❤তোমায় ভালোবেসে❤
স্কুলের ক্লাসরুমের ভিতরে চিল চিৎকার চলছে, বাইরে থেকে শুনলে মনে হবে মাছের বাজার বসেছে। কেউ... কেউ বেঞ্চে ওপর উঠে খেলছে, কেউ কেউ আবার মাড়ামাড়ি করছে একে অপরের সঙ্গে, আবার কেউ কেউ এরই মধ্যে এর ব্যাগ থেকে ওর ব্যাগ থেকে টিফিন চুরি করে নিচ্ছে। আর এই টিফিন চুরি করার মূল চরিত্র হলো তৃষ্ণা। ওর কোনদিনও নিজের টিফিন খেতে ভালো লাগেনা, তাই সুযোগ বুঝে ওর বিরোধি পক্ষের ব্যাগ থেকে টিফিন চুরি করে নেয়। আজও সেই রকম চুরি করছিল, কিন্তু করা হয়ে উঠল না....!!! তার আগেই স্যার ক্লাসরুমে ঢুকে পড়লেন, সাথে সাথে সবাই শান্ত হয়ে যে... যার জায়গায় বসে পড়ল। তবে আজ সবাই একটু অবাক হয়েছে, কারন স্যারের সাথে আজকে ওদের বয়সি একজন মোটা ফ্রেমের গোল চশমা পড়া ছেলে দাঁড়িয়ে আছে। যে... দুদিন আগেই এসেছে তৃষ্ণাদের বাড়ির পাশের বাড়িতে ভাড়াটিয়া রুপে। তৃষ্ণা নিজের ঘরের জানলা দিয়ে দু.... একবার কথা বলার চেষ্টা করেছে, কিন্তু ছেলেটি পাত্তা দেয়নি, বড্ড গম্ভীর। তাই তৃষ্ণাও আর কথা বলার চেষ্টা করেনি।
---------ক্লাসরুমের সবাই স্যারকে দেখে একসাথে বলে উঠল, গুড.... মর্নিং.... স্যার....
-------স্যারও বলে উঠলেন, গুড.... মর্নিং.... স্টুডেন্ট, আজ তোমাদের সাথে তোমাদের আর এক নতুন বন্ধুর পরিচয় করিয়ে দেব, ও... হল সৌনক সেন। আজ থেকে তোমাদের সাথে পড়বে।
----------সবাই আবার একসাথে বলে উঠল, হাই.... সৌনক, তৃষ্ণা বাদে, কারন... ওর ভীতরে রাগ আছে আগের দিন সৌনক ওর সাথে কথা বলেনি বলে। কিন্তু আজও একই ব্যাপার লক্ষ্য করল তৃষ্ণা, সৌনকের দিক থেকে কোনরকম উত্তর এলোনা, এমনকি ঠোঁটের কোনে হাসিটুকুও না...!! স্যার নির্দেশ দিল সৌনককে তৃষ্ণার পাশে বসতে। স্যার কথা মতো সৌনক বসল ঠিক তৃষ্ণার পাশে এসে।
****************************
এইভাবে পার হয়ে গেল একমাস। সৌনক আর তৃষ্ণার বন্ধুত্ব হয়েছে, সৌনক খুব কম কথা বলে আর তৃষ্ণা সারাক্ষন বকবক করে চলে নিজের মত। তবে রোজ এসে ঠিক তৃষ্ণার পাশে বসে সৌনক, অলিখিত ভাবে তৃষ্ণার পাশের জায়গাটা এখন ওর হয়েগেছে, সারাক্ষন উদাসী দৃষ্টিতে ক্লাসরুমের জানলা দিয়ে তাকিয়ে থাকে সৌনক বাইরের দিকে, আর কিসব ভাবতে থাকে। তৃষ্ণা কিন্তু ওর দুষ্টুমি চালিয়ে যায়, সৌনকের তাতে ভালোলাগা বা... বিরক্ত কিছুই যেন নেই!!! তবে এখন আর তৃষ্ণাকে টিফিন চুরি করতে হয়না!!!সৌনক এর টিফিন তৃষ্ণা খায়,আর তৃষ্ণার টিফিন সৌনক। অবশ্য এই নিয়ম চালু হওয়ার পিছনে কারন আছে। গোটা এক সপ্তাহ সৌনক টিফিন খেতে পায়নি, কারন টিফিন রোজ চুরি হয়ে যেত। সৌনক বুঝতেও পারতোনা কে করতো!!! একদিন হঠাৎ সৌনক মাথাঘুরে পড়ে যায়, তারপর থেকে তৃষ্ণা আর টিফিন চুরি করেনা বরং ভাগ করে খায়।
এইভাবে বেশ ধীরে ধীরে একটা বন্ধুত্বের বন্ধন গড়ে উঠছিল তৃষ্ণা এবং সৌনকের মধ্যে। যেখানে তৃষ্ণা সমস্ত কিছু নিয়ম কানুন চালু করেছিল, আর সৌনক বিনা বাক্যব্যায়ে সেইসব মেনে চলত। কিন্তু বেশ কিছু বছর পর সৌনকের বাবার ট্রান্সফার হয়ে গেল এবং সৌনকরা আবার চলে গেল অন্য জায়গায়। তৃষ্ণা সেই দিন খুব কেঁদেছিল বন্ধুত্বের বিচ্ছেদের জন্য। তবে তৃষ্ণা সেইদিন লক্ষ্য করেছিল সৌনক চুপচাপ থাকলেও ওর মোটা ফ্রেমের পাওয়ারের চশমায় ঢাকা চোখটা জলে চিকচিক করে উঠেছিল। সৌনক শুধু যাওয়ার আগে একটা কথা বলেছিল আবার দেখা হবে.........
