...

1 views

বৃক্ষকাহিনী পর্ব ৪
সূর্য অস্ত গেল।সেদিনকার মতো সব কাজ পন্ড হল।তল্পিতল্পা গুটিয়ে সবাই একে একে ফিরে গেল আপন বাসায়।সারা গ্রাম জুড়ে ছেয়ে গেল এক আতঙ্কের কুয়াশা।
গ্রামের বাচ্চা যুবক,নবীন প্রবীণ সবার মধ্যে এখন একটাই কথা,একটাই চর্চা।এই সময়ে গ্রামের এক তেমাথা বৃদ্ধ হুঁকো টানতে টানতে তার সঙ্গীসাথীদের বলল,"আমি বোধহয় এই ব্যাপারটা সম্বন্ধে কিছু জানি কিন্তু নিশ্চিত ভাবে বলতে পারি না কারণ ঘটনাটা ঘটে আমারও দুই পুরুষ আগে।আমার তখন জন্ম হয়নি।কাজেই সত্যমিথ্যা যাচাই না করে কেউ যদি আমায় অবিশ্বাস করে সে আমি বরদাস্ত করব না।তোমরা যদি ঘটনাটি জানতে চাও তো আগে ওই দুই বটগাছের তলা খুঁড়তে আরম্ভ করো।কি পেলে এসে আমায় বলো,তারপর আমি সব বলব।
এই তেমাথা বৃদ্ধের বয়স একশো ছুঁই ছুঁই।গ্রামের সবথেকে প্রবীন মানুষ।তাই গ্রামের সব মানুষ তাঁকে শ্রদ্ধা করে,প্রয়োজনে পরামর্শও নেয়।তাই তিনি যখন বলছেন, তার কথা কেউ অগ্রাহ্য করল না।গ্রামের মানুষরাই কুড়ুল নিয়ে ওই দুই বটগাছের তলার মাটি খুঁড়তে লেগে গেল।অনেকটা খুঁড়ে ফেলার পর আস্তে আস্তে দুটি বটগাছের তলায় একটু একটু করে উন্মুক্ত হতে থাকল একটি করে কবরস্হান।এবার গ্রামের সবাই বিস্ফারিত চোখে একরাশ বিস্ময় ঢেলে এ ওর মুখ চাওয়াচাওয়ি করতে লাগল নীরবতা ভাঙলেন তেমাথা বৃদ্ধ।
"যা বলেছিলুম মিলে গেছে তো!এবার তোমাদের এর গোড়ার কথাটা বলি।মোটামুটি দুশো বছর আগের কথা।সে সময় হিন্দু আর মুসলমান মানুষের মধ্যে মারামারি-কোন্দল-?খুনোখুনি একেবারে নাওয়া খাওয়ার মতোই নিত্য ঘটনা ছিল।সেই সময়েএক হিন্দু চাষার মেয়ের প্রেমে পড়ে এক মুসলমান ব্যবসায়ী ঘরের ছেলে।ভিনজাতে প্রেম বলে সেই খবর আগুনের মতো সারা গ্রামে ছড়িয়ে গেল।ভালোবাসার পিয়াসী দুটি পাখি রাতারাতি সমাজের চোখে বনে গেল দাগী আসামী।তাদের দুজনকে বিচারাধীন হিসাবে বন্দী করা হয়েছিল।সালিশিসভায় তাদের নিয়ে যাওয়ার পথে কিভাবে যে তারা কড়া প্রহরা উপেক্ষা করে দুজনে দুজনের হাত ধরে পালিয়ে গিয়েছিল তা অনুধাবন করা দুঃসাধ্য।কিন্তু এই লৌহকঠিন অন্ধ সমাজের নিকষ অন্ধকারে না মরে একটু বাঁচার স্বপ্ন নিয়ে তারা ঠিকই একে অপরের হাত ধরে পালাতে সক্ষম হয়েছিল কিন্তু শেষরক্ষা হল না।গাঁয়ের শেষ প্রান্তে তারা খোদ মোড়লের হতেই ধরা পড়ে যায়।
