...

0 views

তুমি এলে তাই....
                                      ১
"বাবা সকাল হয়ে গেছে?"-মুখের ওপর থেকে চাদরটা সরিয়ে বলল পূজা।
   ঘড়ির দিকে একবার চেয়ে আদিদেব বলল-" হ্যাঁ রে। অনেক্ষণ হয়েছে। সাতটা বাজে।"
                        "আমি একটু বসতাম, ধরে দাও তো একবার।"
      আদিদেব রোগগ্রস্ত মেয়েকে ধরে বসিয়ে দিয়ে বলল-"আজ আমি একটু বাজরে যাব। আংটি টা বিক্রি না করলে আর উপায় নেই।"
                       "মোটেই না। আমি আর ঔষুধ খাবই না। এতদিন ধরে ঔষুধ খেয়েও তো কই ভালো হলো না? তুমি ওই আংটি টা বিক্রি করবে না।"
    আদিদেব বলল- "ঔষুধ তো তোকে খেতেই হবে। কিন্তু তার সাথে খাবারও তো খেতে হবে নাকি? এছাড়া আর কোনো উপায় নেই আপাতত।"
   পূজা কিছু বলার জন্য মুখ তুলতেই বাবার চোখের দিকে তাকিয়ে ভয় পেয়ে যায়। এর আগে  কখনো এমন কঠোর দৃষ্টি বাবার দেখেনি। তাই কিছু বলা হয় না পূজার।
  আদিদেব কিছুক্ষন স্থির হয়ে বসে থেকে উঠে পড়ে-"আমি আধ ঘন্টার মধ্যেই চলে আসব। ততক্ষন একটু সাবধানে থাকিস। আর হ্যাঁ... পাশেই জল রেখেছি, দরকার পড়লে খাস। আমি যাব আর আসব।"
  আদিদেব হনহনিয়ে ঘর থেকে বেড়িয়ে যায়। পূজা একবার শেষ চেষ্টা করতে গলা উচুঁ করে বলল-"আর একবার ভেবে দেখলে হতো না?" উত্তরের জন্য কান খাড়া করে থাকে পূজা। উত্তর আসে-"ভাবার মতো আর কিছু নেই।"

                                       ২
  গলির মোড়েই মোহন স্যাকরার দোকান। পাড়া-গাঁয়ের ছোটো খাটো দোকান। তাতে আবার সকাল বেলা। আদিদেব দোকানে ঢুকে দেখল দুজন মহিলা কিছু কিনছে। আদিদেব কে দেখে মোহন বলে উঠল-"আরে আদিদা যে সকাল সকাল...তা কী মনে করে? মেয়ের বিয়ে-টিয়ে ঠিক হলো নাকি ?"
    আদিদেব এগিয়ে যেতেই একজন মহিলা  একেবারে অন্য দিকে মুখ ফিরিয়ে সরে গেল। তাই দেখে দ্বিতীয় মহিলা বলল-"কী হলো দিদি কিনবে না?"
  প্রথম মহিলা ধীরে ধীরে বলল-"আগে ভদ্রলোকের হয়ে যাক, তারপর দেখছি। তুই পছন্দ কর না ডিজাইন।"
   আদিদেব সোজা এগিয়ে গিয়ে বলল-"আরে না ভাই সে সৌভাগ্য হবে বলে মনে হচ্ছে না। আর তা ছাড়া মেয়ে সবে ১৭ বছর চলছে, এরমধ্যে কী বিয়ে দেওয়া হয়? তুমি বরং এই আংটি টা নিয়ে বলো কত দাম হবে?"
   আদিদেব পকেট থেকে একটা সোনার আংটি বের করে মোহনের হাতে দিল। মোহন সেটা হাতে নিয়েই বলল-"ওরে বাবা এ তো বেশ ভারী। খাঁটি সোনাও বটে। পঁচিশ হাজার মতো দাম হবে মনে হচ্ছে। তুমি কী এটা বিক্রি করবে?"
                "হ্যাঁ। সেই জন্যই তো তোমার কাছে এলাম।"
                  "আমি তো নিতে পারব না।"
                              "কেন?"
     "আদিদা, তুমিতো সবই জানো। ছোটোখাটো দোকান আমার। অর্ডার মাফিক হালকা সোনার গয়না তৈরি করি। আমিতো এতো দাম দিয়ে কিনতে পারব না। তুমি বরং এখনই বাস ধরে শহরে চলে যাও।"
          "শহরে? সে তো দু-তিন ঘন্টার ব্যাপার। বাড়ীতে অসুস্থ মেয়ে। এখন এমন অবস্থা হয়েছে যে নিজে উঠে বসতে পর্যন্ত পরে না। এই পরিস্থিতিতে আমি কী করে অত দূরে যায় বলতো। বাড়ীতে তো ওকে দেখার মতো কেউ নেই।"
             "সে কী পূজা এখনও সুস্থ হয়নি?"
       "না। তাহলে আর বলছি কী? চিকিৎসাই ভালো করে করতে পরছি না তাহলে সুস্থ কী করে হবে?"