****************************
সময় স্রোতের তীব্র প্রবাহে পার হয়ে গেছে অনেকগুলো বছর। তৃষ্ণা স্কুলের গন্ডি পেরিয়ে এখন কলেজে, তবে তৃষ্ণার দুষ্টুমি এবং বকবক কোন অংশে কমেনি। বরং বয়স বাড়ার সাথে সাথে সবকিছু বেড়ে গেছে। তৃষ্ণা এখন একজন চঞ্চল, প্রানবন্ত, তরুণী। সৌনক আজও তৃষ্ণার মনের মধ্যে গেঁথে আছে ভালো বন্ধু হয়ে। তৃষ্ণা এতদিনে অনেক বন্ধু পেয়েছে, কিন্তু সৌনকের মত একজনকেও পাইনি!!! যে.... নির্ধিদ্ধায় ওর সমস্ত অত্যাচার, দুষ্টুমি, অন্যায়, আবদার মেনে নিত, আর থেকে থেকে গোল গোল করে অবাক দৃষ্টিতে চেয়ে থাকত তৃষ্ণার দিকে। তৃষ্ণা মাঝে মাঝে সোস্যাল মিডিয়ায় সার্চ করে সৌনক সেন নামে, অনেক প্রোফাইল ভেসে আসে স্ক্রিনে কিন্তু কোনটা যে.... ওর বন্ধু সৌনক, সেটাই বুঝতে পারেনা!!! তাই তৃষ্ণা বৃথা খোঁজার চেষ্টা ত্যাগ করে দিয়েছে। সেই রকমই একদিন রাত্রে বেলায় ফেসবুক করার সময় তৃষ্ণার কাছে একটা পোষ্ট আসে খুব সুন্দর দুটো লাইনের কোটেশন সাথে একটা নাম সৌনক সেন......।
হাসি, কান্না, সুখ, দুঃখ,
রাগ অনুরাগ, মান, অভিমান সবকিছু অনুভূতিতে আছে মিশে,
আমি আজও এগিয়ে চলেছি জীবন পথে তোমায় ভালোবেসে।
তৃষ্ণা সাথে সাথে পেজটা ওপেন করে, কিন্তু না..... লেখাটা শেয়ার করা হয়েছে অন্য কোথাও থেকে। তৃষ্ণা পোস্টটা সেভ করে রাখে নিজের মোবাইলে। লাইন দুটো তৃষ্ণার মনে গেঁথে যায়। তৃষ্ণা বিভিন্ন ভাবে খুঁজতে থাকে, কারন তৃষ্ণার বারবার মনে হতে থাকে এই লেখার লেখক বুঝি ওর সৌনক হবে। কিন্তু অনেক চেষ্টা করেও তৃষ্ণা শেষমেশ ব্যার্থ হয়, তাই মাথা থেকে সমস্ত চিন্তা ঝেড়েফেলে আবার নতুন করে এগিয়ে চলে সমস্ত পিছুটান পিছনে ফেলে। কারন আগামীকাল কলকাতা বইমেলার উদ্বোধন, আর তৃষ্ণা এবং ওর বন্ধুরা মিলে ঠিক করেছে একসাথে যাবে বইমেলায়। তাই প্ল্যান মাফিক ওরা বেড়িয়ে পড়ল।
বইমেলায় এসে ওরা যেন বই এর সাগরে ডুবে গেল। চারিদিকে শুধু বই আর বই, পুরনো লেখকের পাশাপাশি নতুন লেখদেরও। তৃষ্ণা মনযোগ দিয়ে একটা বই হাতে নিয়ে উল্টেপাল্টে দেখছিল,
---------তখন বুক স্টলের লোকটি বলে উঠল, দিদি এই বইটা দেখতে পারেন!!! নতুন লেখক সৌনক সেনের। নামটা শুনেই তৃষ্ণা বইটা হাতে নিয়ে নামটার ওপর হাত বোলাতে লাগল। তখনও লোকটি বলে চলেছে, ওনার লেখা এখন সবাই খুব পছন্দ করছে, অনেক পিস তুলেছিলাম সব বিক্রি হয়েগেছে, এই একটাই পড়ে আছে। আজ ওনাকে সম্মান জানানো হবে। এত অল্প বয়সে এত সুন্দর লেখেন, কি বলব!!! নিন পড়ে ভালো লাগবে।
----------ঠিক তখন পিছন থেকে একজন বলে উঠল, লেখক সৌনক সেনের গল্প তোমায় ভালোবেসে বইটা পাওয়া যাবে???
---------লোকটি বলে উঠল, না..... দাদা এক পিস ছিল, এই দিদি নিল, আবার কালকে আসলে পাবেন!!!
--------পিছনের ছেলেটি বলে উঠল, ও.. আচ্ছা।
তৃষ্ণা তখনও চেয়ে আছে এক দৃষ্টিতে বইটির দিকে, কালো মোটা মোটা অক্ষরে লেখা আছে তোমায় ভালোবেসে লেখক সৌনক সেন।
----------বুক স্টলের লোকটি বলে উঠল, কি... হল দিদি নেবে না.. বইটা!!! তাহলে ঐ.... দাদাবাবুকে দেব!!
---------তৃষ্ণা সাথে সাথে বলে উঠল, হ্যাঁ.... নেব কত দাম বলো???
--------লোকটি বলে উঠল, মাত্র দুশো টাকা।
----------তৃষ্ণা ব্যাগ থেকে টাকা বার করতে করতে বলে উঠল, আর কি..... বলছিলে সম্মান দেওয়া হবে কাকে?????
---------লোকটি টাকটা নিয়ে বলে উঠল, ঐ.... তো তরুণ লেখক সৌনক সেনকে।
---------তৃষ্ণা বলে উঠল কখন??? কবে???
---------লোকটি বলে উঠল, এইতো ঘন্টা দেড়েকের মধ্যে।
তৃষ্ণা আর কোন জায়গায় না.... গিয়ে ধীরে ধীরে এক পা... এক পা... করে অস্থায়ীভাবে তৈরী মঞ্চের দিকে এগিয়ে গেল, এবং একটা চেয়ারে বসল।
--------তৃষ্ণার বন্ধুরা তৃষ্ণার এইরূপ আচরণে অবাক হয়ে বলে উঠল, কিরে তুই তোর রেডিও বন্ধ করে চুপচাপ বসে পড়লি??? শরীর ঠিক আছে তো??
----------তৃষ্ণা বলে উঠল, হ্যাঁ সব ঠিক আছে, তোরা ঘোর আমি একজনের খোঁজে এইখানে বসলাম। তোদের ঘোরা হয়েগেলে এইখানে চলে আসবি আমি এইখানেই বসে থাকব।
ওরা আর কথা না বাড়িয়ে চলে গেল। তৃষ্ণা বইএর প্রথম পাতাটা উল্টালো এবং পড়তে শুরু করল। দশবারো পৃষ্ঠা পড়ার পর তৃষ্ণার কানে মাইক্রোফোনের আওয়াজ ভেসে আসল........
