...

0 views

পৈশাচিক
পৈশাচিক
ভাদ্র মাস চলছে। রাতের বেলা খুব জোর ঝড় বৃষ্টি শুরু হয়েছে। ভাদ্রমাসে এত ঝড় বৃষ্টি বীরপুর গ্রামের আগে কেউ কখনো দেখেনি।
গ্রামের জেলে পাড়ায় সোনাদের ছোট একটা মাটির ঘর তাতে সোনা ও তার বিধবা মা থাকে। সোনার বাবা তিন বছর আগে মারা গেছে।
সোনা রোজ ভোরে উঠে কোনো পুকুর বা দীঘীতে জাল ফেলে মাছ ধরে তারপর গ্রামের হাঁটে মাছ বিক্রি করে। সকাল দশটার সময় সে স্কুলে যায়। সে রোজ রাতে মন দিয়ে পড়াশোনা করে। পড়াশোনায় সে মোটামুটি ভাল। সোনার এখন বার বছর বয়স সে ক্লাস সিক্সে পড়ে।
সেদিন ঝড় বৃষ্টির রাতে সোনা একটা বাজারের থলে নিয়ে তার মাকে বলল " মা আমি জমিদার বাবুদের বাগানে যাচ্ছি। আজ খুব ঝড় বৃষ্টি হচ্ছে বাবুদের বাগানের তালগাছগুলো থেকে তাল ঝরে পরবে তাই আমি তাল কুড়োতে বাবুদের বাগানে যাচ্ছি।"
সোনার মা সোনাকে বকতে বকতে বলল " তোকে নিয়ে আর পারি না। এই ঝড় বৃষ্টিতে তোর কি না বের হলে হয় না।"
সোনা কোন কথা শুনলো না সে তাল কুড়োতে চলে গেল।
বীরপুর গ্রামের জমিদার রুদ্রপ্রতাপ চৌধুরি খুব দয়ালু মানুষ তিনি গ্রামের বাচ্চাদের খুব ভালভাসেন। তিনি গ্রামের বাচ্চাদের বলে দিয়েছেন " আমার বাগানের সব ফল তোদের তোরা যতখুশি ফল পেরে খা।"
সোনা বাবুদের বাগানে এসে পৌঁছাল। তখনো ঝড়বৃষ্টি সমানে হয়ে চলেছে। অন্ধকারে স্পষ্ট কিছু দেখা যাচ্ছিল না। সোনা অস্পষ্ট দেখতে পেল তাল গাছটার নিচে কয়েকটা তাল পরে আছে। সোনা কয়েকটা তাল তার থলেতে পুরে ফেলল। তার মনে হল একটা তাল বেশ বড় ও ভারি।
সোনা বাড়ি ফিরে এসে তার মাকে বলল " মা অনেকগুলো তাল পেয়েছি আর একটা তাল তো বিশাল বড়।"
এই কথাগুলো বলে সোনা থলেটা উলটে তালগুলো মেঝেতে রাখল।
তালগুলো মেঝেতে রাখতেই সোনা আর সোনার মা একটা বিকট চিৎকার করে উঠল তারা দুজন ভয়ে থর থর করে কাঁপতে লাগল। তারা দেখতে পেল তালগুলোর সাথে একটা মানুষের কাটা মাথা পরে আছে। সোনা যেটাকে বড় তাল মনে করেছিল আসলে সেটা তাল নয় সেটা হল একটা মানুষের কাটামাথা।
মাথাটা দুচোখ মেলে তাদের দিকে তাকালো আর বিকট শব্দ করে জান্তব স্বরে হাসতে লাগল।
সোনার মা ভয় পেয়ে চিৎকার করতে লাগল তার চিৎকার শুনে আশেপাশের বাড়ির পাড়া প্রতিবেশীরা সোনার বাড়িতে ছুটে এল। এই সব ভুতুড়ে কান্ড দেখে তারা ভয়ে কাঁপতে লাগল।
তাদের মধ্যে হারুজেলে একটু সাহসী ছিল সে সোনাকে বলল " তাড়াতাড়ি মাছ ধরার জালটা নিয়ে আয় আর এই কাটামুন্ডুটার উপর জালটা ফেলে দে। লোহার তৈরি জাল এই অপদেবতার উপর রাখলে সেটা কারো ক্ষতি করতে পারবে না।"
সোনা হারুর কথামত মনে সাহস সঞ্চয় করে মাছ ধরার জালটা নিয়ে এসে কাটামুন্ডুটার উপর রাখল।
কাটামুন্ডুটা ছটফট করতে লাগল আর লাফালাফি করতে লাগল ঠিক মাছ জালে ধরা পরলে যে ভাবে ছটফট করে ঠিক সেই ভাবে।
কাটামুন্ডুটা বিভৎস অপার্থিব কন্ঠে বলতে লাগল " জালটা সরিয়ে দে নাহলে কাউকে ছাড়বো না সবাইকে মেরে ফেলবো।"
হারু সোনাকে বলল " একদম ভয় পাবি না আর ওটার কথা শুনবি না। জালটা একদম ওর থেকে সরাবি না। আমরা তান্ত্রিক বাবাকে ডেকে আনছি। তান্ত্রিক বাবা ওটার সঠিক ব্যবস্থা করবেন।"
(ক্রমশ)
হারু আর গ্রামের অন্য চারজন সাহসী ছেলে বৃষ্টিতে ভিজতে ভিজতে গ্রামের প্রাচীন কালী মন্দিরের দিকে যেতে লাগল। কালী মন্দিরের পাশেই একটা কুটিরে তান্ত্রিক বাবা থাকেন।
তারা তান্ত্রিক বাবার কুটিরের সামনে এসে তান্ত্রিক বাবাকে ডাকতে লাগল।
তান্ত্রিক বাবা কুটির থেকে বের হয়ে এসে তাদের বলল" কিরে তোরা এত রাতে এই ঝড় বৃষ্টির মধ্যে আমার কুটিরে এসে আমায় ডাকছিস কেন? তোদের কি কোন বিপদ হয়েছে?"
হারু বলল " হ্যাঁ বাবা খুব বিপদ।"
হারু তান্ত্রিক বাবাকে সব ঘটনা খুলে বলল।
তান্ত্রিক বাবা নিজের কাঁধে একটা ঝোলা নিয়ে বলল " চল চল তাড়াতাড়ি চল আমাদের এক্ষুনি সোনাদের বাড়ি যেতে হবে।"
তান্ত্রিক বাবাকে গ্রামের সবাই খুব শ্রদ্ধা ভক্তি করে। তিনি সবসময় একটা লালধুতি আর লাল ফতুয়া পরেন। তার মাথায় কাঁচাপাকা লম্বা চুল , মুখে দারি ও কপালে লাল টিকা, তিনি দেখতে খুব সৌম্য দর্শন।
তান্ত্রিক বাবা সোনাদের বাড়িতে পৌঁছাতেই কাটামুন্ডুটা তান্ত্রিক বাবাকে দেখে আরও জোরে চিৎকার করতে লাগল আর জালের ভিতর ছটফট করতে লাগল।
হারু ধিরে ধিরে কাটামুন্ডুটার উপর থেকে জালটা সরিয়ে ফেলল। জালটা সরাতেই কাটামুন্ডুটা এক লাফে হারুর ঘাড়ের উপর উঠে বসল তারপর হারুর ঘাড় কামড়ে ধরলো। হারুর ঘাড় থেকে দরদর করে রক্ত ঝরতে লাগল। হারু বাঁচাও বাঁচাও বলে আর্তনাদ করতে লাগল।
তান্ত্রিক বাবা আর দেরি না করে তার ঝোলা থেকে একটা মন্ত্রপূত রুদ্রাক্ষের মালা বার করলেন আর কাটামুন্ডুটার উপর ছুয়ে দিলেন। কাটামুন্ডুটা দপ করে মাটিতে পরে গেল।
(ক্রমশ)

