আমরা দুজন ♡
কোপাইয়ের পাড়ে এসে বসেছে সুরঙ্গনা আর সুমেধা। সবে বিকেল,খোয়াইয়ের হাটে ভীড় বাড়তে শুরু করেছে। বৈশাখের তীব্র গরমটা যদিও নেই,ঈশাণ কোণে মেঘ জমছে। গতকাল বিকেলেই সুরঙ্গনা শান্তিনিকেতন এসে পৌঁছেছে , সোনাঝুরী টুরিস্ট লজেই উঠৈছে, প্রতিবার যেমন উঠে। রোজকারের অফিস,অ্যাসাইনমেন্ট,ক্লায়েন্টমিটের একঘেয়ে রুটিনে হাফিয়ে উঠলেই সুরঙ্গনা পালিয়ে চলে আসে এখানে। দুম করেই ডুব মারে অফিসে। নেহাৎ বস ভদ্রলোকটি ভালো আর তাছাড়া সুরঙ্গনার ক্রিয়েটিভ রাইটিংএর এফিসিয়েন্সি, চাকরিটা তাই বেঁচে আছে। আর একজন আছে যে এখনও তাকে প্যাম্পার করে—সুমেধা। সুমেধা বোলপুর কলেজে ইতিহাস পড়ায়। বছর তিনেক আগে পৌষমেলায় সুরঙ্গমার সাথে আলাপ হয়। তারপর বন্ধুত্ব। সম্পর্কটা ক্রমে গভীর হয়েছে। সুরঙ্গমা শান্তিনিকেতনে আসলে সুমেধাও কলেজ ছুটি নেয়। সময়টুকু একসাথেই কাটায়। কাল একসাথে উত্তরায়ণ, শ্যামলী সব ঘুরেছে। রাতেও সুমেধাকে হোস্টেলে ফিরতে দেয়নি সুরঙ্গনা। আজ হাটে ঘুরবে,বাউল শুনবে,কতকিছু কিনবে।
ততক্ষণে একটু হাওয়া উঠেছে। সুমেধার চুল উড়ে এসে পড়ছে সুরঙ্গনার মুখে। সুমেধা মাথাটা হেলিয়ে দিল সুরঙ্গনার কাঁধে।
— রবি ঠাকুর এই কোপাই নদী নিয়েই লিখেছিলেন “আমাদের ছোটনদী চলে আঁকে বাঁকে”। তাই না রে সুমেধা?
—তেমনই অনেকে বলে। কিন্তু অনেকে যেটা বলেনা সেটা হল,রবি ঠাকুর আমাদের না দেখেও যেটা লিখেছিলেন।
—কোনটা?
—ওই যে,আমাদের সেই গাঁয়ের নামটি অঞ্জনা।
—কিন্তু আমরা দুজন যে এক গাঁয়ে থাকি না।
— সেই আমাদের একটিমাত্র দুঃখ ।
—তুই,পারিসও। চলে আয় না কোলকাতায়। আমরা একসাথে থাকব। হোম লোন নেব,ছোট্ট একটা ফ্ল্যাট হবে। একসাথে অগোছালো করে রাখবো। নন্দনে মুভি দেখব,প্যারামাউন্টে ডাবের সরবৎ খাবো, প্রিস্সেপঘাটে নৌকা চড়ব।
—আর খোয়াইয়ের অন্য দিনের হাট, তার কি হবে?
—কেন হবে না। উইকএন্ডে চলে আসব। পৌষমেলায় আসবো,২৫শে বৈশাখ আর বসন্ত মেলাতেও আসব। কোলকাতায় থাকলে নাইট ক্লাবেও যাবো কিন্তু।
—ওতে আমি নেই। আমার কাছে সব উঠোনই বাঁকা। তোর ওসব বাঁদরামির জন্য আমি কোলকাতা যাবো না।
—ওরম বলে না বেবি। তোর ওই সেক্সি কোমরের ঠুমকা,নিওনের আলোয় দেখার জন্য হা পিত্যেস করে থাকি।
—তুই দিন দিন অসভ্য হয়ে যাচ্ছিস।
—লোভী হয়ে গেছি। তোর ক্লিভেজ, স্পষ্ট
ন্যাভাল আমাকে পাগল করে দেয়।
—কাল সারারাত তুই জ্বালিয়েছিস। আজ হোস্টেলে ফিরে যাব।
—এই দুদিন আমার।
—আবদার!