             "খুব মুশকিল তো। কিন্ত আমিও এই মুহূর্তে নিতে পারব না।"
          "আমার টাকার খুব প্রয়োজন।তাই এই শেষ সম্বলটুকু বিচতে এলাম। তুমি কিছু করো।"
    এমন সময় প্রথম মহিলা দ্বিতীয় মহিলাকে কিছু একটা বলতেই দ্বিতীয় মহিলা এগিয়ে এসে বলল-"কই আংটি দেখি।"
      মোহন মহিলার হাতে আংটি টা দিয়ে বলল-"একদম খাঁটি সোনা ম্যাডাম। পরলে কিনে নিন।"
          "আমার এখন আংটির দরকার নেই। দিদি দেখবে বলল তাই নিলাম।"
    দ্বিতীয় মহিলা প্রথম মহিলার হাতে আংটিটা দিতেই আংটিটা মুষ্টিবদ্ধ করে ফেলল প্রথম মহিলা। তাই দেখে দ্বিতীয় মহিলা বলল-"একি দিদি তুমি নেবে নাকি এটা?"
      দুই মহিলার হাবভাব দেখে আদিদেবের মনে এক ক্ষীন আশা সৃষ্টি হল। যদিও প্রথম মহিলার মুখ দেখা যাচ্ছে না, তবুও ওনাকেই উদ্দেশ্য করে বলল-"আপনি যদি আংটি টা নেন তাহলে খুব ভালো হয়। মোহনাতো বললই  খাঁটি সোনা। আমার এটা বিক্রি করার ইচ্ছা ছিল না। এটা আমার জীবনের সবচেয়ে দামী উপহার। নেহাত টাকার বড্ড দরকার।"
   প্রথম মহিলা কোনো রকম প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত না করলেও দ্বিতীয় মহিলা বলল-"আপনার যদি এটা বিক্রি করতে মন না চায় তাহলে বিক্রি করছেন কেন? অন্য ভাবে টাকার ব্যাবস্থা করুন না"
       "এছাড়া আর কোনো উপায় নেই ম্যাডাম। আমার সব শেষ। ভগবান আমার থেকে সবকিছুই কেড়ে নিয়েছেন আগেই। শুধু ছিল হৃদয়ের টুকরো মেয়েটা, তো ওকেও আমার থেকে কেড়ে নিতে উঠে পড়ে লেগেছেন।"
  একটু থেমে আদিদেব প্রথম মহিলাকে উদ্দেশ্য করে বলল-"আপনাদের তো দেখে ধনী বলেই মনে হচ্ছে। আপনারা তো সবই শুনলেন। দয়া করে যদি কিনে নেন তা হলে খুব ভালো হয়। মেয়েটাকে বলে এসেছি আধ ঘন্টার মধ্যে ফিরব, পথ চেয়ে বসে থাকবে বোদহয়।"
          প্রথম মহিলা তবুও কোনো উত্তর দিল না বা মুখ ফেরাল না। হাতের মুঠোয় রাখা আংটিটায় আরো একটু চাপ দিয়ে সামনের দিকে ঝুঁকে পড়ল।
        দ্বিতীয় মহিলা কাঁধে হাত রেখে বলল-"কী হলো দিদি?"
       প্রথম মহিলা ক্ষীণ কন্ঠে বলল-"এটা আমিই রাখছি। তুই ভদ্রলোককে দামটা দিয়ে দে।"
     মহিলার ক্ষীণ কন্ঠস্বর আদিদেবের কানে এসে পৌঁছল না।
   দ্বিতীয় মহিলাও ধীরে ধীরে বলল-"কিন্তুু দিদি তুমি তো আংটি কিনতে আসনি। এসেছিলে হাতের চুড়ির অর্ডার দিতে। আর তাছাড়া তুমি এই পুরুষদের আংটি নিয়ে কী করবে?"
                "আমি কোনো চুড়ির অর্ডার দেব না। আমি এটাই নেব। তুই আমার ব্যাগ থেকে পঁচিশ হাজার টাকা দিয়ে আয়।"
                 "কিন্তু................"
        " আর কোনো কিন্তু নেই দিপীকা। তোকে আর আমি কোনো কৈফিয়ত দেব না। যা বললাম তাই কর।"
    দিপীকা আর কোনো কথা না বলে আদিদেবর হাতে পঁচিশ হাজার টাকা দিয়ে বলল-"আংটিটা আমার দিদির খুব পছন্দ হয়েছে তাই কিনেই নিল। টাকাটা দেখে নিন।"
     আদিদেব বলল- "অনেক ধন্যবাদ আপনাদের।কিন্তু এটার দাম কী এত হবে?" জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাকাল মোহনের দিকে।
   মোহন হেসে বলল-"হ্যাঁ। আমি কিনতে হয়তো পরলাম না কিন্তু তাই বলে এটা ভেবো না আমার অভিজ্ঞতা কম।"
             "আরে না না তা নয়....।
  দিপীকা বলল-" তাহলে মোহনদা আমরা আজ আসি।"
              "হ্যাঁ। হ্যাঁ। আবার আসবেন।"
                                        ৩
  প্রায় মাস তিনেক পর।
    পূজা এখন সম্পূর্ণ সুস্থ। পূজার আজ জন্মদিন। তাই আজ আদিদেব কাজের ছুটি নিয়েছে। সকাল সকাল স্নান সেরে স্থানীয় কালী মন্দিরে পূজো দিতে এসেছে বাবা-মেয়ে তে।
মন্দিরের পাশে গিয়েই থমকে দাঁড়ায় পূজা-"যা!"
