...

1 views

“শ্রীহেমন্ত মুখোপাধ্যায়”
শ্রীহেমন্ত মুখোপাধ্যায়
~~~~~~~~~~~~

“একদিনেতে হই নি আমি তোমাদের এই হেমন্ত—
কুঁড়ি ছাড়াই ফুল ফুটেছে, শুনিনি ভাই এমন তো...”
"নকল সোনা" ছবিতে এ গান গেয়েছিলেন যিনি, সেই হেমন্ত মুখোপাধ্যায়ের জীবন ও সঙ্গীতসাধনা যে বস্তুতঃপক্ষে সম্পূর্ণ কুসুমাস্তীর্ণ ছিল না, তা হয়তো অনেকেই জানেন না। কেমন ছিল গায়কের ছোটবেলার দিনগুলো? কেমন ছিল সেই দিনগুলো, যখন বম্বেতে স্ট্রাগল করছিলেন তিনি? গায়ক হেমন্তর মাঝেও যে লুকিয়ে আছেন মানুষ হেমন্ত, তা ক'জন জানেন? এই নিবন্ধে চেষ্টা করা হয়েছে হেমন্ত মুখোপাধ্যায়ের জীবনের আলোকে তাঁর সঙ্গীত-সাধনা এবং অবশ্যই মানুষ হেমন্ত মুখোপাধ্যায়ের কথা বলবার।

হেমন্ত মুখোপাধ্যায়ের জন্ম বারাণসীতে ১৯২০ সালের ১৬ জুন। শৈশব কেটেছে জয়নগর বহড়ুতে। পরে ভবানীপুরে চলে আসা ও কৈশোর যাপন। হেমন্তরা চার ভাই, এক বোন। হেমন্ত ক্লাশ সেভেন থেকে পড়াশোনা করেছেন মিত্র ইন্সটিটিউশনে। পড়াশোনায় ভালো ছিলেন তিনি। ছাত্রাবস্থাতেই ১৯৩৫ সালে তিনি প্রথম রেডিওয় গান করেন‌। এ বিষয়ে তাঁকে উৎসাহ জুগিয়েছিলেন তাঁর বন্ধু ও প্রখ্যাত কবি সুভাষ মুখোপাধ্যায়। ১৯৩৭ সালে ফার্স্ট ডিভিশনে তিনি ম্যাট্রিক পাস করেন। সেই বছরই ভর্তি হন যাদবপুর ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজে। সে বছরই 'কলম্বিয়া রেকর্ডস' থেকে তাঁর প্রথম গানের ডিস্ক বের হয়। সে বছরই "দেশ" পত্রিকায় হেমন্তর একটি ছোটোগল্পও প্রকাশিত হয়েছিল। গল্পটির নাম ছিল "একটি দিন"। ১৯৩৮ সালের শেষদিকে ইঞ্জিনিয়ারিং পড়া শেষ করে শর্টহ্যান্ড টাইপরাইটিং-এর শিক্ষা নিয়েছিলেন। পাশাপাশি গানের টিউশনিও শুরু করেন তিনি। প্রথম প্লেব্যাক "নিমাই সন্ন্যাস" ছবিতে, ১৯৪০ সালে। ছবিটির সঙ্গীত পরিচালক ছিলেন হরিপ্রসন্ন দাস। সে বছরেই "আই পি টি এ" গোষ্ঠীতে যোগদান এবং সলিল চৌধুরী, দেবব্রত 'জর্জ' বিশ্বাস প্রমুখের সঙ্গে আলাপ। সে বছরেই শান্তিনিকেতনে গিয়ে চাক্ষুষ দর্শন করেন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরকে।

বেলা মুখোপাধ্যায়ের সঙ্গে বিবাহ ১৯৪৫ সালে। ১৯৪৭ সালে পুত্র জয়ন্তর জন্ম হয়।

সলিলের কথায় ও সুরে ১৯৪৭ সালে গাওয়া "গাঁয়ের বধূ" সুপারহিট। তারপর সলিলের সঙ্গে জুটি বেঁধে হেমন্ত শ্রোতাদের উপহার দিয়েছেন অজস্র অবিস্মরণীয় সঙ্গীত, যেমন— "পাল্কির গান", "রানার", "আমায় প্রশ্ন করে নীল ধ্রুবতারা" , "ধিতাং ধিতাং বোলে" , "মনের জানালা ধরে" , "পথ হারাবো বলেই এবার" , "দুরন্ত ঘূর্ণির এই লেগেছে পাক" , "অবাক পৃথিবী" , "ঠিকানা" , "পথে এবার নামো সাথী" , "শোনো কোনো একদিন" , "ধান কাটার গান" , "নৌকা বাওয়ার গান" আরও কত না গান!

