...

10 views

প্রেম কি এরকমই হয় ? Part-1/ কলমে কুণাল
- এক্সকিউস মি ম্যাম ! ... রূপেশ মুখার্জি কী এই ব্র্যাঞ্চেরই ব্র্যাঞ্চম্যানেজার?
- হ্যাঁ ছিলেন....! কিন্তু উনিতো রিটায়ার করেছেন প্রায় চার মাস আগে, একত্রিশে জানুয়ারি ২০১৬ তে। আর তাছাড়া .....
- ম্যাম ! আমি জলপাইগুড়ি থেকে আসছি। ওনার ঠিকানাটা পাওয়া যাবে, প্লিজ?
- স্যরি ! আমরা ডাটাবেস থেকে অচেনা কাউকে এরকম ঠিকানা দিতে পারি না !
- "আমি প্রলয় চ্যাটার্জি ! ওনার মেয়ে হিয়ার বন্ধু ! আমরা এক সঙ্গে জলপাইগুড়িতে পড়তাম। গত এক মাস হিয়ার সঙ্গে কোনো যোগাযোগ নেই আমার ! ...মানে ওকে ফোন, ...ফেসবুক, ...হোয়াটস্যাপে... কোত্থাও পাচ্ছি না ! আমি মানে .. আমরা একে অপরকে ভালোবাসি ম্যাম ! আমি ওকে পাগলের মতো খুঁজছি ! ...প্লিজ ম্যাম ! ... যদি দয়া করে আমাকে একটু সাহায্য করেন !"-বলতে বলতেই গলাটা কেঁপে গেলো প্রলয়ের, ছল ছল করে উঠলো চোখ দুটো। প্রলয়ের মুখের এই করুণ অভিব্যক্তি দেখেই বোধহয় এক্সিস ব্যাংক, ভবানীপুর ব্র্যাঞ্চের হেল্পডেস্ক এক্সিকিউটিভ যুবতীটির হৃদয়ে কিঞ্চিৎ দয়া উৎপন্ন হলো।
-"লিখে নিন ! .... এ.কে-৩০৫, সেক্টর-টু, সল্ট লেক সিটি, কলকাতা-৭০০০৯১. ! .... কিন্তু ওখানে গিয়ে তো.........."
-"আপনাকে অজস্র ধন্যবাদ ম্যাম......!" - কথা শেষ হওয়ার আগেই, পরম কৃতজ্ঞতার সঙ্গে উত্তর দিয়েই, দৌড়ে বেরিয়ে গেলো প্রলয়।

বেরিয়েই একটা ট্যাক্সি নিলো সে সল্টলেকের উদ্দেশ্যে। ট্যাক্সি ছুঁটে চললো ব্যস্ত কলকাতার যানজটের ঢেউ ভেঙে। পকেট থেকে একটা রুমাল বের করে, কপালে জমে থাকা বিন্দু বিন্দু ঘাম মুছতে মুছতেই প্রলয়ের চোখ পড়লো তার মোবাইল ফোনটার দিকে। মোবাইলের ওয়ালপেপারে ওর আর হিয়ার ছবিটার দিকে তাকিয়ে, একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে, নিজের মনেই বলে উঠলো - "হিয়া ! তুই কোথায় ....?... কোথায় হারিয়ে গেলি ....?"
চোখের পাতা জোড়া যেন আর পারছে না উপ়্চে আসা জলকে আটকে রাখতে। হৃৎপিন্ডটা স্বস্থান ছেড়ে লাফিয়ে গলার কাছে উঠে এসে যেন শ্বাস রোধ করে ফেলছে তার। সাত-পাঁচ চিন্তা মাথায় ছোবল বসাচ্ছে অনবরত !