   আদিদেবও দাঁড়াল-"কী হলো আবার?"
          " জবা ফুলের মালাটাই তো কেনা হয়নি।"
          "তাই তো। আমারও একদম খেয়লই নেই।"
      "তুমি আমাকে টাকা দাও। আমি এখনি নিয়ে আসছি।"
  আদিদেব পূজার হাতে টাকা দিয়ে বলল-"চল আমিও যায়।"
           "তোমাকে যেতে হবে না। আমি পরব। তুমি এখানেই দাঁড়াবে কিন্তু।" পূজা চলে গেল।
আজ এতদিন পর পূজাকে এত খুশি দেখে আদিদেবেরও খুব ভালো লাগছিল। পাশের মন্দির থেকে ঘন্টার শব্দ ভেসে আসছে। এক অদ্ভুত ভালোলাগার পরিবেশ যেন চারিদিকে।
                   "আরে দাদা আপনি?" চমক ভাঙে আদিদেবের। চেয়ে দেখে দিপীকা।
                "হ্যাঁ। এই একটু মন্দিরে পূজো দিতে এসেছি। কিন্তু আপনি ?"
    দিপীকা হেসে বলে-" আমি কিন্তু আপনার বোনের বয়সি। আমাকে আপনি বললে লজ্জা পাব।"
    আদিদেবও হেসে ফেলে-"তুমিও কী পূজো দিতে এসেছ?"
      "আমি না। আসলে আমার দিদি প্রত্যেক বছর আজকের দিনে ব্রাহ্মণ ভোজন করায় মন্দিরে। তাই দিদির সাথে এসেছি। আপনার মেয়ে কেমন আছে?"
               "একদম সুস্থ। আজ ওর জন্মদিন। এসেছেতো মন্দিরে।"
                              "কোথায় ও?"
    " মালা আনতে গেছে। এখন থেকে সবদিকে এত নজর মাঝে মাঝে তো আমার মনে হয়...ও আমার মেয়ে না আমিই ওর ছেলে।"
     দিপীকা হেসে বলল-"এত খেয়াল রাখে আপনার?"
        আদিদেবও হাসে-"ওর মায়ের একটুকু গুনও বাদ দেয়নি ও।"
          "আজতো দেখা করতেই হচ্ছে আপনার মেয়ের সাথে। কী নাম আপনার মেয়ের?"
                                "পূজা।"
                              "আচ্ছা।"
           "আপনাদের বাড়ি কী এখানেই?" প্রশ্ন আদিদেবের।
           "না না। আমার বাড়ি সেই মেদিনীপুরে। আমি এখানকার ভগিনী নিবেদিতা গার্লস স্কুলের টিচার। আমি যাকে দিদি বলি উনি ওই স্কুলের প্রধান শিক্ষিকা। ওনার কেউ নেই। বড়ো বাড়িতে একাই থাকেন তাই আমাকে দয়া করে থাকতে দিয়েছেন।"
         "আপনার দিদি কিন্তু খুব ভালো মানুষ।"
       "কী জানি কেমন মানুষ। আগাগোড়া পাই না। বিশ্বাস করুন ৩ বছর একসাথে আছি তবুও ওনাকে বুঝে উঠতে পারলাম না।"
       দিপীকার বলার ধরন দেখে আদিদেব হেসে ফেলল।
       "সত্যিই। আজ পর্যন্ত একটা কথাও শেয়ার করল না। এইতো সেদিন আপনার আংটি কিনল তার পরদিন সকালে আমাদের দাজিলিং যাওয়ার কথা ছিল। সবকিছু ঠিকঠাক বেড়নোর আগে বলল যাবে না। হয়ে গেলো টিকিট ক্যানসেল। এই আজই দেখুন না....ব্রাহ্মণ ভোজনের জন্য কেন যে বছরের আজকের দিনটা বেছে নিয়েছেন তা বলে না।"
               "অদ্ভুত লোক তো। ওই দেখো পূজা আসছে।"
দিপীকা দেখল একটি সতেরো-আঠারো বছরের মেয়ে। নীল-সাদা সালোয়ার পড়ে আছে। চুলগুলো কোঁকড়ানো, চোখ মুখের এক অসাধারন সৌন্দর্য। দিপীকা বলল-"খুব সুন্দর তো আপনার মেয়ে। আনেকটা আপনার মতো।"
     আদিদেব বলল-"ও আমার মতো না। ও ওর মায়ের মতো।"
         "আপনার স্ত্রীও বুঝি খুব সুন্দরী ছিলেন?"
                          "হ্যাঁ। খুব সুন্দর।"
              "আপনিও কিন্তু কম সুন্দর ন।"
আদিদেব উত্তর দিতে যাচ্ছিল পূজা এগিয়ে এসে বলল-"বাবা তাড়াতাড়ি চলো। দেরি হয়ে যাবে তো।"পূজা মন্দিরের দিকে চলে গেল।
       আদিদেব দিপীকাকে বলল-"আসছি।"
              "হ্যাঁ। আমিও দেখি গিয়ে দিদির হলো কি না।" দিপীকা অন্য রাস্তা দিয়ে চলে গেল।
      বাড়ি ফেরার সময় দিপীকা বলল-"আজ এমন একজনের সাথে দেখা হলো যে হেডমিস্ট্রেস অরুন্ধতী চ্যাটার্জীর কোঁকড়া চুলের সাথে অনায়াসে টক্কর দেবে।"
            অরুন্ধতী জনলা দিয়ে চোখ রেখেই হেসে বলল-"তাই? কে সেই ব্যাক্তি জানতে পরি কী?"
