মাশুল
শীতের সকাল। জনবিমুখ রাস্তাঘাট। কলকাতা তখনও লেপের তলায় তন্দ্রাচ্ছন্ন। কুয়াশার আবছায়ায় চৌরাস্তার এক কোনে উঁকি দিচ্ছে পাড়ার প্রসিদ্ধ রাখাল দা-র চায়ের দোকানটা। সেখানে প্রায় প্রতিদিনই গরম চায়ের চুমুকে অবসন্ন শরীরটাকে একটু চাঙ্গা করতে ছুটে আসেন স্থানীয় ব্যক্তিবর্গ ও অফিসগামী মানুষেরা। আজ ভিড়টা তুলনায় কম।
বাইরের বেঞ্চে কেবল দু'-একজনের দেখা মেলে। ঠাণ্ডা হাওয়ায় খোশমেজাজে আড্ডা দিতে তাদের নেহাত মন্দ লাগে না। সহসা দেখা গেল, একজন সেদিকেই ক্রমশ এগিয়ে যাচ্ছে। তাহলে তার একটু বর্ণনা দেওয়া যাক।
অদ্ভুত চেহারার সে। ঝাপসা দিগন্তরেখা থেকে ইতঃস্তত ভঙ্গিতে কীসব ইশারা করে চলেছে ধুলোমাখা হাত দুটো নেড়ে। মাঝে মাঝে একটা হাত পকেটে গুঁজে আরেক হাতে একফালি চিরকুট নিয়ে সেদিকে তাকিয়েই কী যেন ফায়সালা করে নিতে চাইছে। বেড়ালের ইঁদুর খোঁজার মতো সেও যেন অলিগলিতে পায়চারি করতে করতে কাউকে খুঁজছে একনাগাড়ে। মুখে মাস্ক, মাথা ভরা উস্কোখুস্কো চুল। নিছক সন্দেহের বশেই তার চোখের চাহনিকে ঠাহর করে দেখল দোকানি রাখাল বসাক। শেষ অবধি এদিকেই এল আনকোরা লোকটা।
"দাদা, বলছিলাম যে–"
"কী চাই এখানে?"
"না, আসলে আমি একজনের ঠিকানা..."
"অন্য কাউকে জিজ্ঞেস করুন, যান," – গ্যাসের নভ ঘুরিয়ে বন্ধ করে বলে উঠল রাখাল দা।
"আজ্ঞে, আমি ঠিকাদার। আজ একটা নতুন কাজ পেয়েছি। যাকে খুঁজছি তার নাম..."
"বললাম তো, ঠিকানা ফিকানা বলতে পারবো না। যান দিকি এবার?"
নিজের খিটখিটে মেজাজে সামাল দিতে পারলো না পাড়ার সখের চায়ের দোকানি। যে ব্যক্তি রোজ মশলা আর লেবুর চায়ের গন্ধে সবার মন জয় করে নেয়, তার থেকে কী এহেন আচরণ আদৌ শোভা পায়? বছরখানেক আগেও এমন ছিল না সে। স্ত্রী মারা যাওয়ার পর পারিবারিক ঘাত প্রতিঘাতে একা একা খেটে খাওয়া মানুষটা এখন বয়সের ভারে এমন হয়ে গেছে। সবই নিয়তি।উপরন্তু, ওই অদ্ভুত লোকটাকে দেখে সুবিধাজনক লাগেনি তার। কারণটা অস্বাভাবিক নয়, অমন ছেঁড়া জামা আর কোমরে গামছা বাঁধা লোকটা যেন অন্যদের থেকে একদম আলাদা। বহু বছর ওই এলাকায় কাউকে সাতসকালে এভাবে ভবঘুরের মতো ঘোরাঘুরি করতে দেখেনি সে। কে জানে, হয়তো ভেতরে অন্য কোনো ফন্দিফিকির এঁটে রেখেছে। চোর, ছিনতাইবাজদের সংখ্যা তো দিনরাত বেড়েই চলেছে। গতকাল মাইলখানেক দূরে ভয়াবহ দুষ্কৃতী হামলার রেশ এখনো কাটেনি।
মোদ্দা কথা হল, আজই লোকটার কাজে যোগ দেবার কথা। অন্তত গতিবিধি দেখে তাই মনে হয়। কিন্তু গতকাল তার সুইচটেপা ফোনটা ভিড়ে ঠাসা লোকাল ট্রেনে শহরে আসার পথে কখন হাপিস হয়ে গেছে, কে জানে ! তাই সন্ধ্যে থেকেই কারুর সাথে যোগাযোগ সম্ভব হয়ে ওঠেনি। উপরন্তু থানাপুলিশের প্রতি অনীহায় সেই চত্বরেরও মুখোমুখি হয়নি সে। ভেবেছিল রাস্তায় পা চালাতে শুরু করলেই আমজনতার মধ্যে কেউ না কেউ বাতলে দেবে ঠিকানা। কিন্তু খাস কলের কলকাতার বুকে সহানুভূতি দেখানোর চেয়ে যেন মুখ ফিরিয়ে নেওয়া মানুষের সংখ্যাই বেশি !