তান্ত্রিক বাবা খুব তাড়াতাড়ি তার ঝোলা থেকে একটা কৌটো বার করলেন তারপর সেই কৌটো থেকে কিছু গুড়ো মত জিনীষ বার করে কাটামুন্ডুটার চার পাশে গোল করে সেই গুড়োটা ছড়িয়ে দিলেন এই ভাবে তিনি কাটামুন্ডুটার চার পাশে গন্ডি কেটে দিলেন।
তিনি বির বির করে মন্ত্র পরতে লাগলেন। কাটামুন্ডুটা শত চেষ্টা করেও গন্ডি থেকে বের হতে পারল না।
কাটামুন্ডটা সেটার দুটো লাল গোল গোল চোখ দিয়ে ক্রুদ্ধ দৃষ্টিতে তান্ত্রিক বাবাকে দেখতে লাগল আর কুৎসিত ভাষায় গালাগাল করতে লাগল।
তান্ত্রিক বাবা কাটামুন্ডটাকে উদ্দেশ্য করে বলল " বল তুই কে?"
কাটামুন্ডুটা তার অপার্থিব স্বরে বলল " বলবো না কিছুতেই বলবো না।"
তান্ত্রিক বাবা বললেন " বলবি না তবে দেখ এবার মজা।"
এইকথা বলে তান্ত্রিক বাবা একটি মাটির মালসাতে অজানা একটি গাছের শিকড় পোড়ালেন। সেটার ধোঁয়া কাটামুন্ডুটার নাকের কাছে নিয়ে গেলেন।
কাটামুন্ডুটা ছটফট করতে লাগল আর জোরে জোরে বিভৎস ভাবে আর্তনাদ করে বলতে লাগল " জ্বলে গেলুম পুড়ে গেলুম।"
তান্ত্রিক বাবা বললেন " এবার ভালয় ভালয় বল তুই কে না হলে মালসাটা তোর নাকের কাছে আবার নিয়ে আসব।"
কাটামুন্ডটা বলল " ঠিক আছে সব বলছি।"
( আগামী পর্বে শেষ)

