লো।
গঙ্গা যমুনার বালি ছাঁক্যে উঠাব লো।।
কাঁসাই নদীর বালি নিয়ে জাওয়া পাতাব লো।
আমাদের জাওয়া উঠে যেমন
শাল ধুঁধের পারা লো।।''

মেয়েরা জাওয়া ডালিগুলো ঘিরে নাচ গান করে, ডালি নিয়ে ঘরে ফিরে আসে। গ্রামে ঢোকার আগে, তাড়া আসে 'করম' ঠাকুরের আখড়ায়,। করম মূলত লোকদেবতা এবং জল - জমিন - জঙ্গল কেন্দ্রীক জীবন ধারার প্রতীক।
এই ঠাকুরের কোনো মূর্তি নেই।
করম , অশ্বত্থ, বট, পাকুড় বা কোনো বড়ো গাছের নীচে করম ডাল পুঁতে তার সামনে মাটির তৈরি হাতি - ঘোড়া রেখে পুজো করা হয়।
পুজোর থালাতে সবাই ফুল, প্রসাদ, সিঁন্দুর ও পুজোর নানান উপাচারের সাথে একজোড়া মাটির হাতি ও ঘোড়াও নিয়ে আসে। যা করম দেবতার থানে সমর্পিত হয়।
তাই মাটির তৈরি হাতি - ঘোড়া এখানকার খুবই জনপ্রিয় ও প্রসিদ্ধ জিনিস। এটি শৈল্পিক নিদর্শন ও।
করম দেবতা আখড়ায় মানে গাছের নীচে আবার নাচ গান হয়।
'' প্রথমে বন্দনা করি,
গাঁয়েরই গরাম হরি।(২)
তারপরে বন্দনা করি,
করম ঠাকুর।
কিআ দিঁয়ে বন্দিব,
গাঁয়েরই গরাম হরি (২)
কিআ দিঁয়ে বন্দিব,
করম ঠাকুর।।
ঘিয়ে দুধে বন্দিব,
গাঁয়েরই গরাম হরি।(২)
জাওয়া দিঁয়ে বন্দিব,
করম ঠাকুর।।''

এরপর নিজের নিজের বাড়িতে পরিস্কার কুলুঙ্গিতে পিঁড়ির উপর জাওয়াডালি রাখে তারা। যে কদিন জাওয়া বাড়িতে থাকে, 'পারবতী'দের এক কঠিন, কঠোর অনুশাসন থাকতে হয়। 'পারবতী'দের স্নান, খাওয়া, শোয়া, সবকিছুতেই নানা নিয়ম মেনে চলতে হয়। নিয়ম ভাঙলে কৃষিকাজ বা সংসার অমঙ্গল হবে বলে বিশ্বাস করা হয়।
এসময় রোজ স্নান করে পবিত্র হয়ে জাওয়া ডালিতে হলুদ জল দেওয়া হয়। 'পারবতীরা সন্ধ্যাবেলায় করম আখড়ায় জাওয়াডালি গুলো ঘিরে নাচ গান করে ।
'করম' পরবের দিন সকাল থেকে 'পারবতী'দের অনেক কাজ। গোবর দিয়ে নিকানো হয় করম আখড়আ। গান গাইতে গাইতে নিকটবর্তী বনে থেকে দাঁতন, পাতা সংগ্রহ করতে হয় উপবাসী থেকে। বনে গিয়েও একপ্রস্থ নাচ গান করে তারা। এ সময় গ্রামের পুরোহিত বা লায়া জঙ্গল থেকে বুড়ি করমের পুরানো করম গাছ ডাল এনে আখড়াতে পুঁতেন । করম ঠাকুরের উদ্দেশ্যে পাতার খালাতে জল দাঁতন ও ঝিঙে পাতায় তেল হলুদ নিবেদন করা হয় সন্ধ্যাবেলায় জলাশয়ে গিয়ে।স্নান সেরে পারবতী'রা নতুন কাপড় পরে 'করম ডালা' সাজায় বাড়িতে এসে। ঘিয়ের প্রদীপ, সিঁদূর, কাজল, আতপচালের গুঁড়ি ইত্যাদি সহ ঝিঙেপাতার উপর একটা সবৃন্তক 'কাঁকুড়' রাখা হয় একটা বাঁশের নতুন ডালায়। 'পারবতী'দের ভবিষ্যত সন্তানের প্রতীক 'কাঁকুড়'বা 'বেটা' নামে পরিচিত, । সবাই ডালা নিয়ে আখড়াতে হাজির হলে। 'লায়া' করমডাল ও ধানগাছি হলুদ রঙের কাপড়ে বেঁধে সূর্য ও বসুমতীর প্রতীকি বিয়ে সম্পন্ন করেন।করম ডাল এখানে সুর্য ও ধানগাছি বসুমতীর বা পৃথিবীর প্রতীক। লোক বিশ্বাস এই যে, এই বিয়ের ফলে বসুমতী মান পৃথিবী ফলবতী হবেন‌।সুজলা সুফলা শস্য শ্যামলা হবে পৃথিবী। ডালা থেকে 'বেটা' বের করে সিঁদূর, কাজল, চালের গুঁড়ির ফোঁটা দেয় 'পারবতী'রা। লায়া মুখে ' করমু- ধরমু'র গল্প শুনে । করম ঠাকুরের পূজা দিয়ে পারবতী'রা ঘরে ফেরে । ভাত বাদে অন্য কিছু খেয়ে উপবাস ভঙ্গ করে তারা। জাওয়াডালি নিয়ে উপস্থিত হয় আবার আখড়ায়। এরপর সারারাত নাচগান চলে । পরেরদিন সকালে করম ঠাকুরের বিসর্জনের হয় । একটু নাচগানের করে‌ 'জাওয়া ভাঙা' ভক্তি ভরে। জাওয়াডালির শস্যচারা উপড়ে নিয়ে সবাইকে দেওয়া হয়। এগুলো ধানক্ষেত, সব্জিবাগান, গোয়ালঘর, নানা জায়গায় ছড়িয়ে দেওয়া হয়। শস্য , গোসম্পদ শ্রীবৃদ্ধি হবার কামনায়।
ছেলেদের হাতে 'করম ডোর' বেঁধে দেয় মেয়েরা, তাদের ভাই বা দাদার মঙ্গলকামনায়। এরপর বাজনা সহকারে লায়া করম ডাল বিসর্জন দিতে যান জলাশয়ে।
'' যাও যাও করম ঠাকুর,
যাও ছয় মাস রে, যাও ছয় মাস।
পড়িলে ভাদর মাস আনব ঘুরাঁই।।''

বিসর্জন পর স্নান করে এসে পারবতী'রা পারণ করেন । গোবর দিয়ে করমু ধরমু দুই ভাইয়ের প্রতীকি ছবি আঁকে বাড়ির কোনো দেওয়ালে।এঁকে তাতে সিঁদূর, কাজল, চালের গুঁড়োর ফোঁটা দিয়ে থাকে তারা। আলতি পাতায় বাসিভাত ও ঝিঙের তরকারি ভোগ হিসেবে নিবেদন করা হয় সেখানে। এই প্রসাদ খেয়ে পার্বতীরা পারণ করে। শস্যকামনা সন্তানকামনা ও ভাইয়ের মঙ্গলকামনার এক কৃচ্ছ্রসাধন অধ্যায় শেষ হয়।

ছবি - তির্থঙ্কর ওঝা ও অনতো মাহাতো