       দিপীকা উৎসাহিত হয়ে বলল-"আরে সেই মোহনদার দোকানে যার আংটি কিনলে না আদিদেববাবু ওনার মেয়ে পূজা। একেবারে তোমার মতোই চুল।"
      অরুন্ধতী অধীর আগ্রহে বলল-"তুই দেখেছিস পূজাকে? কেমন আছে ও?"
  দিপীকা আশ্চর্য হয়ে বলল-"দিদি তুমি পূজাকে তুমি চেনো?"
   ফুঁ দিয়ে মোমবাতি নেভালে যেমন দপ করে আঁধার নামে তেমনই অরুন্ধতীর মুখের দ্বিপ্তী নিভে গেল-"না। মানে আমি চিনি না। সেদিন ভদ্রলোক বলছিলেন ওনার মেয়ে অসুস্থ তাই জিজ্ঞেস করলাম।"
        দিপীকা বলল-" আমি ভাবলাম চেনো।"
                        "না। চিনি না রে।"
             "পূজা একেবারে সুস্থ স্বাভাবিক। বাবার সাথে পূজো দিতে এসেছিলো।"
                                 "ও"
         "মেয়েটা খুব মিষ্টি। জানতো আজ আবার ওর জন্মদিন।"
                             "তাই?"
           "খারাপ লাগছে পূজার জন্য। বেচারার মা নেই। আজকের দিনে কেই বা না চায় তার মা সাথে থাকুক। আদিদা বলছিল ও যেমন ওর মায়ের মতো দেখতে তেমনই গুনও পেয়েছে মায়ের থেকে।"
            "উনি ওনার স্ত্রীর কথা বলেছেন?"
                       "তেমন কিছু না । তবে ওনার কথা শুনে বোঝা গেল উনি স্ত্রী কে খুব ভালো বাসতেন। এখনও বাসেন।"
    কিছুক্ষণ চুপচাপ থেকে অরুন্ধতী বলল-"পূজার মা কী মারা গেছে?"
         দিপীকার সোজা সাপটা উত্তর-"নেই মানে মারা গেছেন ছারা আর কী হবে?"
দিপীকার প্রশ্নের জবাব দেওয়ার মতো ক্ষমতা অরুন্ধতীর ছিল না। তাই চুপ করেই থাকল। শুধু বুক চিঁড়ে বেড়োলো একটা দীর্ঘশ্বাস।
                                         ৪
        "ব্লকের অধীনস্থ সমগ্র উচ্চবিদ্যালয়ের বার্ষিক সাংস্কৃতিক প্রতিযোগিতা আমাদের এই ভগিনী নিবেদিতা গার্লস স্কুলে অনুষ্ঠিত হওয়ায় আমার নিজেদেরকে ভাগ্যাবান মনে করছি......" লাউডস্পিকারে ঘোষনা হচ্ছিল।
        "আমাদের প্রতিযোগিতা আগেই শেষ হয়েছে, এবার ফলাফল ঘোষণার সময় এসে গেছে।"  একে একে নাচ, গান, কবিতা আবৃত্তি প্রভৃতির ফলাফল ঘোষণার পর শোনা গেল-"এবাড় আমাদের অনুষ্ঠানের বড়ো চমক অঙ্কন প্রতিযোগিতা। এই প্রতিযোগিতায় প্রথম স্থান অধিকারী প্রীতিলতা গার্লস স্কুলের পূজা চ্যাটার্জী।"
     নামটা শোনা মাত্রই অরুন্ধতী চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়ায়। একটু পরে পূজা এসে স্টেজে দাঁড়াল। আরে! ওই তো সেই কোঁকড়া চুল, সেই চোখ, সেই মিষ্টি হাসি......মায়ের কী কখনো নিজের মেয়েকে চিনতে ভুল হয়?