কাটামুন্ডুটা এবার বলতে লাগল " আমি একটা পিশাচ  কালু কাপালিক আমায় জাগিয়েছে। কালু কাপালিক পাশের গ্রামের শ্মশানে বসে পিশাচ সাধনা করে আমায় জাগিয়েছে। সে নদীর জলে ভেসে উঠা একটা চান্ডালের মৃত দেহ তুলে এনে সেটার মাথা কেটে সেই মাথার ভিতর আমার প্রাণ প্রতিষ্ঠা করে আর বাকি শরীরটা আমাকে ভোগ হিসেবে দেয়। সে কাটামুন্ডুটাতে আমার প্রাণ প্রতিষ্ঠা করবার পর কাটামুন্ডুটা জমিদার বাড়ির বাগানে চুপি চুপি রেখে আসে। সে জমিদারকে মেরে ফেলে প্রতিশোধ নিতে চায় কারন একদিন জমিদার তাকে খুব অপমান করেছিল।
আজ রাতেই আমার জমিদারকে হত্যা করার কথাছিল তার রক্ত পান করে। কিন্তু এই বাচ্চা ছেলেটা তাল মনে করে ভুল করে আমাকে এইখানে নিয়ে আসে।
আমি তোদের কাউকে ছাড়বো না সবার রক্ত চুষে খাব তারপর জমিদারের রক্ত চুষে খাব।"
তান্ত্রিক বাবা বললেন " আমি থাকতে তুই কারো ক্ষতি করতে পারবি না। তুই এক্ষুনি এই কাটামুন্ডু থেকে বের হয়ে এই গ্রাম ছেড়ে চলে যা।"
কাটামুন্ডুটা বিভৎস ভাবে হুংকার দিয়ে বলল " কিছুতেই যাব না।"
তান্ত্রিক বাবা বললেন " তবে রে।"
এইকথা বলে তান্ত্রিক বাবা তার ঝোলা থেকে একটা কৌটো বার করলেন সেটা থেকে ধুলোমত একটা গুড়ো বার করে কাটামুন্ডুটার উপর বার বার ফেলতে লাগলেন।
কাটামুন্ডুটা চিৎকার করতে লাগল আর ছটফট করতে করতে বলল " থামা থামা আমি জ্বলে গেলুম। আমি চলে যাচ্ছি আমি চলে যাচ্ছি।"
তান্ত্রিক বাবা থামলেন।
সবাই দেখতে পেল একটা কালো ধোঁয়া কাটামুন্ডুটার নাক দিয়ে বের হয়ে গেল।
বাড়ির বাইরে থাকা একটা আম গাছের ডাল ভেঙ্গে পরে গেল।
কাটামুন্ডুটা নির্জীব হয়ে পরে রইল।
তান্ত্রিক বাবা হারুকে বলল " এই কাটামুন্ডুটা সোনাদের বাড়ি থেকে অনেক দুরে নিয়ে মাটির তলে পুতে ফেল আর সাবধানে করবে পুলিশ জানতে পারলে শুধু শুধু তোমাদের নানান ঝামেলায় ফেলবে এখন অঝরে বৃষ্টি পরছে এখন পারবে না। বৃষ্টি থামলে তারপর যাবে আর সাথে দশজন লোক নিয়ে যাবে।
যে ব্যক্তি এই পিশাচকে জাগিয়েছিল এখন পিশাচ সেই ব্যক্তিকেই হত্যা করবে নিষ্ঠুর ভাবে।"
এই কথাগুলো বলে তান্ত্রিক বাবা চলে গেলেন।
সোনার মা সোনাকে বলল " আর যদি কোনোদিন তাল কুড়োতে যাস তাহলে তোর হাত পা আমি ভেঙ্গে দেবো।"
বৃষ্টি থামার পর হারু ও অন্য গ্রামবাসীরা কাটামুন্ডুটাকে অনেক দুরে নিয়ে মাটির তলে পুতে দিল আর কোনো পুলিশি ঝামেলাও হল না।

পরদিন সকালে পাশের গ্রামের শ্মশানে কালু কাপালিকের মৃত দেহ পাওয়া গেল। তার সারা দেহ আমসির মত চুপসে গেছে আর ফ্যাকাশে হয়ে গেছে। কেউ যেন তার দেহের সব রক্ত চুষে খেয়ে ফেলেছে।
(শেষ)



© All Rights Reserved