...

0 views

আঁধার

"এহন‌ও তুমি ঘুমাও নাই ব‌উ?"
শাহানার কণ্ঠ শুনে থমকে যায় পারুল। কিছুটা অপ্রস্তুত হয়ে শাড়ির আঁচল টেনে চোখ মুছে সে। পারুল কিছু বলার আগেই তার শ্বাশুড়ি বলে উঠেন-
" মাইয়া দুইটার ঘুম ভাঙলে তোমারে না পাইয়া ডরাইবো। ঘরে যাও"
"জ্বী আম্মা। যাচ্ছি।"
পারুল কিছুটা স্তব্ধ হয়ে বসে থাকে। বারান্দায় থাকা ছোট্ট কলসি থেকে পানি নিয়ে ওযু করছিল সে। তার শ্বাশুড়ি শাহানা বিছানায় এপাশ থেকে ওপাশ ফিরছিলেন। ঘুম নেই উনার চোখে। নৈঃশব্দের মধ্যে হঠাৎ পারুলের পানি ঢালার শব্দ শুনে ঘর থেকে বেরিয়ে আসেন তিনি। পারুলকে ঘরে যাওয়ার আদেশ দিয়ে এক মুহূর্ত‌ও দেরি না করে তিনি চলে যান।

মাসখানেক হলো নির্ঘুম রাত কাটায় পারুল। তার বিক্ষিপ্ত মনকে শান্ত করার জন্য আল্লাহর দরবারে আকুতি জানায় সে। পারুল তার স্বামী আফজালের অকাল মৃত্যুর শোক কাটিয়ে উঠতে পারে নি এখনও। যার উসিলায় এই বাড়িতে তার আগমন, যেই মানুষটার জন্য ইতি টানতে হয়েছে পড়ালেখার, যার সঙ্গে বুড়ো হবার স্বপ্ন দেখেছিল সে, সেই মানুষটার আকস্মিক মৃত্যুতে পারুল ভেঙে পড়েছে খুব। মেয়ে দু'টোর সামনে দিব্যি হাসিমুখে দিন পার করে সে। কিন্তু তার বুকের মধ্যে পুষে রাখা চাপা কষ্টের বোঝা কতো ভারি তা কেবল সৃষ্টিকর্তাই জানেন।
বেশ ক'দিন যাবৎ বাচ্চা দু'টুকে ঘুম পাড়িয়ে গভীর রাতে হারিকেনের আবছা আলোয় সালাত আদায় করতে দাঁড়িয়ে যায় পারুল। তাহাজ্জুদ সালাতে সিজদায় গিয়ে ফেলা দীর্ঘশ্বাসে নিমিষেই হালকা হয় তার কষ্টের বোঝা। স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলার সুযোগ হয় তার। প্রশান্তির বাতাস বয়ে যায় তার অন্তরে।
আফজাল মারা যাওয়ার পর বেশ ক'দিন বিলাপ করে কেঁদেছেন শাহানা। দু'হাত তুলে ছেলের জন্য মোনাজাত করেছেন কেঁদে কেঁদে। তার একমাত্র সন্তানের অকাল মৃত্যুর শোক দাবানলে পুড়াচ্ছে তাকে। ছেলের কথা ভাবতে ভাবতে কতো নির্ঘুম রাত যে কাটিয়েছেন তিনি তার হিসেব নেই। কতোবার কেঁদে কেঁদে জ্ঞানহারা হয়েছেন। এভাবে দিনের পর সপ্তাহ, সপ্তাহের পর মাস। এখন কিছুটা শান্ত হয়েছেন তিনি। আল্লাহর সিদ্ধান্ত মেনে নিয়ে স্থির হয়েছেন।

পারুল কেঁদে কেঁদে সব আকুতি মিনতি আল্লাহর দরবারে পেশ করার পর, দিনভর চেপে রাখা কষ্টের বোঝা হালকা করে স্বস্তির নিঃশ্বাস নিয়ে সালাত শেষ করে জায়নামাজ তুলে নেয়। হারিকেন নিভিয়ে অন্ধকার করে দেয় ঘরখানি। নিঃশব্দে পা‌ ফেলে এগিয়ে যায় বিছানার দিকে। বিছানায় গা এলিয়ে দেয়। মেয়ে দুটোর দিকে তাকাতেই ভারী মায়া হয় তার। দু'টো ফুল সুরভিত হয়ে আছে তার ঘরে। কি মিষ্টি চেহারা তাদের!