-----------শুরু হতে চলেছে আমাদের সাহিত্য সম্মাননা পুরস্কার বিতরনী অনুষ্ঠান। আমাদের প্রধান অতিথি বিশিষ্ট সাহিত্যবিদ নোবেল পুরস্কার জয়ী, শ্রীমতি বেলাভূমি রায়। তিনি আমাদের সমস্ত লেখকদের হাতে সম্মানপত্র তুলে দেবেন।
তৃষ্ণা বইটা বন্ধ করে সামনের দিকে তাকাল। সামনের মঞ্চ তখন আলোতে ঝলমল করছে। একে একে সবার নাম ঘোষনা করা হচ্ছে, এবং তাদের হাতে তুলে দেওয়া হচ্ছে সম্মানপত্র এবং তার মাঝে মাঝে চলছে আবৃত্তি এবং রবীন্দ্রসঙ্গীতের ছোট অনুষ্ঠান। তৃষ্ণা ধৈর্য্য ধরে বসে আছে সেই মানুষটার জন্য। তৃষ্ণা আদৌও জানেনা এই মানুষটাই ওর সৌনক কিনা!!! তবুও নামের প্রতি এক অমোঘ আকর্ষনের জন্য তৃষ্ণা এখনও অপেক্ষায় আছে। তৃষ্ণার অপেক্ষার অবসান হলো মাইক্রফোনে ভেসে আসল সৌনক সেনের নাম। চারিদিকে হাততালির আওয়াজ হতে লাগল, তৃষ্ণা এক দৃষ্টিতে চেয়ে আছে মঞ্চের দিকে, ধীরে ধীরে তৃষ্ণার চোখের সামনে ফুটে উঠল একটা অবয়ব, এলোমেলো চুল, চোখে মোটাফ্রেমের পাওয়ার বালা চশমা, পাজামা পাঞ্জাবী পড়ে কাঁধে ঝোলানো একটা ব্যাগ। তবে তৃষ্ণার দৃষ্টি আটকেছে মোটাফ্রেমের চশমা দিকে।
--------মাইকে ভেসে আসতে লাগল কথা, নতূন প্রজন্মের তরুণ লেখক সৌনক সেনের হাতে তুলে দেওয়া হল সাহিত্য সম্মান পত্র। আমি অনুরোধ করছি, লেখক সৌনক সেনকে কিছু বলার জন্য।
তৃষ্ণার চোখের পলক পড়ছেনা মন বারবার বলছে এটাই তোর সৌনক হবে। তৃষ্ণার চোখ অতীতের স্মৃতির পাতা থেকে তুলে আনা সৌনকের মুখের সাথে মেলাতে চেষ্টা করছে, মিল খুঁজে পাওয়ার জন্য উদগ্রিব হয়ে উঠছে কিন্তু কিছুতেই মিল খুঁজে পাচ্ছেনা। ঠিকই তখনই ভেসে আসল কয়েকটা কথা........
----------নমস্কার এবং অসংখ্য ধন্যবাদ আপনাদের সকলকে, আমার লেখাটা পছন্দ করার জন্য। আমি বেশি কথা বলতে পারিনা, তাই এইখানেই আমার কথা শেষ করলাম।
---------হঠাৎ প্রশ্ন ভেসে আসতে লাগল, আপনার গল্পটা কি.... নিছক কল্পনা!!! নাকি এর সাথে আপনার জীবনের কিছুটা মিল আছে??
---------সৌনক সেন চলে যেতে গিয়েও আবার বলে উঠল পুরোটা কল্পনা নয়!!!! আর কিছু না... বলে সৌনক সেন চলে গেলেন।
তৃষ্ণা মিল খুঁজতে গিয়েও ব্যার্থ হয়ে ফিরে এল। এবং শুরু করল গল্পটা পড়া। যত পড়তে লাগল ততই যেন নিজেকে একাত্ম করে ফেলতে লাগল গল্পের চরিত্র শ্রীতমার সাথে। বারবার মনে হতে লাগল তৃষ্ণার এটা ওর আর সৌনকের কাহিনী যেটা সৌনক কল্পনা করেছে। তাইতো বলে উঠল পুরোটা কাল্পনিক নয়। তৃষ্ণার চোখে জল ভরে উঠেছে শ্রীতমা এবং অনিকেতের ভালোবাসা জয় করার কাহিনী পড়ে। তৃষ্ণা মনে মনে ঠিক করে ফেলেছে যে.... করেই হোক সৌনক সেনের সাথে ওকে কথা বলতে হবে, কিন্তু কি করে?? তৃষ্ণার মাথায় হঠাৎ করে আইডিয়া খেলে যায় এবং বইএর পিছনে থাকা পাবলিসারের ফোনে ফোন করে সৌনক সেনের নাম্বার চায়। কিন্তু তিনি দিতে নারাজ। শেষে অনেক সাধ্য সাধনা করে নাম্বারটা জোগাড় করে তৃষ্ণা। কিন্তু নাম্বারটা হাতে পেয়েও ফোন করতে পারেনা, কেমন একটা অজানা ভয় বাসা বাঁধে মনের মধ্যে, যদি ওর ধারনা ভুল হয়!!! ওর সৌনক যদি না... হয় তাহলে!!!! পরক্ষনেই নিজের মনকে বুঝিয়ে কাঁপা কাঁপা হাতে নম্বর ডায়েল করে ফেলে তৃষ্ণা।
----------টানা রিং হয়ে ঠিক কেটে যাওয়ার আগের মুহুর্তে একটা গম্ভীর গলার স্বর ভেসে আসে ওপাস থেকে, হ্যালো......
-----------তৃষ্ণা বলে উঠে, নমস্কার লেখক সৌনক সেন বলছেন আপনি???
----------ওপাস থেকে উত্তর আসে, হ্যাঁ.... বলছি বলুন, আপনি কে????
---------তৃষ্ণা বলে উঠে, তোমায় ভালোবেসে গল্পটা নিয়ে আমার একটা প্রশ্ন আছে, করতে পারি?????
---------সৌনক সেন বলে উঠল, হ্যাঁ..... অবশ্যই করুন!!!
---------তৃষ্ণা দৃঢ় কন্ঠে বলে উঠল, আচ্ছা তোমায় ভালোবেসে গল্পের শ্রীতমা কি আসলে আপনার স্কুলফ্রেন্ড তৃষ্ণা???
---------কিছুক্ষনের গভীর নিস্তব্ধতা ভেদ করে সৌনক বলে উঠল, আপনি কে বলুন তো??? আর তৃষ্ণাকে চিনলেন কি.. করে??? আর জানলেনই বা.... কি করে তৃষ্ণা আর আমার বন্ধুত্বের কথা!!!!