১৯৪৮ সালে "জমিন আসমান" ছবিতে প্রথম হিন্দী প্লেব্যাক করেন।

১৯৫১ সালে হেমেন গুপ্ত হেমন্তকে বম্বে নিয়ে যান হিন্দী "আনন্দমঠ"-এ সুরসৃষ্টি‌ করার জন্য।

তারপর বম্বেতে ফিল্মিস্তান স্টুডিওতে 'হেমন্ত্ কুমার' নাম নিয়ে হিন্দী গান গাওয়ার সূচনা হয় তাঁর।

বম্বেতে হেমন্তর প্রথম হিট গান শচীন দেব বর্মণের সুরে ১৯৫২ সালে "জাল" ছবিতে, দেব আনন্দের জন্য—"ইয়ে রাত ইয়ে চান্দনি ফির্ কহাঁ"। পরে শচীন দেব বর্মণ এবং অন্যান্য সুরকারদের এমনকি নিজের সুরেও প্রচুর প্লেব্যাক, বেশিরভাগই দেব আনন্দের জন্য। তার মধ্যে "পতিতা" ছবিতে "ইয়াদ কিয়া দিল নে কহা হো তুম্" , "সোলভাঁ সাল" ছবিতে "হ্যায় আপনা দিল্ তো আওয়ারা" , "না তুম্ হমেঁ জানো" ইত্যাদি উল্লেখযোগ্য। উত্তম কুমারের মতো দেব আনন্দের সঙ্গেও অত্যন্ত মধুর সম্পর্ক ছিল হেমন্তর। ১৯৫৩ সালে লতা মঙ্গেশকরকে দিয়ে রবীন্দ্রনাথের গান গাওয়ান হেমন্ত। ১৯৫৩ সালেই বম্বেতে তাঁর আলাপ হয় মান্না দে’র সঙ্গে। ১৯৫৪ সালে "নাগিন" ছবিতে সুরারোপ; এ ছবি সুপারহিট হয়, এবং হেমন্ত "ফিল্মফেয়ার" পুরস্কার পান এ ছবির জন্য‌।

১৯৫৫ সালে সুধীর মুখার্জী তাঁকে কলকাতায় উত্তম কুমারের জন্য প্লেব্যাকের জন্য অনুরোধ করেন। ছবির নাম ছিল "শাপমোচন"। সেই ছবিতে উত্তম কুমারের জন্য হেমন্ত গাইলেন চারখানি গান— "শোনো বন্ধু শোনো প্রাণহীন এই শহরের ইতিকথা" , "বসে আছি পথ চেয়ে" , "ঝড় উঠেছে বাউল বাতাস" এবং "সুরের আকাশে তুমি যে গো শুকতারা"। সেই শুরু হল উত্তম-হেমন্ত ম্যাজিক, যে ম্যাজিকে আজও বুঁদ তামাম বাঙালী! হেমন্ত তো উত্তমকে নিজের ছোটো ভাই মনে করতেনই, উত্তমও বরাবর হেমন্তকে নিজের বড় দাদার মতনই শ্রদ্ধা করে এসেছেন। একে একে এই জুটির অসংখ্য গান দর্শক ও শ্রোতাদের মনের মণিকোঠায় ঠাঁই পেল। উত্তমের জন্য অজস্র ছবিতে একাধিক গান গাইলেন হেমন্ত। যেমন—"বন্ধু" ছবিতে "মৌবনে আজ মৌ জমেছে" এবং "মালতী ভ্রমরে করে ওই কানাকানি" ; "কুহক" ছবিতে "নওল কিশোরী গো" এবং "বিষ্ণুপ্রিয়া গো" ; "দুই ভাই" ছবিতে "তারে বলে দিও" ; "যৌতুক" ছবিতে "এই যে পথের এই দেখা" ; "হাত বাড়ালেই বন্ধু" ছবিতে "শরীরখানা গড়ো" এবং "শহরে সবই বিকায়" ; "সপ্তপদী" ছবিতে "এই পথ যদি না শেষ হয়" ; "ইন্দ্রাণী" ছবিতে "সূর্য ডোবার পালা" ; "মায়ামৃগ" ছবিতে "ওরে শোন্ শোন্ গেরোবাজ" ; "পৃথিবী আমারে চায়" ছবিতে "নিলামওয়ালা ছ’ আনা" ও "দূরের মানুষ কাছে এসো" ; "সোনার খাঁচা" ছবিতে "কে জানে ক’ ঘন্টা" ; "মন নিয়ে" ছবিতে "ওগো কাজল নয়না হরিণী" ; "সাথীহারা" ছবিতে "ও ময়না কথা কও" এবং "যাদুভরা ওই বাঁশি বাজালে কেন" ; "বাঘবন্দী খেলা" ছবিতে "আয় আয় আশমানী কবুতর" ইত্যাদি। উত্তম-হেমন্ত জুটির জনপ্রিয়তা তৎকালীন সময়ে এতটাই ছিল যে, উত্তমকুমার-অভিনীত অসংখ্য ছবিতে আবহসঙ্গীত অথবা অন্য কোনো অভিনেতার নেপথ্যে সঙ্গীত পরিবেশনের জন্যও হেমন্ত মুখোপাধ্যায়ের ডাক পড়ত। যেমন—"তাসের ঘর" ছবিতে "শূন্যে ডানা মেলে" ; "মরুতীর্থ হিংলাজ" ছবিতে "তোমার ভুবনে মাগো এতো পাপ" ; "সূর্যতোরণ" ছবিতে জহর রায়ের লিপে "ওরা তোদের গায়ে মারবে লাথি" ; "চৌরঙ্গী" ছবিতে বিশ্বজিতের লিপে "কাছে রবে, কাছে রবে" ; "সন্ন্যাসী রাজা" ছবিতে "কা তব কান্তা" ; "স্ত্রী" ছবিতে সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়ের লিপে "খিড়কী থেকে সিংহদুয়ার" এবং "সাক্ষী থাকুক ঝরাপাতা" ; "ধন্যি মেয়ে" ছবিতে "এ ব্যথা কী যে ব্যথা" ইত্যাদি।

১৯৫৮ সালে হেমন্ত-বেলার দ্বিতীয় সন্তান, কন্যা রাণুর জন্ম হয়। সে বছরই "নীল আকাশের নীচে" ছবিটি প্রযোজনা করেন হেমন্ত—যে ছবি পরিচালনা করেছিলেন মৃণাল সেন। ওই বছরেই কিশোর কুমারকে দিয়ে "লুকোচুরি" ছবিতে গাওয়ালেন বাংলা গান। ১৯৫৯ সালে প্রথমবার বিদেশ যাত্রা করেন হেমন্ত।

১৯৬০ সাল থেকে হেমন্ত বম্বেতে ছবি প্রযোজনা নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়েন—১৯৬২ সালে মুক্তি পায় হেমন্ত্ কুমার-প্রযোজিত "বীস্ সাল্ বাদ্"—যে ছবিতে হেমন্ত সন্দেহাতীতভাবেই উত্তম কুমারকে চেয়েছিলেন নায়ক হিসেবে। কিন্তু কোনো কারণে উত্তম কুমার এই ছবিতে অভিনয় করতে পারেন নি ; ফলতঃ হেমন্ত অপর এক অনুজ অভিনেতা ভ্রাতৃপ্রতীম বিশ্বজিৎ এবং ওয়াহিদা রেহমানকে নায়ক-নায়িকা হিসেবে কাস্ট করেন। ছবি হিট্ হয়। এ ছবিতে হেমন্ত বিশ্বজিতের লিপে গাইলেন "বেকারার করকে হমেঁ য়ুঁ না যাইয়ে" , "জরা নজরোঁ সে কহ্ দো জী"-র মতন সুপারহিট গান। কিন্তু তা সত্ত্বেও হেমন্ত বুঝতে পারেন যে, বম্বেতে ছবি প্রযোজনার কাজে ঝুঁকির সম্ভাবনা আছে, এবং ভবিষ্যতে তিনি হয়তো বড়রকম আর্থিক ক্ষতির সম্মুখীন হতে পারেন। তাই সময় থাকতেই তিনি ছবি প্রযোজনার লাইন থেকে সরে আসেন।

