...

7 views

আবর্ত
* উফ !! অসহ্য ...... অসহ্য... আমি আর পারছিনা !! ঐ উচ্ছৃঙ্খল শব্দ যেন গগন ভেদি, আগ্নেয়গিরির মতো কাঁপিয়ে তুলছে ভূগর্ভ । ঐ লেলিহান সর্বগ্রাসী অগ্নির উল্লাস যেন দিগন্ত অবধি..... নানা শুধু দিগন্ত কেনো !! ওর গ্রাসে ঝলসাচ্ছে প্রকৃতির সৃষ্টি, ঝলসায় মাংস, রক্ত, মস্তিষ্ক ...। উফ !! আর পারছিনা ভীষণ যন্ত্রণা, উফ !! অসহ্য... অসহ্য....

হঠাৎই মুখের মধ্যে ঠান্ডা ঠান্ডা অনুভব হলো, চোখ মেলে তাকালাম, ক্ষানিক স্তব্ধ থেকে বললাম - কী রে তৃণা, তুই এখানে ... তুই কখন এলি ?? ও একটু বিস্ময় প্রকাশ করে বলল - এলাম মানে !! আমি তো তোর সাথেই ছিলাম, বাব্বাঃ তোর যা ঘুম ... যে কাউকে পাগল করার জন্য তুই একাই যথেষ্ট বুঝলি । মনেমনে ভাবলাম তবে এতোক্ষণ ধরে স্বপ্ন দেখছিলাম !! এত বাস্তবের কাছাকাছি কখনও স্বপ্ন হতে পারে ... যেনো সবটূকুই নির্মম সত্য, ঐ বিধ্বংসী আগুন, ঐ উচ্চস্বর, ঐ উল্লাস সবটুকু স্বপ্ন ছিলো মাত্র !! ভীষণ তেষ্টায় বুকের ভিতর পর্যন্ত শুকিয়ে গেছে একটু জল খাই, কিন্তু - এ- এ-কি আমার সারা শরীর এমন ব্যাথা কেনো ?? হাত দুটো ভীষণ যন্ত্রণা হচ্ছে ..... হঠাৎই চমকে উঠলাম, এ-এ-এ-কি আমার হাত দুটো এভাবে বীভৎস হয়ে পুড়ল কী ভাবে ...!! এখানে তো কোথাও আগুন নেই !! তাহলে ... তাহলে কি এসব ....। একরাশ প্রশ্ন মাথার ভিতরটা আমার কুরে কুরে খেতে লাগলো, তৃণা গায়ে ঠেলা দিয়ে বলে উঠল - এই তুই আবার কি ভাবতে বসলি বলতো, খাওয়া দাওয়া হবে না নাকি ... সারা রাত তো উন্মাদের মতো চিৎকার করেছিস, আর একটু পরেই তো বেরোবো নেক্সট প্রজেক্ট আছে ...। ধরফড়িয়ে উঠে পড়লাম ঠিকই, কিন্তু ! মনটা অস্থির হয়ে রইল, জলখাবার খেয়ে কিছুক্ষণের মধ্যে বেরিয়ে পড়লাম আমরা ।

ইতিহাসের হাতছানি আমাকে তাড়িয়ে বেড়ায় সেই ছেলেবেলা থেকে, অজানার প্রতি আমার এক অমোঘ টান .... ভালোবেসে তাই ইতিহাসে অনার্স করেছি, কিন্তু পায়ের শিকল ভাঙা ছিলো অসাধ্য !! যে পাখি বন্দি খাঁচায়, সে তো চাইবেই সুরম্য নীলাম্বরীর বুকে সুখের পাখা মেলতে .... পেরিয়ে যেতে অজানা দিগন্ত, মুছে জমাট কুহেলিকা আচ্ছাদন । তাই একদিন পরিবারের নিষেধের বেড়ি খুলে এলাম নিখিলের মাঝে, নাঃ সেটা মোটেও সহজসাধ্য ছিলো না, তবুও বেড়িয়ে পড়লাম রাঙা মাটির পথ ধরে কখনও শাল পিয়ালের বোন আবার কখনও বা পাহাড়ের তলে ঝাউয়ের নিবিড় বোনে.... এই প্রকৃতির মাঝে নিজেকে হারানোর স্বাদই আলাদা, খোঁজ চলল ইতিহাসের ।
" এ সমাজ যারে নারী বলে পড়াতে চায় বেড়ি,
ধিক্ সে সমাজকে ধিক্‌ সেই নিয়মের বাড়াবাড়ি !!
অগ্যতা দুজনায় পরিব্রাজক বেশে ....
ফিরি ভিন দেশে" ।