----------তৃষ্ণার কাছে সমস্ত কিছু পরিষ্কার, তৃষ্ণা এতদিন ধরে যাকে খুঁজছিল তাকে পেয়ে গেছে। তৃষ্ণা নিজের আনন্দকে ধরে রাখতে পারলনা, হো.... হো.... করে হেসে বলে উঠল, ওরে জ্ঞানি, সাহিত্যিক, বুদ্ধু আমি খুব ভালোকরে সবকিছু জানি এবং চিনি, কারন আমি স্বয়ং তৃষ্ণা বলছি।
---------সৌনক উত্তেজিত হয়ে বলে উঠল, তুই.....তৃষ্ণা, আমার সেই ছোট্ট তৃষ্ণা... মিথ্যে বলছিস নাতো????
----------তৃষ্ণা বলে উঠল একটু মিথ্যে আছে, আমি এখন ছোট নয় বড় হয়েগেছি, তুই চিনতেও পারবিনা!!! অবশ্য আগের দিন তোকে চোখের সামনে দেখে আমিও চিনতে পারিনি!!!!
--------সৌনক সাথে সাথে বলে উঠল, তুই কোথায় দেখেছিস আমাকে????
--------তৃষ্ণা বলে উঠল, বই মেলায়, একদম প্রথম সাড়ির চেয়ারে বসে ছিলাম, অবশ্য তুই লক্ষ্য করিসনি!!!! বড় লেখক হয়ে গেছিস এখনকি আর আমার কথা মনে থাকবে!!!
----------সৌনক বলে উঠল, কালকে আমার সাথে দেখা করবি প্রীন্সেপ ঘাটে বিকেল পাঁচটায়, তোর সাথে অনেক কথা আছে।
---------তৃষ্ণা বলে উঠল, ওকে যেতে পারি তবে একটা শর্ত আছে!!!
----------সৌনক করুন সুরে বলে উঠল, কি... শর্ত???
--------তৃষ্ণা হাসতে হাসতে বলে উঠল, টিফিন আনতে হবে আমার জন্য কাকিমার হাতের তৈরী হিংএর কচুরি আর ভাঙ্গা আলুর দম।
---------সৌনক বলে উঠল, আনব তারসাথে আরও কিছু থাকবে।
******************************
গঙ্গার বুকে জোয়ার এসেছে, গঙ্গার জল একবার করে এগিয়ে এসে ধাক্কা দিচ্ছে পাড়ে আবার একই ভাবে ফিরে যাচ্ছে। দূরে একটা নৌকা বাঁধা আছে সেও জলের তালে তালে দুলছে, গঙ্গার জলে পা.... ডুবিয়ে বসে আছে সৌনক আর তৃষ্ণা। গঙ্গার শীতল হাওয়ায় তৃষ্ণার চুল গুলো হাল্কা উড়ে পড়ছে সৌনকের মুখে। সৌনকের তাতে কোন রকম বিরক্তি নেই, সৌনক একভাবে দেখে চলেছে তৃষ্ণাকে। সূর্য তখন অস্ত যাওয়ার পথে পা... বাড়িয়েছে। দিকে দিকে ল্যাম্পপোষ্টের আলো জ্বলে উঠেছে। আর সেই আলো গঙ্গার জলের ওপর পড়ে সুন্দর সুন্দর জলছবি এঁকে চলেছে।
----------তৃষ্ণা আর চুপ থাকতে না..... পেরে বলে উঠল, তখন থেকে চুপ করে বসে আছিস, কিছুই বলছিসনা!!! তোর কি...কোন কথা নেই!! বললি যে অনেক কথা আছে তাহলে!!! সত্যি এতক্ষন কথা না... বলে কি করে যে... থাকিস কে জানে??? আমার তো.... দম বন্ধ হয়ে আসছিল কথা বলতে না... পারার জন্য, কই দেখিদে টিফিন বক্সটা।
---------সৌনক কিছু না... বলে ব্যাগ থেকে টিফিন বক্সটা বার করে খুলে নিজের হাতে খাবার তুলে ধরল তৃষ্ণার মুখের সামনে।
----------তৃষ্ণা মনের আনন্দে খেতে লাগল। আর বকবক করতে লাগল। তৃষ্ণা বলে উঠল, তোর কি.... কোন কথা নেই!!! এতদিন পর দেখা হলো আমাদের তাও কি রকম চুপচাপ বসে আছিস!!!
-----------সৌনক বলে উঠল, আমার সমস্ত কথাতো আমি লেখার মাধ্যমে বলে দিয়েছি, তবে এখন একটা কথা বলবো, তার উত্তর দিবি তো... তুই???
----------তৃষ্ণা জিজ্ঞাসা দৃষ্টিতে সৌনকের দিকে তাকিয়ে বলে উঠল, কি... কথা???
---------সৌনক এক গুচ্ছ টাটকা গোলাপ হাতে বলে উঠল.......
হাসি, কান্না, সুখ, দুঃখ,
রাগ, অনুরাগ, মান অভিমান
সবকিছু অনুভূতিতে আছে মিশে,
আমি আজও এগিয়ে চলেছি
জীবন পথে শুধু তোমায় ভালোবেসে,
শুধু তোমায় ভালোবেসে।
তৃষ্ণা এক দৃষ্টিতে চেয়ে আছে সৌনকের দিকে, কি বলবে বুঝতে পারছেনা যদিও ও বইটা পড়ে বুঝতে পেরেছে সৌনক ওকে ভালোবাসে কিন্তু যে... ছেলেটা এত কম কথা বলে, সে... এইভাবে প্রপোজ করবে সবার মাঝে, সেটা কোনদিনও কল্পনা করতে পারেনি তৃষ্ণা।
----------সৌনক বলে উঠল, কিরে.. উত্তর দিবি না....!!!
----------তৃষ্ণা ফুলটা সৌনকের হাত থেকে নিয়ে বলে উঠল, আমিতো আর লেখিকা নয় যে.... ছন্দ মিলিয়ে কবিতা শোনাব, কিন্তু আমার একটা দাবি আছে...??
--------সৌনক বলে উঠল, কি.... দাবি সব মানতে আমি রাজি।
----------তৃষ্ণা বলে উঠল, সব সময় চুপ থাকলে চলবে, কিন্তু আমি যখন রেগে গিয়ে ঝগড়া করবো, তখন কিন্তু আমার সাথে তাল মিলিয়ে ঝগড়া করতে হবে, চুপ করে থাকলে হবে না....!! ভালোবাসায় একটু খুনসুটি, ঝগড়া, মান অভিমান না... থাকলে কেমন প্যানসা প্যানসা লাগবে ঠিক নুন, ঝাল, ছাড়া তরকারির মত।
-------সৌনক মৃদু হেসে তৃষ্ণার হাতটা ধরে বলে উঠল.......