—তোর কি বয়ফ্রেন্ড জুটেছে?সাবধান বলছি। হেব্বি ক্যালাবো।
—আমায় পরে ক্যালাবি,বৃষ্টি শুরু হয়েছে। চল উঠে পড়ি।
—রেস্ট হাউস অবধি যেতে যেতে পুরো ভিজে যাবো।
বিদ্যুৎ চমকালো হঠাৎ । মেঘ ডাকার আওয়াজে চমকে উঠে সুমেধা। ঝড়ও শুরু হয়েছে। দৌড়ে একটা বন্ধ দোকানের ছাওনির তলায় ঢোকে দুজনে। বৃষ্টি বেড়েই চলেছে। বাড়ছে ঝড়ের দাপটও। ছাওনির তলায় থাকলেও ঝাপটায় পুরো ভিজে গেছে দুজনেই। সুরঙ্গনা জিন্সের পকেট থেকে মোবাইলটা বের করল।
—সাতটা বাজতে যায়।
—আমরা হাট থেকেও বেশ খানিকটা দূরে।
—উঃ তোকে ভিজে কি দারুন লাগছে।
সুমেধাকে জাপটে ধরে সুরঙ্গনা। ভিজে টি-শার্টের তলায় সুরঙ্গনার বুক উত্তেজনায় কাঁপছে। সুরঙ্গনার আঙুল খেলা করছে সুমেধার খোলা পিঠে। সুরঙ্গনার গরম নিঃশ্বাস এসে পড়ছে সুমেধার মুখে। আবেগে সুমেধার চোখ বন্ধ হয়ে আসছে । সুরঙ্গনার ঠোট ছুঁয়েছে সুমেধাকে। তীব্র বিদ্যুতের ঝলকানিতে চমকে উঠলো দুজনেই। ছাওনির কিছুটা ভেঙে পড়ল হুড়মুড় করে। জলের স্রোত বয়ে চলেছে মাটির পথ কেটে। কি যেন একটা গায়ের এসে পড়ল।আৎকে উঠল সুমেধা।
—কি এটা ?
একটা প্যাকেট। ব্রাউন পেপারের খাম,তবে ভিজে গেছে। প্যাকেটের ভেতর কিছু কাগজপত্র আছে। সুরঙ্গনা নিচু হয় প্যাকেটটা কুড়োতে।
—ছাড় না কি না কি আছে।
—ছেড়ে দেব মানে?ওই তো কালপ্রিট,মুডটা নষ্ট করে দিল। আর হতেও তো পারে দারুন কিছু পেলাম!
—কবির লুকোনো চিঠি নাকি গুপ্তধের দলিল?
—তুই না ইতিহাস পড়াস। হতেও তো পারে অমূল্য কিছু।
— আলবাৎ পারে। গোয়াল ঘরের মাচা থেকে যদি শ্রীকৃষ্ণ কীর্তন কাব্য আবিষ্কার হতে পারে তবে ভাঙা দোকান থেকেও কোন মহাকাব্য আবিষ্কার হতে দোষ কোথায়।
সুমেধার ঠাট্টায় পাত্তা না দিয়ে প্যাকেট টা কুড়িয়ে নেয় সুরঙ্গনা। বৃষ্টি কমতে সন্ধ্যে গড়িয়ে যায়। সুমেধার আর হোস্টেলে ফেরা হয় না। সুরঙ্গনার সাথে টুরিস্ট লজেই আসে। ঝড়ে ইলেকট্রিক গেছে। লোডশেডিং,জেনারেটরও ফেল করেছে। মোমবাতির হলদেটে কাঁপা কাঁপা আলোয় বিছানায় গা এলিয়ে দিয়েছে দুজনে। গরমটা একদমই নেই,বরং জোলো হাওয়া বইছৈ। গুনগুন করে গান গাইছিল সুরঙ্গনা। প্যাকেট টা আর খোলা হয়নি। সুমেধা নিজেই হঠাৎ করে পাশ ফিরল। পাশ বালিশের মতন জড়িয়ে নিল সুরঙ্গনাকে।
—আমাদের রিলেসনটা ফিউচারলেস,তাই না রে।
—কেন,এমন বলছিস?তোর ট্র্যান্সফারটা হয়ে যাক। উই উইল লিভ টুগেদার।
— বাড়িতে মানবে না। জানিস, বাড়ির লোক আমার জন্য বর খুঁজছে।
—তাতে কি,স্ট্রেট বলে দে।
—কি বলব? আমি লেসবিয়ান। আমার গার্লফ্রেন্ড আছে। আর তারপর কি হবে,ভাবতে পারিস?