বাইরে আঁধারে ঢাকা আকাশে সূর্যের লালিমা আস্তে আস্তে ছড়াতে থাকে। শুরু হয় পাখির কিচিরমিচির। নির্মল বাতাস বয়ে যায় প্রকৃতিতে। সুবহে সাদিক শুরু হ‌ওয়ার ঠিক আগ মুহূর্তটাতে চোখ বুজে আসে পারুলের। বাতাসে মুয়াজ্জিনের আযানের ধ্বনি ভেসে আসবে কিছুক্ষণ পরেই। তার আগে একটু ঘুমিয়ে নেয় পারুল। মেয়ে দু'টো তার পাশে শুয়ে থেকেও কিছুই টের পায় না। তাঁরা জীবনের অদ্ভুত সমীকরণ সম্পর্কে বেখবর। সদ্য প্রস্ফুটিত হ‌ওয়া ফুল দু'টো জানেই না তাদের মা কিভাবে সংগ্রাম করে আগলে রাখছেন তাদেরকে। জীবনে আসা ঝড়ের গতি কতোটা তীব্র হতে চলেছে তাও বুঝতে পারে না বাচ্চা মেয়ে দু'টো। ছোট মেয়েটা হয়েছে রূপবতী।


নৌশিন, হুমায়রার সকাল শুরু হয় সূর্য ওঠার‌ও আগে। খুব ভোরে যখন সূর্য আকাশে দাগ কাটতে থাকে, গাছের পাতাগুলো দুলতে থাকে নির্মল বাতাসে, পাখিরা শুরু করে কিচিরমিচির, তখনই ঘুম ভাঙে দু'বোনের। ঘুম ভাঙার সাথে সাথেই শুনতে পায় দূর থেকে বাতাসের সঙ্গে ভেসে আসা মুয়াজ্জিনের আযানের ধ্বনি।
অন্ধকার আকাশে ভেসে উঠতে থাকা সূর্যের লালিমা দেখতে দেখতে বাড়ির উঠোনের এক কোণে থাকা কাঁঠাল গাছের মোটা শিকড়ে বসে পারুল আর‌ তার মেয়ে দুটো দাঁত ব্রাশ করে নেয়। পাখির সুমধুর সুরে গাওয়া গান, ব‌ইতে থাকা বাতাস‌ যেন আভাস দেয় সুন্দর একটা দিনের।
দাঁত ব্রাশ করে ওযু করে ঘরে চলে যায় তিনজন‌ই। পাটির উপর জায়নামাজ বিছিয়ে আদায় করে ফজরের সালাত। সালাত আদায়ের পর তারা মধুর সুরে তিলাওয়াত করে কুর‌আনের বাণী। এমনটিই হয়ে আসছে। পারুল তার মেয়ে দুটোকে এভাবে শিক্ষা দিয়েই বড় করছে। পৃথিবীর বুকে আরও একটা অনিশ্চিত সুন্দর দিনের শুরুটা এভাবেই করে পারুল আর তার মেয়েরা।

"স্কুলের যাবার সময় হয়ে গেছে। খেতে আসো তোমরা।"
"আসছি আম্মা।"
নৌশিন, হুমায়রা তাদের মায়ের ডাকে সাড়া দিয়ে চলে যায় রান্নাঘরে। মেয়েগুলো হয়েছে ভীষণ ভদ্র। তাদের মা যা বলেন তাই শুনে। তারা ঘুম থেকে ওঠার পর পর‌ই শাহানাও ওঠে যান। তিনি সালাত আদায়ের পর খেয়ে নেন রাতে পানি ঢেলে রাখা ভাত। পানি ভাত খাওয়া উনার‌ নিত্যদিনের অভ্যাস।

মায়ের শিখিয়ে দেওয়া নিয়ম অনুসারে হাত ধুয়ে বিসমিল্লাহ বলে খেতে শুরু করে দু বোন। খাওয়া শেষে স্কুলে যাবার জন্য রেডি হয় তারা।
নৌশিন পড়াশোনায় বেশ মনোযোগী। আপাদের পছন্দের ছাত্রী সে। যেকোনো কিছু সহজেই মাথায় গেঁথে নেয়। আর হুমায়রা হয়েছে উল্টোটা‌। সুযোগ পেলেই পড়াশোনায় ফাঁকিবাজি করতে চায়। মায়ের বকুনি শুনে কাঁদলে হুমায়রার লাল গাল দেখে মায়া হয় নৌশিনের।
"তুই ভালো করে পড়লেই ত পারিস। আম্মার বকা শুনতে হয় না।"
"আপা আমি পড়ি ত। কিন্তু...."
আর কোনো কারণ দর্শাতে পারে না হুমায়রা। কেননা সে পড়তে বসলেও মনযোগ থাকে অন্য কিছুতে। একমনে কি যেন ভাবতে থাকে বাচ্চা মেয়েটা।