       "পূজার হাতে পুরস্কার তুলে দেবেন স্বনামধন্য চিত্রশিল্পী তথা আমাদের স্কুলের প্রধান শিক্ষিকা অরুন্ধতী চ্যাটার্জী মহাশয়া।" লাউডস্পিকারে ঘোষনা হলো।
    অরুন্ধতী তখন অভিভূতের মতো চেয়ে পূজার দিকে। সামনে এগিয়ে যাওয়ার ক্ষমতাটুকুও নেই। সম্পাদি এগিয়ে এসে বলল- "দিদি আপনাকে ডাকল তো।"
   অরুন্ধতীর চমক ভেঙে গেল। ধীর পায়ে এগিয়ে গিয়ে পূজার সামনে গিয়ে দাঁড়াল।
তারপর কতৃপক্ষের দেওয়া পুরস্কার পূজার হাতে তুলে দিল। পূজা অরুন্ধতীর পা ছুঁয়ে প্রণাম করল কিন্তু জানতেও পরল না এই তার মা। সেখানে উপস্থিত কেউই বুঝতেও পারল না দীর্ঘ ১৬ বছর পর একটা মা তার একমাত্র সন্তানের দেখা পেল। আর সন্তান এই প্রথম তার মায়ের পা ছুঁয়ে প্রণাম করলো। বুকে জড়িয়ে ধরতে ইচ্ছে করল কিন্তু উপায় নেই অরুন্ধতীর চোখ দিয়ে শুধু দু ফোঁটা জল পূজার মাথায় আর্শিবাদ রুপে ঝরে পড়ল।
অরুন্ধতী সেই সময় টা নিজেকে কোনো রকমে সামলে নিল। তারপর স্টেজ থেকে নেমে সোজা নিজের হেডমাষ্ট্রেস রুমে গিয়ে দরজা লাগিয়ে বসে পড়ল।
    লাউডস্পিকারে তখন পূজা কথা বলছে-"আমি ড্রইং শিখি না। আমার বাবা বলেন আমার মা খুব ভালো ছবি আঁকতেন। হয়তো ওনার কাছ থেকেই পেয়েছি এই গুন। কিন্তু আমার যখন দু বছর বয়স তখন মা আমাকে ছেড়ে বাবাকে ছেড়ে চলে যান। আমার বাবাই আমার কাছে সব। তবুও মঝে-মধ্যে খুব মন খারাপ করে। মাকে দেখতে ইচ্ছে করে। তখনই আমি ছবি আঁকতেন বসি। মনটা ভালো হয়ে যায়। ......"
     অরুন্ধতী কথা গুলো মন দিয়ে শুনছিল। হাততালির শব্দে পূজার শেষ কথা গুলো শুনতে পেল না। অরুন্ধতী টেবলের ওপর মাথা রেখে, স্তব্ধ হয়ে বসে রইল।
    ঘন্টা খানেক পর অনুষ্ঠানও শেষ হলো অরুন্ধতী তবুও বাইরে বেড়োনো ক্ষমতা নেই। কিছুক্ষণ পর সবাই বাড়ি ফিরে গেল। হঠাৎই দিপীকা ঘরে ঢুকল, অরুন্ধতী কে দেখে আশঙ্কিত হয়ে বলল-"কী হয়েছে দিদি? এরকম লাগছে কেনো? "
    অরুন্ধতী উঠে পড়ল-"তেমন কিছু না হঠাৎ মাথাটা ঘুরে গিয়েছিল। এখন ঠিক আছি। চল বাড়ি ফিরতে হবে তো।"
   দিপীকা যে কথা গুলো বিশ্বাস করল তা নয়। তবুও বলল-"হ্যাঁ। সেই জন্যই তো খুঁজছি তোমায়।"
   রাতের বেলা। অরুন্ধতী নিজের ঘরে শুয়ে আছে। দিপীকা এসে খবরের কাগজে মোড়া একটা ফটো ফ্রেম এনে টেবিলে রেখে বলল- "নাও তোমার জিনিস।"
          অরুন্ধতী বলল-"কী এটা? "
        "পূজার আঁকা ছবি। তুমি নেবে বললে তাই ...."
     "বাবা! এরই মধ্যে ফটো ফ্রেমে বন্দী করে ফেলাও হয়ে গেছে?"
                         "ঘোষ বাবু করেছেন।"
অরুন্ধতী ছবিটা হাতে তুলে নিয়ে বলল-"ভালই হলো এবাড় এটাকে দেওয়ালে টানানো যাবে।" ছবিটা খুলে দেখার মতো হিম্মত ছিল না।
      দিপীকা বলল-"তুমি জানো পূজা কে?"
  অরুন্ধতী হেসে বলল-"কে?"
              "সেই আদিদেব দার মেয়ে।"
  অরুন্ধতী মনে মনে বলে হায় রে কপাল। মা কে তার নিজের মেয়ে পরিচয় অন্যের মুখে শুনতে হচ্ছে।
      দিপীকা কিছুক্ষণ চুপ করে বসে থেকে বলল-"সত্যি পৃথিবীতে এমনও হয়, পূজার সাথে দেখা না হলে জানতামই না। খুব খারাপ লাগছে ওদের জন্য।"
                          "কেন?"
    "পূজার মা যে কী করে পূজাকে ছেড়ে এমনকি আদিদার মতো মানুষকে ছেড়ে কী করে যে গেল ভাবতেই অবাক লাগে।"
   অরুন্ধতীর মুখ দিয়ে কোনো কথা ফুটল না।
দিপীকা উঠে পড়ল। বলল-"যদি পূজার মায়ের সাথে যদি আমার কোনো দিন দেখা হয় তাহলে গালে একটা কষয়ে চড় আমি মারবই।" দিপীকা হনহনিয়ে চলে গেল। পিছন ফিরে দেখলও না যাকে কথা গুলো বলে গেল তার চেহারা কেমন ফ্যাকাশে হয়ে গেলো।
                                      ৫
   তারপরেও কেটে গেছে সাত-আট টা মাস।
একদিন বিকেল বেলা অরুন্ধতী আর দিপীকা গাড়ীতে করে একটু ঘুরতে বেড়িয়েছে। হঠাৎ দিপীকা ড্রাইভারকে বলল-"গাড়ী থামাও।"
    অরুন্ধতী অবাক হয়ে বলল-"কেন?"