—নিজের সাথে হিপোক্রেসি করিস না। শরীর বা মন,কোন দিক দিয়েই তুই কোন ছেলেকে অ্যাক্সেপ্ট করতে পারবি?
—না। তবুও বাড়িতে মানবে না। হয়ত জানলে সম্পর্কই রাখবে না।
—কেন,তুই কি ক্রাইম করছিস? আর তাছাড়া হোমোসেক্সুয়ালিটি ইললিগ্যাল নয়। তুই ইলিয়াড পড়িসনি? লেসবস দ্বীপের কথা জানিস না,তুই? এত আজকের নয়। এই ট্যাবু আমরা তৈরি করেছি। আমি কি ভালবাসবো সেটা আমার একান্তই আপন।
—সেটা সমাজ মানে না।
—ফাক ইউর সমাজ। তুই নিজেরটা বল। রাতে বয়ফ্রেন্ড বা হাসব্যান্ডের ওই ব্লাডি কক্ পুরে আদর খেতে ইচ্ছে করলে বল,আই উইল লিভ ইউ।
—রাগ করিস না। আমি তা একবারো বলিনি। আমিও চাই একসাথে থাকতে। আমি,দুজনেই ইকনোমিক্যালি সেটেলড,ইন্ডিপেনডেন্ট। আমরা একসাথে থাকতেই পারি। কিন্তু
— কিন্তু কিসে।
— সবাই জানে আমরা বন্ধু,কেউ কিছু ভাবে না। কিন্তু যখনই তুই সত্যিটা জানাবি দেখবি সবার ভুরু কুঁচকে গেছে। আমার কলেজের কোলিগরাই হয়ত ডেপুটেসান দেবে,আমাকে কলেজ ছাড়া করতে। তোর অফিসেও দেখবি একই জিনিস। কাজের মাসি থেকে,লিফ্টম্যান সব্বাই ঘেন্নার চোখে দেখবে। তুই ঘুষ খেতে পারিস,ট্যাক্স ফাঁকি দিতে পারিস তাও সবাই মেনে নেবে কিন্তু যৌনতার অভ্যেসটা স্ট্রেইট হতেই হবে।
—তবে মেনে নে। এইভাবেই থাক। আর তোর লেকচার থামা,ঘুম পাচ্ছে।
—এই যে বললি, রাতটা তোকে দিতে।
সুমেধার শরীর মিশে যেতে থাকে সুরঙ্গনার শরীরে। সুমেধা জানে সুরঙ্গনার রাগ কিভাবে কমে। ভিজে উঠে দুজনেই। দমকা হাওয়ায় নিভে যায় মোমবাতি।
তখন মাঝরাত। সুরঙ্গনা অঘোরে ঘুমাচ্ছে। লোডশেডিং চলছে। প্যাকেটাতে কি আছে সুমেধা জানে। সুরঙ্গনা উঠে পড়ার আগেই পালটে দিতে হবে প্যাকেটের সব কাগজ। তবু ভীষণ অপরাধী মনে হচ্ছে নিজেকে। সুরঙ্গনাকে ঠকাচ্ছে। সত্যিটা এবার বলে দিতেই হবে।
ভোর হতে না হতেই ঘুম ভেঙে যায় সুরঙ্গনার। বিছানা খালি। সুমেধা নেই। কোত্থাও নেই। মেঝেতে ছড়িয়ে ছিঠিয়ে আছে সুরঙ্গনার অন্তর্বাস । সুমেধার মোবাইল ও সুইচড অফ। কিচ্ছু মাথায় আসছে না। রুমের দরজায় কে যেন নক করল। বেয়ারা।
—দিদিমনি ভোর হতেই চলে গেলেন,আর আপনাকে এই চিঠিটা দিয়ে গেছেন। আপনার চা পাঠিয়ে দেব?
