...

3 views

সূর্য-পূজা (পর্ব-১৬)
সুলেখাদেবীর বিতর্কিত বিষয়টি ক্রমশ সত্যি প্রমাণ হল। সুলেখাদেবী প্রথমে মানতে না চাইলেও নানা অছিলায় গোপনে সেই ব্যবসায়ী ভদ্রলোকের সঙ্গে অবৈধ সম্পর্ক বজায় রাখা থেকে বিরত হলেন না। ভুল কখনো ইচ্ছাকৃত হয়না। কিন্তু ইচ্ছা করে একই ভুল বারবার জ্ঞানত পুণরাবৃত্তি করলে সেই বিষয়টি আর ভুলের পর্যায় থাকেনা।
অন্যায় হয়ে দাঁড়ায়। আর এই অন্যায়কে প্রশ্রয় দেওয়া অন্যায় করারই সামিল।

এরই মধ্যে ঋতুরাজ বসন্ত এসে গেছেন। কৃষ্ণচূড়া র রঙে রেঙে আছে প্রকৃতি। সূর্য-পূজার প্রেমকাহিনীতেও এখন ভরা বসন্তকাল।দোলোৎসবের দিন সকালে অনেকদিন পর সূর্য-পূজা আজ কম্পিউটারের সামনে। নেট অন্ করতেই পূজা সূর্যের পাঠানো শুভ দোলোৎসবের শুভেচ্ছার একটা ই-কার্ড পেল। সূর্য নেটে অনলাইন ছিল। অনেকদিন পর চ্যাটে কথা হল ওদের।
সূর্য:"শুভ দোল। happy holi. "
পূজা:" happy holi. আজ সকাল সকাল কম্পিউটারে? "
সূর্য:" আজ তো ছুটি। তোমার পাঠানো পুরাণ কিছু ম্যাসেজ পড়ছিলাম।সত্যি,তোমার ওপরের আস্তরণটা যতটা কঠিন, অন্তর-এর আস্তরণ টা ততটাই নরম। সেই জন্যই বোধহয় তোমার মনে জায়গাটা এত কম সময় পাকা করতে পারলাম আমি।আচ্ছা একটা অনুরোধ করব, রাখবে?"
পূজা:"অনুরোধ! কি বলতো? "
সূর্য:" একদিন দুজনে কলকাতা য় দেখা করবে?এভাবে দূরে থেকে কি সবসময় ভালো লাগে?"
পূজা:"আজ রঙ খেলবে না? "
সূর্য:" আমি তো রঙ খেলিনা। তুমি এলে তবে খেলব।তুমি নিজে হাতে রাঙাবে।
কিন্তু আমার অনুরোধ টা রাখবে কিনা বললে না তো? "
পূজা:" বেশ কাব্যিক হয়ে উঠেছো দেখছি।
দেখা করায় আপত্তি নেই। তবে মাকে জানাতে হবে। "
সূর্য:"মাকে তো আমাদের বিষয়ে তুমি সবই বলেছো। শুধাংশু জ্যেঠুও তো ওনাকে বলেছেন। মা তো আমাদের পাশেই আছেন।"
পূজা:" মা সবটা জানেন। বাবা জানেন না। আমাকে একটু সময় দাও। আমি দেখছি কতটা কি করা যায় এই বিষয়ে। "
সূর্য:" ঠিক আছে। অনেক ক্ষণ কম্পিউটারে আছি। এবার একটু উঠতে হবে। দুপুরে ফোন করব। "
পূজা:" বিকেলে ফোন করো। দুপুরে নয়। "
সূর্য:" যেমন তোমার ইচ্ছা। "

যাজ্ঞসেনীদেবীকে পূজা বিস্তারিত ভাবে সূর্য আর পূজার সম্পর্কে র বিষয়ে সবটুকু বলেছে। যাজ্ঞসেনীদেবী নিজের মেয়েকে খুবই বিশ্বাস করেন।ওদের সম্পর্কে র গভীরতাকে অনুভব করার চেষ্টা করেছেন তিনি।ওনার অনুমতি নিয়েই এপ্রিল মাসের ৮ তারিখ কলকাতার একটা শপিং মলে সূর্য আর পূজা প্রথমবার একান্তে সাক্ষাৎ করার সিদ্ধান্ত নিল।

সূর্য-পূজার এই প্রথম একান্ত সাক্ষাৎ নিয়ে ঘটে গেল একটা বেশ মজার ঘটনা। সকাল ১০টায় কলকাতার একটি শপিং মলে সূর্য আর পূজা দেখা করার সিদ্ধান্ত নিল। সিদ্ধান্ত মতো নির্দিষ্ট দিনে সময়মতো সূর্য কলকাতায় নির্দিষ্ট শপিং মলে পৌঁছে গেল। ওদিকে পূজাও সময়মতো পৌঁছাবার জন্য বাড়ি থেকে বের হল। কিন্তু পূজা কলকাতারই আর এক শপিং কমপ্লেক্স- এ ভুল করে চলে গেল। আসলে আমাদের পূজা সংরক্ষণশীল পরিবারের মেয়ে হওয়ায় কলকাতায় বন্ধু বান্ধবদের সঙ্গে বেশি ঘোরাফেরা করেনি। স্কুল, কলেজ,টিউসন আর বাড়ি এইটাই এতদিন করে আসছে। কিন্তু প্রায় ১১টা বাজতে চলল পূজা দেখা নেই দেখে সূর্য ফোন করল পূজাকে। পূজা কিন্তু তখনও বোঝেনি যে সে ভুল শপিং মলে এসেছে।