- "এ হলো হিয়া মুখার্জি ! আজ থেকে তোদের ব্যাচেই পড়বে. ... আর প্রলয় ! তুই হিয়াকে সব নোটস গুলো দিয়ে একটু আপডেট করে দিবি, ও-তো দু-মাস পরে ভর্তি হয়েছে ?... হিয়া তুমি প্রলয়ের পাশে গিয়ে বসো। প্রলয় জলপাইগুড়ি জেলা স্কুলের টপার !" - রাহুল স্যার আলাপ করলেন, ফিজিক্সের কোচিং ক্লাসে। সেদিন প্রলয় বাধ্য ছেলের মতোই ঘাড় নেড়ে, একটু সরে বসে, হিয়াকে বসার জায়গা করে দিয়েছিলো তার বেঞ্চে।
জলপাইগুড়িতে উকিল পাড়ার এই জ্ঞানপীঠ কোচিং সেন্টার খুব বিখ্যাত। বহু কৃতী ছাত্র ছাত্রী এখন থেকে পড়ে, খুব ভালো রেজাল্ট করেছে উচ্যমাধ্যমিকে। প্রলয় মাধ্যমিকে অত্যন্ত ভালো নম্বর পেয়ে, জেলা হাই-স্কুলেই এগারো ক্লাসে ভর্তি হয়েছে। সৌম্য স্বভাবের এই সুদর্শন তরুণটিকে তার স্কুলে, এমনকি কোচিংক্লাসেও সমস্ত শিক্ষকেরা অত্যন্ত স্নেহ করে, তার মেধা এবং সুমিষ্ট ব্যবহারের জন্য। বাবা জলপাইগুরির আনন্দ চন্দ্র কলেজের অংকের অধ্যাপক। প্রলয় তার বাবা-মায়ের এক মাত্র সন্তান। তাকে নিয়ে তার মা-বাবার অনেক স্বপ্ন।
- "তোর খাতাটা একটু দেখাবি ? .... এই ছেলে তোকে বলছি ! .... ওফফ... কালা নাকি ?... কি ছেলে-রে বাবা ... ড্যাব ড্যাব করে কেমন তাকিয়ে আছে দ্যাখো !" - প্রবল অস্বস্তি নিয়ে, চাপা গলায় স্বগতোক্তি করলো হিয়া ! একাগ্র চিত্তে রাহুল স্যার ফোর্স চ্যাপ্টারটা পড়িয়ে চলেছেন ... ব্ল্যাক বোর্ডে লিখছেন 'ওয়ার্কডান = ফোর্স X ডিস্প্লেস্মেন্ট' ! প্রলয়ের দৃষ্টি তখন আটকে আছে সেই বিদ্যুৎ-চঞ্চলা, মৃগনয়নীর দিকে। অতঃপর হিয়ার পেন্সিলের খোঁচায় বাস্তবে পা রাখলো সে।
-"খাতাটা একটু দ্যাখা না ! .... আমি আসার আগে স্যার কী কী লেখালেন একটু দ্যাখাবি?" - মুখে বিরক্তি এঁকে, চাপা স্বরেই বললো হিয়া !
- "হ্যাঁ..? ... হ্যাঁ ! হ্যাঁ ! ... এই নে না !.... এটা লিখিয়েছেন !" - চমকে বলে উঠলো প্রলয় ! সলজ্জ সতর্কতায় এগিয়ে দিলো নিজের নোটের খাতাটা। এরপর সারাটাক্ষণ ক্লাসে লজ্জায় আর হিয়ার দিকে সোজাসুজি তাকাতে পারেনি সে। প্রলয় অত্যন্ত মনোযোগী ছাত্র ! কিন্তু, এই প্রথম হিয়াকে দেখে কি যে হলো ওর ... যেন অজস্র প্রজাপতি পাখায় সোনালী রোদ্দুর মেখে চোখের সামনে উড়ে বেড়াচ্ছিল ! ওর আঁড় চোখে অপরাধীর মতো তাকানো দেখে হিয়ার অবশ্য খুব হাসি পাচ্ছিলো। তবে প্রলয়ের এই সারল্যটা বেশ মনে ধরেছিলো হিয়ার !
কোচিং থেকে বেরিয়ে, মনে সাহস জুটিয়ে, প্রলয় হিয়াকে বললো - "হাই! আমি প্রলয় ! ..... প্রলয় চ্যাটার্জি ...!"
