...

3 views

ক্ষণিকের স্মৃতি ....
"আজকে না হয় আমার সাথেই টিফিন টা খেয়ে নে, ক্লাসে বসেই!" বিহান অনুরোধ করল তার ছোট্ট বেলার খেলার সাথীকে।

সেদিনের সরস্বতী পুজোর সকালে দরিয়া বুঝে উঠতে পারেনি যে সে তার বিকেলে খেলার সাথীটার মনের মানুষ হয়ে উঠছে।

................


হঠাৎ মোবাইল টা বেজে উঠায় দরিয়ার তন্দ্রা কেটে যায়। "বল্, কী হলো?" ওপার থেকে নীলাঞ্জনা বলে , " যাবিনা, স্কুলে? শাড়ি পরে রেডি হলি?"
"না, ভালো লাগছে না", দরিয়া ফোনটা কেটে দেয়। ভোরে উঠে বাড়িতেই পুষ্পাঞ্জলি দিয়েছে, তারপর পড়তে পড়তে যে কখন টেবিলে ঘুমিয়ে পড়েছে বুঝতে পারেনি।

(শাঁখের আওয়াজ)

দরিয়া বারান্দায় এসে দেখে, পাড়ার প‍্যান্ডেলে পুজো শেষ হলো।
সব পুচকে পুচকেদের শাড়ি পরা দেখে তার মনে পড়ে যায় সেই ছোট্ট বেলার কথা।
সেই ছোট্ট বেলার খেলার সাথী বিহানের কথা।


আজ বাগ্ দেবীর আরাধনা, মানে বাঙালির ভ‍্যালেন্টাইনস্ ডে।
দরিয়ার সব বান্ধবীরা স্কুলে গেছে, ঘুরছে, শাড়ি পরে। শুধু সে বাদ, তার জীবনের বড় ভুলের প্রায়শ্চিত্ত সেটা।

হ‍্যাঁ, ভুল। যা জীবনের মোড় ঘুরিয়ে দিয়েছিল।



দরিয়া ঘরে এসে চেয়ারে বসে টেবিল ল‍্যাম্পটা জ্বেলে, ভাবতে থাকে ....
সেই দিনগুলোর কথা, সেই ছেলেটার কথা, তার ছোট্ট বিহান, আর .....

দরিয়া তখন স্কুলে ভর্তি হয়নি। ওরা যে বাড়িতে ভাড়া থাকতো, তার পাশে বিহানদের বাড়ি ছিল। আরো অনেক বন্ধু আসতো বিকেলে বাড়ির সামনে মাঠে খেলতে। বিহান ও আসতো, দরিয়াও।
সেখান থেকেই পরিচয়। বিহান তখন অন‍্য এক স্কুলে পড়তো। বন্ধুত্ব টা শুধু ওদের মধ্যে ছিল না, দুজনের মায়ের মধ্যেও এমনকি দুটো পরিবারের মধ্যে। দরিয়া শুধু ওর মা-বাবার সাথে থাকতো। কিন্তু বিহানের ছিল জয়েন্ট ফ‍্যামিলি। খুব ভালো লাগতো সেটা একা দরিয়ার ।
তারপর ওরা একই ক্লাসে একসাথে ভর্তি হয় এক স্কুলে। কী সুন্দর, দুজনে রোজ মায়ের হাত ধরে একসাথে বাড়ি ফিরতো।

বর্ষায় একসাথে ব‍্যাঙাচির সাথে খেলা।

ক্লাস ৩ তে বিহানের বাম হাতটা ভেঙে গেলে দরিয়ার ই সবথেকে কষ্ট হয়েছিল। বিহানের ব‍্যান্ডেজহাতে স্কুলে ঢোকা দেখে দরিয়া যেভাবে হেসেছিল, আজ সেকথা ভাবলে তেমনি হাসি পায়।

বিহান বরাবরই একটু বেশি mature ছিল, দরিয়া পড়াশোনা ছাড়া কিছু বুঝতো না।
তারপর ধীরে ধীরে বিহানের দরিয়াকে হয়তো ভালো লাগতো।
কিন্তু, দরিয়ার সেসব বোঝার মতো বয়স আর ক্ষমতা কোনটাই ছিল না, সেটাই স্বাভাবিক।

ধীরে ধীরে ক্লাস এর অন্যরা বেড়ে উঠলেও দরিয়ার মনে সেই বৃদ্ধি আসেনি।

বিহান একদিন কথাচ্ছলে দরিয়াকে নিজের best girlfriend বলেছিল, বলেছিল বড় হয়ে ইঞ্জিনিয়ার হওয়ার পর আমি ওকেই বিয়ে করবো।