সূর্য:"হ্যালো। তুমি কোথায়? "
পূজা:"আমি তো বিগবাজারে। "
সূর্য:"তুমি তাহলে ওপরে এসো। আমি এখানে আছি। দেখতে পাচ্ছো আমাকে? "
পূজা:"না তো। ওপরে যাচ্ছি। দা৺ড়াও।"
পূজা ওপরে গিয়ে সূর্য কে দেখতে পেলনা।
ফোন তখনও দুজনের হাতেই আছে।
সূর্য:"আমি নীচে কাউন্টারে যাচ্ছি। তুমি ওখানে এসো। সহজে দেখতে পাবে আমাকে। "
পূজা নীচে নেমে এল। বছর কুড়ির এক চাইনিজ যুবক ছাড়া আর কাউকে সে দেখতে পেলনা। এবার তার স্তম্ভিত ফিরল।
পূজা:"কই? তোমাকে দেখতে পাচ্ছি নাতো। তুমি কোথায়? "
সূর্য:" আমি তো হাইল্যান্ড পার্কে র বিগবাজারে। এখানেই তো আসার কথা আমাদের। "
সিকিউরিটি কে জিজ্ঞাসা করে পূজা জানল যে সে চিংড়িহাটার বিগবাজারে এসে উপস্থিত।
পূজা:"আমি ভুল করে অন্য জায়গায় চলে এসেছি গো। একটু অপেক্ষা কর। আমি আসছি। "
বেশ নার্ভাস লাগছে পূজার।একটা ট্যাক্সি নিয়ে আরো আধঘণ্টা পর নির্দিষ্ট শপিং মলে পূজা পৌ৺ছাল।
সূর্য পূজার অপেক্ষাতেই ছিল। দুজনের চোখাচোখি হতেই দুজনের মুখেই হাসি ফুটে উঠল।

সূর্য:"সত্যি। কী দুশ্চিন্তায় ফেলেছিলে বলতো? তুমি না কলকাতার মেয়ে? এভাবে ভুল করে ফেললে? "
পূজা:"অনেকক্ষণ অপেক্ষা করতে হল তোমাকে।"
সূর্য:"হ্যাঁ। তা প্রায় দেড় ঘন্টা। যাক্ , খুব খিদে পেয়েছে। ফুড সেন্টারে চল গিয়ে বসি। "
পছন্দমত একটা টেবিলে গিয়ে বসল ওরা দুজন। পূজার পছন্দেই দুই প্লেট দই বড়া এসে গেল দুজনের জন্য। সূর্য পূজা কে একটা পেন আর ক্যাডবেরি দিল। সূর্য পূজাকে দিল তার পছন্দের মিশনের কিছু বই আর সূর্যের পছন্দের একটা আচার। "

প্রথম দেখা তবু মনে হচ্ছে দুজন দুজনকে কত চেনে।
দই বড়া খেতে সূর্য বলল, "বাবা জানেন তুমি আমার সঙ্গে দেখা করতে এসেছো। "
পূজা গম্ভীর হয়ে বলল, "না। জানেন না। বাবা অফিস থেকে ফেরার আগেই আমাকে বাড়ি ঢুকতে হবে। "
সূর্য:" একে তো দেড় ঘন্টা লেট্। আবার যাওয়ার তাড়া!"
পূজা:"কি করি বলতো? sorry.কিন্তু আজ বেশী দেরী করলে মুশকিল। "
সূর্য:" এখানে যদি কেউ দেখে ফেলে আমাদের তোমার অসুবিধা নেই তো?আমার কিন্তু নেই। আমি আমার হবু স্ত্রী হিসেবে পরিচয় করাতে পারব।"
পূজা:"আমারও অসুবিধা নেই। "
বলেই সলজ্জপূর্ণ হাসিতে চোখ নামাল পূজা। আরও কিছুক্ষণ গল্প করার পর মলের এদিক ওদিক একটু ঘুরতে ঘুরতেই বিকেল হয়ে এল। পূজার বাড়ি ফেরার ব্যস্ততা দেখে সূর্য ওকে বাড়ি অবধি পৌঁছে দেওয়া র সিদ্ধান্ত নিল। পূজা বাধা দেওয়া য় বলল,"আবার যদি ভুলে অন্য কোথাও চলে যাও। ভিড় বাসে যেতে পারবে না তুমি। আমি ট্যাক্সি করে ছেড়ে দিয়ে আসি তোমাকে। "

