...

0 views

অনালোচিত লেখক নারায়ণ সান্যাল
আজ 26 এপ্রিল ।প্রখ্যাত সাহিত্যিক ও লেখক নারায়ণ সান্যাল 100 বছর আগে অর্থাৎ 1924 সালে ঠিক আজদিন জন্ম গ্রহণ করেন।
বাংলা সাহিত্য লেখক নারায়ণ সান্যাল একটু অনালোচিত লেখক। অথচ বৈচিত্র্যমূলক ও গবেষণামূলক লেখা খুব লেখকই লিখেছেন। কিন্তু সেই ভাবে তাঁকে নিয়ে মাতামাতি করতে দেখিনি!


নারায়ণ সান্যাল পাঠক খুলে বিপুল জনপ্রিয় হলেও তেমন আলোচিত হননি তিনি। লেখক হিসেবে নারায়ণ সান্যাল শুধু সাহিত্য রচনা করেছেন এমন নয় বিচিত্র-বিষয়ে গবেষণা-নির্ভর লেখা লিখেছেন ৷ ফরাসি ভাস্কর্য থেকে দেবদেউল, বাস্ত্তবিদ্যা থেকে বিজ্ঞানের রহস্যময় আলোছায়া সবই এসেছে তাঁর লেখায় ৷ উপন্যাস থেকে ভ্রমণসাহিত্য, কিশোরসাহিত্য থেকে গোয়েন্দা কাহিনী, এমনকী নেতাজি সুভাষ-রহস্যও তাঁর লেখার বিষয় মানুষের কাছে জনপ্রিয় হয়েছে ৷


নারায়ণ সান্যালের কৃষ্ণনগরে জন্ম হলেও তাঁর লেখা পড়া হয় কলকাতায়৷ শিবপুর ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজ থেকে ১৯৪৮ সালে তিনি বি ই পাশ করেন৷ ইনস্টিটিউট অফ ইঞ্জিনিয়ার্স (ইন্ডিয়া)-র ফেলো ছিলেন তিনি৷ পিডব্লিউডি-তে চাকরি করার সময় তাঁর পোস্টিং হয় দণ্ডকারণ্য অঞ্চলে ৷ তিনি দুটি উপন্যাস'বকুলতলা পি এল ক্যাম্প’ ও ‘দণ্ডকশবরী’ সেখানকার অরণ্য ও উদ্বাস্ত্ত জীবনের কথাই লিখেছেন ৷ বই দুটি খুব জনপ্রিয় হয়েছিল৷তিনিষ ১৪০টির মত বই লিখেছেন ৷ তাঁর লেখায় ছিল বিষয়বৈচিত্র্য । শিশুসাহিত্য থেকে সায়েন্স ফিকশন, স্থাপত্য বিষয়ক গ্রন্থ, শিল্প সমালোচনা, মনস্তত্ত্ব, প্রযুক্তি, উদ্বাস্ত্ত সমস্যা, ইতিহাস, পশুপাখি বিষয়ক বই পাবেন তার লেখা ৷
নারায়ণ সান্যাল পৃথিবীর নানান গুরুত্বপূর্ণ ঘটনার আলো-ছায়া নিয়ে লিখতে ভালোবাসতেন ৷ ' নক্ষত্রলোকের দেবতাত্মা'আদিম মানুষ থেকে সভ্য হয়ে ওঠার ঘটনা নিয়ে তাঁর কল্পবিজ্ঞানের কাহিনি তাঁর উদাহরণ ৷ বিভিন্ন বিদেশি গ্রন্থের ছায়া অবলম্বনে তিনি লিখেছেন কিছু উপন্যাস৷ শুক্রগ্রহ অভিযান নিয়ে আর্থার সি ক্লার্কের ‘২০০১— এ স্পেস ওডিসি’ থেকে অনুপ্রাণিত হয়ে তাঁর লেখা ‘হ্যালের যন্ত্র-না’৷

তবে আমার প্রিয় উপন্যাস তাঁর লেখা ‘বিশ্বাসঘাতক’৷ আমেরিকার প্রথম পরমাণু বোমা তৈরির ম প্রজেক্ট নিয়ে লেখা ওই উপন্যাসটি বাংলা সাহিত্যের ব্যতিক্রমী সৃষ্টি ৷


নারায়ণ সান্যালের আর একটি বিখ্যাত বই ‘তিমি তিমিঙ্গিল’৷ তিমিদের নিয়ে অসাধারণ গল্প আছেএই বইয়ে৷

