...

5 views

প্রেম যখন সূর্যপূজা (পর্ব-৪)
একটি সুয়োপোকা প্রকৃতির নিয়মে তার প্রথম জীবনে নিজের মতো নির্ঝঞ্ঝাট দিনযাপন করে হঠাৎ একদিন নিজের অজান্তেই এক অজানা তাগিদে ব‍্যস্ত হয়ে উঠে নিজেরই লালারসের সাহায্যে গুটি বানাতে শুরু করে আর তারপর এই কঠিন আস্তরণের মধ‍্যে নিশ্চিন্তে শান্তমনে বেশ কিছুদিন কাটিয়ে এই কঠিন আস্তরণটিকে নিজেই ভেদ করে সুন্দর একটি রঙিন প্রজাপতিতে পরিণত হয়ে ডানামেলে বেরিয়ে আসে।সুয়োপোকা যে এত সুন্দর রঙীন প্রজাপতি হয়ে একসময় প্রকৃতির শোভা বাড়াতে পারে তা সুয়োপোকা নিজেও প্রথমে ভেবে উঠতে পারেনা।ঠিক সেভাবেই জীবনের প্রথম পর্যায়টি পেরিয়ে নিজের মনের কঠিন আবরণের ভিতর পূজার মনটির এখন সুয়োপোকা থেকে প্রজাপতি হয়ে ওঠার পর্যায় এসে উপস্থিত।পূজা নিজেও এখনও জানেনা মনের এই কঠিন আস্তরণ ভেঙে গেলে নিভৃতে নিস্তব্ধে সযত্নে রক্ষিত তার নির্মল কোমল মনটি কী সুন্দর রঙিন প্রজাপতি হয়ে অনিদ‍্যসুন্দর ডানা মেলে উড়তে চলেছে।

সেই নির্দিষ্ট সোসাল সাইটটির মাধ‍্যমে সূর্য মাঝে মাঝেই যোগাযোগ রেখে চলেছে পূজার সাথে।সামান্য অচেনা এক বন্ধু থেকে পূজার সাথে প্রকৃত বন্ধুত্বে উন্নিত হয়েছে সে।পূজা কেমন দেখতে তা এখনও চোখে দেখেনি সূর্য।বিশেষ কোনো কারণ নেই,তবু প্রথম থেকেই একটা গভীর বিশ্বাস তৈরী হয়েছে পূজার প্রতি সূর্যের।আর পূজা মাঝেমধ্যে সূর্যের ম‍্যাসেজের উত্তর দেয়।সূর্য জ্ঞানত কখনও পূজাকে তার নীতিবিরুদ্ধ কোনো কথা মেনে নিতে বাধ‍্য করতে চায়না।বরং পূজার কিছু নীতিকে মন থেকেই সম্মান করে সে।মাঝেমধ্যেই যুক্তিবাদী দুটি প্রিয়বন্ধুসত্তার তর্কবিতর্কও হয় কিন্তু কোনো যুক্তিবাদই দুজনের অন্তরাত্মার প্রকৃত বন্ধুত্ব থেকে বিরত রাখতে পারছেনা দুজনকে।বারংবার নিজেদের অজান্তে সুগভীর এক অজানা চুম্বকীয় টানেই আরও কাছে চলে আসছে এই দুটি নিষ্কলুষ মন।
এইভাবেই পূর্বনির্ধারিত প্রথম পবিত্র প্রেমের দিব‍্যসুখের স্পর্শে সূর্য আর পূজার অন্তরমন ক্রমেই পরিপূর্ণ হয়ে উঠতে লাগল।

বর্ষার ঘনঘটা মাস খানেক আগেই কেটে গেছে।শরতের সুনীল আকাশে এখন হালকা সাদা মেঘের ভেসে চলা।মাঝে মাঝে দুএক পশলা বৃষ্টির আনাগোনা এখনও আছে।কাশফুলের বনে মন্দমধুর বাতাসের দোলা লেগেছে।শিশিরশিক্ত শিউলি তলায় এখন সপরিবারে মহিষমর্দিনী মা দূর্গার আসার প্রতীক্ষা।আজকের দিনটা রোজকার একঘেয়েমির থেকে একটু আলাদা।ছুটির আমেজ।
আজ ভাদ্রমাসের সংক্রান্তি;দেবশিল্পী বিশ্বকর্মার আরাধনার দিন।এইবছর আবার আগামীকালই মহালয়া।সচরাচর এমনটা দেখা যায়না।

"কেমন আছো?একটা কথা জিজ্ঞেস করব?সরোসিজ মাইতি কি তোমার জ‍্যেঠামশাই হোন?আর তোমার বাবা কি কলকাতার রামকৃষ্ণ মিশনের টিচার?"গোধূলি বেলায় কৌতুহলী সূর্যের ম‍্যাসেজ পূজাকে।