সূর্য দেবের প্রখর রোদ উপেক্ষা করে পেরিয়ে চলেছি মাইলের পর মাইল, অস্তগামী সূর্যটা যখন পরাজয় স্বীকার করে নিজের শেষ রশ্মিটুকু ছড়িয়েছে মেঘের গায়ে তখন আমরা পৌঁছলাম মুর্শিদাবাদ । যার প্রতি ধূলিকণাও আজ ইতিহাসের সাক্ষী বহন করছে, কাশিমবাজারে প্রবেশ করে গেলাম পাতালেশ্বর মন্দিরে, কিছুক্ষণ ওখানে কাটানোর পর গেলাম পাতালেশ্বর মন্দিরের পিছনে আদি গঙ্গার তীরে, দেখলাম বইয়ের পাতায় পড়া সে'ই রোমহর্ষক স্থান ! যেখানে আজও হয়তো নির্জনে কান পাতলে শোনা যাবে সতী নারীর আর্তনাদ ..... । বেশ রাত হয়ে এলো অগ্যতা সে রাতে আর
বাড়ি ফেরা হলো না, ওখানেই একজনকে ম্যানেজ করে করলাম নিশিযাপন .....।

হাতের ভীষণ যন্ত্রণা নিয়েই পৌঁছালাম হরিহর বাবুর বাড়ি, নরেন বোসের মুখে শুনেছিলাম তার নাম । তৃণা কিছুটা অপ্রস্তুত হয়ে জিজ্ঞাসা করল - কি রে রিনি আমাদের তো আজ অন্য কোথাও যাওয়ার কথা ছিলো, তুই এখানে আসবি কই আগে তো বলিস একথা ..? আমি ওর কথার প্রত্যুত্তর না দিয়ে টোকা মারলাম বাড়ির দরজায়, কারোর কোনো শব্দ পাওয়া গেলো না। কিছুক্ষণ পর একটি ছোটো মেয়ে দরজাটি খুলে দিলো, বললাম - মুখুজ্জে মশাই আছেন বাড়িতে ...? আমরা ওনার সাথে দেখা করতে এসেছি । মুখে কিছু না বলে সরে দাঁড়াল মেয়েটি, বুঝলাম উনি বাড়িতেই আছেন । ঘরের মধ্যে প্রবেশ করে দেখলাম, এক মুমূর্ষু রোগী কাতরাচ্ছেন মৃত্যু যন্ত্রণা .... মনে মনে ভাবলাম এ অবস্থায় তাকে কি কিছু জিজ্ঞাসা করব !! কিছুটা ভরসা করেই বললাম - মুখুজ্জে মশাই শুনতে পাচ্ছেন ... আপনি কি অতসী দেবীকে জানেন ?? শুনেছি আপনার পিতামহ তাকে জানতেন ?? বৃদ্ধ মৃদু স্বরে বললেন - জানি । এবং গভীর স্মৃতি হাতরে বললেন উনি আমার পিতামহের পালিত বোন ছিলেন, উনিই ছিলেন কাশিমবাজারের সতীঘাটের শেষ সতী, এ সমাজ তাকে খুব নৃশংস ভাবে হত্যা করেছিল । বললাম - তার কোনো ছবি কি আপনার কাছে আছে ? বৃদ্ধ খানিক দম নিয়ে বললেন - ছবি !! ওতো দিনের ছবি, সে আমি কোথায় পাবো ...!!
আর কিছু বললাম না অগ্যতা ফিরে এলাম ।