কথাটা হাওয়ায় ভাসতে ভাসতে দরিয়ার কানে এলে দরিয়া ক্ষীপ্ত মেজাজে ভরা ক্লাসের সামনে বিহানকে কী বলে নি সে নিজেও জানে না। overreact করাটা দরিয়ার স্বভাব, কিন্তু এটা সে নিজে থেকে করতে চাই নি, যেন বলা হয়ে গিয়েছিল।

তারপর হঠাৎ যেন ধরা পড়ে তাদের বন্ধুত্ব ক‍্যানসারে আক্রান্ত, বাঁচার আপ্রাণ চেষ্টা করলেও..... এযে মারণ রোগ।
চিকিৎসা হয়নি তা নয়, সেদিন থেকে দরিয়া আর বিহানের সাথে কথাও বলে নি।

প্রাইমারি স্কুল ছাড়ার সময় বিহানের অনুরোধে বিহানের মা দরিয়ার মাকে একই হাই স্কুলে ভরতি করতে বলে।
কিন্তু তাতেও কিছু হয়নি, দরিয়া আলাদা গার্লসস্কুলে আর বিহান অনেক দূরের স্কুলে।



সেদিন দোষটা না ছিল দরিয়ার, না ছিল বিহানের।

দরিয়ার না ছিল বাস্তব বোঝার ক্ষমতা, না বিহানের তৈরি হয়েছিল বাস্তব বোঝানোর ক্ষমতা।
দোষ ছিল ভাগ্যের, দোষ ছিল সময়ের।

অতছোট বয়সে ভালোবাসা না থাকলেও, যে বন্ধুত্ব টা ছিল সেটাও কম কিছু ছিল না।


আজ ৯ বছর কেটে গেছে, আজ দরিয়া বোঝে।

মাঝে সে প্রথম যখন বুঝতে পারে, সে চেষ্টা করেছিল তাদের ক‍্যানসারে ধুঁকতে থাকা বন্ধুত্ব টাকে আবার বাঁচিয়ে সুস্থ করার , অনেকের মাধ্যমে বিহানের কাছে জানতে চেয়েছিল যে দরিয়া কে তার মনে পড়ে কিনা!, নিজের ভুল স্বীকার করতে চেয়েছিল।সরাসরি সামনে যাওয়ার সাহস করতে পারে নি। কিন্তু সময় ছিল বিরূপ। সেই ছোট্ট বিহান সময়ের সাথে সাথে,বয়সে মেজাজে অনেক বড় হয়ে গিয়েছিল। দরিয়ার শেষ চিঠি পৌঁছেও, হয়তো পায়নি বিহান সেই চিঠি পড়ার সুযোগ।

বন্ধুত্বের অকাল মৃত্যু ঘটে, থেকে যায় স্মৃতি গুলো।
পাশাপাশি কয়েকটা চারাগাছ একসাথে বেড়ে ওঠার চেষ্টা করলেও, সবাই বৃক্ষ হয়ে ওঠেনা।
সেরকমই তাদের বন্ধুত্বটা যা অঙ্কুরেই মারা গেছে।

......

দরিয়া বাস্তবে ফেরে .....
বিহান কত বদলে গেছে ,সময় বদলে দিয়েছে।
আর দরিয়ার মনে শুধু কিছু প্রশ্ন ই রয়ে গেছে।

দরিয়ার কথা কি তার মনে পড়ে না?
বিহান কি সত্যিই দরিয়াকে ভালোবেসে ছিল?

দরিয়ার চিঠি কি কখনো পৌঁছাবে?

বিহান হয়তো জানে না, সেদিনের বাসন্তী রঙের শাড়ী পড়া ছোট্ট মেয়েটা, আজ আর সরস্বতী পুজোর সকালে শাড়ি পড়ে না।

দরিয়ার চোখের জল গাল বেয়ে গড়িয়ে ডাইরির পাতায় পড়ে ক্ষত করে দেয়,
সে ভুল করেছিল, সে জানে তার মেজাজ কেমন আর বিহান ও জানতো।

সে সানন্দে বর্তমানকে আগলে রেখেছে, ভালো আছে, কিন্তু এই সুন্দর সকালে তার শুধু একটা কথাই কানে বাজে ....

"আজ তোকে সত্যিই ভালো লাগছে, দরিয়া" , বিহান বলেছিল তাকে।
বিহান আর কোনোদিন ও কী বলবে?
বন্ধুত্ব টার হৃৎস্পন্দন কী আবার শোনা যাবে কোনো দিন, এমনি সুন্দর সকালে ?

© মনের মানুষ

[ বিঃদ্রঃ - চরিত্র গুলো কাল্পনিক, গল্পটা সত্যি।
কোথাও ত্রুটি থাকলে ক্ষমা করে দেবেন। ধন্যবাদ।]