দিপীকা কোনো উত্তর না দিয়ে গাড়ী থেকে নেমে পড়ল-"আদিদা। একটু দাঁড়ান।"
    আদিদেব থমকে দাঁড়াল। গাল ভর্তি কাঁচা পাকা দাড়ি। উসকো-খুসকো চুল, রুগ্ন চেহার। অরুন্ধতী অন্য দিকে মুখ ফেরালেও কান পড়ে রইল এদিকে।
           "আদিদা আমায় চিনতে পারছেন না? আমি দিপীকা।"
          "হ্যাঁ। তোমাকে ভুলব কী করে? বেড়াতে এসেছ নাকি?"
          "এই একটু অনেক দিন পর এলাম। কিন্তু আপনার একি অবস্থা হয়েছে? সব ঠিক আছে তো? পূজা কেমন আছে? ।" একের পর এক প্রশ্ন করেই চলে দিপীকা।
     "কোথায় আর কী ঠিক আছে? ছোটোবেলায় মা-বাবাকে হারিয়েছি। বিয়ের পর যার মধ্যে নতুন করে বাঁচতে শিখলাম সেও ছেড়ে চলে গেল। ব্যাবসা-সম্পত্তি সব খোয়া গেল। বাকি ছিল হৃৎপিন্ডের টুকরো মেয়েটা। বিশাল বাড়ি ছেড়ে দিয়ে পূজার ছোট্ট হাতটা ধরে নর্দমার ধারে টালির ঘরে আশ্রয় নিয়ে ছিলাম। বেশতো ছিলাম দিন মজুরের কাজ করে খেতাম। সেটুকুও ভগবানের সহ্য হল না।" কেঁদে ফেলল আদিদেব।
   অরুন্ধতীর বুকের ভেতর তোলপাড় করে উঠলো। দিপীকা ভীত কন্ঠে বলল- "পূজা কেমন আছে?"
           "একদম ভালো নেই। অনেকদিন ধরেই রোজ রাতে জ্বর আসত। কোনোদিন আমাকে বলেনি পাছে আমার কষ্ট হয়, টাকা খরচ হয়ে যায়। দুমুঠো ভাতের জন্য এত পরিশ্রম করতে হয় তাই দেখার সময়ও পায়নি। আর আমিই বা কী করব? ওর মা থাকলে দেখত।"
         "কোন হাসপাতালে আছে এখন পূজা?"
       "হাসপাতালে এখন নেই। বাড়িতে আছে। ডাক্তারবাবুরা শহরের হাসপাতালে নিয়ে যেতে বলেছেন। কী করে নিয়ে যাব একটা টাকা নেই। আর পূজা তো মরার মতো হয়ে আছে কী করে নিয়ে যাব? আমি আর পারছি না ওর কষ্ট দেখতে। ও যদি মরে যায় তাহলে তো নরক থেকে মুক্তি পায়। আর আমিও............."
     আদিদেবের কথা শেষ না হতেই অরুন্ধতী কেঁদে এসে আদিদেবের পায়ে পড়ল। বিস্ময়ে হতবুদ্ধি হবার পালা দিপীকার।
            "আমার মেয়ের কাছে শুধু আমাকে একবার নিয়ে চলো।"
আদিদেবও কম আশ্চর্য হয়নি...দু হাত ধরে তুলে বলল-"অরুন্ধতী? "
          "হ্যাঁ। আমাকে যা শাস্তি দেবার দিও কিন্তু আমার মেয়ে......"
আদিদেব জড়িয়ে ধরে বলল-" কোথায় ছিলে এতদিন আমরা যে মরে যেতাম জানো না?"
     দিপীকা স্তম্ভিত হয়ে বলল-"তুমিই পূজার মা?"
             "হ্যাঁ। বলেছিলিস না কষিয়ে চড় মারবি। মার। আমিই পূজার মা।"
      হঠাৎ আদিদেব অরুন্ধতীকে ছিটকে সরিয়ে দিয়ে বলল-"তুমি এখানে কেন? চলে যাও এখান থেকে। তোমার এই অশুভ ছায়া যেন পূজার আশেপাশে না পরে।"
        "আজ তুমি আমাকে ফিরিয়ে দিলেও আমি কোথাও যাব না। আমি আমার মেয়ের কাছেই যাব।"
        "তোমার মেয়ে?" বিদ্রুপ করে বলল আদিদেব।
           "পূজা তো আমারই মেয়ে।"
          "কথাটা নতুন করে ঘর বাঁধার আগে মনে ছিল না...যে তোমার মেয়ে আছে। আমার কথাতো বাদই দাও।"
             "কী উলটো পালটা বলছ তুমি? আবার কেন ঘর বাঁধতে যাব।"
            "তাহলে এই টাকা-পয়সা গাড়ী-বাড়ি কী এসব? কোথায় পেলে তুমি?"
          "নিজের মেহনতের ফল। ভুলে যেও না সেদিন রাতে আমাকে এক কাপড়ে বাড়ি থেকে তাড়িয়ে দিয়ে ছিলে। এমনকি পূজাকেও আমার থেকে কেড়ে নিয়েছ। আমি কিন্তু কোনো অন্যায় করিনি।"
          "আমি জানি সেদিনের ভুল আমার ছিল। কিন্তু তাই বলে তুমি........"
