...

6 views

জীবন যখন শুকায়ে যায়

"সে চলে গেছে"? মায়ের গলা শুনে আমি চমকে উঠি। মা যে কখন থেকে বারান্দায় বসে আছে তা আমি খেয়ালই করিনি। সে বাইরের বাগানটাকে দেখছে। " এই কিছুক্ষণ আগে গেছে"। আমি বললাম ধুলুমাখা রাস্তাটার দিকে তাকিয়ে, যার মধ্য কিছুক্ষন আগে বাবার সাদা গাড়ীটি দাড়িয়ে ছিল। "আবার কবে আসবে"? মা জানতে চাইলো। আমি রাস্তার থেকে চোখ না সরিয়ে বললাম। "জানি না - বলে যায়নি"। আমার কথার উত্তরে মা শুধু "হুঁম" বলল্। "তুমি নীচে এলেনা কেন"? আমি জানতে চাইলাম, মা কফি মগটা হাতে নিয়ে বলল্ --- "কেন আমার কথা জানতে চেয়েছে বুঝি"? মায়ের প্রস্নের কি উত্তর দেবো ভাবতে সময় লাগল, তারপর ভাবলাম সত্যি কথাটাই বলি। "না- তবু আসতে পারতে তো"। মা একটু শুকনো হাসি হেসে বলে - "চায়নি যখন তখন না এসে ভালই করেছি"। মা কফিতে চুমুক দিল। আমি চুপ করে রেলিং এ হেলান দিয়ে দাড়িয়ে ছিলাম।

মাঝে মাঝে মনে হয় সব মায়ের দোষ। মা এতো তাড়াতাড়ি ডিভোর্সটা না নিলেই হতো। বাবা তো Sorry বলেছিল। তাকে একটা সুযোগ দিলেই হতো। আজ আমরা একসাথে থাকতাম। আবার মনে হয় আমি খুব selflish, শুধু নিজের কথাই ভাবি, মায়ের কথা চিন্তাই করিনা। "কিরে কিছু জিজ্ঞাসা করবি নাকি"? মায়ের প্রশ্নে চমকে উঠি। মা এইবার আমার দিকে তাকিয়ে আছে। মায়ের শান্ত চোখ যেন আমার মনের সব গোপন কথা জেনে যাচ্ছে। "আমার টিউশন আছে - তৈরি হয়ে নিচ্ছি", এই বলে মায়ের দিকে আর না তাকিয়ে ঘরে চলে এলাম। মাঝে মাঝে এমন আড়ালে আবডালে লুকিয়ে আমি আমার মায়ের দৃষ্টি এড়াই। তবে সত্যি তা এড়ানো যায় কি? আমি অন্যমনস্ক ভাবে ব্যাগে বই ঢুকিয়ে নেই, চুলটা ভালো করে বেধেঁ নেই। বাবা আসবে বলে ভালো জামা তো পড়াই ছিল। ব্যাগ কাধেঁ নিয়ে যখন মাকে বলতে যাব তখন দেখি মা হারমোনিয়াম নিয়ে বসেছে। "মা আমি আসছি"। মা হারমোনিয়াম মুছতে মুছতে বলল - " কিছু খাবি না"? আমি ব্যাগে রাখা টাকা গুনতে গুনতে বললাম - "না টাকা আছে, ক্ষিদে লাগলে কিছু কিনে নেব। "আসি গো" বলে সিড়ি বেয়ে নিচে চলে আসি। গেট খুলে বের হবার সময় মায়ের গলা শুনতে পেলাম - "আমার পরান যাহা চায়, তুমি তাই তাই গো"। মাঝে মাঝে বুঝতে পারিনা মা গাইছে কার জন্য--- বাবাকে বলছে না আমায়?

