...

6 views

প্রেম যখন সূর্যপূজা (পর্ব-৭)
ভোরবেলা থেকেই চারিদিকে শঙ্খধ্বনি,চন্ডীপাঠ ও পুষ্পাঞ্জলি মন্ত্রে পবিত্র হয়ে উঠেছে বাংলার আকাশ-বাতাস।আজ শুভ মহাষ্টমী।মহালয়ার পর থেকে সূর্য প্রতিদিনই পূজাকে ম‍্যাসেজ করছে।দুজনের মধ‍্যে কথোপকথন সেভাবে না হলেও প্রতিদিন প্রভাতী শুভেচ্ছা বিনিময় হয়েছে ম‍্যাসেজের মাধ‍্যমে।

সূর্য:"সুপ্রভাত।শুভ মহাষ্টমী।সকাল সকাল মিলনীর দূর্গা মন্দিরে পুষ্পাঞ্জলি দিয়ে এলাম।আমি প্রতিবছরই দূর্গাষ্টমীতে মায়ের কাছে অঞ্জলী দিই।তুমি কি দূর্গাষ্টমীর ব্রত কর?

প্রায় দুঘন্টা পর পূজা অনলাইনে এল।
পূজা:"সুপ্রভাত।শুভ দূর্গাষ্টমী।হ‍্যাঁ।আমরা তো রামকৃষ্ণ মিশনে দীক্ষিত।দূর্গাষ্টমীতে মিশনেই পুষ্পাঞ্জলি দিই।"
সূর্য:"ওহ্।একটা কথা জিজ্ঞেস করব?মানে তোমাকে কথা দিয়েছি বিয়ের প্রস্তাব নিয়ে আমাদের মধ্যে কোনো কথা হবেনা।কিন্তু দুএকটা প্রশ্ন বারবার আমার মনে আসছে।তাই বলছি একজন ভালো বন্ধু হিসেবে জানতে ইচ্ছা করছে যে তুমি তোমার জীবনসঙ্গীর মধ‍্যে কিরকম মানুষকে মেনে নিতে ইচ্ছুক তুমি?তোমার বাবা মা কেমন ছেলের হাতে তাদের মেয়েকে তুলে দিয়ে নিশ্চিন্ত হতে চাইছেন?তোমার উপযুক্ত পাত্রের যোগ‍্যতা বিচার কিভাবে করতে চাও তুমি?"
পূজা:"এইজন্যই বলেছিলাম হয় এই প্রস্তাব আসা আটকাও না হলে আমার সাথে যোগাযোগ স্থগিত রাখো।একজন ভালো বন্ধু হিসেবে তোমার ভালোর জন‍্যই বলেছিলাম।"
সূর্য":"আমাকে প্লিজ্ ভুল বুঝোনা।ভালো বন্ধু হিসেবে বন্ধুর কাছে তার জীবনসঙ্গীর মধ‍্যে সে কোন ধরনের মানুষকে আশা করে আছে,এটা জানতে চাওয়া কি খুব অপরাধ?"
পূজা:"অপরাধ হয়তো নয়।জ‍্যেঠামশাই বিয়ের প্রস্তাব নিয়ে ভাবনা চিন্তার দিকে এগোলে তো তুমি নিশ্চিত ভাবেই এই বিষয়ে তোমার উত্তর পেয়ে যাবে।এখন জেনে কি লাভ?"
সূর্য:"লাভ বা ক্ষতির কথা আসছে কোথা থেকে।যদি সত‍্যিই ভালো বন্ধু বলে বিশ্বাস কর আমাকে বলতে পারবে।নাহলে থাক।জোর করবনা।"
পূজা:"আমার জীবনসঙ্গীর প্রথম ও প্রধান গুণ হবে সে সব বিষয়ে সৎ হবে।একেঅপরকে বুঝতে যেন কোথাও ফাঁক না থাকে।তাকে অবশ‍্যই কয়েকটি প্রকৃত শিক্ষায় শিক্ষিত হতে হবে।আমার রূপ বা বাহ‍্যিক গুণ দেখে নয়,আমাকে জেনে বুঝে আমার জীবনে সে যেন আসতে পারে।একে অপরকে বুঝতে যেন কোথাও ফাঁক না থাকে।সে যে পরিবারে বড় হয়েছে সেখানের সব মানুষগুলো আর কিছু হোক না হোক মনের দিক থেকে যেন ভালো মানুষ হয় এটা নিশ্চয় আশা করি।আমি মা বাবার একমাত্র সন্তান।সে যেন দুটি পরিবারের প্রতি সমানভাবে কর্তব‍্য করার মানসিকতা রাখে।ব‍্যস্ বাকি ভাগ্য আর ভগবান সহায় হলে দম্পতি হিসেবে জীবনে উন্নতি হবেই।কিন্তু সর্বাগ্রে অভিভাবকদের গন্ডি পেরোলে আমার বিচার বিবেচনার বিষয়।আর বাবামায়ের দিক থেকে যেটুকু জানি যে তাদের মেয়েকে সত‍্যিই ভালো রাখতে পারবে এমন সুপাত্রই আশা করেন তাঁরা।"
সূর্য:"এইটুকুই expectation! সত‍্যিই ভাগ‍্যবান হবে সেই পুরুষ যে তোমাকে জীবনে পাবে।জানিনা কার সংস্কার পেয়েছো তুমি যে একবারের জন‍্যও আমার স‍্যালারি জানতে চাওনি।তবু আমি বলি আমি WBSEDCL -এ চাকুরি করি।আমার স‍্যালারি ৩৫০০০/-।আমাদের দেশের বাড়িতে বাড়ির সবাই খুব সাধারণ।বর্তমানে এগরার ওপর একটা বাড়ি আছে।এগরাতে একটা জমি কেনা আছে।পরে বাড়ি করার ইচ্ছা আছে।"
পূজা:"এসব আমি এখন জেনে কি করব বল?আমি কি এসব জানতে চেয়েছি?"
সূর্য:"তুমি জানতে না চাইলেও ভালো বন্ধু হিসেবে এটুকু তো আমি আমার ব‍্যপারে এখন জানাতেই পারি।"
পূজা:"আমার ক্ষেত্রে এসব বড়দের আগে ভাবা ভালো।এখন উঠতে হবে।আগামী পরশু এগরা যাব।মনে আছে তো আমি এগরা থেকে না ফেরা অবধি জ‍্যেঠামশাইয়ের কাছে মোক্ষদাশঙ্কর জ‍্যেঠু যেন ওই প্রস্তাবটি না রাখেন।লক্ষ্মীপূজার দুদিন পর ফেরার কথা।শুভ শারদীয়া।"
সূর্য:"নিশ্চিন্ত থেকো।এগরা থেকে ফিরলে কথা হবে।ভালো থেকো।শুভ শারদীয়া।"