দিপীকা আর চুপ থাকতে পারল না। বলল- "আদিদা দিদির সাথে আমার আজকের পরিচয় নেই সেই ১৫-১৬  বছর ধরে চিনি। আগে দিদি  আমাদের গ্রামে থাকত মানসী দিদার বাড়িতে । উনি দিদির দূর সম্পর্কের পিসি হন। দিদি তখন আমাদের টিউশন পড়াতো। তারপর চাকরি নিয়ে এখানে আসে। আমিও কয়েক বছর পর চলে আসি। ৩ বছর হলো মানসী দিদা মারা গেছেন তখন থেকে দিদির সাথে আছি।"
        আদিদেব এগিয়ে গিয়ে অরুন্ধতীর হাত ধরে বলল-"ফিরে আসনি কেন? আমার উপর এত অভিমান? আমার জন্য না হোক পূজার জন্যও তো আসতে পরতে।"
        "ভেবেছিলাম আবার হয়তো বিয়ে করেছ।"
    "পাগল নাকি? পূজাকে ছেড়ে তোমায় ভুলে আমি বিয়ে করব ভাবলে কী করে?"
   দিপীকা বলল-"এবার আমার কাছে সব পরিষ্কার। সেই জন্যই তুমি সেদিন আদিদার আংটি কিনেছিলে।"
           "হ্যাঁ। ওটা আমিই ওকে দিয়েছিলাম।" তারপর আদিদেব কে বলল-" আমাকে পূজার কাছে নিয়ে যাবে না?"
          "তোমার মেয়ের কাছে তুমি যাবে আটকানোর আমি কে? চলো।"
    অলি গলি রাস্তা দিয়ে ওরা যখন আদিদেব বাড়ি পৌঁছলো তখন সন্ধ্যে নেমেছে। আদিদেব ঘরে ঢুকে আলো জ্বালতেই পূজা অস্ফুট মৃদু কন্ঠে বলল-"জল খাব।"
      অরুন্ধতী পূজার অবস্থা দেখে কেঁদে ফেলল। পূজার কাছে যাওয়ার ক্ষমতা রইল না।
আদিদেব গ্লাসে করে জল নিয়ে একটু একটু করে খাইয়ে দিল। পূজা কম্পিত হাতে আদিদেবের হাত ধরে বলল-"সকাল হয়নি বাবা? আমি উঠে বসবো।"
       "না রে এখনো সকাল হয়নি। কে এসছে দেখ। তোর মা এসেছে।"
    পূজা কোনো প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করল না, দেখে আদিদেব মাথায় হাত রেখে দেখল আবার বেহুঁশ হয়ে গেছে পূজা। অরুন্ধতী দূরে একটা থাম ধরে কেঁদেই চলেছে। আদিদেব বলল- "আবার বেহুঁশ হয়ে গেছে। এখন এমনই হয়।"
          "মেয়েটার এরকম অবস্থা করেছ?"
আদিদেব উত্তর দিতে যাচ্ছিল। এমন সময় হন্তদন্ত হয়ে এলো দিপীকা। এসেই বলল-"আর দেরী না। অ্যাম্বুলেন্স চলে এসেছে চলো। সব রেডী করে ফেলেছি হসপিটালে।"
     কেউ কোনো উত্তর দেওয়ার আগেই দুজন নার্স এসে পূজাকে নিয়ে গেল।
                                       ৬
                  "আদিদা কোথায়?" অরুন্ধতীর পাশে বসে বলল দিপীকা।
  অরুন্ধতী তখন চেয়ারে বসেই দেওয়ালে মাথা রেখে ঘুমিয়ে পড়েছে। দিপীকার কথায় চমকে উঠে বলল-"ঔষুধ আনতে গেছে। তুই এই সময়?"
            "আমার ওদিকের সব কাজ শেষ। ভাবলাম আজ যখন পূজা ভেন্টিলেশন থেকে বেড়োবেই তা হলে একবার দেখা করেই যায়। তুমি আজও দেখা করনি তাই না?"
            "বললাম না ডাক্তারবাবু নিষধ করেছে। ওর বাবাই দেখা করে সবসময়। আমি এখান থেকেই দূর থেকে দেখি। আগে ভালো হয়ে উঠুক তারপর সব হবে।"
                "হ্যাঁ সে তো বটেই। আমাকে কিন্তু তোমায় ক্ষমা করতে হবে। আমি জানতামই না যে তুমি....।"
             "আচ্ছা বাবা। তুই তো আর সত্যি সত্যি চড় মারিস নি আমায়। এত অনুশোচনার কী আছে।"
           "কিন্তু এমন কী হয়েছিল যে তুমি বাড়ি ছেড়ে চলে এসেছিলে।"
             "আমার দূর সম্পর্কের পিসি শ্বাশুড়ি থাকতেন আমাদের বাড়িতে। উনি আমাকে দেখতে পারতেন না। তাই আমার নামে মিথ্যে বদনাম করে বাড়ি থেকে তাড়িয়ে ছিলেন যাতে সম্পত্তি. .....বুঝতেই পারছিস। যা চেয়েছেন হয়েছেও তাই। আমি চলে আসার পর সব কেড়ে নিয়েছে। তারপর তো তুই সবই জানিস।"
           দিপীকা বলল-"হ্যাঁ সবই জানি। ওইতো আদিদা আসছে।"
   আদিদেব এগিয়ে বসে বলল-"কী ব্যাপার দিপীকা তুমি এই সময়?"
