...

0 views

স্বপ্ন
—তাহলে মা, এতদিন মাথার উপরে যেটা উড়ে যেতে দেখতে, আজ সেটায় চড়ে কেমন লাগছে বলো ?
— খুব ভালো বাবা, আজ তো আমার আর তোর বাবার আরো একটা গর্বের দিন। প্রথম টা ছিল যেদিন তুই আমাদের চাকরি পাওয়ার কথাটা প্রথম শুনিয়েছিলি সেদিন যেমন আনন্দে চোখে জল এসেছিল, আজও চোখের কোণ টা যেন..
শাড়ির আঁচল দিয়ে চোখের জল মুছতে মুছতে তার ছেলেকে কথাগুলো বলল মৃণালিনী। অজপাড়া এক গ্রামের মেয়ে। বাপের বাড়িও প্রত্যন্ত এক গ্রামে। স্বাভাবিকভাবেই জীবনে যাতায়াতের বহর কোনোদিনই অতটা ছিলনা আর এই প্লেনে চড়া তো তার কাছে অনেক দূরের কথা — এক কথায় স্বপ্ন। ছেলে তার কর্মস্থলে মা কে নিয়ে গিয়ে মায়ের প্লেনে চড়ার স্বপ্ন পূরণ করেছে আজ।
— আঃ মা, তুমিও..একটুতেই ইমোশনাল হয়ে যাও। এসো জানলার ধরে বসো।
— না, তুই বস আমি ঠিক আছি।
— আহা, আমি তো বলছি নাকি। আর তাছাড়া তোমার এটা প্রথমবার। আমি তো এর আগে অনেকবারই প্লেনে চড়েছি।
— আচ্ছা নে, খুব বড় বড় কথা হয়েছে তোর।
ছেলের সাথে জায়গা পরিবর্তন করে মৃণালিনী জানালার ধারে বসলো। উপর থেকে সত্যিই আকাশটা এতটা অন্যরকম লাগে যেটা আজ প্লেনে না চড়লে যেন বুঝতেই পারতোনা সে।
দুপুর গড়িয়ে বিকেল হয়। মৃণালিনীর কাজল চোখের মণির উপর পড়া আকাশের নীল আলোর প্রতিফলন যেনো আস্তে আস্তে পড়ন্ত বিকেলের রক্তিম আভার দিকে রূপান্তরিত হতে থাকে। ধীরে ধীরে তার চোখের পাতা মৃদুমন্ত গতিতে পলক ফেলতে ফেলতে আস্তে আস্তে বন্ধ হয়।
গায়ে হাত দিয়ে ঘুম থেকে তোলার মত করে একটা ডাক এলো
— মা, ও মা..আরে ওঠো, চারটে পঞ্চান্ন তো এখানেই বেজে গেলো, আমার তো সাড়ে পাঁচটায় ট্রেন নাকি!
আচমকা ঘুম ভাঙলো মৃণালিনীর। আবছা দৃষ্টি দিয়ে দেখলো তার ছেলে ব্যাগ নিয়ে রেডি হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। একটাই ছেলে। স্কুলিং অর্থাৎ ক্লাস টুয়েলভ পর্যন্ত পড়াশুনা বাড়ি থেকেই হয়। বড়ো হয়ে ডাক্তার হবার স্বপ্ন নিয়ে গত বছর এন্ট্রান্স পরীক্ষায় ভালো স্থান অর্জন করে একটা নামী সরকারি মেডিক্যাল কলেজে অ্যাডমিশন নিয়েছে সে। প্রায় মাস চারেক পর একসপ্তাহর ছুটি নিয়ে এই প্রথমবার বাড়ি এসেছিল। আজ তাকে ভোরের ট্রেনে হোস্টেলে ফিরতে হবে।
নিজেকে তাড়াতাড়ি কোনরকমে প্রস্তুত করে নিয়ে সামনের অটো স্ট্যান্ড পর্যন্ত ছেলেকে ছাড়তে এলো মৃণালিনী। সেখান থেকে অটো ধরলে স্টেশন দশ মিনিটের রাস্তা। আর এমনি পায়ে হেঁটে গেলে প্রায় কুড়ি মিনিটের মত লেগেই যায়। ঘড়িতে তখন পাঁচটা দশ। ব্যাগ পত্তর সব নিয়ে ছেলেকে অটোতে চাপিয়ে দিয়ে বললো,
— সাবধানে আয় বাবা। সব নিয়েছিস তো?
— হ্যাঁ মা।
— গিয়ে কিন্তু ফোন করবি, চিন্তায় থাকবো...
— আচ্ছা ঠিক আছে, তুমি একদম চিন্তা করোনা, আমি ঠিক পৌঁছে যাবো, আর নিজের খেয়ালটা একটু রেখো মা প্লিজ...।
একটা বিকট আওয়াজ তুলতে তুলতে ড্রাইভার তার অটো রিক্সায় স্টার্ট দিল। কুড়ি থেকে তিরিশ সেকেন্ডের মত স্টার্ট ধরে রাখার পর স্ট্যান্ড ছেড়ে বেরিয়ে যেতেই সেই আওয়াজ যেন ক্ষীণ হয়ে আস্তে আস্তে বাতাসের সাথেই মিলিয়ে গেল, সাথে সাথেই মৃণালিনী তার দু'চোখ বন্ধ করে হাতজোড় করে বললো,
— দুগ্গা দুগ্গা..
একটা আস্ত গোটা সপ্তাহও যে এইভাবে নিমেষের মধ্যেই ফুরিয়ে যেতে পারে সেটা কোনোদিনই এর আগে বুঝতে পারেনি মৃণালিনী। এই তো গতকালই যেন সন্ধেবেলায় দরজায় ছেলের "মা" হাঁক শুনে অনেকদিন পর ছেলেকে দেখতে পেয়ে মমতাময়ী হাসি হেসে ঘরের সদর দরজাটা খুলে দিয়েছিল সেদিন ছেলের উদ্দেশ্যে, আর আজ
আলগা করে লাগিয়ে রাখা সেই সদর দরজা খুলেই বিষন্ন মুখ নিয়ে ঘরে ফিরল মৃণালিনী। ঘরে ফিরে প্রথমেই তার ছেলের ঘরে ঢুকে পূবদিকের কোণে টেবিলের সামনের দেওয়ালে জানালার পাশে ঝোলানো ছেলের কেনা সখের স্টেথোস্কোপটি শাড়ির আঁচল দিয়ে মুছতে মুছতে যেন বললো নিজের মনেই,
— ছেলের স্বপ্নপূরণের জন্যে এইটুকু কষ্ট হয়তো মায়েদের সহ্য করতেই হয়, একদিন তোকে ডাক্তারের সাজে দেখবো বলে তোর মা অনেক আশা করে আছে বাবা, আমার বিশ্বাস একদিন তুই অনেক বড় মানুষ হবি, অনেক বড় ডাক্তার হবি তুই...
জানালা দিয়ে দেখলো ভোরের পরিষ্কার আকাশে একটা উড়োজাহাজ শব্দ করে উড়ে গেলো। উড়োজাহাজের বিন্দুরুপি প্রতিফলন পড়ল মৃণালিনীর কাজল কালো চোখে। হাতে শাড়ির আঁচল জড়ানো ছেলের সখের সেই স্টেথোস্কোপ ধরেই বললো,
— তোর স্বপ্ন পূরণ মানেই তো আমার স্বপ্নপূরণ ।।
© শিলালিপি

#shortstory #Writco