চঞ্চলা তন্বী হিয়াও মুখে একখানি মিষ্টি হাসি টেনেই, তার কোমল হাতখানি বাড়িয়ে দিয়েছিলো প্রলয়ের দিকে। চিরকাল পড়াশুনায় ব্যস্ত প্রলয়, কোনোদিন কোনো মেয়ের দিকে তাকানোর অবকাশই পায় নি এখন অবধি। কিন্তু আজ এই সুন্দরী তন্বীর কোমল স্পর্শে তার সমস্ত শরীরে যেন এক অদ্ভুত শিহরণ খেলে গেলো, হৃদয়ে আছড়ে পড়লো এক অদ্ভুত জোয়ার। হাজার পায়রা যেন ডানা ঝাপ্টে উড়ে গেলো বুকের মাঝে। হিয়ার টানাটানা কাজল কালো চোখ দুটোর গভীরে ডুবে, যেন তল খুঁজে পাচ্ছিলো না সে।
- "আমাকে তোর নোটসের খাতাটা একদিনের জন্য দিবি ?" - কণ্ঠে আখের রস ছল়্কে উঠলো হিয়ার !
-"নিশ্চই দেবো! .... তুই বরং আজই নিয়ে যা, নোটসগুলো জেরক্স করে কাল আমাকে দিয়ে দিস !"- হিয়ার প্রশ্নে সম্বিৎ ফিরে পেয়ে বলে উঠলো প্রলয়।
-"কিন্তু কাল তো কোচিং নেই.... কি করে দেবো ?"- খাতাটা নিতে নিতেই প্রশ্ন করলো হিয়া।
-"হ্যাঁ! তাই তো ! ... তাহলে কাল স্কুল থেকে ফেরার সময়ে তুই আমার সঙ্গে এখানেই দেখা করিস, আমি তোর কাছ থেকে খাতাটা নিয়ে নেবো !" - উৎসাহ নিয়েই বললো প্রলয়। আসলে প্রলয়ের আগ্রহ যেন খাতা নেওয়ার চেয়েও, বেশী হিয়ার সঙ্গে কাল আবার দেখা করার।
হিয়াও যেন মনে মনে সেটাই চাইছিলো, তাই সঙ্গে সঙ্গেই রাজি হয়ে গেলো। আসলে সৌম্য প্রকৃতির এই সুদর্শন তরুনের স্পর্শে, তন্বী হৃদয়েও হিল্লোল জেগেছিলো। হিয়া তার সাইকেলে উঠে বাড়ি ফেরার উপক্রম করতেই, প্রলয় বলে উঠলো - "হিয়া ! তোর যে কোনো সাবজেক্টে, যা কিছু অসুবিধে হবে, আমাকে বলিস, আমি তোকে দেখিয়ে দেবো....!"
হিয়া উত্তরে প্রলয়ের দুচোখে তার মিষ্টি হাসিখানি ছড়িয়ে দিয়ে চলে গেলো।
-"কাল বিকেলে আমি তোর জন্য এখানেই অপেক্ষা করবো হিয়া !" - পেছন থেকে মুক্ত কণ্ঠে বলে উঠলো প্রলয়।
- "বাবু ! একটা গোলাপ কেনো না ! সকাল থেকে একটাও বিক্রি হয় নি !"
ছেঁড়া ছেঁড়া মেঘের মতো স্মৃতি রোমন্থনে আচমকাই তাল কেটে গেলো। ট্যাক্সিটা সিগনালে দাঁড়িয়ে আছে। একটা বাচ্চা মেয়ে ... দশ কি বারো হবে .. গোলাপের তোড়া নিয়ে ট্যাক্সির জানালার পাশে দাঁড়ানো ! মেয়েটিকে দেখে প্রলয়ের খুব মায়া হলো। কিনে নিলো গোটা তোড়াটা ... একটা পাঁচশো টাকার নোট দিলো মেয়েটির হাতে!
