...

13 views

ক্যানভাস
দেবরাজপুর রাজবাড়ীর সংগ্রহশালার তেতলায় এখনও সযত্নে শোভা বাড়াচ্ছে সেই পোর্ট্রেট। প্রথম রঙিন পোর্ট্রেট।

উত্তরবঙ্গের এক ছোট্ট গ্রাম এই দেবরাজপুর। সেখানকার জমিদারি আজ একবিংশ শতাব্দীতে না থাকলেও তার বহর বজায় আছে ষোলো আনা। বিশেষ করে এই মিউজিয়াম। আজ থেকে প্রায় সাড়ে পাঁচশ বছর আগে দেবরাজ বংশের দ্বিতীয় পুত্র পদ্মনাভ দেবরাজ এর আমলে এই মিউজিয়াম এর নির্মাণ। সেভাবে দেখতে গেলে সাধারণ মিউজিয়াম হলেও এই সংগ্রহশালার আসল শোভা ওই পোর্ট্রেট। প্রথম রঙিন পোর্ট্রেট।

এই ছবির শিল্পী যে কে সেটা জানা নেই, কোথা থেকে আনা হয়েছিল সেটাও কেউ জানে না, ছবিটার বয়সও সঠিক আন্দাজ হয় না। তবে এর ইতিহাস বিচিত্র। লোককথা অনুযায়ী, এটা কোনো ছবিই নয়, এটা একটা জলজ্যান্ত মানুষ। ছবিতে যার অবয়ব, তার নাম নাকি উদয়ভান এবং এটা নাকি সে স্বয়ং।

ট্রেকিং এর নেশায় নানান গ্রাম ঘুরে দেখেছি, এই অভিজ্ঞতাও এমনই এক ট্রেকিং পথের পান্থশালায় শোনা। অক্টোবর এর রাত। ঠাণ্ডায় জবুথবু হয়ে একটা হুইস্কির গ্লাস নিয়ে গিয়ে বসলাম স্থানীয়দের আড্ডায়। উদ্দেশ্য যদিও ওই গনগনে আগুন। সাথে নতুন মানুষের সাথে পরিচয় মন্দ কি! সাময়িক কিছু আলাপচারিতার পর কথায় কথায় এই অসাধারণ কাল্পনিক বা হয়তো বাস্তব ঘটনা টা জানতে পারলাম, অবিকল সেটাই আপনাদের কাছে পৌঁছে দেওয়ার প্রয়াস করছি।

এই ছবিটার সৃষ্টির আগে নাকি পৃথিবীটা সাদাকালো ছিল। শুনতে অবিশ্বাস্য হলেও শুধু গল্প শুনছিলাম, এই ভেবেই শুনে গেলাম। এই উদয়ভানই প্রথম খুঁজে পায় এই রঙের ভান্ডার। প্রাথমিক ভাবে সে নিজের কুটিরেই সব লুকিয়ে রেখেছিল। নিজেই ছবিতে রং ভরতো; নিজের ইচ্ছে মত। কিন্তু সব নতুনের সাথে যা হওয়ার, এখানেও তাই-ই হলো। একদিন একটা রঙিন ছবি আঁকার আনন্দে সে প্রায় উন্মাদের মত ছুটে বেড়ায়, সবাই কে প্রায় ডেকে ডেকে দেখায় তার সৃষ্টি। ভেবেছিল হয়তো সবাই তাকে মাথায় করে রাখবে। বড়ো শিল্পীর মত মর্যাদা পাবে। দেশে- বিদেশে তাঁর নাম ছড়িয়ে পড়বে। কিন্তু অদৃষ্টের এমনই পরিহাস যে, হলো ঠিক উল্টো। গ্রামের মোড়লরা তাকে প্রেত-বিদ্যা সাধনার কারণে একঘরে করে দিলেন। মেরে ফেলার নির্দেশই দেওয়া হয়েছিলো, কিন্তু তাতে যদি অভিশাপ লাগে সেই ভয়ে সবাই পিছিয়ে এলো। পাশের গ্রামে নাকি এক ডাইনি পুড়িয়ে মারার পর মড়কে গ্রাম উজাড় হতে বসেছিল।