ইংরাজি স্যার লোকটা খুব মজার। রোজ নুতন নুতন জোকস বলে। কিন্ত আজ আমার কিছুই ভাল লাগছে না। শুধু মনে হচ্ছে - মা বুঝতে পেরে গেছে। টিউশন শেষ হবার পর আমার বান্দ্ববীর সাথে চাট খেতে দাড়াই। চাট এর দোকান থেকে ধুঁয়া উঠছে। সামনে খুব ভীড়। দোকানের কর্মচারি ছেলেটা বালতিতে জল নিয়ে তার মধ্য এঁটো বাসনগুলো ঢালছে আর একটা মাজন দিয়ে মেজে তুলে ফেলছে। সাবান দিয়ে ধোয়ার কোন বালাই নেই। সেই প্লেটগুলিই সারি করে সাজিয়ে রেখে তার মধ্য নুতন করে চাট দেওয়া হচ্ছে। "ধর পরে যাবে তো" --মিতার গলা শুনে আমি তার দিকে তাকাই। ওর দুই হাতে দুই প্লেটে ধোয়া উঠা চাট। প্লেট এর নিচে থারমোকল দেওয়া যাতে প্লেট থেকে ছ্যাকা হাতে না লাগে। আমি ওর হাত থেকে আমার প্লেটটা নিয়ে নিই। সে পাশে বসে বলল - "কিরে আজ এত চুপচাপ ? আংকেল এসেছিল বুঝি "। আমি প্লেট থেকে এক চামচ মুখে পুরে বললাম - হ্যা এসেছিল - কিছুক্ষণ বসে গল্প করে চলে গেল।Okk আমার গলাটা ধরে আসছে আবার।

"তোকে সাথে যাবার জন্য বলেছে নাকি" জানতে চাইলে মিতা। "হ্যা, বলেছে যাবার কথা, বাবার সাথে থাকার কথা"। আমি আবার খেতে থাকি। বেশি কথা বললে হয়তো কেঁদেই দেব। "তুই কি ঠিক করলি - যাবি তুই বাবার সাথে"? ওর এই কথার উত্তর তো আমি ও খুঁজছি, আমি নিজেও জানিনা আমি কি করব। তাই শুধু বললাম- "জানিনা"। আজ যেন চাটটা ও খেতে ভাল লাগছিল না। তাই তা রাস্তার পাশে ফেলে দিলাম। দাম মিটিয়ে মিতার সঙ্গে হাটতে লাগলাম। "আচ্ছা, আন্টি ডির্ডোস নিয়েছে দশ বছর হয়ে গেছে, আন্টি তো বিয়ে করেনি - আংকেল তো শুনলাম বিয়ে করেছে। তোর অন্য ভাইবোন আছে"? মিতা খুব মেপে প্রশ্নটা করল, যাতে আমি আহত না হই। আছে বই কি, বোন আছে নাম সাহারা। আজ সে স্কুল ড্যান্স কমপিটিশনে ফাস্ট প্রাইজ পেয়েছে, তারই গল্প করছিল বাবা। মিতা বলল "তুই যে স্কুলে বেস্ট স্টুডেন্ট এওয়ার্ড পেয়েছিস তা আংকেল কে জানিয়েছিস"? সে কি আর চাইনি - এক সপ্তাহ ধরে অধীর আগ্রহে গেইট এর দিকে তাকিয়ে বসে ছিলাম, যে বাবা এলে বলব যে আমি র্ফাস্ট প্রাইজ পেয়েছি। বাবা র্গব করে বলবে "মেয়ে কার দেখতে হবেনা - চল তোকে আজ তোর ফেভারেট আইস্ক্রীম খাওয়াব,র্পাটি করব, এতো বড় খবর"।

বাবা যখন এলো আমি দৌড়ে গেলাম, খবরটা দিলাম - শুনে বাবা বলল- ভালো, ভালো, দ্যাখ্ - তোর বোন কি করেছে দেখ, পুচকি মেয়ে- আমি ভাবলাম কি আর নাচবে, তোর নুতন মা জেদ ধরল, নাম দেবেই তাই দিলাম। সে নেচে র্ফাস্ট প্রাইজ নিয়ে এল। বাবা ও সাহারার মধ্য আমি কেমন হারিয়ে গেলাম। মিতাকে বললাম- সাহারার গল্পই এতো ছিল যে এর মধ্য আমার কথা আর বলা হয়ে উঠলনা। মাঝে মাঝে সাহারা কে খুব হিংসা হয়, আবার নিজেরই খারাপ লাগে। ছিঃ শেষে একটা বাচ্চা মেয়েকে হিংসা করলাম। এতে ওর কি দোষ যে ওর বাবা ওকে ভালবাসে। বাকি রাস্তাটা আমরা চুপচাপ হেঁটে চলে এলাম, কোন কথা না বলে।