পারুল শাড়িটা ঢেকে নেয় বোরকার ভিতর। নিকাবে ঢেকে নেয় তার সুন্দর মুখশ্রী। মেয়ে দুটোও ওড়না পেঁচিয়ে নেয় মাথায়। মায়ের‌ সঙ্গে মেয়েরা স্কুলের উদ্দেশ্যে বেরিয়ে পড়ে বাড়ি থেকে। নৌশিন পড়ে ষষ্ঠ শ্রেণিতে। আর হুমায়রা তৃতীয় শ্রেণিতে পড়ে।
প্রতিদিন মেয়ে দুটোকে স্কুলে দিয়ে বাড়িতে আসার পর‌ই দুঃশ্চিন্তারা ঘিরে ধরে পারুলকে।

পারুল তার দুই এতিম মেয়ে আর অসুস্থ শ্বাশুড়িকে নিয়ে ছন্দপতন হ‌ওয়া জীবনের ছন্দ মিলানোর সংগ্রাম চালিয়ে যাচ্ছে। মাথার উপর ছায়া হয়ে থাকার জন্য এই দুনিয়াতে কেউ নেই তার। বাবার বাড়ি তো তার কখনোই ছিল না। স্বামীর মৃত্যুতে চিরচেনা পরিবেশটাও যেন অচেনা হয়ে ধরা দিয়েছে পারুলের চোখে। বিপদ আপদে যাদেরকে পাশে পাওয়ার আশা করেছিলো, যাদেরকে আপন ভেবেছিল, তাদের মুখোশ উন্মোচন হ‌ওয়ার পর, জীবনে আল্লাহকে ছাড়া আর কারোর উপর ভরসা রাখতে পারে না পারুল। খাওয়া-পরা, কাপড়-চোপর, বাচ্চাদের পড়ালেখা, শ্বাশুড়ির ওষুধ; এসবের জন্য অর্থ উপার্জন করার কেউ নেই। পারুল-ই এখন হাল ধরেছে সংসারের। কাপড় সেলাই করে, বাঁশ-বেতের কাজ করে কোনোমতে সংসার চালাচ্ছে সে। পরিবারে অভাব অনটন লেগেই থাকে। না খেয়েও তাদের দিন পার করতে হয় কখনো কখনো। পারুলের জীবন জন্মলগ্ন থেকেই দুঃখময়। মা মারা যান তার জন্মের সময়ই। কিছুদিন যেতে না যেতেই বাবাও আরেকটা বিয়ে করেন। অসহায় এতিম পারুল বড় হয়েছে তার মামার বাড়িতে।
পড়ালেখা করার খুব ইচ্ছে ছিলো পারুলের। কিন্তু দূর্ঘটনাক্রমে পড়াশোনার ইতি টানতে হয় মেট্রিক পাশ করার আগেই। সে এক কালো অধ্যায় পারুলের জীবনে।


মধুর সুরে গান গাইছে কুকিল। আঁধারে ঢাকা আকাশে কিছু তারা ঝলমল করছে। নিস্তব্ধ প্রকৃতিতে ব‌ইছে স্নিগ্ধ, শীতল বাতাস। হুমায়রা অপলক দৃষ্টে তাকিয়ে আছে সুবিস্তৃত আকাশের দিকে। হঠাৎ দরজা খোলার আওয়াজে সংবিৎ ফিরে তার।

"এখনও জেগে আছিস!‌ ঘুমাস নি?"
"চোখে ঘুম আসছিলো না আম্মা।"

নৌশিনের বিয়ে আটকে আছে তার জন্য। বৃদ্ধা মা তাদের নিয়ে পড়েছেন বিপদে। এই নিয়ে দুঃশ্চিন্তা করার কারণে ঘুম আসছিলো না হুমায়রার। নিঃশব্দে জানালার কপাট খুলে বিছানার কোণে বসে রয় সে। কখন যে এতো গভীর রাত হয়ে গেছে টের পায়নি।