আমি নিজেকে বদলাতেও রাজি,
আমি হাসতেও রাজি,
আমি কাঁদতেও রাজি,
তোমায় নিয়ে সুখের ভেলায়
ভাসতে রাজি,
আবার দুঃখের সাগরে
ডুবতেও রাজি,
আমি তোমায় বাঁধতে চাই
আমার বন্ধনে,
আগলে রাখতে চাই
তোমায় সঙ্গপনে,
আমি সারাজীবন চলতে চাই
তোমার পাশে পাশে
তোমায় ভালোবেসে....
শুধু তোমায় ভালোবেসে।
............সমাপ্ত...............
💞💞💞💞💞💞💞💞
✍শিপ্রা চক্রবর্তী
© shipra chakraborty2021
---------ক্লাসরুমের সবাই স্যারকে দেখে একসাথে বলে উঠল, গুড.... মর্নিং.... স্যার....
-------স্যারও বলে উঠলেন, গুড.... মর্নিং.... স্টুডেন্ট, আজ তোমাদের সাথে তোমাদের আর এক নতুন বন্ধুর পরিচয় করিয়ে দেব, ও... হল সৌনক সেন। আজ থেকে তোমাদের সাথে পড়বে।
----------সবাই আবার একসাথে বলে উঠল, হাই.... সৌনক, তৃষ্ণা বাদে, কারন... ওর ভীতরে রাগ আছে আগের দিন সৌনক ওর সাথে কথা বলেনি বলে। কিন্তু আজও একই ব্যাপার লক্ষ্য করল তৃষ্ণা, সৌনকের দিক থেকে কোনরকম উত্তর এলোনা, এমনকি ঠোঁটের কোনে হাসিটুকুও না...!! স্যার নির্দেশ দিল সৌনককে তৃষ্ণার পাশে বসতে। স্যার কথা মতো সৌনক বসল ঠিক তৃষ্ণার পাশে এসে।
****************************
এইভাবে পার হয়ে গেল একমাস। সৌনক আর তৃষ্ণার বন্ধুত্ব হয়েছে, সৌনক খুব কম কথা বলে আর তৃষ্ণা সারাক্ষন বকবক করে চলে নিজের মত। তবে রোজ এসে ঠিক তৃষ্ণার পাশে বসে সৌনক, অলিখিত ভাবে তৃষ্ণার পাশের জায়গাটা এখন ওর হয়েগেছে, সারাক্ষন উদাসী দৃষ্টিতে ক্লাসরুমের জানলা দিয়ে তাকিয়ে থাকে সৌনক বাইরের দিকে, আর কিসব ভাবতে থাকে। তৃষ্ণা কিন্তু ওর দুষ্টুমি চালিয়ে যায়, সৌনকের তাতে ভালোলাগা বা... বিরক্ত কিছুই যেন নেই!!! তবে এখন আর তৃষ্ণাকে টিফিন চুরি করতে হয়না!!!সৌনক এর টিফিন তৃষ্ণা খায়,আর তৃষ্ণার টিফিন সৌনক। অবশ্য এই নিয়ম চালু হওয়ার পিছনে কারন আছে। গোটা এক সপ্তাহ সৌনক টিফিন খেতে পায়নি, কারন টিফিন রোজ চুরি হয়ে যেত। সৌনক বুঝতেও পারতোনা কে করতো!!! একদিন হঠাৎ সৌনক মাথাঘুরে পড়ে যায়, তারপর থেকে তৃষ্ণা আর টিফিন চুরি করেনা বরং ভাগ করে খায়।
এইভাবে বেশ ধীরে ধীরে একটা বন্ধুত্বের বন্ধন গড়ে উঠছিল তৃষ্ণা এবং সৌনকের মধ্যে। যেখানে তৃষ্ণা সমস্ত কিছু নিয়ম কানুন চালু করেছিল, আর সৌনক বিনা বাক্যব্যায়ে সেইসব মেনে চলত। কিন্তু বেশ কিছু বছর পর সৌনকের বাবার ট্রান্সফার হয়ে গেল এবং সৌনকরা আবার চলে গেল অন্য জায়গায়। তৃষ্ণা সেই দিন খুব কেঁদেছিল বন্ধুত্বের বিচ্ছেদের জন্য। তবে তৃষ্ণা সেইদিন লক্ষ্য করেছিল সৌনক চুপচাপ থাকলেও ওর মোটা ফ্রেমের পাওয়ারের চশমায় ঢাকা চোখটা জলে চিকচিক করে উঠেছিল। সৌনক শুধু যাওয়ার আগে একটা কথা বলেছিল আবার দেখা হবে.........
