প্রেম যখন সূর্যপূজা (পর্ব-৩)
সূর্যের ম্যাসেজটিতে বেশ বিরক্ত বোধ করেছে পূজা।স্বভাবসিদ্ধ ভাবেই সে অচেনা এই ফ্রেন্ড রিকুয়েস্ট ডিলিট করায় উদ্যত হল।কিন্তু আবারও কোনো অজানা কারণে পারলনা বরং স্বভাববিরুদ্ধভাবে উপেক্ষা না করে রিপ্লাই দিল,
"এগরার দুএকজন ছেলে মেয়ে তো আছে আমার ফ্রেন্ড লিষ্টে।আমার এখানে কিছু পুরাণো বন্ধু আর কিছু ভালো নতুন বন্ধু যাদের থেকে কিছু বিষয় জানবো বলেই আসা।বন্ধুত্বটা আমার কাছে খুব সিরিয়াস বিষয়।অকারণে অচেনা অজানা বন্ধু পাতিয়ে সময় কাটাতে এই সাইটে আসিনি আমি।"
"ওঃ।আমিও এই সাইটে নতুন।"প্রতু্্যত্তরে লিখল সূর্য।"আমি চাকরি করি।অফিস থেকে ফিরে কিছু অজানা তথ্যকে জানব বলেই সাইটে আসা।তোমার প্রফাইলে তোমার দেশের বাড়ি এগরা বলে উল্লেখ করা আছে।তুমি ইংরেজী মাধ্যমে র ছাত্রী।ইংরেজীতে স্নাতক।আমি ইংরেজীতে একটু কাঁচা।তাই ফ্রেন্ড রিকুয়েস্ট পাঠালাম। "
পূজা কোনো রিপ্লাই দিলনা।কম্পিউটার বন্ধ করে দৈনন্দিন কাজে মনোনিবেশ করল।কিন্তু খেয়াল করল না কখন নিজের অজান্তেই বিশেষ কোনো কারণ ছাড়াই প্রথমবার একটি অচেনা ছেলের ওপর বিরক্ত হওয়ার পরও কথা বলেছে সে।এক্সেপ্ট করেছে তার ফ্রেন্ড রিকুয়েস্ট।
সূর্য খুব ভালো ভাবেই অন্য বন্ধুদের সঙ্গে পূজার কথোপকথন দেখেছে এই সাইটে।এটুকু বুঝেছে পূজার জীবনে এখনও বিশেষ কেউ আসেনি।পরেরদিন সন্ধ্যায় কিছু নোট সার্চ করবে বলে কম্পিউটার খুলে বসতেই সূর্যের আবার একটা ম্যাসেজ পেল পূজা।
"কেমন আছো?কি করছো এখন?"
বারবার কোনো এক অজানা টানে সূর্যের ম্যাসেজ গুলোকে অন্যান্য বন্ধুদের মতো উপেক্ষা করতে পারছেনা পূজা বরং বাধ্য হচ্ছে রিপ্লাই করতে,"নোট দেখছি।একজন বন্ধুর লাগবে।"
"তুমি অযথা নেটে কথা বলতে পছন্দ করনা গতকাল জানিয়েছিলে।আসলে দেখলাম তুমি অনলাইন তাই ম্যাসেজ করলাম।কিছু মনে করনা।"সূর্য ম্যাসেজ করল।
কোনো উত্তর এলনা কম্পিউটারের ওপার থেকে।সূর্য আবার লিখল,
"আমিও জান তো অফিসে আমার কাজের শেষে অফিসের কাজে কারো প্রয়োজন হলে সাহায্য করতে ভালোবাসি।কিন্তু আমার মা এতে বিরক্ত হন"।সহজ ভঙ্গিতেই বলল সূর্য।
"নিজের কাজ করার পর সময় থাকলে অপরের সাহায্য করা তো ভালো বিষয়।অপরের প্রয়োজনে নিজের সামর্থ অনুযায়ী সাহায্য করা তো মানবিক।বিশেষ করে আত্মীয়-বন্ধুদের ক্ষেত্রে।আমার তো কাউকে সাহায্য করতে খুব ভালো লাগে।"এবার পূজার উত্তর এল কম্পিউটারের ওপার থেকে।
প্রভাতী উপাসনার আগে ঠিক যেভাবে মন্দিরকে স্বচ্ছ জলে ধুয়ে-মুছে শুদ্ধ করে মন্দিরের সব জানালা দরজা খোলা হয়।মন্দিরের যুগলমূর্তি যেমন ফুল-চন্দন আর মালা দিয়ে সুন্দর করে সেজে ওঠেন,ঠিক সেভাবেই প্রথম প্রেমের নির্মল পরশে নিজেদের অজান্তেই দুটি প্রাণ ক্রমাগত সেজে উঠছে।