—পরে দিও। তুমি যাও।
বিছানায় ফিরে আসে সুরঙ্গনা। চিঠিটা খোলে।
সুরঙ্গনা,
আর হয়ত দেখা হবে না। তোর সামনে দাঁড়িয়ে সবটা বলার সাহসও আমার ছিল না। কিন্তু এরপর বড্ড দেরি হয়ে যেত। আমি লেসবি নই। কোনদিন ছিলামও না। তোর মধ্যে একটা নির্ভরতা পেতাম যেতাম আমার নিছক মেয়ে মানুষ হৃদয় আঁকড়ে ধরতে চাইত। সেভ ফিল হোতো কিন্তু বিশ্বাস কর আর একটা মেয়ের স্তনের ঔদ্ধত্য বা যোনির গন্ধ নয়,একজন সত্যি পুরুষের আদরই আমার পছন্দ। তোকে কনভিনসড করতে হলে একটু পিছনে ফিরে যেতে হবে।
বছর পাঁচেক আগের ঘটনা। অনিন্দ্য এল কোলকাতা থেকে। আমার কলেজেই ইংরেজি পড়াতে। আমাদের প্রেমও হল। আমাদের ফিজিক্যাল রিলেসনও ছিল। কি ভালো আবৃত্তি করত। বিদেশি মুভি দেখতো আর আমাকে ইন্টারপ্রেট করত। বড়লোকের ছেলে,দারুন সপ্রতিভ। আমি ভেসে গেলাম। সেদিনও খুব বৃষ্টি হচ্ছিল। ওই ভাঙা দোকানঘরটাতেই আটকে পড়লাম আমরা। সারারাত ধরে চলেছিল বৃষ্টি। অনিন্দ্য জড়িত ছিল এক অতি বাম আন্দোলনেড় সাথে। ওই দিনই আমায় জানিয়েছিল সেকথা। গর্ব করে বলেছিল ওদের আদর্শ আর সমাজকে পাল্টে দেওয়ার গল্প। ওই রাতে যখন খড়ের চাল ফুটো হয়ে নামছিল বৃষ্টির জল আমরা মেতে ছিলাম আদিম আনন্দে। রাত তখন গভীর। হঠাৎ শুনি বাইরে জটলা। জনা তিনেক মাতাল কাক ভেজা হয়ে নিজেদের মধ্যে হল্লা করছে। ওরা দেখেছিল আমাদের। তারপরটা হয়ত আন্দাজ করতে পারছিস,তবু বলছি। ওরা তিনজনে মিলে অনিন্দ্যর সামনেই আমাকে ছিঁড়েছিল। অনিন্দ্যর কিছু করার ছিল না। ওই দিন মেলা থেকেই অনিন্দ্য আমায় একটা শাড়ি কিনে দিয়েছিল আর সেটা দিয়েই ওরা অনিন্দ্যকে বেঁধেছিল। পরেরদিন ক্ষতবিক্ষত মন আর শরীর নিয়ে ফিরে আসার পর অনিন্দ্য ফোন করল। বলল সব চেপে যেতে। থানা পুলিশ হলে ওর সমস্যা হবে। পায়ের তলা থেকে মাটি সরে গেল। যারা রেপ করেছিল তাদের থেকেও বেশি ঘেন্না করছিল অনিন্দ্যকে। তবু মেনে নিলাম,চেপে গেলাম। আর অনিন্দ্য,পালিয়ে গেল। উধাও। কোন যোগাযোগ রাখেনি। এদিকে আমি কনসিভ করলাম। বুঝতে পারছি না বাচ্চা কার—অনিন্দ্যর নাকি ওই মাতালগুলোর। লুকিয়ে অ্যাবরসন করালাম।
এরপর তোর সাথে আলাপ হল। ক্রমে মনে হল তুই পারবি আলগে রাখতে। এটলিস্ট তুই রেপ করলে আমি তো আর কনসিভ করবো না।
সব গোপন রেখেছিলাম। পারলাম কই। ওই প্যাকেটটায় সেই শাড়িটা আছে,ছেঁড়া। পরে আমিই লুকিয়ে রেখেছিলাম। প্রেমিকের উপহার বলে কথা।
তুই শুয়ে পড়ার পর যখন বাথরুমে গেলাম, দেখি ডাস্টবিনে তোর ইউজ্ড স্যানিটারী প্যাড। শেষ পর্যন্ত তুইও নারী,মেয়েছেলে। প্যাকেটের ছেঁড়া শাড়িটা পালটে দেব ভেবেছিলাম। তারপর মনে হল ওইটুকু প্রমাণ তোর জন্য থাক।