বাড়ি যখন ঢুকি দেখি পাড়ায় লোডশেডিং। সারা বাড়ি অন্ধকার। মোবাইল এর আলো জেলে ঘরে ঢুকলাম। মা বই পড়তে খুব ভালবাসে। ঢুকে দেখি মোমের আলোয় বই পড়ছে। আমার মা দেখতে খুব সুন্দর, লম্বা ঘন কালো চুল। গভীর দুটো চোখ। মোমের আলোয় মাকে মনে হচ্ছে রবী ঠাকুরের কোন গল্পের চরিত্র যেন হঠাৎ প্রান খুঁজে পেয়েছে। মোবাইল এর লাইট পড়ায় মা আমার দিকে তাকিয়ে বলল - "চলে এলি, যাক ভালই হল, পুজোর জন্য গাছ কেটেছে আর তা পুরো কারেন্ট এর তার ছিড়ে নিয়ে পড়েছে। কারেন্ট আসবে বলে তো মনে হয়না। তুই হাত পা ধুয়ে নে, আমি ভাত দিচ্ছি। রাত তো কম হলোনা। আমি আর আপত্তি করলাম না। একে তো রাত দশটা বাজে তার উপর চাট টা ও ফেলে দিয়েছিলাম। খাওয়া শেষে আমি মাকে নিয়ে ছাদে উঠে বসি। আকাশে শরতের চাঁদের আলোয় চারিদিক ঝলমল করছে। আমার কাছে পাড়াটা কেমন থ্রিলার ফিল্মের প্লটের মতো লাগছে।

" তুই জানতে চাস যে আমি তোর বাবার সাথে থাকতে চাইনি কেন? কেন আমি ডির্ভোস নিলাম"? মার প্রশ্নের উত্তর আমি মুখে দিতে পারলাম না, আকাশের দিকে তাকিয়ে শুধু মাথা নাড়লাম। মা বলল - "তুই বড় হয়েছিস, বুঝতে শিখেছিস তাই তোকে বলি - যে সাথে থাকতে চায় না, তাকে জোর করে পাশে রাখতে নেই, এতেই দুজনেরই কষ্ট হয়"। "বাবা যে বলেছিল তিনি তোমার কাছে ফিরে আসতে চান-- তুমিই বারন করলে" আমি প্রশ্নটা করেই ফেললাম। বুকের মধ্য কষ্টটা জমে থাকার চাইতে এটা বের হয়ে আসুক। "হুম্ চেয়েছিল তো, তবে আমি জানতাম সে অন্য খাচার পাখি আর কাছে ধরা দেবেনা। তাই ওকে আর বাঁধলাম না-- ছেড়ে দিলাম। মার কথা আমি মাঝে মাঝে কিছুই বুঝতে পারিনা। মা বলে চলেছেন--" আমি তো ওর সাথে ঘর বেঁধেছিলাম এই ভেবে যে সারা জীবন একসাথে থাকব। কিন্ত তা তো হলোনা। ও প্রথম প্রথম রাতে দেরি করে আসতো। তারপর দুই চারদিন পরে আসতে লাগলো। আমি সবই বুঝতাম। তবু কিছু বলতাম না। তোর দিকে তাকিয়ে ভেবেছিলাম জীবনটা এ ভাবেই কাটিয়ে দেব। কিন্ত তা করতে পারলাম না। তাই আমি তোর বাবার সাথে বসে সিদ্বান্ত নিই ডির্ভোসের। তুই খুব ছোট ছিলি তাই তোর বাবা তোকে আমার কাছে রেখে যায়। তবে তুই বড় হয়েছিস, এখন এইটা তোর decide করতে হবে তুই কার সাথে থাকবি। ' মা কথাগুলো বলে কিছুখন থেমে রইল সময় নিস্তব্ধ।

"যে ভালবাসে না তার সঙ্গে থাকা শুধু কষ্ট নয় অপমানের ব্যাপার, আমার ভালোবাসার অপমান, আমার নারীত্বের অপমান, আমার বিশ্বাসের অপমান। আর এতো অপমান নিয়ে আমি ঘর করতে পারিনি। তবে তুমি বড় হয়েছো, বুঝতে শিখেছো, তাই আমি চাই এই ডিসিশনটা তুমি নাও। তুমি যা ডিসাইড করবে তা আমি সম্পূর্ন মেনে নেব"--- মা বলল। আমি চুপচাপ শুনলাম মায়ের কথা। সতিই তো যেখানে ভালবাসা নেই সেখানে কি করে থাকা যায়? আমি মায়ের কোলে মাথা রেখে চুপ করে বসে রইলাম। কোন কথা বললাম না। চাঁদের আলোয় মা মেয়ে বসে রইলাম আমাদের ছোট্ট ছাদে। ভবিষ্যতের কথা আমি জানিনা। তবে এই মুর্হুতে খুব ভাল আছি আমি।









© Darkness is not the end , its just beginning of a new morning.