মধুরেণ (প্রথম পর্ব)
প্রথম দৃশ্য
(মঞ্চের মাঝখানে অবস্থিত একটা পুরোনো দিনের ঢাউস চেয়ারে বসে দশরথ খবরের কাগজ পড়ছেন। ভদ্রলোকের বয়েস বাহান্ন/তিপ্পান্ন। মাথায় কাঁচাপাকা চুল, পরণে ঘরোয়া ধুতি ও ফতুয়া/পাঞ্জাবি, চোখে চশমা, পায়ে হাওয়াই চপ্পল। তাঁর পাশে ছোট গোল টেবিলে রাখা চায়ের কাপ। মাঝে মাঝে তিনি চায়ের কাপে চুমুক দিচ্ছেন। মঞ্চে প্রবেশ করছেন তাঁর স্ত্রী এলোকেশী। ভদ্রমহিলার বয়েস মধ্য চল্লিশের একটু বেশিই হবে। মুখে চড়া মেকআপ, সাজপোশাকে অত্যন্ত আধুনিকা হবার একটা প্রয়াস দেখা যাচ্ছে।)
এলোকেশী : বলি হ্যাঁ গা, তোমার কি আক্কেল বলে কিছু নেই? সেই কবে থেকে বলছি, চলো, কলকাতায় আমার বোনের বাড়ি থেকে একটু ঘুরে আসি, তা এর আর মোটে নড়বার নাম নেই! বলি আমারও তো প্রাণে শখ আহ্লাদ বলে কিছু আছে, না কি? বিয়ে হয়ে এসে অবধি তো শুধু তোমাদের সংসারের হাঁড়িই ঠেলে চলেছি। বলি কানে ঢুকছে কিছু? Hear you?
দশরথ : হ্যাঁ, তা ঢুকছে বৈকি। Hear না করে আর উপায় আছে? Bear যখন আমাকেই করতে হয়। ফাটা কাঁসর কানের কাছে দিনরাত ক্যানোর ক্যানোর করে বেজেই চলেছে। শান্তিতে কোথাও গিয়ে একটু বসবার জো নেই। আচ্ছা, কলকাতায় গিয়ে হবেটা কি শুনি? সেখানে গিয়ে কি তোমার দুটো ড্যানা গজাবে যে কলকাতায় যাবার জন্য ধেই ধেই করছো? যতসব চোর ছ্যাঁচড় আর নেশাখোরদের জায়গা! কোনো ভদ্দরলোক শখ করে কলকাতায় যায়?
এলোকেশী : হ্যাঁ! তোমায় বলেছে! কলকাতায় ভদ্দরলোক থাকে না, সব ছোটলোকরা বাস করে! নাও, নাও, বাজে কথা না বলে যা বলছি তাই করো। What say I, do you. Understand you?
দশরথ : হ্যাঁ হ্যাঁ, very much understand. এখন যাও দিকি।
এলোকেশী : বাড়িখানার চেহারা দেখো না! ঠিক যেন মান্ধাতার আমলের সরাইখানা। সারাদিন এই ঝরঝরে বাড়িটার মধ্যে বসে থাকবে আর বুড়ো হাবড়া বন্ধুদের সঙ্গে বস্তাপচা পুরোনো দিনের গপ্প করবে। এসবের মধ্যে আমি হাঁপিয়ে উঠেছি। I so tired!
দশরথ : কেন, পুরোনো জিনিস কি খারাপ? এই তো, তুমি আমার পুরনো বউ, তোমায় আমি কতো ভালোবাসি!
এলোকেশী : What say you? আমি পুরোনো? I old? মোটেই না! You old, I not old! বুড়ো ভাম! আমার সঙ্গে joke? বলি সতেরো আর সতেরোয় কত হয় শুনি? Tell, tell?
দশরথ : হুঁ, দেখা যাক। সতেরোর সঙ্গে সতেরো যোগ করলে হয়...সাতচল্লিশ! কি, ঠিক কিনা?
এলোকেশী : মিছে কথা! আমার পুলু যখন জন্মেছিল তখন আমার বয়স এই, মেরেকেটে সতেরো। আর পুলুর বয়েস এখন সতেরো। তাহলে আমার বয়সটা কত দাঁড়ালো শুনি?
দশরথ : কি বললে? পুলুর বয়েস সতেরো? সে তো সতেরো বছর আগে ছিল!! হা হা হা!
এলোকেশী : হ্যাঁ! বলবেই তো! আমার ছেলেটাকে তুমি মোটে সহ্য করতে পারো না। তাই ওর নামে যত উল্টোপাল্টা কথা বলছো।
দশরথ : পাগল! তোমার গুণধর ছেলেকে নিয়ে কারো কিছু বলার সাহস আছে? কার ঘাড়ে কটা মাথা? আমার তো বাপু একটাই। আর সেটা আমি অকালে হারাতে মোটেই রাজি নই। অতএব আমি স্পিকটি নট!
এলোকেশী : বুঝি বুঝি, সবই বুঝি। আমার অসহায় রুগ্ন ছেলেটাকে তোমরা কেউ দু চক্ষে দেখতে পারো না। দাঁড়াও না, আগে ওর স্বাস্থ্যটা একটু ভালো হয়ে যাক, তারপর আমার কাছ থেকে ইংরিজিটা একটু শিখে নিলেই...
