...

21 views

রেনেসাঁর খোঁজে (পর্ব ০৩)
#পর্ব ০২ -এর পর

আমার ঘর ভর্তি বই দেখে তার চোখের মধ্যে অদ্ভুত এক খিদে খুঁজে পেলাম আমি। একেই তো চাই! "কিরে? পড়াশুনা করবি?", শুধোলাম তারে। বিদ্যুতের ঝলকের মতো মাথা নাড়া উত্তরে সম্মতি জানালো সে। দেখলাম আমি তাকে খারাপ ভাবে ব্যবহার করতে পারি, সে চিন্তা তার কাছে অতি তুচ্ছ হয়ে গেছে। "এখন বাড়ি যা, পানুকে বলে দেব; ওর দোকানের কাজ ছাড়বি তুই। আমার বাড়িতে কাজ করবি, আমায় খাওয়াবি, নিজে খাবি"। সে বোধয় কিছু বলতে গেছিলো। তাকে থামিয়ে গর্জনের সুরে বললাম, "এখন বাড়ি!"।

পরদিন পানুকে বলে ওকে ঘরে নিয়ে এলাম। প্রতিবেশী ফুলকাকিমাদের নতুন গসিপ টপিক এখন আমি। রাস্তা দিয়ে চলতে গিয়ে মুখোমুখি হলে তাদের হাবে- ভাবে তা ঝরে পড়ছে। আমিও মনে মনে রুক্ষ সুরে বলছি - "ছেড়া গেছে"। আসলে আমাদের বয়েসের পার্থক্য মাত্র নয়। সে ষোড়শী কিশোরী, সদ্য কুসুমিত কুঁড়ি আর আমার যৌবনের প্রখর দাপট দাবানলের মতো জ্বলছে।

ক্রমে তিনটে বছর কেটে গেলো। উচ্চ মাধ্যমিক দেবে সে আগামী বছর। ওপেন স্কুল থেকে মাধ্যমিক পরীক্ষায় স্টার হাঁকিয়েছে মাত্র এক বছরের অধ্যবসায়ে। সাথে অঙ্কে পূর্ণমান। স্কুলের খাতায় তার নাম উঠলো 'রেনেসাঁ বোস'। রেনেসাঁ, সত্যিই হয়ত বোধন হলো এক নতুন পথ চলার। আবার নতুন করে মাথা তুলে দাঁড়াবার লড়াই - এই উদাসীন স্বার্থপর সমাজের মাঝে।

সত্যি বলতে, আমিও প্রেমে পড়েছি তার। তার রূপে, আগ্রহে আমি মোহিত। আমার মধ্যে যেটুকু ভালো, যেটুকু সৃষ্টিশীল, যেটুকু জগৎ সংসারের অগ্রগতির পাথেও হবে; - তা এই সিন্দুকেই রেখে যাবো আমি। মনে মনে তাকে সিভিল সার্ভিসের জন্য প্রস্তুত করবো ভাবছি। কিন্তু সে সুখ আমার বেশী দিন টিকলো না। দিনটা ছিল শনিবার। উচ্চ মাধ্যমিক জীববিদ্যা পরীক্ষা। সন্ধ্যেতে বাড়ি ফিরলো না সে। আমি অস্থির ভাবে চারদিক খুঁজে যখন ক্লান্ত, পুলিশের দ্বারস্থ হওয়াই তখন আমার শেষ উপায়। গেলাম। পাক্কা সোয়া এক ঘন্টা লাগলো বাবুদের, আমাদের সম্পর্কের ক্লাস নিতে। গত কয়েক বছর সে আমার বিছানার উষ্ণতা পাল্টায়নি, সেটা তারা শেষ অবধিও মানতে পারেননি।

