...

3 views

প্রেম যখন সূর্যপূজা (পর্ব-২)
"এগরার ছেলে বলে ফ্রেন্ড লিষ্টে নিতে চাইছোনা?"সেই সোসাল সাইটিতে সূর্যের প্রথম ম‍্যাসেজ পূজাকে।

সূর্য পূর্ব মেদিনীপুরে র এগরার বাসিন্দা।সূর্য ভূঞ‍্যা।এই একই শহরে পূজার দেশের বাড়ি।মধ‍্যবিত্ত পরিবারে জন্ম সূর্যের।সকালের শুভ সম্ভাবনাময় দীপ্ত সূর্যের মতই ২৬ বছরের এক প্রাণবন্ত সৎ ও আদর্শবাণ যুবক সূর্য।সূর্যের বাবা বছর পাঁচেক হল গত হয়েছেন।সূর্য তার মা-বাবার বড় ছেলে।এক বোন ও ভাই আছে তার।সূর্যের বাবা স্বর্গীয় সতীশচন্দ্র বাবু তাঁর জীবদ্দশায় মেয়ে, প্রিয়দর্শিনী র বিবাহ অবস্থাপন্ন পরিবারের এক সৎ ব‍্যবসায়ী পাত্রের সঙ্গে দিয়ে গিয়েছেন।
সূর্যের দেশের বাড়ি কাছেই একটি গ্রামে আর মামার বাড়িও এগরার কাছেই এক মফস্বলে।
এগরার বাংলা মাধ‍্যম স্কুলের সাদামাটা ছাত্র সূর্য।পাশ গ্র‍্যাজুয়েট।ভাই বোন দুজনেই স্কুলের গন্ডিতেই ইতি টেনেছে পড়াশোনা।সূর্যের কম্পিউটার নিয়ে পড়াশোনা আছে।বর্তমানে বাবা যে সংস্থায় কাজ করতেন সেই সরকারী বিদ্যুৎ সংস্থায় চাকুরিরত সূর্য।তবে বাবার অকাল প্রয়াণে পরিবারের হাল ফেরাতে নিজেদের বাড়িতেই বছর দুই আগে জেরক্স আর প্রিন্টিং-এর ভালো ব‍্যবসা শুরু করেছিল সূর্য।বর্তমানে তার ছোট ভাই, বারিদ এই ব‍্যবসার কর্ণধার।বিধবা মা,আর ছোট ভাইকে নিয়ে সূর্যের পারিবারিক জীবন বর্তমানে স্বচ্ছলতার সাথেই কাটছে।বোনের শ্বশুরবাড়ির পরিবারের সাথে খুব ভালোই সম্পর্ক এবাড়ির।সূর্য স্বভাবত মিশুক প্রকৃতির ছেলে হলেও খুব বেশি বন্ধু-বান্ধব সে পছন্দ করেনা।মনের সব কথা খুলে বলার মতো ঘরে বা বাইরে সেরকম কোনো প্রিয় বন্ধু সূর্যর প্রায় নেই বললেই চলে।তাই সবার মাঝেও কোথায় কেন যেন খুব একা একা লাগে সূর্যের।

বাবাকে খুব ভালোবাসতো সূর্য।বাবাও খুব বিশ্বাস করতেন সূর্যকে।কিন্তু অদ্ভুত ভাবে ছোট থেকেই মায়ের সাথে সূর্যের মতানৈক্য।সূর্যের মা সুলেখাদেবী একজন ব‍্যবসায়ী পরিবারের স্বল্পশিক্ষিতা মহিলা।এবাড়ির ছোট বউ।গন্ডিবধ‍্য কিছু কুসংস্কারাচ্ছন্ন সাংসারিক সার্থকতায় তিনি কৃত্রিম সুখশান্তি খোঁজেন।নীতি,আদর্শ, জীবনের গভীর মূল‍্যবোধের চেয়ে লোক,লৌকিকতা এবং আত্মসুখ চরিতার্থ করা তাঁর জীবন ও সংসারে বরাবরই বেশী দাম পেয়ে এসেছে।সতীশচন্দ্র বাবুর অবর্তমানে তাঁর প্রধান উপদেষ্টা হিসাবে তাঁর বেয়ানও নিজেদের কুঁয়োটিকেই পৃথিবীর সবচেয়ে বড় জলাশয় ভেবে সদর্পে সংসারধর্ম পালন করে এসেছেন।নিষ্ঠাসহকারে সম্পর্কের প্রতি বিশ্বাস ও ভালোবাসা দিয়ে পরিবারকে আগলে রাখার মানসিকতা নেই সুলেখাদেবীর।শিক্ষার মূল‍্য ও ধর্মবোধ বাস্তব জীবনে তেমন মান পায়নি সুলেখাদেবীর সংসারে।আত্মসর্বস্ব অধিকারবোধ ও অর্থবল সুলেখাদেবীর জীবনে সুখ ও শান্তির মূল আধার।বর্তমানে তিনি সূর্যের বিয়ে দিয়ে ঘরে বউ আনতে চান।মেয়েটির মানুষ হিসাবে যোগ্যতার চেয়ে কিংবা তার ছেলের জীবনে সেই মেয়েটির প্রাধান্যর চেয়ে সুলেখাদেবীর বড়বৌমার প্রধান গুণ হবে তাঁর আদেশাধীন থেকে একপ্রকার তাঁর কৃতদাসত্ব বরণ করে সংসার ধর্মের নামে গন্ডিবধ‍্য দাসত্বের জীবনযাপন করা।তাই নিজের বৌমা হিসেবে অবস্থাপন্ন বাড়ির উচ্চশিক্ষিতা বা স্বনির্ভরশীল মেয়ে সুলেখাদেবীর বিশেষ অপছন্দ।