****************************
সময় স্রোতের তীব্র প্রবাহে পার হয়ে গেছে অনেকগুলো বছর। তৃষ্ণা স্কুলের গন্ডি পেরিয়ে এখন কলেজে, তবে তৃষ্ণার দুষ্টুমি এবং বকবক কোন অংশে কমেনি। বরং বয়স বাড়ার সাথে সাথে সবকিছু বেড়ে গেছে। তৃষ্ণা এখন একজন চঞ্চল, প্রানবন্ত, তরুণী। সৌনক আজও তৃষ্ণার মনের মধ্যে গেঁথে আছে ভালো বন্ধু হয়ে। তৃষ্ণা এতদিনে অনেক বন্ধু পেয়েছে, কিন্তু সৌনকের মত একজনকেও পাইনি!!! যে.... নির্ধিদ্ধায় ওর সমস্ত অত্যাচার, দুষ্টুমি, অন্যায়, আবদার মেনে নিত, আর থেকে থেকে গোল গোল করে অবাক দৃষ্টিতে চেয়ে থাকত তৃষ্ণার দিকে। তৃষ্ণা মাঝে মাঝে সোস্যাল মিডিয়ায় সার্চ করে সৌনক সেন নামে, অনেক প্রোফাইল ভেসে আসে স্ক্রিনে কিন্তু কোনটা যে.... ওর বন্ধু সৌনক, সেটাই বুঝতে পারেনা!!! তাই তৃষ্ণা বৃথা খোঁজার চেষ্টা ত্যাগ করে দিয়েছে। সেই রকমই একদিন রাত্রে বেলায় ফেসবুক করার সময় তৃষ্ণার কাছে একটা পোষ্ট আসে খুব সুন্দর দুটো লাইনের কোটেশন সাথে একটা নাম সৌনক সেন......।
হাসি, কান্না, সুখ, দুঃখ,
রাগ অনুরাগ, মান, অভিমান সবকিছু অনুভূতিতে আছে মিশে,
আমি আজও এগিয়ে চলেছি জীবন পথে তোমায় ভালোবেসে।
তৃষ্ণা সাথে সাথে পেজটা ওপেন করে, কিন্তু না..... লেখাটা শেয়ার করা হয়েছে অন্য কোথাও থেকে। তৃষ্ণা পোস্টটা সেভ করে রাখে নিজের মোবাইলে। লাইন দুটো তৃষ্ণার মনে গেঁথে যায়। তৃষ্ণা বিভিন্ন ভাবে খুঁজতে থাকে, কারন তৃষ্ণার বারবার মনে হতে থাকে এই লেখার লেখক বুঝি ওর সৌনক হবে। কিন্তু অনেক চেষ্টা করেও তৃষ্ণা শেষমেশ ব্যার্থ হয়, তাই মাথা থেকে সমস্ত চিন্তা ঝেড়েফেলে আবার নতুন করে এগিয়ে চলে সমস্ত পিছুটান পিছনে ফেলে। কারন আগামীকাল কলকাতা বইমেলার উদ্বোধন, আর তৃষ্ণা এবং ওর বন্ধুরা মিলে ঠিক করেছে একসাথে যাবে বইমেলায়। তাই প্ল্যান মাফিক ওরা বেড়িয়ে পড়ল।
বইমেলায় এসে ওরা যেন বই এর সাগরে ডুবে গেল। চারিদিকে শুধু বই আর বই, পুরনো লেখকের পাশাপাশি নতুন লেখদেরও। তৃষ্ণা মনযোগ দিয়ে একটা বই হাতে নিয়ে উল্টেপাল্টে দেখছিল,
---------তখন বুক স্টলের লোকটি বলে উঠল, দিদি এই বইটা দেখতে পারেন!!! নতুন লেখক সৌনক সেনের। নামটা শুনেই তৃষ্ণা বইটা হাতে নিয়ে নামটার ওপর হাত বোলাতে লাগল। তখনও লোকটি বলে চলেছে, ওনার লেখা এখন সবাই খুব পছন্দ করছে, অনেক পিস তুলেছিলাম সব বিক্রি হয়েগেছে, এই একটাই পড়ে আছে। আজ ওনাকে সম্মান জানানো হবে। এত অল্প বয়সে এত সুন্দর লেখেন, কি বলব!!! নিন পড়ে ভালো লাগবে।
----------ঠিক তখন পিছন থেকে একজন বলে উঠল, লেখক সৌনক সেনের গল্প তোমায় ভালোবেসে বইটা পাওয়া যাবে???
---------লোকটি বলে উঠল, না..... দাদা এক পিস ছিল, এই দিদি নিল, আবার কালকে আসলে পাবেন!!!
--------পিছনের ছেলেটি বলে উঠল, ও.. আচ্ছা।
তৃষ্ণা তখনও চেয়ে আছে এক দৃষ্টিতে বইটির দিকে, কালো মোটা মোটা অক্ষরে লেখা আছে তোমায় ভালোবেসে লেখক সৌনক সেন।
----------বুক স্টলের লোকটি বলে উঠল, কি... হল দিদি নেবে না.. বইটা!!! তাহলে ঐ.... দাদাবাবুকে দেব!!
---------তৃষ্ণা সাথে সাথে বলে উঠল, হ্যাঁ.... নেব কত দাম বলো???
--------লোকটি বলে উঠল, মাত্র দুশো টাকা।
----------তৃষ্ণা ব্যাগ থেকে টাকা বার করতে করতে বলে উঠল, আর কি..... বলছিলে সম্মান দেওয়া হবে কাকে?????
---------লোকটি টাকটা নিয়ে বলে উঠল, ঐ.... তো তরুণ লেখক সৌনক সেনকে।
---------তৃষ্ণা বলে উঠল কখন??? কবে???
---------লোকটি বলে উঠল, এইতো ঘন্টা দেড়েকের মধ্যে।
তৃষ্ণা আর কোন জায়গায় না.... গিয়ে ধীরে ধীরে এক পা... এক পা... করে অস্থায়ীভাবে তৈরী মঞ্চের দিকে এগিয়ে গেল, এবং একটা চেয়ারে বসল।
--------তৃষ্ণার বন্ধুরা তৃষ্ণার এইরূপ আচরণে অবাক হয়ে বলে উঠল, কিরে তুই তোর রেডিও বন্ধ করে চুপচাপ বসে পড়লি??? শরীর ঠিক আছে তো??
----------তৃষ্ণা বলে উঠল, হ্যাঁ সব ঠিক আছে, তোরা ঘোর আমি একজনের খোঁজে এইখানে বসলাম। তোদের ঘোরা হয়েগেলে এইখানে চলে আসবি আমি এইখানেই বসে থাকব।
ওরা আর কথা না বাড়িয়ে চলে গেল। তৃষ্ণা বইএর প্রথম পাতাটা উল্টালো এবং পড়তে শুরু করল। দশবারো পৃষ্ঠা পড়ার পর তৃষ্ণার কানে মাইক্রোফোনের আওয়াজ ভেসে আসল........