পরদিন কেটে গেলো। আমি জানিনা কি করেছিলাম সেই দিন। সোমবার পুলিশ খবর দিলো, উত্তরবঙ্গের রায়গঞ্জের কাছে চৌত্রিশ নম্বর জাতীয় সড়কে কাল একদল নারী পাচারকারী জমায়েত হবে। নিলামে উঠবে সারা ভারতের প্রায় তেরোটি শহরের মেয়ে। দেওলাও থাকতে পারে। জেলা পুলিশকে সাথে নিয়ে হানা দেবে কলকাতা পুলিশ তাদের ডেরায়। আমি বড়ো বাবুকে প্রস্তাব দিলাম আমায় সাথে নেওয়ার। প্রচন্ড বাক বিতন্ডার পর হাওড়ার এসিস্ট্যান্ট কমিশনারের কথায় আমি দলে জায়গা পেলাম। ভদ্রলোকের সাথে আমার সাহিত্যের সম্পর্ক। তবে আমার দলে থাকাটা গোপন রাখতে হবে আমায়। দলে বড়বাবু ছাড়াও দুজন সাব ইন্সপেক্টর, আর পাঁচজন কনস্টেবল থাকবে। সবাই সশস্ত্র শুধু আমি ছাড়া, যাকে বলে, আমি হলাম দুধ - ভাত।

সোমবার রাত এগারোটায় আমরা যথাস্থানে বাছাধনদের বেহিসেবী চালের অপেক্ষায়। আমি হঠাৎ উত্তেজিত, " ওই তো দেওলা!"; বড়বাবু আমায় টেনে মাটিতে শুইয়ে মুখে পিস্তল গুঁজে গর্জে উঠলেন, " চুপ! নয়তো শালা তোরে আগে ঠুকব"। বাপরে! দম আছে লোকটার। কমিশনারের কথা কি মনে নেই তার? হঠাৎ প্রচন্ড শব্দ, গ্যাস সিলিন্ডার ফাটলো কোথাও। সেই ঘরে দাউ দাউ আগুন। কিছু মানুষের গায়ে আগুন লেগেছে। ছুটছে তারা। আমরা ছুটে গেলাম। পুলিশ দেখে বুলেট তাদের কদর্য অভ্যর্থনা জানালো। খান বাবু ( সাব ইন্সপেক্টর) মাটিতে লুটিয়ে পড়লেন। ডান পাঁজরে ধারে লেগেছে। দুটি অল্প বয়সী ছেলে মরলো পুলিশের গুলিতে। একটা যুবক রক্তাক্ত, যৌনাঙ্গ কাটা - মাটিতে কাতরাচ্ছে। পাশের গুদামে যেখানে মেয়েরা মজুত সেখানে আগুন পৌঁছয়নি। সেটা ছিল ফুট দশেক দূরে। একটি করে মেয়ে এনে নিলাম হচ্ছিল পাশের এই ঘরে। রান্না চলছিল, চলছিল খানা পিনা। সেখানেই বিস্ফোরণ। কিছু দূরে এক আর্তনাদ, কোপানো হচ্ছে কাউকে। ছুটে গেলাম, পুলিশ জানালো সর্দার সে। মৃত সর্দার। ক্ষত - বিক্ষত।

আজ অমাবস্যা। চারদিক অন্ধকার। তবে তাকে দেখেছি আমি। জাতীয় সড়ক পার হয়ে গেলো সে। অর্ধমৃত বাল্ব এর আলোয় তার হাঁটা দেখে চিনলাম তারে। ছুটে গেলাম। " দেওলা! ফিরে আয়", - দূরের অন্ধকারে মিলিয়ে গেলো সে। হাতের কাটারি টা শক্ত করে ধরে আছে এখনও।

আমি আবার যাযাবর। বছর পাঁচ আবার বাইরে। গতকাল ফিরলাম শহরে। পাড়ার চায়ের দোকানে বুড়োদের আড্ডা জমেছে। " থানায় নাকি নতুন ও সি এসছেন। দারুন জাঁদরেল। নাম রেনেসাঁ, রেনেসাঁ - কি যেন একটা।" তবে কি! যাবো, আমি যাবো, দেখে আসব কে সে। পা যেন মানা করছে। মাটিটা কামড়ে দাঁড়িয়ে থাকলো ঠায়।

© জিপ্`সি
১১ই নভেম্বর, ২০১৭