"ঘুমা। অস্থির হয়ে কোনো ফায়দা হাসিল করতে পারবি না। সব তো মহান আল্লাহর ইচ্ছাতেই হচ্ছে।"
"এতো সব দুঃখ-কষ্ট আমাদের জীবনেই কেন আম্মা? আমি যে আর স‌ইতে পারি না।"
"সুখ, দুঃখের মিশেলে-ই তো মানুষের জীবন। জীবনে আসা প্রতিকূলতা কাটিয়ে সামনের দিকে যারা আগাতে পারে তারাই জয়ী।"
"তোমার কষ্ট হয় না আম্মা?"
"ছোটবেলা থেকেই তো কষ্টের মধ্যে বড় হচ্ছি। কিন্তু জানিস! সাময়িক কষ্টের পরে হঠাৎ জীবনে নতুন চমক আসে। আল্লাহ পরীক্ষা করেন আমাদেরকে। ভরসা রাখ আল্লাহর উপর।"
"তুমি সত্যিই অসাধারণ আম্মা।"
মুচকি হেসে পারুল জবাব দেয়-
"তোকে সান্তনা দেওয়ার জন্য তোর মা আছে। আর আমি! আমি কখনো মা'কে দেখিই-নি।"
"তুমি পড়ালেখা ছেড়েছিলে কেন আম্মা?"
"অন্যদিন‌ বলবো"
দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বারান্দায় চলে যায় পারুল। আফজালের মৃত্যুর পর থেকে, গভীর রাতে বিছানা ছেড়ে উঠে সিজদায় নত হ‌‌ওয়া অভ্যাসে পরিণত হয়েছে তার। আগে যখন ওযু করতে উঠতো তখন তার শ্বাশুড়ি মাঝেমধ্যে দরজা খুলে বের হতেন। এখন পূবের দিকের ঘরটা খালি। কেউ থাকে না সেখানে। তার শ্বাশুড়ি শুয়ে আছেন কবরে।

আফজাল মারা যাওয়ার ছয় বছর হলো। পারুল তার বৃদ্ধা অসুস্থ শ্বাশুড়ি আর দুই মেয়েকে নিয়ে কোনোমতে দিন পার করছিলো। এর‌ই মধ্যে তার শ্বাশুড়ি দুনিয়ার মায়া ত্যাগ করে চলে যান। পারুল আর তার মেয়েদের জীবনে আসে নতুন এক ঝড়।

গতবছর ক্লাস টেন পাশ করেছে নৌশিন। আর্থিক সংকটের কারণে কলেজে ভর্তি হতে পারে নি। এবার মেয়েকে তার নিজের সংসারে পাঠিয়ে দেওয়ার চিন্তা করছে পারুল। নৌশিনের বিয়ের বয়স হয়েছে।

প্রতিবেশী খুশির মা অহরহ যাওয়া আসা করে পারুলের বাড়িতে। প্রতিবার বিয়ের সম্বন্ধ নিয়ে আসে। কিন্তু সম্বন্ধ নৌশিনের জন্য না। সম্বন্ধ নিয়ে আসে তার ছোট বোন হুমায়রার জন্য।

হুমায়রার গায়ের ফর্সা চামড়ার জন্য তার কদর বেশি। নৌশিনের এতো এতো গুণ থাকা সত্ত্বেও গায়ের রং কালো হ‌ওয়ায় বিয়ের সম্বন্ধ আসে না কোনো।

সবেমাত্র ক্লাস এইটে উঠেছে হুমায়রা। বহু গুণে গুণান্বিত বড় বোনকে রেখে তাঁর পিছনে উঠেপড়ে লেগেছে গ্রামের মহিলারা। শুধুমাত্র তাঁর গায়ের রং সাদা বলে! বিষয়টা খুব ভাবায় হুমায়রাকে।

তাদের বাড়িতে ঘটকদের প্রবেশ নিষেধ। বাড়িতে পর পুরুষের আনাগোনা একদমই পছন্দ করে না পারুল। মেয়ে দুটোও বাইরে গেলে বোরকা, নিকাব দিয়ে ঢেকে যায় নিজেদেরকে। কোনো ছেলের দিকে তাকায় পর্যন্ত না। মেয়ে দু'টো শালীনভাবে চলাফেরা করায় গ্রামে পারুলের বেশ সুনাম। ছোটবেলা থেকে এমনভাবে বড় করেছে সে।

প্রতিবেশী মেয়েরা মাঝেমধ্যে আসে পারুলের বাড়িতে। সপ্তাহে একদিন তালিম নেন পারুল। তার মেয়ের বয়সী এলাকার মেয়েগুলো পারুলের ভীষণ ভক্ত। এতো বাড়ির মানুষের মধ্যে পারুল আর তার মেয়েরাই শুদ্ধ ভাষায় কথা বলে। গ্রামের অন্য পাঁচ জন মেয়ের থেকে পারুলের মেয়ে দুটোকে আলাদা করা যায় সহজেই। তাদের ভদ্রতা, লাজুকতা, নম্রতা দেখে মুগ্ধ হয় সকলে।

