...

6 views

প্রেম যখন সূর্যপূজা (পর্ব-১২)
নাহ্!পূজার কোনো উত্তর সূর্য গতকাল রাত অবধি পায়নি।
সারারাত এক তীব‍্র মানসিক অস্থিরতায় সূর্য নিজের মনকে ইতিবাচক আশা ভরসা সান্তনা দিয়ে ভুলিয়ে রাখার চেষ্টায় কাটিয়ে দিল।সকালে অফিস বেরোবার আগে কম্পিউটার খুলে আশাহত হল।পূজার কোনো প্রত‍্যুত্তর নেই।অফিসে কোনো কাজে আজ মন দিতে পারছেনা সূর্য।বারবার ভুল হচ্ছে।কিছুই যেন ভালো লাগছেনা তার।
আজ তাড়াতাড়ি অফিস থেকে ফিরে এল।অনেকটা আশা নিয়ে কম্পিউটার খুলল।কিন্তু এবারও নিরাশ হল।
সূর্য-পূজার পুরানো কিছু ম‍্যাসেজ আনমনে দেখতে দেখতে হঠাৎ পূজার একটি ম‍্যাসেজ ঢুকল সূর্যের ইন্ বক্সে।
মেঘের দেখা পেলে ময়ূর যেমন আনন্দে মেখম মেলে ধরে,ঠিক সেরকম সূর্যের মনময়ূরী যেন সানন্দে প্রেমের মধুর রঙে রঙীন পেখম মেলে ধরল।কিন্তু পরমূহূর্তেই এক অজ্ঞাত ভয় কাজ করতে শুরু করল সূর্যের মনে।মন দেওয়া নেওয়ার বিষয়টা সবসময়ই ঝুঁকিপূর্ণ।এতে নিজের কাঙ্ক্ষিত মনের মানুষটিকে হারানোর একটি সহজাত ভয় সর্বদাই হৃদয়ের অন্তর্স্থলে লুকিয়ে থাকে।সংকোচ ও ভয় নিয়ে পূজার ম‍্যাসেজটি পড়তে শুরু করল সূর্য।

পূজা:"আমি তো তোমার কাছে কিছুই জানতে চাইনি।ভাগ্য ও ভগবান আমিও মানি।আর শুধাংশুবাবুর গগণাকেও অগ্রাহ‍্য করছি না।ঈশ্বর চাইলে তোমার ভাগ‍্যে নিশ্চয় তোমার প্রেম পূর্ণতা পাবে।তবে তা স্বাভাবিক ভাবেই ঘটতে দিলে ভালো হয়।প্রেম,ভালোবাসা,বিয়ে এগুলো আমার কাছে জীবনের সব থেকে চিরস্থায়ী পবিত্র সম্পর্ক।আর বিয়ের পর আমাদের সাথে সাথে দুটি পরিবারের ও বংশের সম্পর্কও স্থাপিত হবে।তাই আমি এটুকু জানি আমি জ্ঞানত এমন কোনো কিছু করতে চাইনা যা বড়দের অমত আছে।তাঁরা আমাকে অত‍্যন্ত স্নেহ করেন,বিশ্বাস করেন।আমি আগেও বলেছি এখনও বলছি তাদের অমতে আমি তাদের আঘাত দিয়ে সংসার করতে যেতে পারিনা।"

মনে যেন ঝড়ের মধ‍্যে পড়া সাগরের ঢেউয়ের উথাল পাথাল অনুভব করল সূর্য।এবার মন ও আত্মিক অনুভবে যে পূজাকে সূর্য চেনে জানে,তাকে মস্তিষ্কের বিচারে একটু বাস্তবে বিচার করে দেখতে গিয়ে সূর্য বেশ বুঝতে পারল পূজা তাকে ভালোবাসে ঠিকই, কিন্তু সে যেধরণের মেয়ে আত্মসুখের জন‍্য প্রিয়জনদের বিশ্বাসে আঘাত সে দিতে পারবেনা কোনোদিন।তাই সূর্যের কাছে সে ধরা দিতে চাইবে না।