প্রতিবছর দূর্গাষ্টমীর এই সন্ধ্যায় সূর্য তাদের বাড়ির পাশের দূর্গামন্দিরের সামনে বন্ধু বান্ধবদের সাথে আড্ডা দিত।এবছর সেভাবে ইচ্ছা করছেনা।সব সময় পূজার চিন্তা সূর্যের মন জুড়ে বিচরণ করে চলেছে।দূর্গাষ্টমীতে মাকে অঞ্জলী দিয়ে মনে মনে পূজাকেই আজসকালে জীবনসঙ্গীনীরূপে কামনা করেছে সূর্য।ওদিকে অষ্টমীর সন্ধ্যায় পূজা মাবাবার সাথে ঠাকুর দেখতে বেরোলো।কিন্তু মাঝে মাঝে মাঝেই সূর্যের কথাগুলো মনে পড়ে যাচ্ছিল পূজার।শারদীয়া মহাষ্টমী আর মহানবমীর সন্ধিক্ষণে মধ‍্যরাত্রে এবছর সাড়ম্বরে সন্ধিপূজা সমাপন হল।মহানবমীর সকালে অনলাইনে শুধু একটি মহানবমীর শুভেচ্ছাবার্তা বিনিময় হল সূর্য-পূজার।এল বিজয়া দশমী।
পূজারা ভোরে এগরা রওনা হয়েছে।চেনা এগরাকে এবার কেমন যেন অচেনা লাগছে পূজার।মনের মধ‍্যে একটা চাপা অস্থিরতা কাজ করছে।পূজা খুব চাপা স্বভাবের মেয়ে বলে তাকে দেখে কেউ কিছু বুঝতেই পারলনা।পূজা বুঝতে দিলও না।এগরাতে একাদশীর দিন প্রতিমা নিরঞ্জন হয়।তাই দশমীতে পূজা তার খুড়তুতো দাদা পার্বনের সঙ্গে ঠাকুর দেখতে বেরোলো।পার্বণ আর পূজা পিঠোপিঠি খুড়তুতো-জ‍্যেঠতুতো ভাই-বোন।ওদের মধ‍্যে তাই বেশ বন্ধুত্ব আছে।সূর্যের বাড়ি পূজার দেশের বাড়ির ছাদ থেকে একটু দূরে দেখা যায়।তাদের বাড়ির পাশেই মিলনী দূর্গামন্দির।সূর্যের বাড়ি ঠিক কোনটা এটা পূজা না জানলেও কথায় কথায় সূর্য জানিয়েছিল যে মিলনীর পাশেই তাদের বাড়ি।পূজা পার্বণকে তার তাড়াতাড়ি বাড়ি ফেরার অজুহাত দেখিয়ে ওদিকের পথ মাড়ালো না।

