...

15 views

বনানী ভবন
(১)
অভীক আমার ছোটোবেলার বন্ধু। বতমানে দুজনেই উচ্চ মাধ্যমিক পরীক্ষার পর কেবল তিনমাসের অবসর নিয়েছি। অভীক ছেলেটা পড়াশোনায় খুবই ভালো, তবে বাড়ির অবস্থা অতটা ভালো নয়। তাই পরীক্ষার পর পরই ও দেশের বাড়ি চন্দনপুর গ্রামে চলে যায়। সেখানে ওদের পৈতৃক বাড়ি আছে। সেই বাড়িতে ওর দাদু, ঠাকুরমা এবং একজন চাকর ভজন ছাড়া আর কেউ থাকেন না। ওর বাবা কাকারা কাজের সূত্রে দেশ-বিদেশে থাকেন। থাক, ভূমিকায় আর বেশি না গিয়ে আসল গল্পে আসি, গল্প নয় এটা সত্যি। প্রায় একমাস আগে অভীকের চিঠি পেয়েছিলাম। যুগ বদলাচ্ছে সাথে সাথে যোগাযোগের মাধ্যমও, তবে আমরা আমাদের পুরোনো সংস্কৃতিকে ধরে রেখে চিঠি লিখি। ওর চিঠিতে যা লেখা ছিল তা পড়ে প্রথমে মনে হল ওর মনের ভুল-ভ্রান্তি তবে ও আমাকে এ ব্যাপারে নিশ্চয়তাও দিয়েছে। ওর চিঠিতে যা লেখা ছিল তা হল:
প্রিয় অনিন্দ,
আশা করি তুই ভালো আছিস, আমিতো এখানে দাদু, ঠাকুরমা আর ভজনদার আদরে যথেষ্ট ভালো আছি। তোকে একটা কথা বলার ছিল। কথাটা সাহস করে কাওকে বলতে পারছি না, পাছে কেউ আমাকে ভীতু ভেবে ঠাট্টা করে। কিন্তু তুই আমার বেস্ট ফ্রেন্ড তাই বলছি। এখানে আসার পর ভজনদা আমার জন্য একটা টিউশন ঠিক করে দিয়েছিল। সেখানে পড়াতে যেতাম, ঘরে আসতাম, খাওয়া-দাওয়া, ঘুম সবই ঠিক-ঠাক ছিল। কিন্তু হঠাৎ করে যেন আমার জীবনে আমূল পরিবর্তন এল। সেদিন পড়াতে গিয়েছিলাম, ফিরতে সন্ধ্যে হয়ে গেল। আর আমাদের গ্রামে তো জানিস সূর্য মামা ডুবলেন মানে সকলেই ঘরবন্দি হলেন। সন্ধ্যেবেলা নিজন পথ দিয়ে একা ফিরছিলাম। দুদিকে ফাঁকা জমি আর চারিদিকে জোনাকির মিটমিটে আলো ছাড়া আর কোনো আলো মানুষজন নেই। এ গ্রামে এখোনো বিদ্যুৎ এসে পৌঁছয়নি। এদিকে পুব দিকের আকাশ ইস্পাতের মতো কালো হয়ে এসেছে। পথে যেতে যেতে এক শ্মশান পড়ে। সেই শ্মশানে এক মস্ত ক্যাওড়া গাছ আছে। সেই গাছে নাকি তেনাদের আনাগোনা সবসময় লেগেই রয়েছে। এই কারণে শ্মশানটির নাম ক্যাওড়া তলার শ্মশান। শ্মশানের কাছে পৌঁছতেই হঠাৎ একটা শীতল বাতাস আমার শিরদাঁড়ার ভেতর দিয়ে বয়ে গেল। এক অদ্ভুত অনুভূতি এর আগে কখনো পাইনি। কিছুক্ষণ নিঃসাড়ভাবে দাড়িয়ে রইলাম। কোথা থেকে যেন তক্ষনি প্রবল ঝড় আরম্ভ হয়ে গেল। সেই ঝড়ে ধুলো-বালি আমার চোখের ভেতর আশ্রয় গ্রহণ করলে। তাদের আশ্রয়ের জেরে আমি কোনো দিকে কিছুই দেখতে পাচ্ছিলাম না। তাও এগিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করলাম কিন্তু প্রকৃতি আমার প্রতিকূল হয়ে দাঁড়াল , শুরু হয়ে গেল প্রবল বষন। ঝড়ের দাপটে বৃষ্টির জলের ছিটে গায়ে ছুরির ফলার মতো আঘাত করছিল। কোনোরূপ উপায় না পেয়ে শেষে শ্মশানের পাশে এক ছোট্ট কুঠুরিতে আশ্রয় নিলাম। অন্ধকার ঘরটির এক কোণে চুপচাপ বসে আছি মনে হল আমার ঘাড়ের ওপরে কারো নিশ্বাস পড়ছে। সেই নিশ্বাসের বাতাস বরফের চেয়েও বেশি ঠান্ডা। এরপর আমি শিউরে উঠলাম তবুও বাইরে বেরোনোর উপায় নেই, বৃষ্টি ও ঝড় সেই একই তালে নৃত্য করে যাচ্ছে। তবুও সাহস করে বসে রইলাম। হঠাৎ কানে এক মিনমিনে গলার আওয়াজ শুনতে পেলাম, "মাঁ মাঁ কঁতদিন মাঁনুষের মাঁংসঁ খাঁই নাঁ আঁজ খুঁউউউউউউব ইঁচ্ছে কঁরছেঁ দেঁ নাঁ মাঁ। " "এঁইতোঁ চোঁখেঁর সাঁমনেঁ জঁলঁজ্যাঁন্ত মাঁনুষ বঁসেঁ,চঁল আঁজ ওঁকে দিঁয়েই আঁমাঁদেঁর মঁহাভোঁজ হবে। " এই কথার পরেই সমস্ত ঘরময় কতগুলি আলোক বিন্দু জ্বলে উঠল। আর একমুহূর্তও দেরি না করে আমি সোজা ঘরের দিকে ছুট। তখন মনে হচ্ছিল আমি নিজের মধ্যেই নেই আর পিছনে সেইরকম কতগুলো আওয়াজ ছুটে আসছিল। কতক্ষন ছুটেছি জানি না। যখন জ্ঞান ফেরে তখন সুয্যিমামার আলো আমাদের গ্রামে প্রবেশ করে গেছে। চোখ মেলতেই দেখি দাদু-ঠাম্মি-ভজনদা, গ্রামের আরো কয়েকজন আমার সামনে দাঁড়িয়ে আছেন। ভজনদা বলছিল আমি নাকি ঝড়ের মধ্যে এক বটগাছ তলায় অজ্ঞান হয়ে পড়েছিলাম। অনেক রাত অবধি ঘরে না যাওয়ায় ঠাম্মি চিন্তা করছিল। তখন ভজনদা গ্রামের কয়েকজনকে সাথে নিয়ে আমাকে খুঁজতে বেরিয়েছিল। সারারাত আমি অজ্ঞান ছিলাম। জানি এসব কথায় তুই বিশ্বাস করবি না। তবে সেদিনের পর থেকে আমি পড়াতে যাওয়া বন্ধ করে দিয়েছি। এমনকি ওই পথের দিকে ফিরেও তাকাই না।
আমি কদিন পরেই মা-বাবার কাছে যাচ্ছি তখন তোর সাথে দেখা হবে। ভালো থাকিস।
ইতি,
তোর প্রিয় অভীক
..................