- "তোমার মনের মানুষকে দিও ... খুব খুশি হবে !" - আন্তরিক শুভেচ্ছা জানিয়ে চলে গেলো মেয়েটি। সিগন্যাল সবুজ হতেই ট্যাক্সি ছেড়ে দিলো। প্রলয় গোলাপের তোড়াটা হাতে নিয়ে, খানিক্ষন নিস্পলক দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলো সেটির দিকে। একটা উষ্ণ দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে এলো অন্তর থেকে ... তার মনের মানুষটি কোথায় ? ... কোথায় হারিয়ে গেলো ? ... বেশ বুঝতে পারলো, চোখের কোলে নোন জল জমতে শুরু করেছে !
-"লাল গোলাপের তোড়া ! .... আমার জন্য ?.... হাউ সুইট ! ... লাল গোলাপ আমার ভীষণ প্রিয় .... থ্যাঙ্ক ইউ মাই সুইট ফ্রেন্ড !" - সোনালী রোদ্দুর খেলে গেলো হিয়ার চোখেমুখে। তোড়াটা হাতে নিয়ে, পরক্ষনেই একটু উদ্বিগ্ন কণ্ঠে প্রশ্ন করলো - "তুই অনেকক্ষণ এসেছিস ?"
- বেশি না ! ... এই আধ ঘন্টা ! ... আসলে তোর দেরি দেখে, আমি তো ভেবেছিলাম তুই বোধ হয় আজ ......
- ......আসবই না... তাই তো...? আরে আমি আজ স্কুলেই যাই নি ! শরীরটা ভালো নেই ! তাই মাকে ম্যানেজ করে আসতে একটু দেরি হলো রে !
- "শরীর খারাপ? ...ডাক্তার দেখিয়েছিস তো?" - উদ্বিগ্ন স্বরে প্রশ্ন করলো প্রলয় !
-"আরে বাবা তেমন কিছু না ! তুই অতো চিন্তা করিস না ! এই নে তোর খাতাটা !"- বলেই হিয়া ব্যাগ থেকে বের করে, নোটসের খাতাটা বাড়িয়ে দিলো।
- "আজ তোর শরীর ভালো নেই ! আমি তোকে একা ছাড়বো না কিছুতেই ! চল তোকে তোর বাড়ি অবধি এগিয়ে দিয়ে আসছি !"- বলেই প্রলয় এক রকম জোর করেই হাঁটতে লাগলো হিয়ার সঙ্গে। প্রলয়ের এরূপ যত্নশীল ব্যবহার যেন হিয়ার হৃদয়কে আরো বেশী আপ্লুত করলো। সে আবেগের সঙ্গেই বললো - "ঠিক আছে চল ! কিন্তু একটা শর্ত আছে !"
-"কি শর্ত বল !" - প্রলয় আগ্রহের সঙ্গেই জিজ্ঞেস করলো।
-"বাড়ির বাইরে থেকে চলে গেলে হবে না ! আমাদের বাড়িতে কিছুক্ষণ বসতে হবে।"
হিয়ার এই প্রস্তাবে প্রলয়ের মনটা নেচে উঠলেও, আবেগ সংবরণ করেই সে বললো - "আজ একটু কাজ আছে রে, অন্য কোনোদিন না হয় .... !"
হিয়াও নাছোড়বান্দী ! প্রলয়ের হাত ধরে, জোর করে তাকে রাজি করালো। রাস্তায় আসতে আসতে হিয়া নিজের সম্পর্কে সব বললো...যে তার বাবা এক্সিস ব্যাংক জলপাইগুড়ি ব্রাঞ্চের ম্যানেজার, তার ছোট বোন রিয়া ক্লাস নাইনে পড়ে, মা হাউজ ওয়াইফ ... ইত্যাদি ইত্যাদি। প্রলয়ও তার নিজের সম্পর্কে বললো।
বাড়ি পৌঁছে হিয়া তার মায়ের সঙ্গে প্রলয়ের আলাপ করালো। হিয়ার মা মানুষটি অত্যন্ত স্নেহময়ী। অগত্যা প্রলয়ের যথেষ্ট আপ্যায়ন হলো হিয়ার বাড়িতে।
- সল্টলেকে কোন সেক্টরে যাবেন স্যার ?