উদয়ভান তাও তাঁর আঁকা থামায় নি, কিছুই বাদ পড়েনি তাঁর আঁকা থেকে। শোনা যায়, এই দুনিয়াতে তুমি যাই দেখবে, তাতে যে রং আছে সেসব আসলে তাঁরই শিল্প। ঈশ্বর সাম্যবাদী তাই সে প্রথমে রং না, শুধু সাদা আর কালোকে বেঁছেছিলেন তাঁর সৃষ্টির জন্য। সবই গড়েছিলেন সাদা আর কালো দিয়ে। আমাদের স্বভাবটাও। রং টা তিনি লুকিয়েই রেখেছিলেন আর ‌সেটা উদয়ভান-এরই আবিষ্কার।

বেশ কয়েক বছর এভাবেই চলে, সবাই প্রায় ভুলেই গেছিল এই সৃষ্টিছাড়া ছেলেটার কথা। কেউ খোঁজও রাখেনি তার। মরে গেছে না বেঁচে আছে কে জানে। কিন্তু এক শুক্লা পঞ্চমী তিথিতে এক অদ্ভুত ঘটনা বদলে দিল পৃথিবীর ইতিহাস। সেই কুটিরের বন্ধ দরজার তোলা থেকে বেরিয়ে আসছে রং। ছড়িয়ে পড়ছে আকাশে, মাটিতে, গাছের পাতায়। এদিক ওদিকে যেনো শুধুই রঙের আগ্রাসন। তুলকালাম পড়ে গেলো দিকে দিকে। একদল পালায় তো অন্যদল খুঁজতে খুঁজতে পৌঁছালো সেই বন্ধ দরজার কাছে। মোড়লের আদেশে দরজা ভেঙে সবাই যা দেখলো তা অলৌকিক। ঘরের মধ্যে উল্টে পড়ে আছে রঙের বাক্স, তার থেকে প্রতি রন্ধ্রে ছড়িয়ে পড়ছে রং। সামান্য ছোয়ায় সব রঙিন হতে শুরু করেছে। কিন্তু এ তো অপরূপ! আমার রূপ তোমার থেকে আলাদা। আলাদা পরিচিতি। " ভয় পেওনা। মারণ ব্যাধি নয়গো…"। আশে পাশের আর্তনাদ যেন মুহূর্তে পাল্টে গেলো উৎসবে। রঙের উৎসব। সবাই তাদের তৃপ্ত রঙিন অবগাহনে মত্ত।

সব শেষে সেই ঘর থেকেই পাওয়া যায় ওই ছবির। বিশাল এক অন্ধকারের সামনে হাসি মুখে দাড়িয়ে উদয়ভান।

সবার অনুমান, এই ক্যানভাসের সৃষ্টিও তার হাতে। প্রথম ক্যানভাস। আগের রাতে সেটা তৈরি করে সে শুতে যায়। পরদিন কিছু বিশেষ আঁকার বাসনা ছিল নিশ্চই। কিন্তু পরদিন সেই ক্যানভাসের ভিতরে সে দেখতে পায় এক অন্ধকার অন্তহীন গুহা। কৌতূহলের বসেই সে তার ভিতরে ঢুকতে যায়, আর তখনই তার পায়ে লেগে উল্টে যায় সেই রঙের ভান্ডার।

ঈশ্বরের সাম্যবাদী সমাজের মধ্যে এমন রং ছড়িয়ে দেওয়ার শাস্তি নাকি, ঈশ্বরের অসমাপ্ত নান্দনিক কাজের জন্য অমর হয়ে রইল উদয়ভান? এর উত্তর আপামর রঙিন পৃথিবী কোনোদিন জানতে পারবে না। তবে চির অব্যয় হয়ে থাকবে উদয়ভানের পোর্ট্রেট আর তার রঙিন স্বপ্ন। ওই অমায়িক হাসিটা হয়তো সেই কারণেই অমলিন।

© জিপ্`সি
২২ শে আগস্ট, ২০২০