...

0 views

করোনা ভাইরাস
― যা ভাই, এবার অন্তত বলে দে, কতোদিন আর এইভাবে চালাবি?
― না রে, কী যে বলিস তোরা, ও জানলে আমাদের বন্ধুত্বটাও আর টিকবে না, কত্ত দেখলাম এর আগে...কুনাল,সৈকতের মতো হ্যান্ডসাম ছেলেদেরও ও রিজেক্ট করে দিয়েছে...
― আরে ধুস! তুই ওদের থেকে অনেক আলাদা আর তাছাড়া কত হেল্প করে বলতো মেহুল তোকে, আর তুইও তো ওর কত হেল্প করিস―তোরা যেন একে অপরের পরিপূরক বুঝলি, যা যা আর দেরি না করে এবার প্রপোজ টা করেই ফেল..
― বলছিস? করে দেব? আর যদি না হয়?
―আরে হবে হবে, সব হবে আর তাছাড়া তুই হলি আমাদের ক্লাসের টপার..তোকে রেজেক্ট করবে এমন সাদ্ধি কার আছে বলতো? কাল কলেজে গিয়েই ওকে তোর মনের কথাটা বলে ফেল বুঝলি?
কলকাতার একটা বেসরকারি ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজের ফাইনাল ইয়ারের ছাত্র অঞ্জন। মা বাবার একমাত্র সন্তান। বাবার বড় ইচ্ছে ছেলে তার বিদেশে গিয়ে চাকরি করবে, ছেলের কাছ থেকে বিদেশের সব গল্প শুনবে আর তাছাড়া অফিসের আর পাঁচটা লোকজনের কাছে ফ্রান্স, জার্মান, প্যারিস, লন্ডন এসবের গল্প বললে গল্পের স্বাদটাই যেন অন্যরকম হয়। বাবা একটা বেসরকারি অফিসে চাকরি করে। আর হয়তো বড়োজোর তিন থেকে চার বছর চাকরি আছে, আর তারপরেই রিটায়ারমেন্ট। তাই মা বাবার একমাত্র আশা ভরসা সবই অঞ্জন আর তাই তার একমাত্র লক্ষ যে করেই হোক একটা চাকরি জোগাড় করা, তবে সে চিন্তা আর নেই―আগের দিনই কলেজের ক্যাম্পাসিংএর একটা মাল্টিন্যাশনাল কোম্পানির ইন্টারভিউ তে অঞ্জন সিলেক্টেড হয়েছে, তবে পোস্টিং কোথায় হবে সে'ব্যাপারে ওরা এখনো কিছু জানায় নি, আর প্রায় একমাস পরেই জানাবে বলেছে।
অঞ্জনের ক্লাসমেট মেহুল। গত দু' মাস ধরেই অঞ্জন তার প্রেমে পাগল। মেহুল ও তাকে খুব ভালোবাসে তবে দু'জনের মধ্যে কেউই সাহস করে বলে উঠতে পারছেনা তাদের মনের কথাটা। একদিন সকালে উঠে অঞ্জন ভেবেই নেয় যে সে মেহুলকে আজই মনের কথা টা বলে দেবে।
সেদিন কলেজে গিয়ে দেখে মেহুল করিডোরে দাঁড়িয়ে। বুকে একরাশ সাহস নিয়ে অঞ্জন তার কাছে গিয়ে,
― মেহুল, তোকে আমার কিছু বলার ছিল আর আশা করি তুই জানিস আমি তোকে কি ব্যাপারে বলবো...
(একটু লজ্জা পেয়ে আর কিছুটা আগ্রহী হয়ে মেহুল উত্তর দেয়,)
― কি ব্যাপারে..
―তুই রাগ করবিনা বল আগে, তাহলেই বলবো...
― আরে না না, বল না রে
(কিছুক্ষন দু'জনেই চুপ, তারপর আবার মেহুলের গলা,)
― কি হলো রে, বল কি বলবি, এবার তো ক্লাস শুরু হবে..