- "হ্যাঁ ? ..... সেক্টর টু" - চমকে উঠে উত্তর দিলো প্রলয় ! আবার অজগর কুণ্ডলী দুশ্চিন্তার ধোঁয়া পাকে পাকে গ্রাস করতে লাগলো তাকে। উদ্বিগ্ন স্বরেই বলে উঠলো - "ভাই ! একটু তাড়াতাড়ি চালান না !"
- দেখছেন তো স্যার ... কি জ্যাম রাস্তায় !
সেদিনও কদম-তলার মোড়ে খুব জ্যাম ছিল। উদ্বিগ্ন হয়েই জ্যাম কাটিয়ে সাইকেল চালাচ্ছিল প্রলয়। হিয়ার জ্বরটা বেড়েছে।
কলিং বেলটা টিপে অপেক্ষা করতে লাগলো। পুরোনো দিনের কলিং বেল। ঢিবির মতো গোল, কালো, ওপরে সাদা বোতাম। দেখে মনে হলো ওটা কলিং বেল না, যেন কোনো বুড়ো গায়ে কালো চাঁদর জড়িয়ে, দাঁত বের করে ব্যঙ্গ করছে
-" হিয়াকে দেখার আচ্ছা বাহানা পেয়েছিস তো ? ... এক দিন না দেখে থাকতে পারিস না ... তাই না ?"
- "ওর জ্বর শুনেই তো .... আর তাছাড়া আজকের নোটসগুলো দিতে ...!" - নিজের মনেই আওড়ে উঠলো প্রলয়।
- " প্রলয় !.... এসো বাবা ! ... ভেতরে এসো !" - দরজা খুলেই, সস্নেহে বললেন হিয়ার মা।
- মাসিমা ! হিয়ার জ্বর শুনলাম ... এখন কেমন আছে ও ? ... আজ ক্লাসের নোটস গুলো দিতে এলাম!
- তা বেশ করেছো বাবা ! ... এখন জ্বরটা কম, ও শুয়ে আছে ! ... তুমি ওঘরে যাও ... আমি তোমার জন্য শরবত বানিয়ে আনছি !
মিষ্টি হেসে প্রলয় হিয়ার ঘরে চলে গেলো।
প্রলয়ের এভাবে আসাটা হিয়ারও খুব ভালো লেগেছিলো সেদিন। হয়তো ও-ও প্রলয়কে খুব মিস করছিলো। তাই আর থাকতে না পেরে, ক্লাসের পড়া বোঝার ফাঁকে প্রলয়কে জিজ্ঞেস করেই ফেলেছিলো - "সত্যি করে বলতো, তুই কি শুধু আমাকে পড়া বোঝাতেই এসেছিস ? নাকি ..."
প্রলয়ও মনের কথাটা গোপন রাখতে পারেনি সেদিন হিয়ার কাছ থেকে। ইতস্তত করে বলেই ফেলেছিলো - "রণিতার কাছে শুনলাম তোর জ্বর ... তাই আমার বড্ড চিন্তা হচ্ছিলো রে ... তোকে না দেখে ... মানে ... !"
প্রলয়ের এই কথাতে, আবেগে হিয়ার চোখের পাতা ভিজে গেছিলো সেদিন ! ঠোঁট-জোড়া থিরথিরিয়ে কেঁপে উঠেছিল ! হয়তো নিজের অন্তরটা উজাড় করে দিতে চেয়েছিলো .... কিন্তু পারেনি ও ! জানালা দিয়ে ভেসে আসছিলো এফ.এমের একটা গানের কলি - "মন জানে তুই ছাড়া কি এঁকা লাগে .... কাছে এলে হৃদয়েতে প্রেম জাগে .... তোরই ইশারায় .. আজকাল মন হারায় ... এমন তো হয় নি আগে ...."
মায়াবী সুরের মূর্ছনায়, দুটি হৃদয় যেন নিঃশব্দে মনের কথা বিনিময় করে চললো!
