...

8 views

চুরি
মনে আছে ক্লাস নাইনে প্রথম কবিতা লিখেছিলাম — মাকে নিয়ে । সে নিজের ডায়েরীর জন্য নয় , স্কুল ম্যাগাজিনের জন্য । সেই ছিল বোধ হয় আমার সবচেয়ে বড় ভুল । শিক্ষক মহাশয় পড়ে বলেছিলেন , ' সবই তো ঠিক আছে , কিন্তু বুঝলাম না লেখাটা স্বরচিত না চুরি করা ।' আমি বলেছিলাম , ' দুটোই ' ; প্রথমত এটা আমার নিজের লেখা আর দ্বিতীয়ত চুরি করাও বটে — নিজের ভাবনা থেকে চুরি করা । কিন্তু শিক্ষক মহাশয় সে কথা বুঝবেন না । যাই হোক আমার মুখের দিকে তাকিয়ে আর আমার পূর্বকৃত কর্মের কথা স্মরণ করে বললেন , ' ঠিক আছে , ঠিক আছে , এটা তোমাদের সম্পাদিকাকে দিয়ে এসো । '
আমি জানতাম স্কুলের 'ডন'দের কামরায় আমার সামান্য খ্যাতি থাকলেও ভালো ছেলেমেয়েদের মহলে আমার স্থান নেই । তাই আমার সম্পর্কে শিক্ষক মহাশয়ের চিন্তা-ভাবনাকে বদলাব এমন ক্ষমতা বা ইচ্ছা কোনোটাই আমার নেই । সে যাই হোক এরপরও বহু স্বরচিত কবিতা তাঁকে দেখিয়েছি , তাতেও তাঁর মন আমার প্রতি সদয় হয়েছে বলে মনে হয় না ।
আমার প্রতি স্কুলের শিক্ষক-শিক্ষিকারা যে বিরূপ আচরণ করেন তার সামান্য ইতিহাস আছে । ইতিমধ্যে আমি ছাত্রছাত্রীদের প্রতি শিক্ষক-শিক্ষিকাদের অসমদর্শিতা প্রদর্শন হেতু তাঁদের বিরুদ্ধাচরণ করেছি । তাঁরা স্কুলের কিছু আইন-শৃঙ্খলা নিয়ে আমদের বিশেষভাবে জ্ঞানদান করে পরমুহূর্তেই নিজ স্বার্থহেতু নিজেই তা ভঙ্গ করলে তার বিরুদ্ধে আন্দোলনের ঝড় তুলেছি । এমনকি অপ্রিয় শিক্ষকের অকথ্য বাক্যে আনন্দিত হয়ে তাঁকে দুই চারিটি শ্রুতিমধুর কথা শুনিয়ে নিশ্চিন্তে ক্লাস পরিত্যাগ করতেও দ্বিধা বোধ করিনি । তাই আমার কীর্তিকলাপে অসন্তুষ্ট হয়ে শিক্ষক-শিক্ষিকারা যে আমার প্রতি সদয় দৃষ্টি রাখবেন না , সেটাই স্বাভাবিক । বস্তুত স্কুলের আদর্শ ছেলেমেয়েরা সর্বদা সত্য কথা বলার আর সত্য পথে চলার যে পাঠ বাল্যকালে নিয়েছিল , গত বছরের সিলেবাসের পাঠগুলোর মতোই নিমেষে , বিনা আয়াসেই তা গুলিয়ে খেয়েছে । তাই সেগুলি শুধু ঠোটস্থ করাই হয়েছে , কার্যস্থ করা হয় নাই । বলতে গেলে পূর্ব-অর্জিত বিদ্যাকে কার্যস্থ করার সাহস বা ইচ্ছা কোনোটাই এই সমস্ত সুবোধ বালক-বালিকাদের নেই ।
পূর্বেই বলেছি স্কুলের আদর্শ বালক-বালিকাদের বাজারে আমার দর নেই আর দর বাড়াবার চেষ্টাও নেই ।