সূর্য এমনিতে স্বল্পভাষী।নিজের কাজ নিয়ে ব্যস্ত থাকতেই ভালোবাসে সে।অবসর সময় বই পড়তে ভালোবাসে।কিন্তু সূর্যও কেন জানেনা পূজার সাথে কথোপকথন এত ভালো লাগছে।
"এগরা কবে আসা হবে?",সূর্যের ম্যাসেজ এল।
"এগরা আমার দেশের বাড়ি।জ্যেঠু কাকুরা থাকেন।আমি কিন্তু কলকাতার মেয়ে।আমার জন্ম,পড়াশোনা সব এখানেই।বড় ছুটি ছাড়া এগরা তেমন যাওয়া হয়ে ওঠেনা।পূজার সময় যাওয়া হয়"।রিপ্লাই করল পূজা।
"তাহলে এলে দেখা হবে।"সূর্য আবারও সহজভাবে ম্যাসেজ করে বসল।
"কী!দেখা হবে? তোমার সাথে দেখা করতে যাব কেন? আমার এখানে আসা বা ফ্রেন্ড রিকুয়েস্ট এক্সেপ্ট করার উদ্দেশ্য তো প্রথমেই স্পষ্ট করেছিলাম তোমাকে!"অতিশয় বিরক্তি প্রকাশ করে লিখল পূজা।সূর্য সম্পর্কে একটা খারাপ ধারণা হল তার।সোসাল সাইট থেকে বেরিয়ে এসে নোট সার্চে মন দিল।
পরেরদিন সকালে অন্যান্য ম্যাসেজ চেক্ করতে গিয়ে গতকাল সূর্যের পাঠানো একটা ম্যাসেজ পেল পূজা।
"আমি অতো ভেবে কিছু বলি নি কিন্তু।এগরা এলে দেখা হয়ে যেতেও পারে।বন্ধুর সাথে বন্ধুর যেমন দেখা হয় সেইভাবেই বলা।"
পূজা মনকে কোনোরকম প্রশ্রয় দিলনা কোনো প্রতু্্যত্তরের জন্য।এইভাবে দুটো দিন অতিবাহিত হল।অনলাইন জেনেও সূর্য পূজাকে কোনোরকম ম্যাসেজ করা থেকে নিজের মনকে বিরত রাখল।
দুদিন পরে সূর্যের একটা অপ্রত্যাশিত ম্যাসেজ পেল পূজা।
"একটা সমস্যায় পড়েছি।বন্ধু হিসেবেই তোমার কাছে এর সমাধান আশা করছি।আসলে গত দুদিন তোমার সাথে কথা বলার ইচ্ছা হলেও তুমি পছন্দ করনা বলে ম্যাসেজ করিনি।কিন্তু কেন জানিনা তুমি মাঝেমধ্যে আমার অজান্তেই মনে ঢুকে পড়ছো।অফিস যাওয়ার সময় বাসে আমি খবরকাগজ পড়তে পড়তে যাই।পড়তে পড়তে কি করে যেন তুমি মনে ঢুকে যাচ্ছ।আমার তো কোনো মেয়েকে আর ভালোই লাগছেনা।স্কুল-কলেজ পেরিয়ে এসেছি অনেকদিন।তারপর এতদিন কেটে গেছে।এরকম আগে কখনও ঘটেনি আমার সঙ্গে।তোমাকে কেন জানিনা খুব আপন মনে হচ্ছে।এই সোসাল সাইটটিতে অন্য অচেনা বন্ধুদের আমি প্রথমে আপনি বলেই সম্বোধন করেছি।কিন্তু তোমাকে কেন বুঝতে পারছিনা খুব আপন বলে মনে হচ্ছে।তাই প্রথম থেকে তুমি বলতেই ইচ্ছা হল তোমাকে।এরকম তো কখনও আগে হয়নি আমার।আমি প্রেম ভালোবাসা অতো তো বুঝিনা।তবে মনে হয় আমি না তোমার প্রেমে পড়ে গেছি।তোমার ফোন নংটা দিলে ভালো হয়।বোধহয় কথা বললে এই সমস্যার সমাধান পাওয়া সহজ হত। "