ক্ষমা করিস। আমি চলে যাচ্ছি। খোঁজ করিস না। তোর জন্য একটা সত্যিকারের পুরুষ খুঁজে নে। হয়ত পেয়ে যাবি। আদর তো অভ্যেস মাত্র।
তার মনটাকে নিজের মনের মত গড়ে নিস।
ইতি
সুমেধা
বাথরুমে শাওয়ারের তলায় এসে দাঁড়ায় সুরঙ্গনা। প্যাকেট থেকে ছেঁড়া হলদে ডুরে শাড়িটা এনে ভিজে শরীরে লেপটে নেয়, সুরঙ্গনা। অনুভব করছে বৃষ্টির রাত,সুরঙ্গনার শরীর খাবলে খাচ্ছে ওরা। সুমেধা কাঁদছে।
সুমেধাকে হোস্টেলেও পাওয়া যায়নি। বাড়িতেও যায়নি। সুরঙ্গনার কোলকাতা ফেরাও আটকে গেল। পুলিসে খবর দিতেই হল। কাল রাতে সুমেধা সুরঙ্গনার সাথেই ছিল,তাই পুলিসের হ্যাপা এড়ানো গেল না। টুরিস্ট লজেই পুলিস এল। ইন্টারোগেট করল সব্বাইকে। ভোর বেলা উঠৈ সুমেধা চলে যাওয়ার কথা বেয়ারাই জানালো পুলিসকে। তবু লোকাল থানার ওসি মিঃ মিত্র আলাদা করে বসলেন সুরঙ্গনার সাথে।
—আপনিই সুরঙ্গনা সেন ?
—হ্যাঁ
—সবই তো বোঝেন। যদিও সুমেধা ব্যানার্জির মিসিং এর সঙ্গে এখনও পর্যন্ত আপনার কোন ডাইরেক্ট মোটিভ নেই,আমাদের ইনভেস্টিগেসনের জন্য আজকের দিনটা এখানে ওয়েট করে যান। কালকে ফিরুন কোলকাতা। তারপরে প্রয়োজন পড়লে ডেকে পাঠাবো।
—যা বলবেন,মিঃ মিত্র। আমি নিজেও আপসেট। সবরকম ভাবেই আমি সাহায্য করবো। এই নিন আমার কার্ড,দরকার হলেই কনটাক্ট করবেন।
—ওঃ বাবা আপনি মিডিয়ার লোক!
—সেভাবে নই। আমি খবর করি না কেবল কিছু ক্রিয়েটিভ রাইটিং।
—একটা প্রশ্ন করতে পারি, মিস সেন?
—বলুন।
—আপনার সাথে সুমেধার রিলেসনটা ঠিক কি?
চোয়ালটা শক্ত হয় সুরঙ্গনার। কান্নাটা গলার কাছে যেন আটকে আছে। আগে এত কান্না পেত না।
—বন্ধু ,গার্লফ্রৈন্ড।
মিঃ মিত্র একটু অবাকই হলেন। কিছু সন্দেহ করলেন হয়ত। উত্তর দিলেন না। উঠৈ পড়লেন।
বিকেল পর্যন্ত সুমেধার খোঁজ পাওয়া যায়নি। কেবল জানা গেছে বোলপুর থেকে কোলকাতার ট্রেন ধরেছিল। ওর শিলিগুড়ির বাড়ি থেকেও ফোন এসেছিল। বাবা নেই,মা খুব কান্নাকাটি করছেন। ওর দাদা আসছেন কাল।
কোলকাতায় ফিরে এসেই অফিসে জয়েন করেছে সুরঙ্গনা। কাজে মন নেই। মেজাজ খিঁচড়ে আছে। পুলিসও কোন ট্রেস পায়নি। আজ অফিস ফেরার পথে একবার লালবাজারে যাবে ঠিক করে সুরঙ্গন। ক্রাইম ব্রাঞ্চের সুধীর জেঠুর সাথে দেখা করে বলবে সব কথা,যদি ওনার সোর্সে কিছু হয়।
জেঠুর সাথে কথা বলে বেরোতে রাত হয়ে গেল। একটা শেয়ার ক্যাব পেয়ে গেল। সামনের সিটের লোকটা মুকুন্দপুর নামবে। সুরঙ্গনা নামবে সেই নরেন্দ্রপুর। জ্যাম কাটিয়ে মুকুন্দপুর পৌঁছাতেই দশটা বেজে গেল। বাইপাস দিয়ে ক্যাবটা ছুটছে। ঢালাই ব্রীজ ক্রশ করেই গাড়িটা থেমে গেল। আশপাশ ফাঁকা।
—থামলেন কেন?