এরপর থেকে ক্রমশঃ গাঢ় থেকে গাঢ়-তর হতে থাকে ওদের বন্ধুত্ব। ওরা প্রায়ই এক সঙ্গে পড়াশুনা করতো। কখনো প্রলয় হিয়ার বাড়িতে, আবার কখনো হিয়া প্রলয়ের। প্রলয়কে হিয়ার মা-বাবা যতটা স্নেহ করতো, হিয়াকেও প্রলয়ের বাড়িতে ততোধিক স্নেহ করতো। সময় বয়ে চললো নিজের গতিতে।
দুজনেই উচ্চমাধ্যমিকে খুব ভালো নম্বর পেয়ে উত্তীর্ণ হলো।
এরপর প্রলয় জলপাইগুড়ি ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজে কম্পিউটার সাইন্স এন্ড ইঞ্জিনিয়ারিংয়ে চান্স পেলো আর হিয়া ভর্তি হলো জলপাইগুড়িতেই পি.ডি. উইমেন্স কলেজে ফিজিক্স অনার্স নিয়ে বি.এস.সি তে।
মোবাইলের রিংটোনটা হঠাৎই কানে ঝাপ্টা মারলো। শান্তনুদার নামটা স্ক্রিনে ভাসছে। ফোনটা ধরতেই ওপার থেকে ভেসে এলো শান্তনুদার উদ্বিগ্ন কণ্ঠ
- "কী রে ? হিয়ার সল্টলেকের ঠিকানাটা পেলি ?
- হ্যাঁ দাদা ! ওখানেই যাচ্ছি ... জানি না .... কপালে কী আছে ?
- অতো চিন্তা করিস না ! ভগবানের ওপর ভরসা রাখ ! হিয়াকে ঠিক খুঁজে পাবি ! ... আর হ্যাঁ ! ... আমাকে আপডেটস দিস ... চিন্তায় আছি রে !
- হ্যাঁ ! দাদা .... জানাচ্ছি ! .... এখন রাখি ?... বাই !
শান্তনুদা প্রলয়ের ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজেরই ছাত্র ছিল। ওর থেকে দুবছরের সিনিয়ার। উইপ্রোতে চাকরি করে ... সিস্টেম এনালিস্ট ... নিউ টাউনে থাকে। ও-ই প্রলয়কে উইপ্রোতে চাকরির ব্যবস্থাটা করে দিয়েছে। এমনকি নিউ টাউনে থ্রি-বিএইচকে ফ্ল্যাটটার ব্যবস্থাও করে দিয়েছে। প্রলয় নর্থবেঙ্গল ইউনিভার্সিটিতে কম্পিউটার সাইন্স এন্ড ইঞ্জিনিয়ারিংএ সেকেন্ড হয়ে, ক্যাম্পাস ইন্টারভিউতে দুটো চাকরি পেয়েছিলো। ক্যালিফোর্নিয়া আর আমস্টারডামের বহুমূল্য চাকরি ছেড়ে, কলকাতায় উইপ্রোতে জয়েন করছে, শুধু মাত্র হিয়ার জন্য ! কলকাতায় হিয়ার পাশে থাকবে বলে .... হিয়াকে বিয়ে করে, ওর সাথে সংসার করবে বলে ! .....ও যে হিয়াকে কথা দিয়ে ছিল সেদিন।
সেদিনটা ছিল প্রলয়ের জীবনের সব চেয়ে বেশি গুরুত্বপুর্ণ .....সব চেয়ে বেশি আনন্দের দিন ! ছোট-বেলা থেকেই ওর স্বপ্ন ছিল কম্পিউটার ইঞ্জিনিয়ার হওয়ার। সেই স্বপ্ন সফল করার প্রথম সোপানে পা রাখতে চলেছিল সে। সেদিন জলপাইগুড়ি ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজে কম্পিউটার ইঞ্জিনিয়ারিংএ তার প্রথম দিন ছিল। তাই সে ঠিক করেছিল, সেই শুভদিনটাতেই হিয়াকে চিরজীবনের জন্য নিজের করে নেওয়ার ..... জীবনসঙ্গিনী করার অঙ্গীকার করবে !