ব্যস্।পূজার মাথা গরম!আত্মীয়-বন্ধুদের মধ্যে ইতিপূর্বে অনেক প্রেম প্রস্তাবকেই খুব শক্ত হাতে প্রত্যাখ্যান করেছে পূজা আগেই বলেছিলাম।আর এরকম দুদিনের চেনা একজন বন্ধুর কাছে এরকমটা আশা করা যায়না।কোনো উত্তর না দিয়ে সোজা সেটিংসে গিয়ে ডিলিট অপ্সন খুঁজতে যাবে, সূর্যের আরেকটা ম্যাসেজ,
"আমি এই সমস্যা থেকে বেরোতে চাই।তুমি বন্ধুদের সাহায্য করতে ভালোবাসো।তাই তোমাকে জানালাম।পারলে বেরোতে সাহায্য কর।"
ম্যাসেজটা পড়ে একটু থেমে গেল পূজা।
খুব সহজে অজানা কাউকে বিশ্বাস করা পূজার স্বভাব নয়।কিন্তু কোন সেই অজানা কারণে সূর্যের প্রতি ধারণা ভালো না হলেও অবিশ্বাস করতে পারছে না তার কোনো কথা।এক অজানা টানে সূর্যকে সমস্যার সমাধান জানাবার একটা আন্তরিক তাগিদ অনুভূত হল তার।সিদ্ধান্ত নিল সমাধান দিয়েই সূর্যের একাউন্ট টা ফ্রেন্ডলিস্ট থেকে ডিলিট করে দেবে সে।
লেখা শুরু করল পূজা,
"তোমার সাহস দেখে অবাক হলাম।কিন্তু বলেছিলাম বন্ধুত্বটা আমি সিরিয়াসলি নিই।তুমি সমাধান চেয়েছো তাই কিছু কথা বলে দিতে চাই।
তুমি আমাকে কতটুকু চেনো বা জানো যে চারদিনে আমার প্রেমে পড়ে গেলে? আমাকে কখনও দেখোনি। এর আগে কাকে কি বলেছো বা বলনি আমি দেখতে যায়নি।
তবে আমার মনে হয় তুমি মনে মনে কাউকে খুঁজছো?প্রকৃত বন্ধুত্ব বা ভালোবাসা একটা স্বতঃস্ফূর্ত বিষয়।দুচারদিনে জোর করে হয়না।আর তাছাড়া তুমি ভাবলে কি করে যাকে চাইবে তাকেই পেয়ে যাবে জীবনে?
প্রথমতঃ তোমার অবগতির জন্য জানাই বন্ধুদের মধ্যে এসব বিষয়ে আমি কোনোদিন ভাবতেই পারিনা।দ্বিতীয়তঃ আমার জীবনে আমার ভাগ্যে যে জীবনসঙ্গী হিসেবে পূর্বনির্ধারিত সেই একজনকেই আমি মেনে নিতে সক্ষম।উদ্দেশ্যহীন সম্পর্কে কোনো কথাপোথন আমার স্বভাববিরুদ্ধ।আমার প্রতি আমার পরিবারের বিশ্বাস আমার প্রাণের চেয়েও প্রিয়।আমি তা কখনও কোনো মূল্যে ভাঙতে পারবনা।
আশাকরি তোমার সমস্যা র সমাধান জানাতে পেরেছি।এরপর এরকম ভুল করলে তোমাকে ফ্রেন্ড লিস্টে রাখা সম্ভব হবেনা।harsh step নিতে বাধ্য হব।"
পূজার এই উত্তরে সূর্যের মনে যেমন একটা অচেনা কষ্টে সূর্যের মনটা অস্থির হয়ে উঠল আবার পূজার প্রতি ভালো লাগাটা তেমনই এক ধাক্কায় অনেকটা বেড়ে গেল।
"Harsh step তুমি নিতেই পার।আজ আমি তোমাকে আমার মনের কথাটা জানালাম বলে আমি খারাপ হয়ে গেলাম।বন্ধুদের মধ্যে কেউ যদি মনে মনে তোমার প্রতি এরকম ধারণা রাখে তবে ঠিক আছে?তোমার বন্ধুদের মধ্যে কেউ যদি তোমার সেই একজন হয় তুমি তো বুঝতেও পারবেনা।"পূজাকে মন খারাপের কথাগুলো অকপটে বলে দিল সূর্য।
"বন্ধুদের মধ্যে কেউ হবে কিনা তা নিয়ে তোমার মাথা ব্যথা না করলেও হবে।আমি নিজেকে যতটুকু চিনি তা সম্ভব নয়।আর যদি ভাগ্যে কখনও আমার তাই থাকে তবে যে আমাকে ভালো বন্ধু হিসেবে বুঝবে সে এই বিষয়টা নিশ্চয় সেইভাবে handle করবে।