—আসছি ম্যাডাম। একটু টয়লেট করবো।
ড্রাইভার নেমে পড়ে। এগিয়ে যায় রাস্তার ধারের দিকে। কাকে যেন ফোন করছে মনে হল। মিনিট তিনেকের মধ্যেই ফিরে এসে গাড়ি ছাড়ল। হঠাৎ খেয়াল করল সুরঙ্গনা,ফ্রন্ট মিররে ড্রাইভার বিশ্রী ভাবে দেখছে। নিজের শার্টের উপর স্টোলটা জড়িয়ে নিল সুরঙ্গনা। সুমেধার কথাগুলো যেন ওকে ব্যঙ্গ করছে। সত্যিই এখন নিজেরই ইনসিকিউরড লাগছে।
ঘটনাটা ঘটলই। হঠাৎ করে আরও দুজন চড়ে বসল গাড়িতে। গাড়িটাও বাঁক নিল সার্ভিস রোড ধরে। একটা ছেলে সুরঙ্গনার মুখটা চেপে ধরেছে। ড্রাইভারটা খ্যাকখ্যাক করে হাসছে। একটানে সুরঙ্গনার শার্টের বোতামগুলো ছিঁড়ে ফেলল ওরা। বিপদটা ঘটেই যেত। একটা জোরালো আলো এসে পড়ল কাঁচ ভেদ করে। বাইকটা এসে দাঁড়াল। অল্পবয়েসি একটি ছেলে। বাঁধা দেওয়ার চেষ্টাও করেছিল ছেলেটি। মারও খেল বেদম। সুরঙ্গনাও যেন একটু জোর পেল। দুজনেই আহত হলেও বিপদটা আটকাতে পারল। ততক্ষণ পেট্রোল ভ্যান এসেছে।
পাটুলি থানায় বসে নিজেকে আরএকবার অসহায় মনে হচ্ছিল। পুলিস তিনটেকেই ধরেছে। বাইকের ছেলেটি পিৎজা ডেলিভারি করে ফিরছিল। ও না আসলে হয়ত,বিপদটা আটকানো যেত না। পুলিসই বাড়ি পৌঁছে দিল।
পরেরদিন আর অফিসে যায়নি সুরঙ্গনা। খবরটা কাগজেও বেরিয়েছে। শুধু বারবার ফোন আসছিল। বারবার এককথা বলতে আর ভালো লাগছিল না সুরঙ্গনার। কিন্তু ফোনটা অফ রাখতেও পারছে না যদি সুমেধার কোনো খবর আসে। বিকেলে ওই ছেলেটিও একবার খবর নিয়ে গেছে।
সন্ধ্যে বেলায় ছাদে এসে বসে সুরঙ্গনা। বোগেনভ্যালিয়ায় ফুল এসেছে। মিনমিনে হাওয়া বইছে। চাঁদ উঠেছে। ফোনটা অনেকবার বেজে বেজে থেমে গেছে। সাইলেন্ট করা,তাই শুনতে পায়নি। দশটা মিসড কল,আননোন একটা নম্বর থেকে। রিং ব্যাক করল সুরঙ্গনা। গলাটা শুনেই সব ঘোর কেটে গেল,সুরঙ্গনার। সুমেধার গলা! গলায় আঁটকে থাকা কান্নাটা উগরে উঠে। হাউহাউ করে কাঁদছে সুরঙ্গনা আর ফোনের ওপারে সুমেধাও ফোঁপাতে থাকে।
—কোথায় পালিয়েছিলি,ব্লাডি বিচ!
—গালাগাল করিস না প্লিজ। তুই শুনবি না আমি কোথায়?
—না। আমার শুনে কি হবে। ফোন করলি কেন?