―আসলে...
―কি...
―আমি তোকে বড্ড ভালোবাসি রে মেহুল, প্লিজ মেহুল, আমাকে তোর যা ইচ্ছে তুই বল কিন্তু আমাদের বন্ধুত্ব টা নষ্ট করিসনা রে..
কথা টা শুনে মেহুলও খুব খুশি হলো, আর কেনই বা খুশি হবেনা, সেও ঠিক এরকম কথাই যে আশা করেছিল অঞ্জনের কাছ থেকে, তার মনেও জমে ছিল অঞ্জনের প্রতি একরাশ ভালোবাসা। কথা টা শুনে লজ্জায় গাল দুটো লাল হয়ে গেছে মেহুলের..মুচকি হেসে অঞ্জনকে বললো,
― আমিও তোকে খুব ভালোবাসি রে অঞ্জন, কিন্তু কিভাবে বলব কথাটা তা বুঝে উঠতে পারিনি রে...
এখন দু'জনেই যেন মনের দিক থেকে অনেকটা হালকা। মেহুল যে কখন একজনের বন্ধু থেকে প্রেমিকা হয়ে উঠবে সে নিজেও ভাবতে পারেনি। এরপর শুরু হয় তাদের চ্যাটিং, ফোনে কথা বলা, রাত জাগা―আর এভাবেই একমাস পেরিয়ে যায়।
একদিন কলেজে গিয়ে অঞ্জন জানতে পারে তার পোস্টিং মেরিলেবোনে―লন্ডনের কাছাকাছি একটা শহর। দশ দিন পরেই ফ্লাইট আর তার পরের দিনই জয়েনিং। টিকিটের ব্যাবস্থা কোম্পানি থেকেই নাকি করে দিয়েছে। খবরটা শুনে একদিক থেকে অঞ্জনের বাবা মা যেমন খুশি ছিল তেমনই ছেলেকে এতদূরে পাঠানোর জন্যে দুশ্চিন্তাও হচ্ছিল খুব। মেহুলের কাছেও খবর টা খুব একটা আনন্দের ছিল না, তবে একটু হলেও আনন্দ হচ্ছিল এই ভেবে যে তার প্রেমিক বিদেশ যাবে। এবার থেকে একদমই বন্ধ হয়ে যাবে তাদের দেখা সাক্ষাৎ, বন্ধ হবে কলেজ থেকে ফেরার পথে রাস্তার মোড়ে শ্যামলদার দোকানে একসাথে চা খাওয়া। তাই সেদিন খবর টা শুনে মেহুল খুব কেঁদেছিল।
ন'দিন পেরিয়ে যায়। আজ সকাল থেকেই অঞ্জনের খুব মন খারাপ। কালই ছেড়ে চলে যেতে হবে সবাইকে। রাতে মেহুলের ফোন―
― কি রে সব নিয়েছিস তো ঠিক করে?
―হমম্...
―কাল তো ফ্লাইট..
―হমম্...
―বিদেশ গিয়ে আমায় ভুলে যাবি না তো?
―না রে, তোকে কি কখনো আমি ভুলতে পারি?
―এখন বলছিস, কিন্তু পরে ভুলে যাবি জানি...কত সুন্দরী সুন্দরী মেয়ে থাকবে ওখানে, তারপর কাজেরও চাপ থাকবে...তখন কি আর আমাকে মনে রাখবি বল...
―চুপ কর তো, তোর সবসময় উল্টোপাল্টা কথা..
―ঠিক আছে। খাবার খেয়েছিস?
― না খাব..
―ঠিক আছে, তাহলে খেয়ে শুয়ে পড়বি। কাল তো সকাল সকাল যেতে হবে...