-----------শুরু হতে চলেছে আমাদের সাহিত্য সম্মাননা পুরস্কার বিতরনী অনুষ্ঠান। আমাদের প্রধান অতিথি বিশিষ্ট সাহিত্যবিদ নোবেল পুরস্কার জয়ী, শ্রীমতি বেলাভূমি রায়। তিনি আমাদের সমস্ত লেখকদের হাতে সম্মানপত্র তুলে দেবেন।
তৃষ্ণা বইটা বন্ধ করে সামনের দিকে তাকাল। সামনের মঞ্চ তখন আলোতে ঝলমল করছে। একে একে সবার নাম ঘোষনা করা হচ্ছে, এবং তাদের হাতে তুলে দেওয়া হচ্ছে সম্মানপত্র এবং তার মাঝে মাঝে চলছে আবৃত্তি এবং রবীন্দ্রসঙ্গীতের ছোট অনুষ্ঠান। তৃষ্ণা ধৈর্য্য ধরে বসে আছে সেই মানুষটার জন্য। তৃষ্ণা আদৌও জানেনা এই মানুষটাই ওর সৌনক কিনা!!! তবুও নামের প্রতি এক অমোঘ আকর্ষনের জন্য তৃষ্ণা এখনও অপেক্ষায় আছে। তৃষ্ণার অপেক্ষার অবসান হলো মাইক্রফোনে ভেসে আসল সৌনক সেনের নাম। চারিদিকে হাততালির আওয়াজ হতে লাগল, তৃষ্ণা এক দৃষ্টিতে চেয়ে আছে মঞ্চের দিকে, ধীরে ধীরে তৃষ্ণার চোখের সামনে ফুটে উঠল একটা অবয়ব, এলোমেলো চুল, চোখে মোটাফ্রেমের পাওয়ার বালা চশমা, পাজামা পাঞ্জাবী পড়ে কাঁধে ঝোলানো একটা ব্যাগ। তবে তৃষ্ণার দৃষ্টি আটকেছে মোটাফ্রেমের চশমা দিকে।
--------মাইকে ভেসে আসতে লাগল কথা, নতূন প্রজন্মের তরুণ লেখক সৌনক সেনের হাতে তুলে দেওয়া হল সাহিত্য সম্মান পত্র। আমি অনুরোধ করছি, লেখক সৌনক সেনকে কিছু বলার জন্য।
তৃষ্ণার চোখের পলক পড়ছেনা মন বারবার বলছে এটাই তোর সৌনক হবে। তৃষ্ণার চোখ অতীতের স্মৃতির পাতা থেকে তুলে আনা সৌনকের মুখের সাথে মেলাতে চেষ্টা করছে, মিল খুঁজে পাওয়ার জন্য উদগ্রিব হয়ে উঠছে কিন্তু কিছুতেই মিল খুঁজে পাচ্ছেনা। ঠিকই তখনই ভেসে আসল কয়েকটা কথা........
----------নমস্কার এবং অসংখ্য ধন্যবাদ আপনাদের সকলকে, আমার লেখাটা পছন্দ করার জন্য। আমি বেশি কথা বলতে পারিনা, তাই এইখানেই আমার কথা শেষ করলাম।
---------হঠাৎ প্রশ্ন ভেসে আসতে লাগল, আপনার গল্পটা কি.... নিছক কল্পনা!!! নাকি এর সাথে আপনার জীবনের কিছুটা মিল আছে??
---------সৌনক সেন চলে যেতে গিয়েও আবার বলে উঠল পুরোটা কল্পনা নয়!!!! আর কিছু না... বলে সৌনক সেন চলে গেলেন।
তৃষ্ণা মিল খুঁজতে গিয়েও ব্যার্থ হয়ে ফিরে এল। এবং শুরু করল গল্পটা পড়া। যত পড়তে লাগল ততই যেন নিজেকে একাত্ম করে ফেলতে লাগল গল্পের চরিত্র শ্রীতমার সাথে। বারবার মনে হতে লাগল তৃষ্ণার এটা ওর আর সৌনকের কাহিনী যেটা সৌনক কল্পনা করেছে। তাইতো বলে উঠল পুরোটা কাল্পনিক নয়। তৃষ্ণার চোখে জল ভরে উঠেছে শ্রীতমা এবং অনিকেতের ভালোবাসা জয় করার কাহিনী পড়ে। তৃষ্ণা মনে মনে ঠিক করে ফেলেছে যে.... করেই হোক সৌনক সেনের সাথে ওকে কথা বলতে হবে, কিন্তু কি করে?? তৃষ্ণার মাথায় হঠাৎ করে আইডিয়া খেলে যায় এবং বইএর পিছনে থাকা পাবলিসারের ফোনে ফোন করে সৌনক সেনের নাম্বার চায়। কিন্তু তিনি দিতে নারাজ। শেষে অনেক সাধ্য সাধনা করে নাম্বারটা জোগাড় করে তৃষ্ণা। কিন্তু নাম্বারটা হাতে পেয়েও ফোন করতে পারেনা, কেমন একটা অজানা ভয় বাসা বাঁধে মনের মধ্যে, যদি ওর ধারনা ভুল হয়!!! ওর সৌনক যদি না... হয় তাহলে!!!! পরক্ষনেই নিজের মনকে বুঝিয়ে কাঁপা কাঁপা হাতে নম্বর ডায়েল করে ফেলে তৃষ্ণা।
----------টানা রিং হয়ে ঠিক কেটে যাওয়ার আগের মুহুর্তে একটা গম্ভীর গলার স্বর ভেসে আসে ওপাস থেকে, হ্যালো......
-----------তৃষ্ণা বলে উঠে, নমস্কার লেখক সৌনক সেন বলছেন আপনি???
----------ওপাস থেকে উত্তর আসে, হ্যাঁ.... বলছি বলুন, আপনি কে????
---------তৃষ্ণা বলে উঠে, তোমায় ভালোবেসে গল্পটা নিয়ে আমার একটা প্রশ্ন আছে, করতে পারি?????
---------সৌনক সেন বলে উঠল, হ্যাঁ..... অবশ্যই করুন!!!
---------তৃষ্ণা দৃঢ় কন্ঠে বলে উঠল, আচ্ছা তোমায় ভালোবেসে গল্পের শ্রীতমা কি আসলে আপনার স্কুলফ্রেন্ড তৃষ্ণা???
---------কিছুক্ষনের গভীর নিস্তব্ধতা ভেদ করে সৌনক বলে উঠল, আপনি কে বলুন তো??? আর তৃষ্ণাকে চিনলেন কি.. করে??? আর জানলেনই বা.... কি করে তৃষ্ণা আর আমার বন্ধুত্বের কথা!!!!
----------তৃষ্ণার কাছে সমস্ত কিছু পরিষ্কার, তৃষ্ণা এতদিন ধরে যাকে খুঁজছিল তাকে পেয়ে গেছে। তৃষ্ণা নিজের আনন্দকে ধরে রাখতে পারলনা, হো.... হো.... করে হেসে বলে উঠল, ওরে জ্ঞানি, সাহিত্যিক, বুদ্ধু আমি খুব ভালোকরে সবকিছু জানি এবং চিনি, কারন আমি স্বয়ং তৃষ্ণা বলছি।
---------সৌনক উত্তেজিত হয়ে বলে উঠল, তুই.....তৃষ্ণা, আমার সেই ছোট্ট তৃষ্ণা... মিথ্যে বলছিস নাতো????
----------তৃষ্ণা বলে উঠল একটু মিথ্যে আছে, আমি এখন ছোট নয় বড় হয়েগেছি, তুই চিনতেও পারবিনা!!! অবশ্য আগের দিন তোকে চোখের সামনে দেখে আমিও চিনতে পারিনি!!!!