তাই সেদিন ক্লাস সেরেই , বিকেলে কদমতলা থেকে হিয়ার জন্য স্মার্ট ফোনটা কিনেছিলো, নিজের জমানো হাত খরচ থেকেই। উপহার দেবে বলে। তিস্তা গার্ডেনে অপেক্ষা করছিলো হিয়ার জন্য অধীর আগ্রহে। নিজের অন্তরটাকে ওর সামনে উজাড় করে দেওয়ার অপেক্ষা। যদিও ওরা দুজনেই পরস্পরের মনের খবর রাখতো। তবু ভেবেছিলো সেদিন অফিসিয়ালি প্রপোজ করবে হিয়াকে। হিয়া এলো ... কিন্তু মুখটা বিবর্ণ... চোখ-দুটো ছলছল করছে ! বুকে ধুকপুকানি নিয়ে অসহিষ্ণু গলায় প্রশ্ন করলো প্রলয় -"কী রে হিয়া ? ... কী হয়েছে তোর ?"
- "বাবার ট্রান্সফার অর্ডার এসেছে ! কলকাতার ভবানীপুর ব্র্যাঞ্চে ! ... আমরা ... মানে ... আমরা সবাই নেক্সট উইকে চলে যাচ্ছি রে !" - কাঁপা গলায় বলে উঠলো হিয়া.....কান্না যেন ভেঙে আসতে চাইছে। .......বুকের যন্ত্রনাটা যেন গলার কাছে উঠে দলা পাকাচ্ছে !
কথাটা শোনা মাত্র প্রলয়ের সমস্ত বিশ্বব্রহ্মাণ্ড যেন তোলপাড় হয়ে যাচ্ছিলো ! তবুও শান্ত দীঘির ন্যায় স্থির-অচঞ্চল, স্থাণুবৎ, কিংকর্তব্য-বিমূঢ় হয়েই দাঁড়িয়ে রইলো সে ! চোখের কোল থেকে এক ফোঁটা নোনা জল গড়িয়ে পড়লো তার।
নিজের স্নায়ু-পেশী শক্ত করে, অতি কষ্টে কাঁপা গলায় হিয়া বলে উঠলো - "আসবি তো .. প্রলয় ! ... আমাকে বিয়ে করতে ... কলকাতায় ? ... আমি তোর জন্য অপেক্ষা করে থাকবো রে !"
- "আসবো রে পাগলী ! ... আমি ... আমি তোকে বিয়ে করতে .... তোকে ছাড়া আর .... আমি কথা দিচ্ছি ... আমি কলকাতায় ..."- কান্নায় গলা জড়িয়ে গেছিলো সেদিন প্রলয়ের ! শক্ত করে বুকে জড়িয়ে ধরেছিলো হিয়াকে। হিয়ার দুচোখেও শ্রাবণধারা আর বাঁধ মানে নি সেদিন ! প্রলয়কে অশ্রুজলে সিক্ত করে, চুম্বনে চুম্বনে ভরিয়ে তুলেছিল ! হিয়ার উষ্ণ নিঃশ্বাসের স্পর্শ যেন ক্ষণিকের জন্য মাতাল করে দিয়েছিলো প্রলয়কে ! প্রলয়ের কম্পমান ঠোঁট-জোড়া হিয়ার সিক্ত, উষ্ণ ঠোঁটের মাঝে হারিয়ে গেছিলো সেই মুহূর্তে।
- "এই স্মার্ট ফোনটা তোর জন্য ... কলকাতায় গিয়ে যখনই মন চাইবে, আমাকে ফোন করবি !" - একটু ধাতস্থ হয়ে প্রলয় বললো।
- "রোজ ভিডিও কলে কথা হবে আমাদের !" - আবেগ আপ্লুত কণ্ঠে বললো হিয়া !

