...

17 views

অস্তিত্ব
বাড়ির বাগানে দোলনায় শুয়ে রবীন্দ্রনাথ পড়ছিলাম। বিকেল পাঁচটা বাজতে না বাজতে ঝুপ করে অন্ধকার নেমে এল।এই কারনেই শীতকালটাকে ভালোবাসা যায় না।আরো খানিক্ষন অন্ধকারকে উপেক্ষা করে প্রকৃতির মাঝে সাহিত‍্য উপভোগের চেষ্টা চালালাম। না,নিরাশ হতে হল না।কোথা থেকে একটা প্রজাপ্রতি এসে বইয়ের পাতায় বসে সাহিত‍্যের গন্ধটা পৌঁছে দিল আমার হৃদয়। অনুভব করলাম আন্ধকারেরও একটি আলাদা সৌন্দর্য আছে।
বাড়ির ভিতর থেকে ডাক এল,মায়ের গলা,-"আশিষ দেখা করতে এসেছে,ভিতরে আয়"
আশিষের সাথে শেষ দেখা প্রায় ১৫ বছর আগে।উচ্চশিক্ষার জন‍্য বিলেত গিয়েছিল বেচারা! কিসের সব বড়ো বড়ো ডিগ্রি নিয়ে গতকাল দেশে ফিরেছে।খবরটা টেলিফোনেই পেয়েছিলাম।শুনে ব‍্যেঙ্গ করে বলেছিলাম,"এলি কেন?ওখানেই তো পাকাপাকি ভাবে থেকে যেতে পারতিস!এখন কি আর এখানে পোষাবে তোর?আবার দুদিন পরেই তো পালাবি।"
ওপারের বহু পরিচিত গলাটা বলে উঠেছিল,"চেনা গন্ধে আর একবার ডুব দিতে এসেছি।"
বইয়ের পাতায়ে প্রজাপ্রতির রঙটা অন্ধকারে ভালো বোঝা যাচ্ছে না।ঠিক যেন মনে হচ্ছে অন‍্য কোথাও থেকে প্রজাপ্রতিতে রুপান্তরের সফলতার সাথে একরাশ অন্ধকার নিয়ে ফিরে এসেছে রবীন্দ্রনাথের গল্পে ডুব দিতে।তাদের দুজনের বিচ্ছেদ ঘটিয়ে,বই বন্ধ করে বাড়ির ভিতর ঢুকলাম।
ঘরে ঢুকে দখি আশিষ আমার বইয়ের তাকে রাখা বইগুলি মনযোগ সহকারে দেখছে।
-ডিগ্রির বাইরে আর কোনো বই কি পড়া হয়ে?না কি সেসব পাঠ উঠে গেছে।
পিছনে তিকিয়ে আশিষ একগাল হাসল।বিনিময় আমি আরামকেদারাটার দিকে নির্দেশ করে বললাম "বোস"।হাসতে ঠিক প্রবৃত্তি হল না।
আশিষ: তারপর বল কি করছিস এখন?
-তোর মত বড়ো কিছু নয়,শুধু জীবনে নিজের ইচ্ছা মতন বাঁচছি।
আশিষ:মানে চাকরি-বাকরি কি করছিস?
-চাকরি?অল্প একটু হাসলাম।তেমন কিছু না,বলে বইয়ের তাক থেকে একটা বই নামিয়ে ওর হাতে দিলাম।
আশিষ: আরে!শেষে তুই লেখক হলি নাকি?
-তুই তো জানিস লেখক হওয়ার জন‍্য কোনোদিনই আমি লিখি না।হ‍্যাঁ কিছু বই ছাপা হয়েছিল,মানুষের ভালোও লেগেছিল।যথারিতি বেশ কিছু রোজগারও হয়েছিল।
আশিষ:তারপর?
-তারপর আর কি..একটা পত্রিকায় নিয়মিত লেখার প্রস্তাব পেয়েছিলাম।কিন্তু বাঁধা ধরা সময় লেখা আমার পোষায় না।তাই রাজি হইনি।এখন একটা অন‍্য পত্রিকায় নিজের ইচ্ছা মতন লেখা দিই।আয় খুব সামানই হয়।
আশিষ: সেদিনই তোকে বলেছিলাম "আমার সাথে বিলেত চল।জীবনে স্থিরতা আসবে"।কিন্তু তুই গেলি না,বরং আমার ওপর রেগে গেলি।বললি আমি নাকি আমাদের দেওয়া বন্ধুত্বের কথা রাখিনি।হ‍্যাঁ কথা দিয়েছিলাম যে জীবনে যা করব একসাথে করব,কারন আমাদের ভাবনাটাও ছিল একই রকম,কিন্ত..
-কিন্তু তুই মাঝপথে সরে গেলি।
আশিষ:কারন আমি বাস্তবটা বুঝেছিলাম,ভালোভাবে বেঁচে থাকার সামগ্রিক প্রয়োজনটা বুঝেছিলাম।কিন্তু তুই সেটা বুঝিসনি।