যাইহোক এটুকু বলি আমাদের ভালো বন্ধুত্বের বিষয়টা প্রথমেই আঘাত দিয়েছো। এসব থেকে তাড়াতাড়ি বেরিয়ে আসার চেষ্টা কর।ভালো থেকো।"পূজা দৃঢ়ভাবে তার বক্তব্য সুস্পষ্ট করে জানিয়ে দিল সূর্যকে।
মন দিয়ে পূজার কথাগুলো পড়ে বোঝার চেষ্টা করছে সূর্য।সে অবাক হল এই ভেবে যে একটা ছেলে প্রপোজ করলে কোনো মেয়ে এতটা নির্লিপ্ত থেকে বন্ধুত্বের সত্তাকে মূল্য দিতে পারে এর আগে তার ধারণা ছিলনা।তাছাড়া পূজা কি করে জানল যে সে মনে মনে কাউকে খুঁজছে?পূজাকে সত্যিই খুব ভালো লেগে গেছে সূর্য র।যত কথা বলছে ততই যেন মনে মনে ভালোলাগার বাঁধনে জড়িয়ে পড়ছে সে।সেটা বন্ধুত্ব, না প্রেম সে জানেনা।মেয়েদের সাথে খুব একটা কথা বলায় অভ্যস্ত নয় সূর্য। আগে কখনোই এরকম উপলব্ধি হয়নি তার।মনে অস্বস্তি আর সন্তুষ্টি একসাথে মিলেমিশে এক বিচিত্র অনুভূতি হচ্ছে তার।কিন্তু পূজার একটা কথা তাকে মানতেই হবে।যাকে চাইবে তাকে পেয়ে যাবে সহজে,এটা ভাবা তার ভুল।জোর করে আর যাই হোক কারো গভীর ভালোবাসা ও বিশ্বাস পাওয়া যায় না।সত্যিই তো প্রকৃত প্রেম তো স্বতঃস্ফূর্ত একটা অনুভূতি।
"তোমার থেকে প্রকৃত বন্ধুত্ব যা জানলাম নিশ্চয় মনে রাখব সারা জীবন।ঠিক আছে ওসব বিষয় নিয়ে আর ভাববো না।এবার থেকে সচেতন থাকব।তবে এটুকু বলব তোমার মতো বন্ধু পাওয়াও ভাগ্যের বিষয়।"
সকালে ঘুম ভাঙতেই ম্যাসেজ করল সূর্য পূজাকে।
বাহিরমুখী শিক্ষা র চেয়ে অন্তরমুখী শিক্ষার প্রতি কিশোরী অবস্থা থেকেই পূজার সহজাত আগ্রহ।বরাবরই অন্তরদৃষ্টির প্রতি পূজার বিশেষ ঝোঁক।আশে পাশের মানুষজনের কথা আর ব্যবহারের আড়ালে তাদের মনের গভীরে অনায়াসেই ঢুকে দেখতে জানে আমাদের পূজা।বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই নির্ভুল হয় তার বিচার।সূর্য যে স্বভাবসিদ্ধ কোনো কুঅভ্যাসবসতঃ নয়,বরং সে সহজসরলভাবে মনে মনে তার জীবনে বিশেষ কাউকে খুঁজে বেড়াচ্ছে বলেই এই সমস্যার সম্মুখীন হয়েছে সেটা একদম সঠিকভাবে মূল্যায়ণ করতে পেরেছে পূজা।
সূর্যর প্রতু্্যত্তরে আর কিছুই লিখলনা পূজা।কিন্তু ফ্রেন্ড রিকুয়েস্টটি ডিলিট করা আর হল না।ইউনিভার্সিটির কিছু বিষয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়ল পূজা।এভাবেই কেটে যেতে লাগল একটা মাস।পূজা আবারও একটা বিষয়ে খেয়াল করে উঠল না যে কোন অজানা কারণেই তাকে প্রপোজ করার পরও কোনো বন্ধুর সাথে স্বভাবসিদ্ধভাবে পুরোপুরি যোগাযোগ শেষ করে দিতে প্রথমবার মন চায়নি তার।পূজার অন্তরের কঠিন বরফটা সূর্যের উষ্ণ তেজে কখন যে তার অজান্তেই কোনো কারণ ছাড়াই ধীরে ধীরে গলতে শুরু করে দিয়েছে সেটুকু এখনও টের পায়নি পূজা।