আমি নিজেকে একটু বেশিই ভালোবাসি , তাই (আমি) বুঝি আমাকে অন্য কেউ ভালোবাসে না । না , না , বোধ হয় একজন আছে যে ভালোবাসে কিন্তু সামনে আসার সুযোগ পায় না । আমি স্কুলে যতটা অন্যের অপ্রীতিভাজন , সে ততটাই সকলের প্রিয় পাত্র , স্কুলের topper সে । অনেক অধ্যবসায়ের পর শেষ পর্যন্ত একদিন সে সামনে এলো , এই অজুহাতে যে সে আমার কবিতা খুব ভালোবাসে আর আমার কাছে কবিতা লেখা শিখতে চায় ।
তাকে আমি ' না ' করিনি । Permission সে পেয়েছিল , শুধুই কি পদ্যশিক্ষার , তা মনে হয় না — কারণ জানতাম কবিতা লেখার থেকে বেশি আমার দিকেই তার নজর । সে আমার কবিতার অজস্র স্তুতিবাদ উপস্থিত করত আর যখন আমি অপ্রস্তুত হয়ে পড়তাম সে বলত , ' চল্ ঐ দিকটায় ঘুরে আসি । ' এই বলে নিজের ব্যাগটা পিঠে তুলে আর আমার ডায়েরীটা হাতে নিয়ে আমার সঙ্গে বাগানের পাশ দিয়ে হাটতে হাটতে অজস্র অপ্রয়োজনীয় কথা বলে যেত । আমিও বলতে পারতাম না , ' আমার দেরি হচ্ছে , এবার বাড়ি যেতে হবে । ' যখন কথা শেষ হত তখনও তার ঘোর কাটত না , নানাবিধ অসম্ভব কল্পনায় বিভোর হয়ে ঘরে ঢুকতাম । বেশিরভাগ দিনই দেখতাম ব্যাগে আমার ডায়েরীটা নেই , জানতাম সেটা কোথায় । একদিন তাকে জিজ্ঞাসা করেছিলাম , ' আমার ডায়েরীটা নিয়ে তুই করিস টা কি ? ' সে বলেছিল , ' কিছুই না , শুধু যার কবিতা আমার ভিতরের প্রেমিকটাকে জাগিয়ে তোলে তার অনুপস্থিতিতে তার কবিতার মধ্যে তাকে খোঁজার চেষ্টা করি । ' এর প্রত্যুত্তরে আমার কিছুই বলার ছিল না অথবা বলতে পারি যা বলার ছিল তার উপযুক্ত শব্দ আমার শব্দকোষে ছিল না ।
সময় ! সে বড় অদ্ভুত ! কীভাবে কাটে বুঝি না — অতীত হওয়ার পরও সে চিরনবীন থেকে যায় ।
চুরি গেল ! আমার জীবনের অজস্র মুহূর্ত চুরি গেল । আর সেই নির্দয় চোর আমার নিরীহ মনটাকেও রেহাই দিল না আর রেহাই দিল না আমার হৃদয়াবেগ নিঃসৃত কবিতাগুলোকে । যখন বুঝলাম বাস্তবটা কী ততক্ষণে আমি নিঃস্ব হয়েছি । এরপরও আমি কবিতা লেখা ছাড়িনি কিন্তু বহুদিন হল সে আমার পথ পরিত্যাগ করেছে ।
ইতিমধ্যে আমার অজস্র কবিতা তার নামে স্কুল-ম্যাগাজিনে প্রকাশিত হয়ে জনমনের শ্রদ্ধা অর্জন করেছে । আজকাল প্রায় তার মুখোমুখি হই । আমি নির্দ্বিধায় অম্লানবদনে তার দিকে তাকাই আর সে ও বোধ করি কিছু বলতে চায় কিন্তু পারে না । ভাবটা এইরকম , ' বন্ধু , তুই সবার কাছে কৈফিয়ত চাস , শুধু আমার কাছেই চাইলি না । ' আর তারপর নিঃশব্দে আমার পথ সে ত্যাগ করে ।
এমন নয় যে আমি কবিতা লেখা ছেড়েছি । আজও কবিতা লিখি তবে তাকে ডায়েরীতে বন্দী রাখতেই যত্নবান , স্কুল-ম্যাগাজিনে দেবার প্রয়াস একেবারেই করি না আর ভবিষ্যতেও করব কি না ...
যাক গে ভবিষ্যতের কথা ভবিষ্যতে হবে ।