দশরথ : কি? কি বললে? তোমার ছেলে তার নেশাভাঙ, তাসপাশা, ঘুড়িলাটাই ছেড়ে ইংরিজি শিখবে? তাও কিনা আবার তোমার কাছে? তবেই হয়েছে! ওই যে, এলেন বাবু!
(মঞ্চে পুলকের প্রবেশ। সাতাশ/আঠাশ বছরের যুবক। প্রায় কাঁধ পর্যন্ত লম্বা চুল পনিটেইল করে বাঁধা। পরণে হাতকাটা রঙিন টি শার্ট ও চাপা জিন্সের প্যান্ট। গলায় রুপোলি চেইন, হাতে স্টীলের বালা, পায়ে বুটজুতো, চোখে রঙিন চশমা।)
পুলক : (উচ্চৈঃস্বরে গান গাইতে গাইতে) ট্রা লা লা লা লা
এলোকেশী : আয় আয় পুলু! আমার সোনা, my darling son! আমার কাছে এসে বোস। কিছু খাবি? Here you sit, then you eat.
পুলক : এখন বসা ফসার সময় নেই মা। বেরুতে হবে।
এলোকেশী : সেকি! এই ভরসন্ধ্যেবেলা আবার কোথায় বেরোবি? ইস, বাছার আমার মুখচোখ বসে গেছে গো!
পুলক : আঃ, ন্যাকামি কোরো না তো মা! আমি খুব ভালো আচি। এখন ও পাড়ার ঘনাদার বাড়ি তাস খেলতে যাচ্ছি।
এলোকেশী : কি? ওই ঘনা মণ্ডল? That nasty man? ব্যাটা নেশাভাঙ করে, জুয়া খেলে! খবরদার তুমি ওখানে যাবে না। You not go!
পুলক : এই বাওয়াল কোরো না তো মাইরি! সরো সরো, দেরি হয়ে যাচ্ছে।
এলোকেশী : আমি বলছি তুমি যাবেনা পুলু। আমি কিছুতেই যেতে দেবো না।
পুলক : আবে ধুর! এই আমি যাচ্ছি। দেকি তুমি কি করে আটকাও।
(প্রায় লাফ মেরে পুলক মঞ্চ থেকে বেরিয়ে গেলো।)
এলোকেশী : যাঃ! চলে গেলো! আমাকে পাত্তাই দিলো না!
দশরথ : আহা হা, রাগ করছো কেন? তোমার অসহায়, রুগ্ন সুপুত্তুর নাহয় একটু জুয়া খেলতে গেল! হা হা হা...কে ওখানে? ও লবঙ্গ! আয় মা। এত সেজেগুজে যাচ্ছিস কোথায়?
(মঞ্চে লবঙ্গলতার প্রবেশ। চব্বিশ/পঁচিশ বছরের মেয়ে, সুন্দরী ও আধুনিকা। পরণে হাল ফ্যাশনের চুড়িদার কামিজ, সঙ্গে ম্যাচ করা জাঙ্ক জুয়েলারী, মুখে মানানসই মেকআপ, পায়ে হাইহিল জুতো।)
লবঙ্গ : কমলার জন্মদিনে যাচ্ছি বাপি। কাকিমা বারবার করে যেতে বলেছেন। আমার সঙ্গে দামিনীও যাবে।
এলোকেশী : ফিরতে বেশি দেরি করিস না যেন। আজ সন্ধ্যেবেলা একটা ছেলে তোকে দেখতে আসছে।
লবঙ্গ : তাই নাকি? কই, তোমরা আমায় আগে কিছু বলোনি তো?
দশরথ : বলবো কি, কাল রাতেই তো সব ঠিক হলো। আমার ছোটবেলার বন্ধু চরণদাস, তারই ছেলে মদন। যদিও মদনের সঙ্গে আমার চাক্ষুষ আলাপ নেই, কিন্তু শুনেছি সে খুব ভালো ছেলে। ইঞ্জিনিয়ারিং পাশ করার পর এমবিএ করেছে, এখন একটা নামকরা মাল্টিন্যাশনাল কোম্পানীতে উঁচু পোস্টে চাকরি করে। দেখতে শুনতেও নাকি ভালো।
এলোকেশী : তার ওপর আবার কলকাতা শহরে নিজেদের বাড়ি গাড়ি...very rich!
দশরথ : চরণও কাল দুপুরে আসছে। তুই আর মদন নিজেদের মধ্যে কথাবার্তা বলার পর যদি আপত্তি না করিস তাহলে আশীর্বাদটা একেবারে করেই যাবে। তাহলে যা মা, তোরা চট করে ঘুরে আয়। ততক্ষণ আমি দিগম্বরটাকে একটু শহুরে আদবকায়দা শেখাই। যা গেঁয়ো ভূত! কি করতে কি করে বসবে।
লবঙ্গ : আচ্ছা, আমি আসছি বাপি।
দশরথ : আয় মা। সাবধানে যাস। দুগ্গা দুগ্গা।
...