মিতভাষী চাপা স্বভাবের পূজা খুব সহজেই সূর্যের সঙ্গে বেশ স্বতস্ফূর্ত কথোপকথনে অভ‍্যস্ত হয়ে গেছে সময়ের সাথে।পূজা আগের মতো অবিশ্বাস করেনা সূর্যকে।তবে আকস্মিক এরকম অপ্রত্যাশিত একটা প্রশ্নে খুব অবাক হল পূজা।

পূজা:"হ‍্যাঁ।কিন্তু তুমি এসব জানলে কি করে?"
সূর্য:"আমার বোনের শ্বশুরমশাই তোমার জ‍্যেঠামশাই এর বন্ধু হন।বোনের শ্বশুর মশাইকে আমরা মেসোমশাই বলি।মেসোমশাইয়ের দোকানে আমি ফাঁকা পেলে মাঝে মাঝেই যাই।তোমার জ‍্যেঠামশাইও মেসোমশাইয়ের দোকানে আসেন মাঝেমধ্যে।সেইসূত্রে অনেকদিন ধরেই আমি তাঁকে চিনি আর তিনিও আমাকে চেনেন।আজ সকালে কোনো কারণে তিনি মেসোমশাইয়ের দোকানে হোইট সিমেন্ট আনতে এসেছিলেন।মেসোমশাইয়ের দোকানে বিশ্বকর্মা পূজা হয়।আমাদের দোকানে সেভাবে বিশ্বকর্মা পূজা হয়না।আমাদের ওই ক‍্যালেন্ডার,কার্ড এসবের দোকান আছে।তাই আমি মেসোমশাইয়ের ওখানে পুষ্পাঞ্জলি দিই।আজ কথা প্রসঙ্গে জানলাম ওনার ভাই কলকাতায় রামকৃষ্ণ মিশনের শিক্ষক।তাই মনে হল উনি তোমার জ‍্যেঠামশাই হতে পারেন।তবে আমি যে তোমাকে চিনি এই নিয়ে কোনো কথা আমি ওখানে কাউকেই কিছু বলিনি।"
পূজা:"হুম্।বুঝলাম!বাবা নরেন্দ্রপুর রামকৃষ্ণ মিশনে লেক্চারার।তোমার বোনের শ্বশুরমশাইয়ের নাম কি?"
সূর্য:"মোক্ষোদাশঙ্কর সাহু।উনি সিভিল ইন্জিনিয়ার।"
পূজা:"বুঝেছি।তুমি মোক্ষোদাশঙ্কর জ‍্যেঠুর কথা বলছো।এগরার বাড়ি হওয়ার সময় উনিই তো বাড়ির প্ল্যান করেছিলেন।জ‍্যেঠামশাইয়ের বন্ধু।বাবাও চেনেন ওনাকে।"
সূর্য:"গতবছর চাকরির জয়েনিং লেটার পাওয়ার দিন মেসোমশাইয়ের দোকানে দেখা হয়েছিল তোমার জ‍্যেঠামশাইয়ের সাথে।উনি তো সরকারী ভেটিনারি ডাক্তার।রিটায়ার্ড করে গেছেন।মাঝে অসুস্থ হয়েছিলেন।এখন শরীরটা বেশ খারাপ হয়ে গেছে।"
পূজা:"হ‍্যাঁ।স্কিন ডিজিজে ভুগছিলেন মাঝে।এখন ভালো আছেন।"
সূর্য:"তোমার জ‍্যেঠামশাই খুব সাদামাটা ভদ্রলোক।ওখানে তোমার জ‍্যেঠামশাইয়ের সাথে আমার মায়েরও কথা হল।তোমার জ‍্যেঠামশাই আবার মাকে বললেন ছেলের তো বিয়ের বয়স হল।বিয়ের ব‍্যবস্থা করুন এবার।"
পূজা:"জ‍্যেঠামশাই এরকমই।আজ আমাকে উঠতে হবে।সন্ধ্যা দেওয়ার সময় হল।"
সূর্য:"আজ অনেকক্ষণ কথা হয়ে ভালোই লাগল।আগামীকাল তো মহালয়া।আমার ছুটি আছে।সকালে একবার কথা বলা যাবে?"
পূজা:"মহালয়া র ভোরে রেডিওতে প্রভাতী অনুষ্ঠান শুনে টিভিতে মহালয়ার বিশেষ অনুষ্ঠান আমরা সপরিবারে প্রতিবছরই দেখি।তারপর পূজার্চনা করে বাকি কাজ সেরে আসতে দেরী হবে।bye"
সূর্য:"ঠিক আছে।অনলাইন হলে বুঝতে পারব।আজ তবে এইটুকু থাক।bye"