অন্যান্য দোকানপাটও এখনও ঝাঁপি বন্ধ করে বসে আছে, বেলা হওয়ার অপেক্ষায়। আগের দুজন উঠে চলে গেলেও এখন মর্নিং ওয়াকের শেষ রাউন্ডের আগে চা পানে ঢুকেছে একদল মাঝবয়সি লোক। এবারে শেষ ছিঁটেফোঁটা আশার উপর ভর করে ওই দোকানের রোয়াকেই উঠলো সে – পাছে কেউ সহৃদয় হয় এ নির্লিপ্ত, ভাবলেশহীন সমাজে ! নইলে যে আজকের মতো তার ভাগ্যে বাড়ি ফেরাই নিয়তি, রোজকার বন্ধ।
"দাদা, দয়া করে বলছি – এই ঠিকানাটা খুব দরকার। সময় যে নেই।", দুটো অস্ফুট চোখের মণি ও গোবেচারা কণ্ঠ ভেসে উঠলো সবার অনর্থক গল্পগুজবের মাঝে। কয়েক সেকেন্ড সবাই চুপ। তারপরেই শোনা গেল – ভদ্রলোকগুলো একে অপরের কানে বিড়বিড় করছে কীসব ! নিজের সংশয় আর ধরে রাখতে না পেরে অবশেষে ধমক দিল দোকানি : "তখন থেকে হয়রানি করছেন কেন বলুন তো মশাই? যাবেন, নাকি পুলিশ ডাকবো? চালচলন দেখে তো ছিঁচকে চোর মনে হচ্ছে।" শেষমেষ বলে উঠল অপর প্রান্তে থাকা ব্যক্তিটি, "এই ভুবন বাগ গরীবের বাচ্চা হয়ে জন্মাতে পারে, ঠিকা করে পেট চালাতে পারে, কিন্তু নিজের নামে অকারণে চোর অপবাদ মানবে না। বুঝেছেন?"
পরিপ্রেক্ষিত না বুঝেই পায়ে পা দিয়ে তর্কে নেমে পড়ল কিছু তথাকথিত ভদ্রলোক, "গাঁইয়া কোথাকার! একে সাতসকালে জ্বালাচ্ছে, আবার মুখে বড়ো বড়ো কথা!"
নিজের ইজ্জত রক্ষার প্রশ্নে মুখে কুলুপ এঁটে আর লাভ নেই, একথা বুঝেই বললো সে, "পুরোটা না জেনে কেন পাগলের প্রলাপ করছেন আপনারা?"
একজন ইতিমধ্যে বলে বসলো, "জানার কিছু বাকি আছে? আপনাদের মতো অনেক দেখেছি। সব একেকটা মুখোশ পরা..."