© বুনানী
"এগরার দুএকজন ছেলে মেয়ে তো আছে আমার ফ্রেন্ড লিষ্টে।আমার এখানে কিছু পুরাণো বন্ধু আর কিছু ভালো নতুন বন্ধু যাদের থেকে কিছু বিষয় জানবো বলেই আসা।বন্ধুত্বটা আমার কাছে খুব সিরিয়াস বিষয়।অকারণে অচেনা অজানা বন্ধু পাতিয়ে সময় কাটাতে এই সাইটে আসিনি আমি।"
"ওঃ।আমিও এই সাইটে নতুন।"প্রতু্্যত্তরে লিখল সূর্য।"আমি চাকরি করি।অফিস থেকে ফিরে কিছু অজানা তথ্যকে জানব বলেই সাইটে আসা।তোমার প্রফাইলে তোমার দেশের বাড়ি এগরা বলে উল্লেখ করা আছে।তুমি ইংরেজী মাধ্যমে র ছাত্রী।ইংরেজীতে স্নাতক।আমি ইংরেজীতে একটু কাঁচা।তাই ফ্রেন্ড রিকুয়েস্ট পাঠালাম। "
পূজা কোনো রিপ্লাই দিলনা।কম্পিউটার বন্ধ করে দৈনন্দিন কাজে মনোনিবেশ করল।কিন্তু খেয়াল করল না কখন নিজের অজান্তেই বিশেষ কোনো কারণ ছাড়াই প্রথমবার একটি অচেনা ছেলের ওপর বিরক্ত হওয়ার পরও কথা বলেছে সে।এক্সেপ্ট করেছে তার ফ্রেন্ড রিকুয়েস্ট।
সূর্য খুব ভালো ভাবেই অন্য বন্ধুদের সঙ্গে পূজার কথোপকথন দেখেছে এই সাইটে।এটুকু বুঝেছে পূজার জীবনে এখনও বিশেষ কেউ আসেনি।পরেরদিন সন্ধ্যায় কিছু নোট সার্চ করবে বলে কম্পিউটার খুলে বসতেই সূর্যের আবার একটা ম্যাসেজ পেল পূজা।
"কেমন আছো?কি করছো এখন?"
বারবার কোনো এক অজানা টানে সূর্যের ম্যাসেজ গুলোকে অন্যান্য বন্ধুদের মতো উপেক্ষা করতে পারছেনা পূজা বরং বাধ্য হচ্ছে রিপ্লাই করতে,"নোট দেখছি।একজন বন্ধুর লাগবে।"
"তুমি অযথা নেটে কথা বলতে পছন্দ করনা গতকাল জানিয়েছিলে।আসলে দেখলাম তুমি অনলাইন তাই ম্যাসেজ করলাম।কিছু মনে করনা।"সূর্য ম্যাসেজ করল।
কোনো উত্তর এলনা কম্পিউটারের ওপার থেকে।সূর্য আবার লিখল,
"আমিও জান তো অফিসে আমার কাজের শেষে অফিসের কাজে কারো প্রয়োজন হলে সাহায্য করতে ভালোবাসি।কিন্তু আমার মা এতে বিরক্ত হন"।সহজ ভঙ্গিতেই বলল সূর্য।
"নিজের কাজ করার পর সময় থাকলে অপরের সাহায্য করা তো ভালো বিষয়।অপরের প্রয়োজনে নিজের সামর্থ অনুযায়ী সাহায্য করা তো মানবিক।বিশেষ করে আত্মীয়-বন্ধুদের ক্ষেত্রে।আমার তো কাউকে সাহায্য করতে খুব ভালো লাগে।"এবার পূজার উত্তর এল কম্পিউটারের ওপার থেকে।
প্রভাতী উপাসনার আগে ঠিক যেভাবে মন্দিরকে স্বচ্ছ জলে ধুয়ে-মুছে শুদ্ধ করে মন্দিরের সব জানালা দরজা খোলা হয়।মন্দিরের যুগলমূর্তি যেমন ফুল-চন্দন আর মালা দিয়ে সুন্দর করে সেজে ওঠেন,ঠিক সেভাবেই প্রথম প্রেমের নির্মল পরশে নিজেদের অজান্তেই দুটি প্রাণ ক্রমাগত সেজে উঠছে।