তৃণা বিরক্তিকর সুরে বলল - ঐ তোর কী হয়েছে বলত ? যাওয়ার কথা ছিলো এক জায়গায় তুই গেলি আর এক জায়গায়, আর কব্বে কার কে অতসী তাকে নিয়ে পড়েছিস .... সত্যিই তোর ব্যপার গুলো আজকাল খুব অদ্ভুত লাগে আমার জানিস । আমি কোনো কথা না বলে জামার হাতা গুটিয়ে আমার হাত দুটো বাড়িয়ে দিলাম ওর দিকে .... তুই বলতে পারবি এর মানে কী ? মানে ...!! তোর কী করে পুড়ল রে এতোটা ? জানিস সেদিন রাতে যে স্বপ্ন আমাকে উন্মাদ করে তুলে ছিলো এটা তারই ফল .... মানে তুই বলছিস "স্বপ্নে পাওয়া দহন" !! বেশ ইন্টারেস্টিং ..... তা পেলি কোনো সূত্র ?? নাঃ আর পেলাম কই পেয়েছি তো শুধু অতসী কে । তাই তো আজ গেলাম বীরভূমে হরিহর বাবুর বাড়ি । জানিস মুর্শিদাবাদ থেকে ফেরার পর এই ঘটনাটা ঘটল, তোর সেদিন রাতের ঐ নরেন বোস কে মনে আছে ..? তার বলা কয়েকটা কথা আজও আমার কানে বাজে জানিস - " ওরা বাঁচতে দিল না ঐ একরত্তি মেয়েটারে .... ঐ গোঁয়ার বামুনের ব্যাটা, ওর হাত পা বেঁধে তুলে দিলো ঐ জলন্ত আগুনে, তাতেও ওরা থামেনিকো মেয়েটির মাথায় মারল বাঁশের বারি .... কী রক্ত ... কী রক্ত .... সব ছাই হয়ে গেলো" । ও তুই সতী ঘাটের কথা বলছিস .... ঐ সব ওর বানানো গল্প, ও এমন ভাবে সব বলেছে যেনো - সমস্ত ঘটনা ও স্বচক্ষে প্রত্যক্ষ করেছে.... আর তুই ওর কথা নিয়ে পড়ে আছিস, দাঁড়া দাঁড়া তৃণা কী যেনো বললি তুই - "স্বচক্ষে প্রত্যক্ষ".... ব্যাস্ ... তুই আবার বসলি যতসব আদ্যোপান্ত নিয়ে !!


প্রায় ছমাস কাটল, আমি রয়ে গেছি একই আবর্তে ....। তৃণা বলেছে - " রিনি তুই উন্মাদ, উন্মাদ বদ্ধ উন্মাদ হয়ে গেছিস, তোর হিস্টিরিয়া হয়েছে হিস্টিরিয়া... এভাবে আর এক সাথে থাকা যায় না" ....। তৃণা ফিরে গেছে, বাড়ি থেকেও কেউ খোঁজ রাখেনি, ওরা বলেছে লক্ষীছাড়া আমি ...। এ আবর্তে চলে শুধুই মায়ার খেলা, কত অঙ্ক কষা কত যোগ বিয়োগের লড়াই তবু বারবার ফিরে ফিরে আসে সেই শূন্যতেই !! দু’মাস ধরে রয়েছি নরেন বোসের বাড়িতে, নাঃ ও উত্তর দিতে পারেনি .... ওরা তাড়িয়ে দেয় বারবার, তবুও আমি মাটি আঁকড়ে পড়ে রয়েছি, রাত যাপন চলে সতী ঘাটেই । কিন্তু, কাল ..... দেখেছি, হ্যাঁ হ্যাঁ আমি দেখেছি ঐ দূরে ঐ-ঐ খানে দাউ দাউ করে জ্বলছে বিধ্বংসী আগুন, আকাশচুম্বী তার লেলিহান শিখা .... গাছে গাছে প্রতিধ্বনিত তার আর্তনাদ !! এ আকাশ পাতাল এ বায়ুমণ্ডল মুখরিত এক মৃত্যুর উৎসবের উল্লাস ধ্বনিতে ...... শুধু সতীর কন্ঠে বাজে এক করুণ চরম সত্য - " আমি অতসী... আমি ফিরব .... আমি ফিরবই এই সমাজের বুকে এ পৃথিবীতে এই সতীঘাটে... জেনে রেখো শাস্ত্রবিদ এক নতুন ভোরে আমি ফিরবই, সেদিন সতীর রক্তে ভেজা এ নির্মম শাস্ত্র মিশে যাবে কালের ধুলোয়.... আমি বাঁচব সেদিন আর তোমরা তলিয়ে যাবে সময়ের অন্তরীক্ষে....

আজ ফিরেছি আমি রেখেছি আমার প্রতিশ্রুতির দাম, দেখো আজ শাস্ত্র নির্বাক ..... নারী মহান তেজে মহীয়সী, ভেঙেছে আবর্ত আমার .... তবু আমি সেই অতসী রিনির মাঝেই সদর্পে বাঁচি ।
------------------------------------------------------
#মৌসুমীচ্যাটার্জী #বাংলা_কবিতা #মৃত্যু