―হমম্..গুড নাইট।
― ওকে গুড নাইট।
পর দিন সকাল ন'টা পঁয়তাল্লিশে অঞ্জনের ফ্লাইট। ছেড়ে যেতে হবে বাবা -মা কে, ছাড়তে হবে তার মেহুলকেও। সেদিন অঞ্জনের বাবা মা তাকে এয়ারপোর্টে ছাড়তে আসে। মায়ের চোখে জল। বেরোনোর সময়ই অনেক কান্না কাটি করেছিল তাই কান্না টা এখন যেন বুকের মধ্যে থমকে গেছে...আর হবে নাই বা কেন, একমাত্র ছেলে বলে কথা, দেশের মধ্যেই দূরে কোথাও গেলেই মায়েদের কষ্ট হয়, সন্তানদের ছাড়তে খারাপ লাগে আর এ তো বিদেশ―কষ্ট তো হবেই। বাবা মা কে প্রনাম করে অঞ্জন বললো,
― আসছি, আর আমাকে নিয়ে তোমরা একদম চিন্তা কর না, জানি চিন্তা হবে কিন্তু ছুটি পেলে আমি তো আবার আসব নাকি...একেবারেই কি চলে..
অঞ্জনের কথাটা শেষ হতে না হতেই তার মুখে হাত দিয়ে কথা বলতে বাধা দেওয়ার মতো করে তার মা বললো,
―না বাবা, ওরকম কথা বলতে নেই , ওসব আবার কী কথা?
― আচ্ছা আর বলবনা, এখন একটু হাসো দেখি, দেখো তোমার ছেলে কেমন বিদেশ যাচ্ছে..বাবা তুমি মা কে দেখবে তো যেন আর আমাকে নিয়ে দুশ্চিন্তা না করে...আহা: আবার কাঁদছো কেন...
মায়ের চোখের জল মুছে দিয়ে অঞ্জন বললো,
―এই দেখো, এরকম করে তুমি যদি কাঁদতে থাক তাহলে আমি যাবো কি করে বলতো...আমি তো ফোন করব নাকি...
অঞ্জনের বাবা বললো,
―তোর মা যতক্ষণ এখানে থাকবে ততক্ষণ এভাবেই কাঁদবে, তাই আমরা বরং এবার আসি বুঝলি, তুই সাবধানে যাস, আর প্লেনে তো তোকে ফোনে পাবনা তাই ওখানে নেমে ফোন করিস...
অঞ্জনের বাবা ওর মাকে নিয়ে চলে যায় আর রঞ্জনও রওনা দেয় মেরিলেবনের উদ্দেশ্যে।
প্রায় ছ'মাস কেটে যায়। যে ছেলে একদিনও তার বাবা মা কে ছেড়ে কোথাও যায়নি, সে আজ টানা ছ'মাস বাড়ি থেকে দূরে। কাজের চাপে এখন ফোন টাও আর নিয়মিত হয়না তার মা বাবার সাথে। মেহুলকেও আগের মতো আর ফোনে সময় দিতে পারেনা অঞ্জন। যখনই কথা হয় তখন আগের একসাথে কাটানো মুহূর্তগুলো, সেই প্রেমে পড়ার ঘটনা, একসাথে চা খাওয়া এসব দু'জনে মনে করে আর কাঁদে। এখন তাদের সদ্য গড়ে ওঠা প্রেম সম্পর্ক টা যেন একটা লঙ ডিস্টেন্স রিলেস্যানশিপে পরিণত হয়েছে।
কয়েকদিন ধরেই অঞ্জন সোশ্যাল মিডিয়া থেকে জানতে পারে চীনে করোনা নামের একটা মারণ ভাইরাস আবিষ্কার হয় এবং সেটা চীন সহ আশেপাশের আরও কিছু দেশে ছড়িয়ে পড়ে, লন্ডনের দিকে তখনও সেরকম কিছু খবর শোনা যায়নি, এরপর হটাৎ একদিন অঞ্জনের বাবার ফোন,
― বাবা, তুই ঠিক আছিস তো, শুনেছিস তো করোনা হচ্ছে চারিদিকে, সাবধানে থাকিস কিন্তু, আর বাইরে যখনই বেরোবি সবসময় মাস্ক অবশ্যই পরে থাকবি কেমন?