সূর্য:"আমি জানি তুমি অভিভাবকদের বিরুদ্ধে গিয়ে এরকম কিছু করবেনা।আমি এটাও জানি তুমি আমাকে ভালোবেসে ফেলেছো।শুধু তোমার কিছু মনগড়া নীতির জন‍্য স্বীকার করতে পারছো না।আমাকে একটা সুযোগ দাও তোমার যোগ্য হয়ে ওঠার।আমি তো চেষ্টা করছি।এম.বি.এ করে class-1 officer হওয়ার চেষ্টাও করছি।আমি জানি হয়তো সাংসারিক দিক থেকে দেখলে প্রথম ৪/৫ বছর তোমার কষ্ট হবে,কিন্তু তারপর তুমি সবার কাছে মাথা উঁচু করেই চলতে পারবে।
কিন্তু আমার মনের জোর তো তুমিই।তোমাকেও তো সেই বিশ্বাস দিয়ে আমার পাশে মানসিকভাবে থাকতে হবে।আমি জানি তুমি আমার পাশে থাকলে আমি নিশ্চয় অভিভাবকদের মন জয় করে তোমার যোগ‍্য হয়ে উঠতে পারব।আর তাঁরা যদি দেখেন যে তাদের সন্তানরা নিজেরাই নিজেদের জীবনের প্রকৃত উদ্দেশ্য খুঁজে নিয়ে প্রকৃত সুখী হতে পেরেছে তাঁরা নিশ্চয় আমাদের আশীর্বাদ করবেন।কিন্তু তুমি এরকম আচরণ করলে আমার তো খুব কষ্ট হয়।খুব ভেঙে পড়ি।আমার স্বাভাবিক জীবন যেন বিপর্যস্ত হয়ে পড়ে।এই কষ্ট খুব অসহনীয়।"

পূজা:"আমি সবটুকু ঈশ্বরের হাতে ছেড়ে দিয়েছি সূর্য।আর তোমাকে যিনি এই কষ্টের মধ‍্যে ফেলেছেন তাকেই বল সেই কষ্টের নিবারণ করতে।আমি তোমাকে বন্ধু হিসেবে আবশ‍্য ই সাহায্য করতে পারি।কিন্তু এসবে জড়ানোর সময় এটা নয়।"

সূর্য:"এই জন‍্যেই আমি প্রেম নামক জিনিস থেকে নিজেকে সবসময় দূরে রাখতে চেয়েছিলাম।এই মূহুর্ত্তের কষ্টটা যেন বাবার মৃত্যুর সময়ের কষ্টের চেয়েও বেশী অনুভব করছি।আমি সত‍্যিই তোমাকে খুব ভালোবেসে ফেলেছি পূজা।আমার দেয়ালে পিঠ ঠেকে গেছে।সামনে এগিয়ে যাওয়া ছাড়া উপায় নেই।কিন্তু তোমার সাহায্য আমি এভাবে আগামী দিনে এমনি এমনি কি করে নিতে পারি?ভাগ্যের ওপর সবকিছু ছেড়ে দিয়ে হাতপা গুটিয়ে বসে থাকলে কি চলে?তুমি কেন বুঝতে চাইছো না যদি তোমার মনে আমার জন‍্য বিশেষ জায়গা না তৈরি হত তাহলে তোমার মতো মেয়ে এভাবে আমার মতো একটি ছেলের জন‍্য এত গভীরে ভাবতে যেতনা।আর যদি তোমার মনে হয় আমার জীবনে এলে তুমি তোমার আত্মীয় পরিজনদের কাছে ছোটো হয়ে যাবে,তবে প্রার্থনা করি আমার ভাগ‍্যে যেন তোমাকে আসতে না হয়।ভালো থেকো।খুব সুখী হও।Goodbye."