তিক্ত বাদানুবাদ শুনে পথচারীরা থমকে দাঁড়িয়েছে। দোকানের সামনে মস্ত জটলা, যেন মাছিও গলবে না। এ দখিনা বাতাসেও উত্তাপ যেন যেতে চাইছে না কিছুতেই। কথা কাটাকাটি ছেড়ে তখনই পরিস্থিতি পৌঁছাল মারধরের পর্যায়ে। উত্তেজিত, উন্মত্ত জনতা রক্তচক্ষু নিয়ে এগিয়ে আসছে। কেউ যেন শুনতেই চাইলনা ভুবন বাগের কথা – বাকি সকলেই তার বিপক্ষে। একলা প্রহরী বা শেষ সিপাহীর মতন একাই নিজেকে রক্ষার চেষ্টা করছে প্রাণপণ, কেউ আপন নয় তার! একজন ছোকরা সজোরে ঘুঁষিই মেরে দিল বারকয়েক। পুলিশের অস্তিত্ব তখনও টের পাওয়া যায়নি। বেদম প্রহারে জামার সিকিভাগও টেকেনি আর, ছেঁড়া ন্যাকড়ার ন্যায় খন্ড খন্ড হয়ে ছিটকে গেছে। পিঠে, হাতে রক্তের জমাট বাঁধার দাগ। কথা বলার জোর নেই আর, আর্তনাদ করে গলা গেছে শুকিয়ে; মৃতপ্রায় কুকুরের মতো ধুঁকছে সে।
তার অন্তিম আর্তনাদ শুনে একজন বৃদ্ধ মানুষ যেন দেবদূত হয়ে নামলেন কোথা থেকে, ও চিৎকার করলেন, "থামো সবাই! মারছো কেন? ও বারবার যা বলতে চাইছে, কেউ কি শুনেছে?" এতক্ষণে পুলিশ হাজির হয়ে সমস্ত ব্যাপারে সামাল দিতে লাঠিচার্জ করে ভিড় সরিয়ে দেখল, লোকটি অজ্ঞান। বেঞ্চের উপর শুইয়ে জল ছেটানোর সময় গামছা থেকে বেরিয়ে এলো সযত্নে রক্ষিত সেই চিরকুট, যাতে লেখা ছিল বাবুজির নাম, ও ঠিকানার প্রথম পাঁচটি শব্দ। অবশেষে পুলিশ সকলের উদ্দেশ্যে হাঁক দিল, "মুমূর্ষু অবস্থায় ওনাকে হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয়েছে। প্রাথমিক তদন্ত বলছে, উনি নির্দোষ। এবার যারা যারা হিংস্রভাবে নিরীহ লোকটাকে ঘায়েল করেছেন, চলুন থানায়। খুনের চেষ্টার ধারায় তাদের নিয়ে যাওয়া হবে।"
ভর্ৎসনার সুরে বৃদ্ধ মানুষটি বললেন, "এরা নাকি ভদ্দরলোক, অ্যাঁ ! হলো তো? শান্তি? যারা বাইরের রূপ দেখে মানুষকে জানোয়ার ভাবে, তারা তো পশুর চেয়েও অধম? হলো তো শালার ব্যাটাদের মাশুল গোনা?"
সত্যিই তো, কি দোষ ছিল তার ? কিসের মাশুল গুনতে হল সেই ঠিকাদারকেও ? আসলে, যে দেশে বুভুক্ষু মানুষের প্রতি সমবেদনার পরিবর্তে বাইরের চাকচিক্য মান্যতা পায়, ধনী- মধ্যবিত্ত-গরীব ভেদাভেদ থাকে, সেখানে তো আবালবৃদ্ধবনিতাকে যুগ যুগ ধরে এরকম হাজারো মাশুল গুনতেই হয় !
© soumik299
বাইরের বেঞ্চে কেবল দু'-একজনের দেখা মেলে। ঠাণ্ডা হাওয়ায় খোশমেজাজে আড্ডা দিতে তাদের নেহাত মন্দ লাগে না। সহসা দেখা গেল, একজন সেদিকেই ক্রমশ এগিয়ে যাচ্ছে। তাহলে তার একটু বর্ণনা দেওয়া যাক।
অদ্ভুত চেহারার সে। ঝাপসা দিগন্তরেখা থেকে ইতঃস্তত ভঙ্গিতে কীসব ইশারা করে চলেছে ধুলোমাখা হাত দুটো নেড়ে। মাঝে মাঝে একটা হাত পকেটে গুঁজে আরেক হাতে একফালি চিরকুট নিয়ে সেদিকে তাকিয়েই কী যেন ফায়সালা করে নিতে চাইছে। বেড়ালের ইঁদুর খোঁজার মতো সেও যেন অলিগলিতে পায়চারি করতে করতে কাউকে খুঁজছে একনাগাড়ে। মুখে মাস্ক, মাথা ভরা উস্কোখুস্কো চুল। নিছক সন্দেহের বশেই তার চোখের চাহনিকে ঠাহর করে দেখল দোকানি রাখাল বসাক। শেষ অবধি এদিকেই এল আনকোরা লোকটা।
"দাদা, বলছিলাম যে–"
"কী চাই এখানে?"
"না, আসলে আমি একজনের ঠিকানা..."
"অন্য কাউকে জিজ্ঞেস করুন, যান," – গ্যাসের নভ ঘুরিয়ে বন্ধ করে বলে উঠল রাখাল দা।
"আজ্ঞে, আমি ঠিকাদার। আজ একটা নতুন কাজ পেয়েছি। যাকে খুঁজছি তার নাম..."
"বললাম তো, ঠিকানা ফিকানা বলতে পারবো না। যান দিকি এবার?"