―হমম্ বাবা, এখানে তো আসেনি এখনো সেই ভাইরাস...
(ফোন টা হয়তো তখন লাউডস্পিকারে ছিল, তাই তার মায়ের গলাও পাস থেকে শোনা গেল)
―তোকে অত দেখতে হবেনা, বাবা যেটা বলছে সেটা শোনো...কম চিন্তা হয় তোকে নিয়ে আমাদের বলতো?
পাশ থেকে বাবা আবার বললো,
― ও এখন বুঝবেনা বাবা মায়ের কিরকম চিন্তা হয় সন্তান যখন বাইরে থাকে, যেদিন ছেলের বাবা হবে সেদিন বুঝবে...
কিছুক্ষন কথা বলে কথা শেষ করার পর নিজের কর্মব্যস্ততায় আবার ব্যস্ত হয়ে পড়ে অঞ্জন। আর এইভাবে কিছুদিন কেটে যায়। হঠাৎ একদিন মেহুলের ফোন,
―কি রে তোকে যে কাল বিকেলে বললাম স্যানিটাইজার কিনতে, কিনেছিস?
― না, মানে..
― না মানে? কিনিসনি তো? জানতাম তো আমি তুই কিনবিনা...
― আচ্ছা আজই কিনে নেব...
―এরকম করে কতদিন চালাবি বলতো?
― আহা বললাম তো আজই কিনে নেব।
এই বলে অঞ্জন ফোন রেখে দেয়। অঞ্জনের এরকম গা ফিলতি দিনের পর দিন চলতেই থাকে আর চার পাঁচ দিনের মধ্যেই সেই করোনা ভাইরাস ঢুকে পড়ে লন্ডনে, এমনকি সেটা মেরিলেবনেও পৌঁছায়। আক্রান্তের সংখ্যা প্রথমে দুই ― তারপর দুই থেকে কুড়ি― কুড়ি থেকে দু'শো―এইভাবে বাড়তে থাকে।
হঠাৎ করেই অঞ্জন লক্ষ করে গা টা যেন জ্বর জ্বর লাগছে...সেদিন দিনে দু'টো প্যারাসিটামল খেয়েছিল তারপর দিন আর আসেনি কিন্তু দু'দিন পর আবার জ্বর আসে আর সঙ্গে কাশিও শুরু হয়। প্রথমে ব্যাপার টা অতটাও সিরিয়াসলি নেয়নি সে,ভেবেছিল ঠান্ডা লেগে গেছে হয়তো। প্রায় একসপ্তাহ এইভাবে কাটানোর পর একদিন হটাৎ শ্বাসকষ্ট শুরু হয় আর শরীর টাও ভীষণভাবে দুর্বল হয়ে পড়ে। বাড়ি থেকে ফোন আসে কিন্তু রিসিভ করা হয়না। সকাল থেকে মেহুলেরও ফোন এসেছে অনেকবার। এম্বুলেন্স আসে আর তাকে ভর্তি করা হয় মেরিলেবনের নাইটিংল হসপিটালে। ধরা পড়ে তার করোনা পসিটিভ আর দু'দিন পরেই অঞ্জন মারা যায়।
অঞ্জন যেমন ছিল তার মায়ের একমাত্র সন্তান, সেরকমই অপরদিকে ছিল মেহুলের প্রথম প্রেম। শুধুমাত্র একটু সতর্কতা আর সাবধানতার অভাবে এই ভাইরাস এইভাবেই কত কত বাবা মা কে সন্তান হারা করছে আর ধ্বংস করছে অঞ্জন-মেহুলের মতো প্রেম সম্পর্ককেও। তাই এই গল্পের সমস্ত পাঠকদের কাছে আমার অনুরোধ, আপনারা সবাই সাবধানে থাকুন আর পরিচ্ছন্ন থাকুন। ধন্যবাদ । জয় ভারত।
© শিলালিপি