কোজাগরী লক্ষ্মী পূজার প্রস্তুতি শুরু হয়ে গেল একাদশী থেকে।গজলক্ষ্মী প্রতিমায় কুলোপুরোহিত দিয়ে ষোড়োপচারে কোজাগরী লক্ষ্মীপূজা হয় পূজার দেশের বাড়িতে।তার ঠাকুরদা এই পূজার প্রচলন করেছিলেন।পূজার জ‍্যেঠিমা,ইভাদেবী প্রতিবছর কোজাগরী লক্ষ্মীপূজার সংকল্প হয়ে এসেছেন।এবছর পূজার মনে হঠাৎ করেই লক্ষ্মীপূজায় সংকল্প হওয়ার ইচ্ছা হল।পূজার এই ইচ্ছা বাড়ির সবাই সানন্দে মেনেও নিলেন।বাড়ির সবার সাথে আনন্দেই কাটলো লক্ষ্মীপূজা।কিন্তু কোথাও যেন পূজার এবছরের পূজা আর পাঁচটা বছরের মতো নিশ্চিন্তে কাটলনা।।
মা শ্রীলক্ষ্মীর কাছে কোজাগরী পূর্ণিমার রাতে পূজা নিষ্ঠাসহকারে অঞ্জলী দিয়ে জানালো "মাগো,আমার মনের এই অস্থিরতা শান্ত কর।আর কেউ না জানুক তুমি তো জানো কোন পরিস্থিতির সম্মুখীন হয়েছি আমি।জ‍্যেঠিমা বলেন মেয়েরা বাড়ির লক্ষ্মী।তার মানে আমি এবাড়ির লক্ষ্মী।যার ভাগ্যলক্ষ্মীরূপে এই বাড়ির লক্ষ্মীর ভাগ‍্যনির্ধারিত করেছো এবার তাকে সহায়তা কর আমাকে পেতে আর নিশ্চিত করে তাকে চিনে নিয়ে তার গৃহলক্ষ্মী হতে সাহায্য কর আমাকে।সহায় হয়ো মা।"
এভাবেই শুদ্ধ সরল মনে প্রার্থনা জানিয়ে পূজা মালক্ষ্মীর শ্রীচরণে ভক্তিপূর্ণ প্রণাম জানাল।
পরের দিন সকালে ঘট বিসর্জন,সন্ধ্যায় প্রতিমা নিরঞ্জন আর ফিরে আসার প্রস্তুতিতেই সারাদিন কেটে গেল।কোজাগরী লক্ষ্মীপূজার পরিশেষে এবছরের শারদীয়া দেবীপক্ষের সমাপন হল।




© বুনানী