ঘরের পর্দা সরিয়ে মা চা নিয়ে অতিথি আপ‍্যায়নে ঘরে ঢুকল।আশিষ উঠে মায়ের পা ছুঁলো।মা ওর মাথায়ে আশীর্বাদের হাত রাখল।তারপর বলল"রাতে খেয়ে যেও"।
কাকিমা,ওটি আজ হবে না,পরে আবার কোনোএকদিন আসব,সেদিন না হয়..
মা:আচ্ছা বেশ তাই হবে।
মা ঘর থেকে বেরিয়ে যাওয়ার পর পুরানো কথার রেশ টেনে বললাম
-তোকে কে বলল যে ভালোভাবে বেঁচে নেই?
আশিষ: হ‍্যাঁ তুই ভালোভাবেই আছিস,কিন্তু স্বার্থপরের মতন,কোনোদিনও কাকিমার চোখের দিকে তাকিয়ে দেখেছিস?সেখানে কতখানি ক্লান্তি জমা আছে!
-হয়ত দেখেছি,আবার হয়ত দেখিনি।হয়ত আমি স্বার্থপর।
বাইরে ভীষন ঝড় উঠল।হাওয়াতে টেবিলে রাখা কাঁচের গ্লাসটা মাটিতে পরে চূর্ণ হয়ে গেল
জানলাটা বন্ধ করতে করতে অস্ফুটেই বললাম -"আমার তিন বছর বয়সে যখন মা আত্মহত্যা করতে গিয়েছিল তখন কি একবারও দেখেছিল আমার চোখে কি ছিল!সবাই নিজের সুখটাকেই ভালোবাসে।আমিও স্বার্থপরের মতো নিজেকেই ভালোবাসি"
কথাগুল বোধহয় আশিষের শ্রুতিগোচর হল না।বলল-"কিছু বলছিস?"
-না কিছু বলিনি।সন্তান হিসাবে সত‍্যি হয়ত নিজের কর্তব‍্য পালন করতে পারিনি।
আশিষ: আচ্ছা আজ চলি তাহলে।
-বাইরে খুব ঝড় হচ্ছে।আরএকটু বোসে যা।
আশিষ:চিন্তা নেই,বিলাতেও ঝড় হয়। উড়ে যাব না।আর এখন অনেকটা শান্ত হয়েছে।
-আচ্ছা আয় তবে।কতদিন আছিস এখানে?
আশিষ:আছি কিছুদিন।
-আচ্ছা।
আশিষকে সাথে নিয়ে দরজার দিকে এগোলাম।দরজা খুলেই চমকে উঠে চোখ বন্ধ করলাম।জানিনা আমার মুখে কি ছিল!আশিষ বিস্মিত হয়ে জিঙ্গাসা করল "কি হল রে?"তাপর নিজেই এগিয়ে গেলে বিষয়টা দেখার জন‍্য।দরজার সামনে একটা মৃত পাখি এসে পরেছে।মাথাটা থেঁতলে গেছে।হঠাৎ দেখলে চোখদুটো আপনেই বন্ধ হয়ে যায়।ঝড়ের করুন পরিণতি আর কি।
আশিস খানিক্ষন খুব হাসল।তারপর বলল তুই তো বলতিস,কাউকে ভালোবাসলে তার পুরটা নিয়ে বাসতে হয়..খারাপ ভালো সবকিছু।আর এই প্রকৃতি প্রেমি?এই নাকি তুই প্রকৃতির সমস্ত উপাদানকে প্রাণভরে উপভোগ করতে চাস?এই তাহলে তোর ভালোবাসা?সুন্দরকে ভালোবাসবি কিন্তু কুৎসিতকে নয়..সৃষ্টিকে ভালোবাসবি কিন্তু বিনাশকে নয়..?অথচ সূর্যের আলো কিন্তু দুজনের ওপরেই এসে পরবে।কাল সকার অবধি অপেক্ষা কর দেখবি,তোর বাগানে একটা ফুলে যে আলো এসে পরেছে,মৃত পাখিটার ওপরেও একই আলো এসে পরেছে।
ধিরে ধিরে বললাম-"কুৎসিতকে ভয়ংকরকে পারবি ভালোবাসতে?পারবি মৃত‍্যুর বীভৎসতাকে ভালোবাসতে?
আশিষ: পারব না বলেই তো আমি আর পাঁচজনের মতই সাধারন ভাবে বাঁচতে চেয়েছি।কিন্তু তুই তো চিরকালই নিজেকে আলাদা রেখেছিস..আলাদা ভেবেছিস..কিন্তু আলাদা হতে পেরেছিস কি?..আচ্ছা আমি আসি।
আশিষ চলে যেতে দরজাটা বন্ধ করে ধিরে ধিরে নিজের ঘরে ঢুকে সেই দরজাটাও বন্ধ করলাম।কানে তখনও ওর শেষের কথাগুলো ধ্বনিত হচ্ছে।আয়নার সামনে এসে দাঁড়ালাম নিজেকে দেখার উদ্দেশ্যে।কিন্তু চোখের সামনে শুধু একদিকে সেই মৃত পাখিটি,আরএকদিকে বইয়ের পাতায় বসা প্রজাপ্রতিটি।

সমাপ্ত



© rupkotha@Tithi