পূজার বাবারা চার ভাই।বাবাদের চারভাইয়ের মধ‍্যে বড়ভাই নিঃসন্তান ও ছোটভাই অবিবাহিত।পূজা আর পার্বণ হল মেজো ভাই ও সেজো ভাইয়ের দুটি সন্তান।পূজা ছোট,পার্বণ বড়।পূজার মা বাবার সেরকম কোনো দুশ্চিন্তা বা তাড়া পূজার বিয়ে নিয়ে না থাকলেও পূজার গ্র‍্যাজুয়েশনের পর থেকেই পূজার জ‍্যেঠামশাই নিজের থেকেই নিজের বন্ধুবান্ধবদের পূজার বিয়ের জন‍্য ভালো সম্বন্ধের বিষয়ে বলে রেখেছেন।সরোসিজবাবু নিজের মেয়ের মতোই ভালোবাসেন পূজাকে।বাড়িরও একমাত্র মেয়ে পূজা।বাবা- মার কাছে খুব আদর যত্নে মানুষ হয়েছে পূজা। পূজার বিয়ের বিষয় মানে বাড়ির একমাত্র জামাইয়ের বিষয়!তিনি নিজের থেকেই তাই ভালো পাত্রের সন্ধানের দায়িত্ব নিয়েছেন।পূজার জ‍্যেঠামশাই তাঁর বন্ধুর আত্মীয়ের কম্পিউটার ইন্জিনিয়ার ছেলের সঙ্গে পূজার জন‍্য যে সম্বন্ধের কথা মাসখানেক আগে কমলবাবুকে বলেছিলেন পূজার জ‍্যেঠামশাইয়ের সেই বন্ধু এই মোক্ষোদাশঙ্করবাবু।অর্থাৎ সূর্যর নতুন একটা পরিচয় উঠে এল পূজার সামনে; সূর্য হল পূজার জ‍্যেঠামশাইয়ের নিকট বন্ধুর একমাত্র ছেলের বড় শ‍্যালক।জ‍্যেঠামশাই তাহলে অনেকদিনই চেনেন সূর্যকে।

"কি রে,তোর সন্ধ্যা দেওয়া হল।তাড়াতাড়ি জপ করে চলে আয়।তোর পছন্দের জলখাবার ঠান্ডা হয়ে যাবে।"
সন্ধ্যা দিতে দিতে সূর্যের কথাগুলো ভাবতে ভাবতে একটু আনমনা হয়ে গিয়েছিল পূজা।মায়ের ডাকে স্তম্বিত ফিরে পেল।

জলখাবারে আজ মায়ের হাতের মশলামুড়ি আর এলাচ- চা।মায়ের সঙ্গে জলখাবার খেতে খেতে মাকে হঠাৎ জিজ্ঞেস করল,"এখন আমার শুক্রের মহাদশা আর বুধের অন্তরদশা চলছে,তাই না?"