সূর্যের মন ও মানসিকতা ঠিক তাঁর মায়ের বিপরীত।সামাজিকতার চেয়ে সম্পর্কের প্রতি বিশ্বাস ও সততাই তার সহজাত জীবনাদর্শে বেশী গুরুত্বপূর্ণ।বিজ্ঞান মনস্ক ও তীক্ষ্ম যুক্তিবাদী মন সূর্যের।অজানা সত‍্যকে জানার ইচ্ছা প্রবল।প্রকৃত সত‍্য ও মিথ‍্যার প্রভেদ করার চিন্তাশক্তি আছে তার।সূর্য সহজ সরল সুউন্নত জীবনযাপনে আগ্রহী। দূরদর্শিতা ও কর্মদক্ষতা প্রখর সূর্যের।কিছু বিশেষ সহজাত শুভ আত্মিক সুসংস্কার ছোট থেকেই তার মধ‍্যে লালিত হয়ে অজান্তেই এক বিবেকবান ফলদায়ক বৃক্ষে পরিণত হয়েছে।ভীষণ সত‍্যপ্রিয় ও ঈশ্বরবিশ্বাসী সূর্য।নিজের ইচ্ছাতেই গ্র‍্যাজুয়েশন।বাবার শেষ সম্বল থেকে একটা কম্পিউটার কিনে নিজে ডি.টি.পি শিখে ব‍্যবসা শুরু।আবার নিজের যোগ‍্যতায় বাবার সংস্থায় ভালো চাকুরি করছে সূর্য।বাবা চলে যাওয়ার পর মাকে দেখতে হবে।ভাইকে সাবলম্বী করে তুলতে হবে।কিছু আর্থিক ঋণ ও সুপরামর্শ দিয়ে তার বোনের শ্বশুর-শ্বাশুড়ী উপকার করেছিলেন তাদের দুঃসময়।ব‍্যবসার উন্নতি করে সেই আর্থিক ঋণ পরিশোধ করেছে তবে তাদের প্রতি সূর্যের মধ‍্যে এখনও প্রবল কৃতজ্ঞতাবোধ।এখন মায়ের হাতে বাবার পেন্সনের পুরো টাকাটা তুলে দিতে পেরেছে সে।ভাইকেও ব‍্যবসার ভার পুরোপুরি এখন তার ভাইকে দিয়ে দিতে পেরেছে।বাবার টাকা থেকে দুই ভাইয়ের নামে একটা জমিও কিনে রেখেছে।নিজে এখন সে সরকারী চাকুরিজীবি। ঈশ্বরের আশীর্বাদে এই সংসারের আর্থিক দায়ভার নিয়ে সূর্য এখন অনেকটাই নিশ্চিন্ত।প্রথমে মায়ের হাতে নিজের জীবনসঙ্গিনী চয়নের দায়িত্ব দিতে চেয়েছিল সূর্য।কিন্ত মা তো তাকে বোঝেনই না।বলা ভালো বুঝতে চান না।তার সুখের চেয়ে মায়ের স্বার্থপূরণ অনেক বেশী প্রয়োজন মায়ের কাছে।চেষ্টা করে দেখেছে সে,মা তো জীবনবোধের গভীরে ঢুকতেই চান নি কখনও।মা ও ছেলের মতাদর্শের এত অমিল উপলব্ধ হতে সূর্য নিজের জীবনসঙ্গিনী নিজেই খুঁজে বার করার সিদ্ধান্ত নিল।ভাগ‍্যে থাকলে সে ঠিক খুঁজে পাবে তাকে যে শুধু তাকে ভালোবেসে বিশ্বাস করে আসবে তার জীবনে।যার কাছে গভীর বিশ্বাস আর প্রেমে নিশ্চিন্তে নির্দিধায় আত্মসমর্পণ করতে স্বতঃস্ফূর্তভাবেই সূর্যের মন চাইবে।যাকে সত‍্যিই ভালোবাসবে তাকেই স্ত্রী হিসাবে স্বীকৃতি দিয়ে আনবে কূললক্ষ্মী করে।কিন্তু এই পরিস্থিতিতে একটা আশংকা মাঝেমধ্যে ডানা বাঁধে সূর্যের মনে।তার সাথে মায়ের মতান্তরের রেশ তার জীবনসঙ্গীর ওপরেও পড়া খুব স্বাভাবিক।এটুকু ভেবে নিজেকে সান্ত্বনা দিত ভালোবাসা আর বিশ্বাসের ভীত খুব মজবুত হলে সংসারধর্মের বাকি বিষয়গুলিতে অবশ‍্যই ক্রমাগত সফল হবে তারা।কিন্তু যাকে খুঁজে বেড়াচ্ছে সর্বাগ্রে তার ভালো বন্ধু হয়ে না উঠলে এই ইচ্ছা বাস্তবায়ন করবে কি করে?এই ভেবেই সোসাল একটি সাইটে আসা সূর্যের।

সোসাল সাইটে পূজার কোনো ছবি নেই।কিন্তু সাইটির বাওগ্রাফিতে লেখা পূজার কিছু মনোগ্রাহী আধ‍্যাত্মিক কথা প্রথম আকৃষ্ট করল সূর্যকে।মনে মনে সূর্য তার জীবনসঙ্গিনীর ভালো পরিবারের এক সুশিক্ষিতা মেয়েকেই পেতে চাইছে।তাই ফ্রেন্ড রিকুয়েস্ট পাঠালো।কিন্তু এক্সেপ্ট হল না।আবার ডিলিটও হলনা।তাই পূজাকে ম‍্যাসেজটা করেই বসল সূর্য।



© বুনানী