পারুলের মা চৌধুরী বংশের মেয়ে ছিলেন। পারুল তার মামার কাছে বড় হ‌ওয়ায় ছোটবেলা থেকে ভদ্রতা শিখেছে খুব। শুদ্ধ ভাষায় কথা বলার অভ্যেস ছোটবেলা থেকেই। হঠাৎ এক অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনার কারণে আফজালের সঙ্গে বিয়ে হয় তার। ক্লাস টেন আর পড়ে শেষ করতে পারে নি পারুল।

মেয়ে হিসেবে নৌশিনের তারিফ করে সবাই। কিন্তু বিয়ের পাত্রী হিসেবে তাদের ফর্সা মেয়ে চাই। নৌশিন আর হুমায়রা দু'জন‌ই দুঃশ্চিন্তায় মগ্ন থাকে সারাক্ষণ। অথচ তাদের মায়ের কোনো অস্থিরতা নেই! পারুল সময়ানুযায়ী সঠিক সিদ্ধান্ত নিতে পারে। দুঃশ্চিন্তায় ডুবে যায় না সহজেই। তার স্বাভাবিক স্বচ্ছ বুদ্ধির দরুন কম বয়সে বিধবা হ‌ওয়া সত্ত্বেও মেয়ে দুটোকে সামলে নিয়ে সামনের দিকে আগাতে পারছেন।

এখন অবধি নৌশিনের জন্য কোনো সম্বন্ধ আসে নি। মেয়েটা কষ্ট চাপা দিয়ে রাখে। গায়ের রং কালো বলে এই অবহেলা!


"এতো সুন্দর মাইয়্যারে আর পড়াইয়া কি করবা আফা?‌ বিয়া দেও। সংসার করুক।"
"বিয়ে দিব সময় হলে। এখন পড়ুক।"
"মাইয়্যা মাইনষের আবার পড়ালেখার দরকার কি আফা? সংসার করবো, পোলাপান মানুষ করবো।"
" হ্যাঁ ললিতা। সংসার করার জন্য, সন্তান বড় করার জন্য‌ই মেয়েদের পড়তে হয়। সন্তানকে মানুষের মতন মানুষ করতে হলে মা'কে অবশ্যই শিক্ষিত হতে হবে।"
"এইডা তো ঠিকই আফা। তুমি পড়ছিলা দেইখ্যাই তো পড়ালেখার কদর বুঝো। তোমার মাইয়্যাগুলাও ভদ্রতা জানে।"
ললিতা চলে যায়। সে একটা জামা সেলাই করাতে এসেছিল পারুলের কাছে।
পারুল হুমায়রাকে অনেক পড়াবে। এলাকার মানুষের কোনো কথাই সে কানে নেয় না। সে জানে ব্যক্তি, সমাজ ও দেশের কল‌্যাণে নারীশিক্ষার বিকল্প নেই। সংসারের দায়িত্ব নেওয়ার জন্য যথাযথ জ্ঞান থাকা চাই। আল্লাহ পুরুষকে যেমন শিক্ষা অর্জনের নির্দেশ দিয়েছেন তেমনি নারীকেও শিক্ষা অর্জনের নির্দেশ দিয়েছেন। পবিত্র কোরআন নাজিল করে মহান আল্লাহ সর্ব প্রথম যে নির্দেশ দিয়েছেন সেই নির্দেশটাই হচ্ছে নর-নারীর জন্য শিক্ষা বিষয়ক।
'‘পড় তোমার প্রভুর নামে”[১]
ইলম (জ্ঞান) অর্জন করা সকল নর-নারীর উপর ফরজ ঘোষণা করে রাসূল সা. ইরশাদ করেন- ‘ইলম অর্জন করা প্রত্যেক মুসলমান নর-নারীর উপর ফরজ’[২]

প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা সম্পন্ন করতে না পারলেও জ্ঞান অর্জন থেমে থাকেনি পারুলের। শত ব্যস্ততার মধ্যেও সময় করে নানা ব‌ইপত্র পড়তো সে। তার থেকে দেখে দেখে মেয়ে দু'টোও ব‌ই পড়ার অভ্যাস আয়ত্তে এনেছে।