তাঁর লেখা ‘কাঁটা’ সিরিজ গোয়েন্দা কথাসাহিত্যের জগতে বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য৷ পাশাপাশি তিনি শিশুদের জন্যে যুক্তাক্ষর বর্জিত ‘হাতি আর হাতি’-র মতো বইও লিখেছেন৷ শিশু-কিশোর সাহিত্য হিসেবে উল্লেখ যোগ্য ‘শার্লক হেবো’, ‘অরিগ্যামি’, ‘ডিজনিল্যান্ড’, ‘নাক উঁচু’ প্রভৃতি বইগুলি৷ ‘অজন্তা অপরূপা’ উপন্যাসের জন্য নারায়ণ সান্যাল ১৯৬৯ সালে পেয়েছিলেন পশ্চিমবঙ্গ সরকারের রবীন্দ্র পুরস্কার৷
তাঁর বেশ কিছু উপন্যাস চলচ্চিত্রায়িত হয়েছে৷ ‘সত্যকাম’ উপন্যাস থেকে তৈরি হয়েছে একটি হিন্দি চলচ্চিত্র৷ এছাড়া তাঁর লেখা ‘নাগচম্পা’, ‘অশ্লীলতার দায়ে’, ‘নীলিমায় নীল’, ‘প্রশান্ত পণ্ডিত’ ইত্যাদি নিয়ে বাংলা সিনেমা তৈরি হয়েছে ৷

তিনি পুরস্কৃত ‘সত্যকাম’-এর জন্য বেঙ্গল ফিল্ম জার্নালিস্ট অ্যাসোসিয়েশন থেকে পুরস্কৃত হন৷তাঁর ‘রূপমঞ্জরী’ উপন্যাসের জন্য ২০০২ সালে পান পশ্চিমবঙ্গ সরকারের বঙ্কিম স্মৃতি পুরস্কার৷

এসব সত্ত্বেও দেখা যায়, সেই অর্থে তিনি খুব একটা আলোচিত নন৷ তিনি যেমন নিন্দিতও নন, তেমনি বিশেষ প্রশংসাও তাঁকে নিয়ে দেখা যায় না৷ বাংলা সাহিত্যে নারায়ণ সান্যাল একজন বিরল ও অনন্য লেখক৷
তাঁর আত্মজীবনীমূলক গ্রন্থ ‘ষাট একষট্টি’-তে নারায়ণ সান্যাল একটি কৌতুকপ্রদ ঘটনার কথা উল্লেখ করেছেন৷ তাঁর নিজের উক্তিতেই সেটা দেখে নেওয়া যাক— ‘লস এঞ্জেলসের দুর্গাপূজা মণ্ডপে ঠাকুর দেখতে গেছি৷ পূজামণ্ডপে নাচ-গান-ভ্যারাইটি প্রোগ্রাম৷ বাচ্চারা ‘আলিবাবা’ অভিনয় করবে৷ উদ্যোক্তারা বললেন, এসেই যখন পড়েছেন তখন মঞ্চে উঠে দু-চার কথা বলুন৷ …কর্মকর্তাদের কেউ হবেন— আমাকে দর্শকদলের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দেবার দায়িত্ব নিলেন৷ মঞ্চে অবতীর্ণ হওয়ার আগে ভদ্রলোক জনান্তিকে আত্মীয় সম্বোধন করে বললেন, মেসোমশাই, আমি ইলেকট্রনিক্স এঞ্জিনিয়ার, বাংলা বই-টই, মানে বিশেষ পড়ি-টড়িনি— ইয়ে হয়েছে, আপনি যদি আপনার লেখা খানকতক বইয়ের নাম বলে দেন৷ আমি বলি, কী দরকার? তুমি শুধু বলো, ইনি বই-টই লেখেন৷ —না মানে, অন্তত আপনার একাডেমি পুরস্কার পাওয়া বইটার নাম যদি…৷ —আবার বাধা দিয়ে বলি, তুমি ভুল করছ ভাই৷ একাডেমি পুরস্কার আমি আদৌ পাইনি৷ তুমি আমার ওপর যা-ইচ্ছে গুণের আরোপ করতে পারো; শুধু বোলো না— ‘আমি ভালো গান গাই বা ভালো রাঁধতে জানি৷ কারণ এ পূজামণ্ডপে তা যাচাই হয়ে যাবার আশঙ্কা আছে৷’

এই উদ্ধৃতি থেকে স্পষ্ট বোঝা যায়, বড়ো পুরস্কার না পেলে বাঙালিরা বড়ো কোনও লেখক সম্পর্কে অজ্ঞ থেকে যায়৷ এবং তাঁকে বিশেষ গুরুত্বও দিতে চায় না৷ রবীন্দ্রনাথ এর সবচেয়ে বড়ো উদাহরণ৷ নোবেল পুরস্কার পাওয়ার আগে রবীন্দ্রনাথকে একশ্রেণির বাঙালি কম ব্যঙ্গবিদ্রুপ করেনি!


© Manab Mondal