সূর্য এমনিতে স্বল্পভাষী।নিজের কাজ নিয়ে ব্যস্ত থাকতেই ভালোবাসে সে।অবসর সময় বই পড়তে ভালোবাসে।কিন্তু সূর্যও কেন জানেনা পূজার সাথে কথোপকথন এত ভালো লাগছে।
"এগরা কবে আসা হবে?",সূর্যের ম্যাসেজ এল।
"এগরা আমার দেশের বাড়ি।জ্যেঠু কাকুরা থাকেন।আমি কিন্তু কলকাতার মেয়ে।আমার জন্ম,পড়াশোনা সব এখানেই।বড় ছুটি ছাড়া এগরা তেমন যাওয়া হয়ে ওঠেনা।পূজার সময় যাওয়া হয়"।রিপ্লাই করল পূজা।
"তাহলে এলে দেখা হবে।"সূর্য আবারও সহজভাবে ম্যাসেজ করে বসল।
"কী!দেখা হবে? তোমার সাথে দেখা করতে যাব কেন? আমার এখানে আসা বা ফ্রেন্ড রিকুয়েস্ট এক্সেপ্ট করার উদ্দেশ্য তো প্রথমেই স্পষ্ট করেছিলাম তোমাকে!"অতিশয় বিরক্তি প্রকাশ করে লিখল পূজা।সূর্য সম্পর্কে একটা খারাপ ধারণা হল তার।সোসাল সাইট থেকে বেরিয়ে এসে নোট সার্চে মন দিল।
পরেরদিন সকালে অন্যান্য ম্যাসেজ চেক্ করতে গিয়ে গতকাল সূর্যের পাঠানো একটা ম্যাসেজ পেল পূজা।
"আমি অতো ভেবে কিছু বলি নি কিন্তু।এগরা এলে দেখা হয়ে যেতেও পারে।বন্ধুর সাথে বন্ধুর যেমন দেখা হয় সেইভাবেই বলা।"
পূজা মনকে কোনোরকম প্রশ্রয় দিলনা কোনো প্রতু্্যত্তরের জন্য।এইভাবে দুটো দিন অতিবাহিত হল।অনলাইন জেনেও সূর্য পূজাকে কোনোরকম ম্যাসেজ করা থেকে নিজের মনকে বিরত রাখল।
দুদিন পরে সূর্যের একটা অপ্রত্যাশিত ম্যাসেজ পেল পূজা।
"একটা সমস্যায় পড়েছি।বন্ধু হিসেবেই তোমার কাছে এর সমাধান আশা করছি।আসলে গত দুদিন তোমার সাথে কথা বলার ইচ্ছা হলেও তুমি পছন্দ করনা বলে ম্যাসেজ করিনি।কিন্তু কেন জানিনা তুমি মাঝেমধ্যে আমার অজান্তেই মনে ঢুকে পড়ছো।অফিস যাওয়ার সময় বাসে আমি খবরকাগজ পড়তে পড়তে যাই।পড়তে পড়তে কি করে যেন তুমি মনে ঢুকে যাচ্ছ।আমার তো কোনো মেয়েকে আর ভালোই লাগছেনা।স্কুল-কলেজ পেরিয়ে এসেছি অনেকদিন।তারপর এতদিন কেটে গেছে।এরকম আগে কখনও ঘটেনি আমার সঙ্গে।তোমাকে কেন জানিনা খুব আপন মনে হচ্ছে।এই সোসাল সাইটটিতে অন্য অচেনা বন্ধুদের আমি প্রথমে আপনি বলেই সম্বোধন করেছি।কিন্তু তোমাকে কেন বুঝতে পারছিনা খুব আপন বলে মনে হচ্ছে।তাই প্রথম থেকে তুমি বলতেই ইচ্ছা হল তোমাকে।এরকম তো কখনও আগে হয়নি আমার।আমি প্রেম ভালোবাসা অতো তো বুঝিনা।তবে মনে হয় আমি না তোমার প্রেমে পড়ে গেছি।তোমার ফোন নংটা দিলে ভালো হয়।বোধহয় কথা বললে এই সমস্যার সমাধান পাওয়া সহজ হত। "
ব্যস্।পূজার মাথা গরম!আত্মীয়-বন্ধুদের মধ্যে ইতিপূর্বে অনেক প্রেম প্রস্তাবকেই খুব শক্ত হাতে প্রত্যাখ্যান করেছে পূজা আগেই বলেছিলাম।আর এরকম দুদিনের চেনা একজন বন্ধুর কাছে এরকমটা আশা করা যায়না।কোনো উত্তর না দিয়ে সোজা সেটিংসে গিয়ে ডিলিট অপ্সন খুঁজতে যাবে, সূর্যের আরেকটা ম্যাসেজ,