--------সৌনক সাথে সাথে বলে উঠল, তুই কোথায় দেখেছিস আমাকে????
--------তৃষ্ণা বলে উঠল, বই মেলায়, একদম প্রথম সাড়ির চেয়ারে বসে ছিলাম, অবশ্য তুই লক্ষ্য করিসনি!!!! বড় লেখক হয়ে গেছিস এখনকি আর আমার কথা মনে থাকবে!!!
----------সৌনক বলে উঠল, কালকে আমার সাথে দেখা করবি প্রীন্সেপ ঘাটে বিকেল পাঁচটায়, তোর সাথে অনেক কথা আছে।
---------তৃষ্ণা বলে উঠল, ওকে যেতে পারি তবে একটা শর্ত আছে!!!
----------সৌনক করুন সুরে বলে উঠল, কি... শর্ত???
--------তৃষ্ণা হাসতে হাসতে বলে উঠল, টিফিন আনতে হবে আমার জন্য কাকিমার হাতের তৈরী হিংএর কচুরি আর ভাঙ্গা আলুর দম।
---------সৌনক বলে উঠল, আনব তারসাথে আরও কিছু থাকবে।
******************************
গঙ্গার বুকে জোয়ার এসেছে, গঙ্গার জল একবার করে এগিয়ে এসে ধাক্কা দিচ্ছে পাড়ে আবার একই ভাবে ফিরে যাচ্ছে। দূরে একটা নৌকা বাঁধা আছে সেও জলের তালে তালে দুলছে, গঙ্গার জলে পা.... ডুবিয়ে বসে আছে সৌনক আর তৃষ্ণা। গঙ্গার শীতল হাওয়ায় তৃষ্ণার চুল গুলো হাল্কা উড়ে পড়ছে সৌনকের মুখে। সৌনকের তাতে কোন রকম বিরক্তি নেই, সৌনক একভাবে দেখে চলেছে তৃষ্ণাকে। সূর্য তখন অস্ত যাওয়ার পথে পা... বাড়িয়েছে। দিকে দিকে ল্যাম্পপোষ্টের আলো জ্বলে উঠেছে। আর সেই আলো গঙ্গার জলের ওপর পড়ে সুন্দর সুন্দর জলছবি এঁকে চলেছে।
----------তৃষ্ণা আর চুপ থাকতে না..... পেরে বলে উঠল, তখন থেকে চুপ করে বসে আছিস, কিছুই বলছিসনা!!! তোর কি...কোন কথা নেই!! বললি যে অনেক কথা আছে তাহলে!!! সত্যি এতক্ষন কথা না... বলে কি করে যে... থাকিস কে জানে??? আমার তো.... দম বন্ধ হয়ে আসছিল কথা বলতে না... পারার জন্য, কই দেখিদে টিফিন বক্সটা।
---------সৌনক কিছু না... বলে ব্যাগ থেকে টিফিন বক্সটা বার করে খুলে নিজের হাতে খাবার তুলে ধরল তৃষ্ণার মুখের সামনে।
----------তৃষ্ণা মনের আনন্দে খেতে লাগল। আর বকবক করতে লাগল। তৃষ্ণা বলে উঠল, তোর কি.... কোন কথা নেই!!! এতদিন পর দেখা হলো আমাদের তাও কি রকম চুপচাপ বসে আছিস!!!
-----------সৌনক বলে উঠল, আমার সমস্ত কথাতো আমি লেখার মাধ্যমে বলে দিয়েছি, তবে এখন একটা কথা বলবো, তার উত্তর দিবি তো... তুই???
----------তৃষ্ণা জিজ্ঞাসা দৃষ্টিতে সৌনকের দিকে তাকিয়ে বলে উঠল, কি... কথা???
---------সৌনক এক গুচ্ছ টাটকা গোলাপ হাতে বলে উঠল.......
হাসি, কান্না, সুখ, দুঃখ,
রাগ, অনুরাগ, মান অভিমান
সবকিছু অনুভূতিতে আছে মিশে,
আমি আজও এগিয়ে চলেছি
জীবন পথে শুধু তোমায় ভালোবেসে,
শুধু তোমায় ভালোবেসে।
তৃষ্ণা এক দৃষ্টিতে চেয়ে আছে সৌনকের দিকে, কি বলবে বুঝতে পারছেনা যদিও ও বইটা পড়ে বুঝতে পেরেছে সৌনক ওকে ভালোবাসে কিন্তু যে... ছেলেটা এত কম কথা বলে, সে... এইভাবে প্রপোজ করবে সবার মাঝে, সেটা কোনদিনও কল্পনা করতে পারেনি তৃষ্ণা।
----------সৌনক বলে উঠল, কিরে.. উত্তর দিবি না....!!!
----------তৃষ্ণা ফুলটা সৌনকের হাত থেকে নিয়ে বলে উঠল, আমিতো আর লেখিকা নয় যে.... ছন্দ মিলিয়ে কবিতা শোনাব, কিন্তু আমার একটা দাবি আছে...??
--------সৌনক বলে উঠল, কি.... দাবি সব মানতে আমি রাজি।
----------তৃষ্ণা বলে উঠল, সব সময় চুপ থাকলে চলবে, কিন্তু আমি যখন রেগে গিয়ে ঝগড়া করবো, তখন কিন্তু আমার সাথে তাল মিলিয়ে ঝগড়া করতে হবে, চুপ করে থাকলে হবে না....!! ভালোবাসায় একটু খুনসুটি, ঝগড়া, মান অভিমান না... থাকলে কেমন প্যানসা প্যানসা লাগবে ঠিক নুন, ঝাল, ছাড়া তরকারির মত।
-------সৌনক মৃদু হেসে তৃষ্ণার হাতটা ধরে বলে উঠল.......
আমি নিজেকে বদলাতেও রাজি,
আমি হাসতেও রাজি,
আমি কাঁদতেও রাজি,
তোমায় নিয়ে সুখের ভেলায়
ভাসতে রাজি,
আবার দুঃখের সাগরে
ডুবতেও রাজি,
আমি তোমায় বাঁধতে চাই
আমার বন্ধনে,
আগলে রাখতে চাই
তোমায় সঙ্গপনে,
আমি সারাজীবন চলতে চাই
তোমার পাশে পাশে
তোমায় ভালোবেসে....
শুধু তোমায় ভালোবেসে।
............সমাপ্ত...............
💞💞💞💞💞💞💞💞
✍শিপ্রা চক্রবর্তী
© shipra chakraborty2021