নিজের খিটখিটে মেজাজে সামাল দিতে পারলো না পাড়ার সখের চায়ের দোকানি। যে ব্যক্তি রোজ মশলা আর লেবুর চায়ের গন্ধে সবার মন জয় করে নেয়, তার থেকে কী এহেন আচরণ আদৌ শোভা পায়? বছরখানেক আগেও এমন ছিল না সে। স্ত্রী মারা যাওয়ার পর পারিবারিক ঘাত প্রতিঘাতে একা একা খেটে খাওয়া মানুষটা এখন বয়সের ভারে এমন হয়ে গেছে। সবই নিয়তি।উপরন্তু, ওই অদ্ভুত লোকটাকে দেখে সুবিধাজনক লাগেনি তার। কারণটা অস্বাভাবিক নয়, অমন ছেঁড়া জামা আর কোমরে গামছা বাঁধা লোকটা যেন অন্যদের থেকে একদম আলাদা। বহু বছর ওই এলাকায় কাউকে সাতসকালে এভাবে ভবঘুরের মতো ঘোরাঘুরি করতে দেখেনি সে। কে জানে, হয়তো ভেতরে অন্য কোনো ফন্দিফিকির এঁটে রেখেছে। চোর, ছিনতাইবাজদের সংখ্যা তো দিনরাত বেড়েই চলেছে। গতকাল মাইলখানেক দূরে ভয়াবহ দুষ্কৃতী হামলার রেশ এখনো কাটেনি।
মোদ্দা কথা হল, আজই লোকটার কাজে যোগ দেবার কথা। অন্তত গতিবিধি দেখে তাই মনে হয়। কিন্তু গতকাল তার সুইচটেপা ফোনটা ভিড়ে ঠাসা লোকাল ট্রেনে শহরে আসার পথে কখন হাপিস হয়ে গেছে, কে জানে ! তাই সন্ধ্যে থেকেই কারুর সাথে যোগাযোগ সম্ভব হয়ে ওঠেনি। উপরন্তু থানাপুলিশের প্রতি অনীহায় সেই চত্বরেরও মুখোমুখি হয়নি সে। ভেবেছিল রাস্তায় পা চালাতে শুরু করলেই আমজনতার মধ্যে কেউ না কেউ বাতলে দেবে ঠিকানা। কিন্তু খাস কলের কলকাতার বুকে সহানুভূতি দেখানোর চেয়ে যেন মুখ ফিরিয়ে নেওয়া মানুষের সংখ্যাই বেশি !
অন্যান্য দোকানপাটও এখনও ঝাঁপি বন্ধ করে বসে আছে, বেলা হওয়ার অপেক্ষায়। আগের দুজন উঠে চলে গেলেও এখন মর্নিং ওয়াকের শেষ রাউন্ডের আগে চা পানে ঢুকেছে একদল মাঝবয়সি লোক। এবারে শেষ ছিঁটেফোঁটা আশার উপর ভর করে ওই দোকানের রোয়াকেই উঠলো সে – পাছে কেউ সহৃদয় হয় এ নির্লিপ্ত, ভাবলেশহীন সমাজে ! নইলে যে আজকের মতো তার ভাগ্যে বাড়ি ফেরাই নিয়তি, রোজকার বন্ধ।
"দাদা, দয়া করে বলছি – এই ঠিকানাটা খুব দরকার। সময় যে নেই।", দুটো অস্ফুট চোখের মণি ও গোবেচারা কণ্ঠ ভেসে উঠলো সবার অনর্থক গল্পগুজবের মাঝে। কয়েক সেকেন্ড সবাই চুপ। তারপরেই শোনা গেল – ভদ্রলোকগুলো একে অপরের কানে বিড়বিড় করছে কীসব ! নিজের সংশয় আর ধরে রাখতে না পেরে অবশেষে ধমক দিল দোকানি : "তখন থেকে হয়রানি করছেন কেন বলুন তো মশাই? যাবেন, নাকি পুলিশ ডাকবো? চালচলন দেখে তো ছিঁচকে চোর মনে হচ্ছে।" শেষমেষ বলে উঠল অপর প্রান্তে থাকা ব্যক্তিটি, "এই ভুবন বাগ গরীবের বাচ্চা হয়ে জন্মাতে পারে, ঠিকা করে পেট চালাতে পারে, কিন্তু নিজের নামে অকারণে চোর অপবাদ মানবে না। বুঝেছেন?"