এই ভয়ংকর "গর্হিত" অপরাধে তাদের শাস্তি জোটে একটাই।মৃত্যুদন্ড দুজনকে লটকানো হয় ফাঁসির দড়িতে।শোনা যায়,তখন পরস্পর পরস্পরের কাছে আকাশ কাঁপিয়ে অঙ্গীকারবদ্ধ হচ্ছে,"এ জন্মে একসাথে বাঁচা হল না...কিন্তু মরণের পর আর কোনো শক্তি আমাদের আলাদা করতে পারবে না।আজ আমরা পরস্পরের মৃত্যুতে নীরব।মরণের পরে আমাদের অনন্ত মিলনের পর আর কোনো আঘাত...কোনো বিরহ আমরা সইব না...সইব না...সইব না...।
এই তীব্র দ্রোহের ধ্বনিকেই চেপে ঠেসে ধরে ফাঁসির দড়ি পরানো হয়েছিল গলায়।ফাঁসির পর ছেলেটির দেহ কবর দেওয়ার সিদ্ধান্ত হল।কিন্তু হিন্দু চাষা মেয়ের বাপ মা জাত খোয়ানোর ভয়ে মুসলমান ছেলের সংস্পর্শে আসা মেয়ের দেহ আর নিতে পারল না।বাকি হিন্দু মানুষজনও ছুঁতে চাইল না মেয়েটির দেহ।সবাই বলল,"অচ্ছুত মেয়েমানুষের দেহ ছুঁয়ে কি নরকে যাব!যার যেমন পাপ সে তেমন শাস্তিই পেয়েছে।
শেষমেষ ছেলেটির কবরের পাশেই মেয়েটির দেহ বেওয়ারিশ লাশের মতো পড়ে থাকল।কিছুদিন যাওয়ার পর গ্রামবাসী একটু একটু করে উপলব্ধি করতে সক্ষম হল যে কত বড় অবিচারের শিকার হল ওই নিষ্পাপ দুটি ছেলেমেয়ে।গ্রামের মানুষের মনে অনুশোচনা জেগে উঠল।অতঃপর গ্রামবাসীরা মেয়েটির চিল শকুনের খাওয়া পচাগলা লাশটিকে উপর থেকে মাটিচাপা দিয়ে তার আত্মার শান্তি কামনা করল।দুজনের মৃতদেহ পাশাপাশি থাকায় ওই দুটি স্হানে গ্রামবাসীরা চাঁদা তুলে গড়ে তুলল দুটি সমাধিক্ষেত্র। এক্ষেত্রে আর হিন্দু কি মুসলমান...চিতা না কবর এই শ্রেণীবিন্যাসে না গিয়ে তাদের দুজনের একটি স্মৃতিচিহ্ন তৈরি করল।এই দুই বটগাছের উৎপত্তি যে ওই কবরস্থানের উপরেই এ নিশ্চয়ই আর বলার অপেক্ষা রাখে না।
সকলের মনের মধ্যে এক বিস্ময় যেন বিদ্যুতের তরঙ্গ বইয়ে দিয়ে চলে গেল।তাদের বুঝতে আর বাকি রইল না,যে মৃত্যুকালে তাদের অঙ্গীকারের কি তীব্র পরিস্ফুটনই তারা স্বচক্ষে অবলোকন করেছে।
সন্ধ্যা নামল।গায়ের বাতাসের সাথে ফের সখ্যতা স্হাপন করল গাঢ় অন্ধকার।গ্রামবাসী তেমাথা বৃদ্ধের কাছ থেকে বিদায় নিয়ে যে যার ঘরের পথ ধরল।ফেরার পথে একটি হাড় হিম করা দৃশ্য দেখে তারা কাঠের পুতুলের মতো দাঁড়িয়ে পড়ল।বিস্ময়ে হাঁ হয়ে তারা দেখতে থাকল,উন্মুক্ত প্রান্তরে পূর্ণিমার মায়াবী জ্যোৎস্নার মায়ায় স্নাত হয়ে মিশমিশে কালো দুই বৃক্ষমূর্তি তাদের আপন শাখা দিয়ে একে অপরকে তীব্র আদরে জড়িয়ে ধরে অনির্বাচনীয় উন্মাদনার সাগরে যেন এক মাতাল জোয়ার তুলে অনন্ত প্রণয়ের উৎসবে আত্মগহন করেছে। সকলের শিড়দাড়া দিয়ে যেন একটা হিমশীতল ঠান্ডা স্রোত বয়ে গেল...।