ট্যাক্সিতে যেতে যেতেও কথা যেন শেষ হয়না ওদের। মিষ্টি প্রেমের এই সাক্ষাৎ দুজনেরই মনে আড়লন সৃষ্টি করেছে। বাড়ির কাছে পূজাকে নামিয়ে দিয়ে ফিরে আসার সময় সূর্যের এক অদ্ভুত মন খারাপের অনুভূতি হল। যতদূর চোখ যায় দুজন দুজনকে হাত নেড়ে বিদায় জানাল। ভারাক্রান্ত মন নিয়ে ফিরে এল পূজাও। এসেই ম্যাসেজ করলে, "বাস পেয়ে জানিও। পৌঁছে ম্যাসেজ করুন। সাবধানে যেও। "

সুলেখাদেবী হঠাৎ ই একদিন ফোনে কথা বলতে চাইলেন পূজার সঙ্গে। সৌজন্যমূলক কথাবার্তা ই শুধু হল সেদিন।
এরপর জামাই ষষ্ঠী র দিন যাজ্ঞসেনীদেবীর সঙ্গেও সূর্যের সৌজন্যমূলক প্রথম কথা হল ফোনে। শুধাংশু বাবুর চেম্বারে সূর্যের ভাইয়ের সঙ্গেও কাকতালীয়ভাবে দেখা ও কথা হল। পূজার দাদা পার্বণে র সঙ্গে আগেই এগরায় দেখা হয়েছিল সূর্যের।পূজার বাবা, কমলবাবুও যাজ্ঞসেনীদেবীর কাছে জেনেছেন এই বিষয়ে। কালক্রমে সরোসিজবাবুর কানেও সুর্য-পূজার সম্পর্কে র বিষয়টি বিপুলাদেবীর মাধ্যমে পৌঁছল।এভাবেই সূর্য-পূজার প্রেম কাহিনী এক এক করে এবার পরিবারের সকলেরই চর্চিত বিষয় হয়ে উঠল।
এরমধ্যে আরও দুইবার সূর্য পূজা কলকাতা য় দেখা করেছে। শুধাংশুবাবুর চেম্বার,ভিক্টোরিয়া, বিগ বাজার একসঙ্গে ঘুরে বেড়িয়েছে।


এভাবে কেটে গেল আরও দু-তিনমাস ।
সুলেখাদেবী আর সূর্যের মধ্যে সেই ব্যবসায়ী ভদ্রলোকটিকে নিয়ে অশান্তি তুঙ্গে উঠল।
সুলেখাদেবীর এই স্বচ্ছাচার সূর্যের পক্ষে মেনে নেওয়া সম্ভব ছিল না। পূজার পক্ষে তো প্রশ্নই ওঠেনা এসব মেনে নেওয়া। তাই অন্যত্র স্থায়ী ঠিকানা র সন্ধান কথার জন্য মনস্থির করল সূর্য। অবশেষে জন্মাষ্টমীর শুভক্ষণে মায়ের সংসার ছেড়ে সূর্য তার নতুন জীবনের লক্ষ্যে পা বাড়াল। সুলেখাদেবীও বাধা দিলেন না। বড় ছেলে ঘরে থাকলে তার সাথে মতবিরোধ হওয়ায় সুলেখাদেবী এই সিদ্ধান্ত সাগ্রহে মেনে নিলেন।
দা৺তনে তার অফিসের কাছেই একটা মেসে বসবাস শুরু করল সূর্য।অফিস যাতায়াতও এবার সুবিধা হল। তবে সুলেখাদেবী কিন্ত সূর্যের এই নতুন ঠিকানা ও জীবনযাত্রা নিয়ে চিন্তিত ছিলেননা। ছেলের খোঁজও সেভাবে নিতেন না। সপ্তাহান্তে সূর্য মাঝে মাঝে মায়ের কাছে যেত।ভাইয়ের সাথে কথাবার্তা হত। কিন্তু সূর্য-পূজার ভবিষ্যৎ স্থায়ী বা অস্থায়ী ঠিকানা হিসেবে সুলেখাদেবীর এই বাড়িটিকে আর কখনো উল্লেখ করতে চাইবেনা এই দৃঢ় সিদ্ধান্তটি সূর্য নিয়ে নিয়েছে ইতিমধ্যেই।সূর্য বরাবরই জানত কর্মসূত্রে তার সংসার জীবন ওই বাড়িতে স্থায়ীভাবে সম্ভব ছিল না। এক্ষেত্রে সুলেখাদেবীও তার ছোট ছেলের ওপরই মানসিক ভাবে আগের থেকেই বেশি নির্ভরশীল।তাই সূর্য আর বিলম্ব না করে দুমাস পরেই একটি বাসা ঘরের খোঁজ করতে শুরু করে দেয় দা৺তনে। তার এই নতুন সফরে সে যেন আর একা নয়।পূজার বিশ্বাস আর ভালোবাসা তার মনের জোর হয়ে তার সঙ্গে সবসময় আছে।






© বুনানী