১৯৬২ সালে ভারত-চীন যুদ্ধের সময় নতুন কিছু দেশাত্মবোধক গান গাইলেন হেমন্ত। ১৯৬৪ সালে ওয়েস্ট ইন্ডিজ ও সুরিনাম যাত্রা এবং সেখানে বিপুল সম্বর্ধনা প্রাপ্তি‌। ১৯৬৮ সালে "আনন্দধারা" নামে প্রথম আত্মজীবনী প্রকাশ পেল। ১৯৭০ সালে হেরম্যান হেস্-এর কাহিনী অবলম্বনে নির্মিত কনরাড রুক্সের ইংরেজী ছবি "সিদ্ধার্থ"-এ সুরারোপের কাজ শুরু করেন তিনি, যে ছবিটি মুক্তি পেয়েছিল ১৯৭২ সালে‌। ১৯৭০ সালে হেমন্ত পরিচালনা করলেন "অনিন্দিতা" ছবিটি। এই ছবিতে আবারও কিশোর কুমারকে দিয়ে গাওয়ালেন "ওগো নিরুপমা"। ১৯৭১ সালে হেমন্ত মুখোপাধ্যায়কে বাল্টিমোর সিটির সাম্মানিক নাগরিকত্ব প্রদান করা হল। ১৯৮০ সালের মার্চ মাসে রবীন্দ্র সদনে আয়োজিত এক অনুষ্ঠানে হেমন্ত, জর্জ বিশ্বাসকে সম্বর্ধনা জ্ঞাপন করেন। সেই সভায় দাঁড়িয়ে জর্জ বিশ্বাস বলেছিলেন, "রবীন্দ্রনাথের গানকে জনপ্রিয় করার ক্ষেত্রে হেমন্ত মুখোপাধ্যায় দ্বিতীয় নায়ক—প্রথমজন অবশ্যই পঙ্কজ মল্লিক।"

১৯৮৩ সালে "বৈতানিক" কর্ত্তৃক "রবীন্দ্রসঙ্গীতাচার্য" উপাধিতে ভূষিত করা হল তাঁকে। ১৯৮৫ সালে রবীন্দ্র ভারতী বিশ্ববিদ্যালয় হেমন্তকে প্রদান করলেন ডি.লিট. উপাধি। ১৯৮৫ সাল হেমন্তর সঙ্গীত জীবনের সুবর্ণজয়ন্তী বর্ষ—বহু পুরস্কার ও সম্বর্ধনা পেলেন তিনি। ১৯৮৭ সালে "লালন ফকির" ছবির জন্য‌ পেলেন জাতীয় পুরস্কার। এ বছরেই পেলেন "সঙ্গীত নাটক অ্যাকাডেমী পুরস্কার"।
১৯৬২ থেকে ১৯৭৬ সাল অবধি হেমন্ত পেয়েছেন এক ডজন বি.এফ.জে.এ. সম্মান, যা অবশ্যই এক রেকর্ড! ১৯৮৮ সালের ১ এপ্রিল কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয় হেমন্ত মুখোপাধ্যায়কে অর্পণ করলেন ডি.লিট. উপাধি।

১৯৬৩ সালে তরুণ মজুমদার হেমন্ত মুখোপাধ্যায়কে অনুরোধ করেন "পলাতক" ছবিতে সুরারোপ করার জন্য। এ ছবির ফোক্-ঘেঁষা গানগুলিতে সুরারোপণ নিয়ে হেমন্ত প্রথমে রাজি হন নি, তরুণ মজুমদারের...