                "চলে এলাম দেখা করতে।"
      "ভালো করেছো। আজতো পূজাকে ছুটি দিয়ে দেবে।"
          অরুন্ধতী বলল-"আজই?"
          "হ্যাঁ। সুস্থ তো প্রায় হয়েই গেছে। ডাক্তারবাবু বললেন বাড়িতে সাবধানে রাখতে। তাহলে এখানে ফালতু দরকার নেই। আর পূজাও বলছিল এখানে থাকতে আর ভালো লাগছে না। সব মিলিয়ে আজ যাওয়ায় ভালো। আমি নার্সদের বলে একবার বাড়ি গিয়ে সবকিছু ঠিক করে আসছি।"
           "পূজা ওখানে আর যাবে না। আমার সাথে যাবে।"
   আঁতকে উঠলো আদিদেব-"তোমার সাথে? আমি তো তাহলে মরেই যাব।"
   কথটা যে কত বড়ো সত্যি সেটা অরুন্ধতী জানত।
দিপীকা হেসে বলল-"আপনিও তো যাবেন আমাদের সাথে। এবাড় থেকে আমরা একসাথে থাকব। আমি যায় তাহলে বাড়িটা একটু সাজিয়ে নিতে হবে তো। তাছাড়া পূজাকে ওয়েলকাম করার জন্যও তো কাউকে চায়।" দিপীকা চলে গেল।
আদিদেব বলল- "আমি তোমার বাড়িতে..."
           "কেন? একসাথে কী আর থাকা যায় না?"
         "আসলে তা নয়.........।"
            "আমি আর কোনো কথা শুনব না, ব্যাস।"
তারপর দুজনেই চুপচাপ। আদিদেব আরও কাছে এসে অরুন্ধতীর পীঠের ওপর হাত রেখে বলল-"কী হলো?"
           "আমার খুব ভয় করছে। পূজা যদি মেনে না নেয়। ও যথেষ্ট বড়ো হয়েছে, বুঝতে শিখেছে।"
  আদিদেব হেসে বলল-"তুমি তোমার মেয়েকে চেনো না। কিন্তু আমি চিনি।"
     এমন সময় নার্স এসে বলে গেল পূজাকে সাধারন কমরায় দেওয়া হয়েছে। চাইলেই এবার দেখা করতে পারে। আর ডাক্তারবাবু এসে চেকাপ করে ছুটি লিখে দেবেন।
       আদিদেব উঠে পড়ল। কিন্তু অরুন্ধতী বসেই রইল।
     "কী হলো এসো।"
  অরুন্ধতী উঠে বলল- "আমি ওর সামনে দাঁড়াতে পারব না তুমি যাও।"
       "পাগলামো করো না চলো। আমি তো আছি। আজ পুরো ২৩ দিন তুমি এখানে আছ। দূর থেকে দেখছ। আর না চলো।"
              "কিন্তু........."
      "আর কোনো কিন্তু না। চলো..........।" বলে অরুন্ধতীর হাত ধরে টেনে নিয়ে চলে গেল।
   পূজা তখন বালিসে হেলান দিয়ে বসে ছিল। হঠাৎ বাবাকে অরুন্ধতীর হাত ধরে টেনে আনতে দেখে অবাক হয়ে গেল। আদিদেব অরুন্ধতীর হাত ছেড়ে পূজার পাশে বসলো। অরুন্ধতী দাঁড়িয়েই রইল। আর পূজা অবাক হয়ে চেয়েই রইল।
           "কেমন লাগছে এখন?" বলল আদিদেব।
                                "ভালো।"
               "তোমার জন্য একটা দারুন খবর আছে। আজ তোমার ছুটি হয়ে যাচ্ছে। বাড়ি যাবে এবার।"
                             "সত্যি বলছো তুমি?" মিষ্টি হাসিতে মুখ উজ্জ্বল হয়ে উঠল পূজার।
                    "হ্যাঁ। ওনাকে চিনতে পারছ?"
  পূজা আবার হেসে বলল-"হ্যাঁ।"
                 পূজার উত্তর শুনে দুজনেই অবাক হয়ে গেল। আদিদেব বলল- "কে বল দেখি?"
            "উনিতো অনেক বড়ো আর্টিস্ট আর বি. এন. ডব্লিউ. গার্লস স্কুলের প্রধান শিক্ষিকা অরুন্ধতী চ্যাটার্জী ম্যাম।"
     আদিদেব হেসে ফেলল-"ওরে না রে পাগলি। ও তোর মা।"
                     "আমার মা?" অরুন্ধতীর দিকে তাকিয়ে পূজার দুচোখ জলে ভরে গেল। তবুও বলল-"আপনি সত্যিই আমার মা?"
     অরুন্ধতী এবার এগিয়ে এসে পূজাকে জড়িয়ে ধরে কেঁদে বলল-"হ্যাঁ। আমি তোর মা।"
           "তুমি কেন ছেড়ে গিয়েছিলে।আর কিন্তু আর কোথাও যেতে দেব না তোমায়।"
             "আমি আর কোথাও যাব না তোদের ছেড়ে।"
আদিদেব বলল-"আবার সব ঠিক হয়ে গেল, শুধু তুমি ফিরলে তাই।"
   


© All Rights Reserved