"হ‍্যাঁ।কিন্তু হঠাৎ জিজ্ঞেস করছিস কেন?"সন্দিগ্ধ মনে মায়ের প্রশ্ন পূজাকে।

"এমনি।এম.এ ফাইনাল ইয়ার শেষ হবে এই দশাতেই।তাই ভাবছিলাম।"নির্লিপ্ত উত্তর পূজার।

আমাদের পূজা ছোট থেকেই নীতিকথার গল্প,আধ‍্যাত্বিক চর্চা, বেদের বৈজ্ঞানিক ভিত্তি, শাস্ত্রমতে পূজার্চনার মূল উদ্দেশ্য,পুরাণের ব‍্যাখ‍্যা,রামায়ণ ও মহাভারতের চরিত্রের মূল‍্যায়ণ প্রভৃতি বিষয় নিয়ে সহজাত ভাবে আগ্রহী।আর এই চর্চায় তার প্রধান সঙ্গী হলেন পূজার মা।
মাধ্যমিকের পর বেদেরই কিছু রহস‍্যবিজ্ঞান যেমন বাস্তশাস্ত্র,জ‍্যোতিষশাস্ত্র,আয়ুর্বেদ,যোগবিদ‍্যার মতো বিষয়ে আকৃষ্ট হয়ে প্রাথমিকভাবে একটু আধটু পড়াশোনা করতে শুরু করেছিল শুধুমাত্র অজানা কিছু তথ‍্য জানার কৌতুহলে।পূজার মাও এই বিষয়ে মেয়ের সাথে চর্চা করতে খুব ভালোবাসেন।পূজার দিদিমাও এসব খুব মানেন।পূজার মা তাই এসবে বরাবর বিশ্বাসী।মা-দিদিমার চিরাচরিত এই বিশ্বাসগুলো কুসংস্কার না সত‍্যিই এই বিষয়গুলির বৈজ্ঞানিক ভিত্তি আছে এটা খুব অল্প বয়স থেকেই তাই পূজার জানার আগ্রহ প্রবল।
অনেক আগে থেকেই বিভিন্ন জ‍্যোতিষের কাছে পূজার শরীর স্বাস্থ্য, পড়াশোনা, কেরিয়ার, বিয়ে এগুলো নিয়ে পূজার মা তার জন্মকুন্ডলী বিচার করিয়েছেন।জ‍্যোতিষ ভবিষ‍্যতের কিছুটা আভাস দিতে পারে এটা সত‍্যি,কিন্তু ভগবান হয়ে ভবিষ্যতে র সবটুকু নির্দিষ্ট করে বলতে পারেনা---একথা পূজা মানে।সব ক্ষেত্রে আমাদের কর্মফলই ভাগ‍্য হয়ে আমাদের কাছে ফিরে আসে।তবে জ‍্যোতিষ মতে শুক্রের মহাদশাতেই পূজার বিবাহ হওয়ার কথা।আর ২বছর আছে শুক্রের এই মহাদশা পূরণ হতে।জ‍্যোতিষমতে পূজা প্রতিভাবান ও সৌভাগ্যবতী।কিন্তু পূজার বিবাহোত্তর জীবনে কিছু সমস‍্যার কথা কমবেশী উল্লেখিত আছে।পূর্বনির্ধারিত প্রেমজ বিবাহ হবে বলেই বলছে পূজার জন্মছক। রীতিবিরুদ্ধ বিবাহ হবে পূজার;তবে দুটি পরিবারের উপস্থিতিতে সামাজিক ভাবেই হবে।বিবাহোত্তর জীবনে পূজার ক্ষেত্রে অনেক শুভযোগও আছে।
কিন্তু পূজা একদিকে খুব বাস্তবাদী।তাই এইসবের মধ‍্যে এক্ষুনি জড়িয়ে না পড়ে তার ইচ্ছা নিজের কেরিয়ার নিয়ে নিশ্চিত হলে তবে বিয়ে নিয়ে ভাবনা চিন্তা করার।পূজা নিজেকে চেনে।জন্মছক যাই বলুক নিজের থেকে কারোর প্রেমে পড়ার কথা সে ভাবেনি কখনও।তবে নিজে যাচাই না করে বা সম্পর্কের গভীরতা অনূভব না করলে কাউকে বিয়ে করা তার পক্ষে সম্ভব নয়।উচ্চমাধ্যমিকের পর আত্মীয়স্বজনদের মধ‍্যে থেকে কয়েকটি বিয়ের সম্বন্ধ এসেছে।কোন প্রস্তাবেই পূজা এগোতে দেয়নি মা বাবাকে।মনে মনে সে জানে মাবাবা তাকে কতটা ভালোবাসেন,বিশ্বাস করেন।পরিবারের অমতে সে কোনোদিনই কিছু করতে যাবেনা।তাই গুরুজনদের গন্ডি পেরিয়ে তার সামনে যখন কাউকে আনা হবে এবং তার নিজের থেকে তার সাথে কথা বলার ইচ্ছা হবে,তখন বিয়ে করার বিষয় আসবে তার আগে নয়।কিভাবে কখন এসব হবে সে জানেনা,তবে পূজার বংশ,পিতৃপরিচয়,শিক্ষাগতযোগ্যতা দেখে কেউ প্রেমে পড়ুক সে চায়না।শুধুমাত্র পূজাকে অর্থাৎ পূজার মন,মানসিকতা,আচার-আচরণ,বিচারবুদ্ধি,ভালো মন্দ সবটুকুকে যে জেনে বুঝে ভালোবেসে সারাজীবন অটুট বিশ্বাসের বাঁধনে তাকে বাঁধতে পারবে,তাকেই সবটুকু ভালোবাসা উজাড় করে দিতে পারবে সে।আর নিবিড় বন্ধুত্ব,সুগভীর ভালোবাসা ও অটুট বিশ্বাস ছাড়া বিয়ে যে প্রকৃত বিয়ে হয়না,সেই সংসারে যে শুধু সংটাই পড়ে থাকে সার থাকেনা,সেই সম্পর্কের মধ্যে কোনো পবিত্র বাঁধনের নিশ্চয়তা থাকেনা---এটা পূজার বধ‍্যমূল বিশ্বাস।আর তথাকথিত বৌয়ের সং সেজে সারহীন একটা গতানুগতিক জীবন তার একদমই কাম‍্য নয়।

© বুনানী