—সকালে খবরে কাগজে পড়লাম।
—তাই ন্যাকাপনা করছিস। আমি ওসব পাত্তা দিই না,তুই তো জানিস।
—আমি দেই। সেটা তুইও জানিস। কাল আসছি তোর কাছে,কোলকাতায়।
—বয়ফ্রেন্ডের সাথে আলাপ করাবি তাই?
—তুই তো আমার বয়ফ্রেন্ড,তবে একটু মেয়েলি। এখন বেশি কথা বলব না। দাদাকে ফোন করেছিলাম,ও বোলপুরে। থানাতেও জানালাম সব। সরি ফর এভরিথিং। একটু ওয়েট কর,কাল সন্ধ্যার মধ্যেই আসছি। সামনে পেলে যা ইচ্ছে করিস। গুডনাইট।
সন্ধ্যা সাতটায় সুমেধা এল,একাই। সুরঙ্গনা নিজের ঘরে ওকে নিয়ে গিয়ে দরজা দিল।
—তোকে চিঠি লিখে পালিয়ে আসতে আসতে ভাবলাম বাড়ি ফিরে যাই। কিন্তু ভাবলাম যদি তুই সেখানে খোঁজ করিস। তখন মনে হল, রাতুলের কথা। রাতুল আমার বন্ধু, ডাক্তার। সেবার লুকিয়ে অ্যাবোর্ট করানোর সময় ওই ব্যবস্থা করেছিল। ও এখন সিউড়িতে। চলে গেলাম ওর কোয়ার্টারে। ওকে সব বললাম। ও আর ওর ওয়াইফ দুজনেই চাইছিল আমি তোর সামনে এসে যা বলার বলি। পালিয়ে এসে ঠিক করিনি বুঝতে পারলাম। তারপর কাগজে তোর ইনসিডেন্টটা পড়ে আরো কনফিউসড হয়ে গেলাম। রুমি মানে রাতুলের বৌ আমায় একটা দারুন শব্দ শেখালো। সিনার্জি,দুই আর দুই যোগ করলে চারের বেশিও হয়। রিয়ালাইজ করলাম। আমরা ইনসিকিউরড,সে তো আমাদের রিলেসনটা লেসবি বলে নয়,আমরা আলাদা ছিলাম তাই। আমরা বন্ধু তো বটে। দুই বন্ধু একসাথে থাকতেই পারে।
তাই চলে এলাম। কোলকাতাতেই থাকবো,কিন্তু তোর সাথে না। আমাদের রোজ দেখা হবে। কলেজের চাকরিটা ছেড়ে দেব। আমার চেনা একটা গ্রুপ আছে,ওরা কোলকাতা,দার্জিলিং, শান্তিনিকেতন, ঝাড়গ্রাম এমন অনেক জায়গায় হেরিটেজ টুর করায়। ক্লায়েন্ট মূলতঃ বিদেশীরা। ওদের সাথে কাজ করব। সাহেবদের ইতিহাসের গপ্প বলব। ছুটিতে তোর সাথেও বেড়াবো। তবে হ্যাঁ,নো নাইট ক্লাব। খুব দুষ্টুমি করতে ইচ্ছে করলে ফ্ল্যাটে,চুপিচুপি।
চুপ করে আছে সুরঙ্গনা। চোখের কোনা চিকচিক করছে। সুমেধা ওর হাতদুটো মুঠোর মধ্যে ধরে।
—কবিতাটা একবার বলবি,সুমেধা।
—কোনটা?
— ওই যে “এক গাঁয়ে”
“ আমরা দুজন একটি গাঁয়ে থাকি,
সেই আমাদের একটিমাত্র সুখ।
তাদের গাছে গায় যে দোয়েল পাখি
তাহার গানে আমার নাচে বুক।
তাহার দুটি পালন-করা ভেড়া
চড়ে বেড়ায় মোদের বটমূলে,
যদি ভাঙে আমার ক্ষেতের বেড়া
কোলের 'পরে নিই তাহারে তুলে।
আমাদের এই গ্রামের নামটি খঞ্জনা,
আমাদের এই নদীর নামটি অঞ্জনা,
আমার নাম তো জানে গাঁয়ের পাঁচজনে,
আমাদের সেই তাহার নামটি রঞ্জনা।”
© ...Sycira