নিদারুন হৃদয় যন্ত্রণা নিয়ে সূর্য বিছানায় শুয়ে কেবলই নিজের মন ও মস্তিষ্কের দ্বন্ধে নিজের ভালোবাসার মানুষটির মনে নিজের জায়গাটির নিশ্চয়তা তন্ন তন্ন করে খুঁজে দেখতে দেখতে ভোররাতে ঘুমিয়ে পড়ল।পূজাকে সে কখনও ভুলতে পারবেনা।আজ একথাও অস্বীকার করতে পারবেনা যে মনে মনে নিজের স্ত্রীর স্থানে পূজাকেই বিগত দুটি মাস সে কল্পনা করে এসেছে।সে এখানো মেনে নিতে পারছে না যে পূজার সাথে তার যোগাযোগ কখনও কোনোদিন বিচ্ছিন্ন হয়ে যেতে পারে।পূজার সাথে তার সম্পর্ক অবিচ্ছিন্ন বলেই তার অবচেতন মন জানে।কোথাও যেন সূর্যের কোনো দামী জিনিস হারিয়ে যাওয়ার ভয় আর বেদনা একাকার হয়ে উঠেছে।এই অসহ‍্য মনকষ্ট নিয়ে এখানে আর থাকা যায়না।সূর্য তাই ঠিক করল আগামীকাল কম্পিউটার থেকে সবকিছু delete করে দিয়ে দূরে
transfer নিয়ে চলে যাবে।

ওদিকে সূর্যের ম‍্যাসেজটি পড়তে পড়তে পূজার দুচোখ বেয়ে কখন যে জলের ধারা ক্রমাগত ঝরে চলেছে খেয়াল নেই পূজার।মনের ভিতর যেন ঝড়ো হাওয়া বয়ে যাচ্ছে পূজার।কেন এত কষ্ট অনুভূত হচ্ছে?মনকে শক্ত করে ধরে রেখেছে পূজা,কিন্তু আত্মিক একটি গভীর নির্বাক যন্ত্রণা অঝোর অশ্রুধারা হয়ে ঝরে পড়ছে।এ কেমন অদম‍্য অদ্ভূত অনুভূতি?
পুরো ম‍্যাসেজটি পড়ার পর বাস্তবতার প্রচন্ড আঘাতেই পূজার মনের কঠিন আস্তরণটিতে সৃষ্ট সেই ফাটলটি থেকে প্রেমের রঙীন প্রজাপতি মন এবার ডানা মেলে ধরল।
সারারাত সূর্যের লেখা কথাগুলো তাকে ঘুমাতে দিল না।পূজা সবসময় আত্মবিশ্বাসী হয়ে তার প্রকৃত সঙ্গী র জন‍্য অপেক্ষা করে এসেছে।শুনতে রূপকথার মতো লাগলেও বাস্তবে আজও এরকম ঘটনা বিরল নয়।
পূর্বজন্মের সেই চিরবন্ধুত্ব ও স্থায়ী প্রেমের গভীর বাঁধনে জড়াবে বলেই পার্থিব কোনো প্রলোভনে পড়ে নিজের এই পবিত্র সম্পর্কের ক্ষতি করতে চায়নি পূজা।আজ বাস্তবে যখন সেই মাহেন্দ্রক্ষণ এসে উপস্থিত তখন সে কি করে পার্থিব আভিজাত্য ও মায়াজালে জড়িয়ে পূর্ব নির্ধারিত সুগভীর প্রেমকে অগ্রাহ্য করে?এই প্রেমে প্রেম প্রকাশের আতিশয্য নেই,নেই কোনো আলাদা করে প্রেম উপভোগের আড়ম্বর,কিন্তু সুগভীর বিশ্বাস আর অটুট বন্ধুত্বের এক পবিত্র বন্ধন আছে যা অবিচ্ছেদ্য।
বিগত শ্রাবণী পূর্ণিমা থেকে আজ পর্যন্ত একের পর এক ঘটনা একটি একটি করে পূজার মানসপটে পুণঃ চিত্রিত হতে লাগল।প্রথম থেকেই ঘটনাপ্রবাহের গতিশীলতা,সূর্যের কাছে তার স্বতঃস্ফূর্ত বন্ধুত্বের নিবিড় টান অনুভব করা,হাতের রেখায় শুধাংশুবাবুর সূর্য-পূজা সম্বন্ধে নির্ভুল গগণা---সব কিছু সূক্ষ্মভাবে বিচার করে দেখলে কোনোটাই নিছক সাধারণ মোহ মায়াগ্রস্থ প্রেমের পরিচয় বহন করছেনা।এখনো দুজনের সাক্ষাৎ ঘটেনি।কিন্তু এত মান অভিমানের পরও সূর্যকে নিয়ে সে এখনো দুশ্চিন্তা না করে থাকতে পারছে না।মনে মনে ঈশ্বরকে একদিকে ধন‍্যবাদ আর অপরদিকে সঠিক পথের দিশা দেখানোর অনুরোধ জানিয়ে পূজা ভোররাতেই সূর্যকে মনের অবস্থান সরল ভাষায় জানাতে ম‍্যাসেজ করল:-
"সূর্য, তোমার কথাগুলো ফেলে দেওয়ার মতো নয় ঠিকই।কিন্তু আমার কাছে প্রকৃত বন্ধুত্ব ও ভালোবাসা যেমন অমূল‍্য তেমন আমার ওপর সবার বিশ্বাসের মূল‍্যও কম নয়।তুমি যদি সত‍্যিই আমার ভাগ্যে থেকে থাকো,তাহলে এপর্যন্ত যিনি আমাদের সম্পর্ককে নিয়ে ভেবেছেন,তাকেই ভাবতে দাও।এইটাই বলতে চেয়েছিলাম আমি।আমি নিশ্চয় তোমার কোনো ক্ষতি চাই না।কিন্তু আমি জ্ঞানত তোমাকে আমার জীবনসঙ্গীর জায়গায় আজ পর্যন্ত বসিয়ে ভাবিনি।এটা আমার জন‍্য নীতিবিরুদ্ধ।কিন্তু বিধির বিধানে আজ বাধ‍্য হয়ে ভাবতে হচ্ছে।তোমার ভালোবাসা সত‍্যি হলে তুমি নিশ্চয় তোমার কাঙ্ক্ষিত মনের মানুষকে জীবনে পাবে।ঈশ্বরের উপর বিশ্বাস রেখে নিজেকে দুশ্চিন্তামুক্ত রাখার চেষ্টা কর।আর তুমি জানো আমি সবসময়ই মানি প্রকৃত বন্ধু কখনও আরেক বন্ধুর কাছে সামাজিক কারণে ছোট-বড় হয়না।ভালো থেকো।"