"তুই পড়া ছাড়িস না হুমায়রা। প্রয়োজনে তোর পড়ার খরচ আমি জোগাড় করবো।"
সেলাই করার পর অবশিষ্ট সূতাটুকু কাটতে কাটতে হুমায়রাকে বলে নৌশিন।

তাদের দাদি মারা যাওয়ার পর পারুল ভীষণ অসুস্থ হয়ে পরে। অসুস্থ হ‌ওয়ায় সেলাই কাজ বন্ধ হয়ে যায় পারুলের। মেয়ে দু'টোকে নিয়ে অভাব অনটনে খেয়ে না খেয়ে দিন পার করে পারুল। এমতাবস্থায় নৌশিন আর পড়ালেখা চালিয়ে যেতে পারে নি। ভীষণ কষ্ট হয় মেয়েটার।

মায়ের কষ্ট কমাতে নৌশিন‌ও সেলাই কাজ শুরু করে। সংসারের হাল ধরতে চেষ্টা করে। মা আর বড় বোনের স্বপ্ন হুমায়রা ডাক্তার হবে। গ্রামের মানুষদের বিনামূল্যে চিকিৎসা সেবা প্রদান করবে। অনেক পড়বে সে।

"আমার মেয়েকে বিয়ে দিবো না এখন। ভুল করেও দ্বিতীয়বার এই বিষয়ে কথা বলতে আসবেন না।"
পারুল কিছুটা রাগত স্বরে বলে কথাগুলো। শুনে খুশির মা কিছুটা ইতস্তত বোধ করে বলে-
"বাপ নাই। বিয়ার বয়স হ‌ইছে দুই মেয়ের-ই। অতো ভালা পাত্র পাইয়াও সুযোগ হাতছাড়া করতাছো। করো। তোমার যেমন ইচ্ছা।"
"এইটে পড়ে মেয়ে এখনও যথেষ্ট ছোট। জীবন সম্পর্কে তার তেমন কোন অভিজ্ঞতা হয় নি এখনো। তাছাড়া বড় মেয়েরে রেখে ছোটটারে বিয়ে দেওয়ার প্রসঙ্গ‌ই আসে না। গায়ের সাদা রঙ দেখে এতো পাগল হ‌ইছেন কেন আপনারা?"
"তা ঠিক ক‌ইছো। আইচ্ছা দেখি। বড় মাইয়্যার জন্য কোনো ভালো পোলা পাওন যায় কি না।"
খুশির মা চলে যায়।
পারুল এ সবকিছুর জন্য বিরক্তিবোধ করে। বাচ্চা মেয়ে বড় হবে, তার আগেই মানুষের নজর।

আফজাল বেঁচে থাকলে হয়তো আজকে জীবনটা অন্যরকম হতো। মেয়ে দু'টোকে নিয়ে শহরে থাকতো। শহুরে পরিবেশে বড় হতো মেয়েরা। নামীদামি স্কুল কলেজে পড়তো।...
অথচ একজন মানুষের মৃত্যুর কারণে কতোটা বেহাল দশা পরিবারটির!

আফজাল মারা যাওয়ার বছরখানেক বাদেই মানুষ বলেছিলো পারুলকে আরেকটা বিয়ে করতে। পারুল রাজী হয় নি। দুই মেয়ে আর শ্বাশুড়িকে নিয়ে তার স্বামীর ভিটাতেই থাকতে চেয়েছে সে। শ্বাশুড়ি গত হয়েছেন। এই বাড়িতে এখন মুরব্বি বলতে পারুল‌ই আছেন। রাত বিরেতে মানুষের পায়চারির শব্দ পাওয়া যায়। ভয়ানক পরিস্থিতি পার করছে পারুল। কিন্তু মেয়েদেরকে সাহস জোগানোর জন্য তার ভয় প্রকাশ করে না সে। পাড়ার কিছু ছেলের নজর পড়েছে তার সুন্দরী মেয়ের উপর। কোনো পুরুষ ছাড়া একজন অল্প বয়সী নারী হয়ে এমন পরিস্থিতি সামাল দেওয়া বিপজ্জনক। তবুও তো দিন পার করছে পারুল।

পারুলের বৃদ্ধা মামী বারবার বলেন পারুলকে তার মেয়ে নিয়ে তাদের বাড়িতে চলে যেতে। পারুল কিছুটা ভরসা পায়।

তথ্যসূত্র:
১) সূরা আলাক:১
২)(ইবনে মাজাহ, বায়হাকী)।

© All Rights Reserved