পরিপ্রেক্ষিত না বুঝেই পায়ে পা দিয়ে তর্কে নেমে পড়ল কিছু তথাকথিত ভদ্রলোক, "গাঁইয়া কোথাকার! একে সাতসকালে জ্বালাচ্ছে, আবার মুখে বড়ো বড়ো কথা!"
নিজের ইজ্জত রক্ষার প্রশ্নে মুখে কুলুপ এঁটে আর লাভ নেই, একথা বুঝেই বললো সে, "পুরোটা না জেনে কেন পাগলের প্রলাপ করছেন আপনারা?"
একজন ইতিমধ্যে বলে বসলো, "জানার কিছু বাকি আছে? আপনাদের মতো অনেক দেখেছি। সব একেকটা মুখোশ পরা..."
তিক্ত বাদানুবাদ শুনে পথচারীরা থমকে দাঁড়িয়েছে। দোকানের সামনে মস্ত জটলা, যেন মাছিও গলবে না। এ দখিনা বাতাসেও উত্তাপ যেন যেতে চাইছে না কিছুতেই। কথা কাটাকাটি ছেড়ে তখনই পরিস্থিতি পৌঁছাল মারধরের পর্যায়ে। উত্তেজিত, উন্মত্ত জনতা রক্তচক্ষু নিয়ে এগিয়ে আসছে। কেউ যেন শুনতেই চাইলনা ভুবন বাগের কথা – বাকি সকলেই তার বিপক্ষে। একলা প্রহরী বা শেষ সিপাহীর মতন একাই নিজেকে রক্ষার চেষ্টা করছে প্রাণপণ, কেউ আপন নয় তার! একজন ছোকরা সজোরে ঘুঁষিই মেরে দিল বারকয়েক। পুলিশের অস্তিত্ব তখনও টের পাওয়া যায়নি। বেদম প্রহারে জামার সিকিভাগও টেকেনি আর, ছেঁড়া ন্যাকড়ার ন্যায় খন্ড খন্ড হয়ে ছিটকে গেছে। পিঠে, হাতে রক্তের জমাট বাঁধার দাগ। কথা বলার জোর নেই আর, আর্তনাদ করে গলা গেছে শুকিয়ে; মৃতপ্রায় কুকুরের মতো ধুঁকছে সে।
তার অন্তিম আর্তনাদ শুনে একজন বৃদ্ধ মানুষ যেন দেবদূত হয়ে নামলেন কোথা থেকে, ও চিৎকার করলেন, "থামো সবাই! মারছো কেন? ও বারবার যা বলতে চাইছে, কেউ কি শুনেছে?" এতক্ষণে পুলিশ হাজির হয়ে সমস্ত ব্যাপারে সামাল দিতে লাঠিচার্জ করে ভিড় সরিয়ে দেখল, লোকটি অজ্ঞান। বেঞ্চের উপর শুইয়ে জল ছেটানোর সময় গামছা থেকে বেরিয়ে এলো সযত্নে রক্ষিত সেই চিরকুট, যাতে লেখা ছিল বাবুজির নাম, ও ঠিকানার প্রথম পাঁচটি শব্দ। অবশেষে পুলিশ সকলের উদ্দেশ্যে হাঁক দিল, "মুমূর্ষু অবস্থায় ওনাকে হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয়েছে। প্রাথমিক তদন্ত বলছে, উনি নির্দোষ। এবার যারা যারা হিংস্রভাবে নিরীহ লোকটাকে ঘায়েল করেছেন, চলুন থানায়। খুনের চেষ্টার ধারায় তাদের নিয়ে যাওয়া হবে।"
ভর্ৎসনার সুরে বৃদ্ধ মানুষটি বললেন, "এরা নাকি ভদ্দরলোক, অ্যাঁ ! হলো তো? শান্তি? যারা বাইরের রূপ দেখে মানুষকে জানোয়ার ভাবে, তারা তো পশুর চেয়েও অধম? হলো তো শালার ব্যাটাদের মাশুল গোনা?"
সত্যিই তো, কি দোষ ছিল তার ? কিসের মাশুল গুনতে হল সেই ঠিকাদারকেও ? আসলে, যে দেশে বুভুক্ষু মানুষের প্রতি সমবেদনার পরিবর্তে বাইরের চাকচিক্য মান্যতা পায়, ধনী- মধ্যবিত্ত-গরীব ভেদাভেদ থাকে, সেখানে তো আবালবৃদ্ধবনিতাকে যুগ যুগ ধরে এরকম হাজারো মাশুল গুনতেই হয় !
© soumik299
Related Stories