"আমি এই সমস্যা থেকে বেরোতে চাই।তুমি বন্ধুদের সাহায্য করতে ভালোবাসো।তাই তোমাকে জানালাম।পারলে বেরোতে সাহায্য কর।"
ম্যাসেজটা পড়ে একটু থেমে গেল পূজা।
খুব সহজে অজানা কাউকে বিশ্বাস করা পূজার স্বভাব নয়।কিন্তু কোন সেই অজানা কারণে সূর্যের প্রতি ধারণা ভালো না হলেও অবিশ্বাস করতে পারছে না তার কোনো কথা।এক অজানা টানে সূর্যকে সমস্যার সমাধান জানাবার একটা আন্তরিক তাগিদ অনুভূত হল তার।সিদ্ধান্ত নিল সমাধান দিয়েই সূর্যের একাউন্ট টা ফ্রেন্ডলিস্ট থেকে ডিলিট করে দেবে সে।
লেখা শুরু করল পূজা,
"তোমার সাহস দেখে অবাক হলাম।কিন্তু বলেছিলাম বন্ধুত্বটা আমি সিরিয়াসলি নিই।তুমি সমাধান চেয়েছো তাই কিছু কথা বলে দিতে চাই।
তুমি আমাকে কতটুকু চেনো বা জানো যে চারদিনে আমার প্রেমে পড়ে গেলে? আমাকে কখনও দেখোনি। এর আগে কাকে কি বলেছো বা বলনি আমি দেখতে যায়নি।
তবে আমার মনে হয় তুমি মনে মনে কাউকে খুঁজছো?প্রকৃত বন্ধুত্ব বা ভালোবাসা একটা স্বতঃস্ফূর্ত বিষয়।দুচারদিনে জোর করে হয়না।আর তাছাড়া তুমি ভাবলে কি করে যাকে চাইবে তাকেই পেয়ে যাবে জীবনে?
প্রথমতঃ তোমার অবগতির জন্য জানাই বন্ধুদের মধ্যে এসব বিষয়ে আমি কোনোদিন ভাবতেই পারিনা।দ্বিতীয়তঃ আমার জীবনে আমার ভাগ্যে যে জীবনসঙ্গী হিসেবে পূর্বনির্ধারিত সেই একজনকেই আমি মেনে নিতে সক্ষম।উদ্দেশ্যহীন সম্পর্কে কোনো কথাপোথন আমার স্বভাববিরুদ্ধ।আমার প্রতি আমার পরিবারের বিশ্বাস আমার প্রাণের চেয়েও প্রিয়।আমি তা কখনও কোনো মূল্যে ভাঙতে পারবনা।
আশাকরি তোমার সমস্যা র সমাধান জানাতে পেরেছি।এরপর এরকম ভুল করলে তোমাকে ফ্রেন্ড লিস্টে রাখা সম্ভব হবেনা।harsh step নিতে বাধ্য হব।"
পূজার এই উত্তরে সূর্যের মনে যেমন একটা অচেনা কষ্টে সূর্যের মনটা অস্থির হয়ে উঠল আবার পূজার প্রতি ভালো লাগাটা তেমনই এক ধাক্কায় অনেকটা বেড়ে গেল।
"Harsh step তুমি নিতেই পার।আজ আমি তোমাকে আমার মনের কথাটা জানালাম বলে আমি খারাপ হয়ে গেলাম।বন্ধুদের মধ্যে কেউ যদি মনে মনে তোমার প্রতি এরকম ধারণা রাখে তবে ঠিক আছে?তোমার বন্ধুদের মধ্যে কেউ যদি তোমার সেই একজন হয় তুমি তো বুঝতেও পারবেনা।"পূজাকে মন খারাপের কথাগুলো অকপটে বলে দিল সূর্য।
"বন্ধুদের মধ্যে কেউ হবে কিনা তা নিয়ে তোমার মাথা ব্যথা না করলেও হবে।আমি নিজেকে যতটুকু চিনি তা সম্ভব নয়।আর যদি ভাগ্যে কখনও আমার তাই থাকে তবে যে আমাকে ভালো বন্ধু হিসেবে বুঝবে সে এই বিষয়টা নিশ্চয় সেইভাবে handle করবে।