আরও একটা শীতের সকাল এল।অনেকটা অভিমান মনে পুঞ্জীভূত করে সূর্য ঘুম থেকে উঠেই কম্পিউটার থেকে সব মুছে ফেলবে বলে কম্পিউটার খুলতে পূজার ম‍্যাসেজটি পেল।কাঁপা কাঁপা হাতে ম‍্যাসেজটি খুলে মন দিয়ে পড়ল।সূর্যের মনের সবটুকু অভিমান কোথাও এক নিমেষে শান্ত হয়ে গেল।সূর্যের মনের আর মস্তিষ্কের দ্বিধা দ্বন্ধ পূজা নিজের থেকেই মিটিয়ে দিয়েছে।সূর্য আত্মিক গভীরতায় পরিষ্কার উপলব্ধি করতে পারল যে পূজার প্রতি সূর্যের প্রেম ও বিশ্বাস যেমন সত‍্যি, তেমন সূর্যের প্রতি পূজার ভালোবাসাও মিথ‍্যা নয়।কিন্তু সূর্যের সাধ‍্যি কি পূজাকে বাধ‍্য করে তার কাছে ধরা দিতে?

প্রত‍্যুত্তরে সূর্য লেখা শুরু করল:
"আমি বুঝতে পেরেছি তুমি কি বলতে চাইছো।এতটাই আঘাত পেয়েছিলাম গতকাল যে পুরো পৃথিবীটাই মিথ‍্যা বলে মনে হচ্ছিল।যাইহোক,দেখো এরকম আঘাত আর কখনো যেন তোমার কাছে আমি না পাই।নাহলে সত‍্যিই আমি পাগল হয়ে যাব।ইতিমধ্যে কয়েকদিন আগে মায়ের কথায় আমার বোন ও তার শাশুড়ি আমাকে বোঝাতে এসেছিলেন যাতে আমি তোমাকে ভুলে স্বাভাবিক হতে পারি।কিন্তু তুমিই বল এটা কি কখনও সম্ভব?আমার স্বাভাবিক জীবন আর আগের মতো নেই।আমার সবটুকু চিন্তা ভাবনা জুড়ে শুধুমাত্র তুমিই আছ। আমি তো জানতাম আমি তোমাকে চিনতে ভুল করিনি।তবে তোমার সাথে আজ এখনি একবার ফোনে কথা বলা একান্ত প্রয়োজন পূজা।আজ ফোনে একটিবার কথা হতে পারে আমাদের?"


© বুনানী