হিয়া কলকাতায় চলে আসার পর, ওরা থাকতো ফুলবাগানে। দূরত্ব যেন ওদের দুজনের প্রেমের গভীরতাকে আরো বহুগুন্ বাড়িয়ে তুলেছিল......তীব্র-তর করে তুলেছিল ওদের একে অপরের প্রতি আকর্ষণটাকে দিনের পর দিন। গভীর রাত পর্যন্ত চলতো ওদের ভিডিওকলিং। দৈনন্দিন জীবনের খুঁটিনাটী বিষয়ে আলাপচারিতায় বেশ কাটছিলো দুজনের। দুজনেই যেন একেঅপরকে নিজেদের ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র অনুভূতিগুলোকে শেয়ার না করা পর্যন্ত শান্তি পেতো না। কোথা দিয়ে দিন কেটে মাস, মাস কেটে বছর অতিবাহিত হতে থাকলো, তা যেন প্রলয় আর হিয়া অনুভবই করতে পারলো না। ....এতটাই হারিয়ে গেছিলো তারা একে অপরের হৃদয়ের গভীরে।
সত্যিই প্রেমের ক্ষেত্রে একে অপরের হৃদয়ের গভীরে বিরাজ করলে, দূরত্ব যে কোনো প্রভাব বিস্তার করতে পারে না, তার জলজ্যান্ত উদাহরণ এই প্রলয় আর হিয়া।

ফিফ্থ মে জয়েনিং উইপ্রোতে। কলেজের সব পেপার ফরম্যালিটিজ সেরে সাতাশে এপ্রিলই প্রলয় চলে এলো কলকাতায়। এসেই প্রথমে গেলো ফুলবাগানে অনেক আশা নিয়ে। হিয়ার সঙ্গে যখন ফোনে কথা হতো, একদিন ও ওদের ফুলবাগানের ঠিকানাটা দিয়েছিলো। ঠিকানা খুঁজতে অসুবিধে হলো না প্রলয়ের। .... কিন্তু, ওখানে বাড়ির সদর দরজায় একটা বড়ো তালা ঝুলছে ! একরাশ নিরাশার আঁধার মুখে লেপে, আশেপাশে প্রতিবেশীদের বাড়িতে খোঁজ নিলো সে। জানতে পারলো হিয়া-রা মার্চের ফার্স্ট উইকেই সল্টলেকে শিফট করেছে .... কিন্তু ওখানকার ঠিকানা সঠিক ভাবে কেউই দিতে পারলো না। অগত্যা নিরাশার অন্ধকার হাতড়ে, প্রলয় পৌঁছলো শান্তনুদার ফ্ল্যাটে।
শান্তনু এসবের কিছুই জানতো না। কেবল এটুকুই জানতো হিয়া আর প্রলয় একে-অপরকে ভালোবাসে আর হিয়ার জন্যই প্রলয়ের কলকাতায় উইপ্রোতে চাকরি নিয়ে আসা। প্রলয়ের কাছে সব শুনে, খানিক্ষন চুপ করে থেকে, শান্তনু চিন্তিত স্বরেই জিজ্ঞেস করলো - "হিয়ার সঙ্গে তোর শেষ কবে কথা হয়েছে ?"
- গত তিরিশে মার্চ .... রাতে ভিডিও কলে !
- কোনো ঝগড়া-টগড়া হয় নি তো ? .... ওর আবার অন্য কোনো ছেলের সঙ্গে ..
- না না ! হতেই পারে না ! .... আরে সেদিনও তো ভিডিওকলে প্রায় দেড় ঘন্টা কথা হলো ... ও কতো প্ল্যান করছিলো ... আমি জয়েন করলেই, ও নিজে এসে নতুন ফ্ল্যাটটা সাজাবে ... নেক্সট ইয়ার চাকরিতে কনফার্মেশন পেলেই আমরা বিয়ে করবো ... ও কত একসাইটেড ছিল সেদিন ! ... পরদিন থেকেই মোবাইল সুইচ অফ .... !!
- তুই ফেসবুকে কিছু আপডেট দেখেছিস ? ... বা হোয়াটস্যাপ স্টাটাস টা ...
- সব ... সব চেক করেছি ! ... কোত্থাও কোনো ট্রেস নেই .... যেন হটাৎ করে উধাও হয়ে গেছে !
- তাহলে কোথায় গেলো মেয়েটা ! ... কোথায় যেতে পারে ? ...contd