যাইহোক এটুকু বলি আমাদের ভালো বন্ধুত্বের বিষয়টা প্রথমেই আঘাত দিয়েছো। এসব থেকে তাড়াতাড়ি বেরিয়ে আসার চেষ্টা কর।ভালো থেকো।"পূজা দৃঢ়ভাবে তার বক্তব্য সুস্পষ্ট করে জানিয়ে দিল সূর্যকে।
মন দিয়ে পূজার কথাগুলো পড়ে বোঝার চেষ্টা করছে সূর্য।সে অবাক হল এই ভেবে যে একটা ছেলে প্রপোজ করলে কোনো মেয়ে এতটা নির্লিপ্ত থেকে বন্ধুত্বের সত্তাকে মূল্য দিতে পারে এর আগে তার ধারণা ছিলনা।তাছাড়া পূজা কি করে জানল যে সে মনে মনে কাউকে খুঁজছে?পূজাকে সত্যিই খুব ভালো লেগে গেছে সূর্য র।যত কথা বলছে ততই যেন মনে মনে ভালোলাগার বাঁধনে জড়িয়ে পড়ছে সে।সেটা বন্ধুত্ব, না প্রেম সে জানেনা।মেয়েদের সাথে খুব একটা কথা বলায় অভ্যস্ত নয় সূর্য। আগে কখনোই এরকম উপলব্ধি হয়নি তার।মনে অস্বস্তি আর সন্তুষ্টি একসাথে মিলেমিশে এক বিচিত্র অনুভূতি হচ্ছে তার।কিন্তু পূজার একটা কথা তাকে মানতেই হবে।যাকে চাইবে তাকে পেয়ে যাবে সহজে,এটা ভাবা তার ভুল।জোর করে আর যাই হোক কারো গভীর ভালোবাসা ও বিশ্বাস পাওয়া যায় না।সত্যিই তো প্রকৃত প্রেম তো স্বতঃস্ফূর্ত একটা অনুভূতি।
"তোমার থেকে প্রকৃত বন্ধুত্ব যা জানলাম নিশ্চয় মনে রাখব সারা জীবন।ঠিক আছে ওসব বিষয় নিয়ে আর ভাববো না।এবার থেকে সচেতন থাকব।তবে এটুকু বলব তোমার মতো বন্ধু পাওয়াও ভাগ্যের বিষয়।"
সকালে ঘুম ভাঙতেই ম্যাসেজ করল সূর্য পূজাকে।
বাহিরমুখী শিক্ষা র চেয়ে অন্তরমুখী শিক্ষার প্রতি কিশোরী অবস্থা থেকেই পূজার সহজাত আগ্রহ।বরাবরই অন্তরদৃষ্টির প্রতি পূজার বিশেষ ঝোঁক।আশে পাশের মানুষজনের কথা আর ব্যবহারের আড়ালে তাদের মনের গভীরে অনায়াসেই ঢুকে দেখতে জানে আমাদের পূজা।বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই নির্ভুল হয় তার বিচার।সূর্য যে স্বভাবসিদ্ধ কোনো কুঅভ্যাসবসতঃ নয়,বরং সে সহজসরলভাবে মনে মনে তার জীবনে বিশেষ কাউকে খুঁজে বেড়াচ্ছে বলেই এই সমস্যার সম্মুখীন হয়েছে সেটা একদম সঠিকভাবে মূল্যায়ণ করতে পেরেছে পূজা।
সূর্যর প্রতু্্যত্তরে আর কিছুই লিখলনা পূজা।কিন্তু ফ্রেন্ড রিকুয়েস্টটি ডিলিট করা আর হল না।ইউনিভার্সিটির কিছু বিষয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়ল পূজা।এভাবেই কেটে যেতে লাগল একটা মাস।পূজা আবারও একটা বিষয়ে খেয়াল করে উঠল না যে কোন অজানা কারণেই তাকে প্রপোজ করার পরও কোনো বন্ধুর সাথে স্বভাবসিদ্ধভাবে পুরোপুরি যোগাযোগ শেষ করে দিতে প্রথমবার মন চায়নি তার।পূজার অন্তরের কঠিন বরফটা সূর্যের উষ্ণ তেজে কখন যে তার অজান্তেই কোনো কারণ ছাড়াই ধীরে ধীরে গলতে শুরু করে দিয়েছে সেটুকু এখনও টের পায়নি পূজা।
© বুনানী