...

0 views

ঘেটু পুজা
সাধারণ ভাবে আমাদের বাংলায় শীতকাল থেকে গরম কাল হবার সময় অর্থাৎ ঋতু পরিবর্তনের সময় চুলকানি ,খোস, ঘা-পাঁচড়া-র মতো রোগের মতো আরো আবির্ভাব ঘটে। এই রোগের হাত থেকে নিস্তার পাওয়ার জন্যই অনেক গুলি লৌকিক এবং পৌরাণিক ঘেটু, ভিটাকুমার থেকে শীতলতার মতো দেবী দেবতার পুজোর উদ্ভব বলে মনে করা হয়।
প্রথমেই বলি ঘেটু আমরা বন জুঁই ফুল বলি। ঘেটু কে ভাঁট গাছ বলা হয়। এর ঔষধি গুণসম্পন্ন উদ্ভিদ। এর পাতার রস শিশুর জ্বর দূর করে। তবে সনাতন ধর্মালম্বীরা ভাঁট ফুল দিয়ে ভাঁটি পূজা করে। গ্রাম বাংলার কৃষিজীবী মানুষেরা বিভিন্ন এলাকায় ভাঁট ফুল দিয়ে ভাঁটি পূজার আয়োজন করে ফাল্গুনের শেষ দিনটিতে। তবে এ পূজা শুরু হয় মাসের প্রথম দিন থেকেই। বাংলাদেশের বৃহত্তর যশোর-খুলনা, বরিশাল-ফরিদপুর অঞ্চলের মানুষ ভাটি পুজো করে। মূলত ভাটি অঞ্চলের পুজো বলেই একে ভাটি পুজো বলা হয়।
ভিটা তৈরি করা হয়,ঘরের কাছে, তার চারদিকে গাছের কাণ্ড দিয়ে বর্গাকার ঘর তৈরি করা হয় , এর পর প্রতিদিন সন্ধ্যায় পূজা দেওয়া হয় , ভাঁট ফুল সংগ্রহ করে এবং পূজা শেষ হয় ফাল্গুনের শেষ দিনে। সেদিন সকালে শিশুরা ভাঁট ফুল সংগ্রহ করে পূজামঞ্চে প্রার্থনা করে। লোক বিশ্বাস এই ভাঁট ফুল মাথায় নিয়ে জলে স্নান করার পর শিশুদের বিপদ ও রোগবালাই দূর হয়। তবে তাদের গৃহপলিত পশুর ঘা-পাঁচড়া হতে মুক্তির জন্য এই পূজাপদ্ধতি পালন করে।
তবে এই ভিটাকুমার কোনো পৌরাণিক দেবতা নন। এমন কি তিনি দেব না দেবী তা বিতর্ক আছে ।দেবী শীতলার একটি রূপ বলে ধরা হয়। তবে কেউ কেউ একে বাস্তু পূজা বলছেন।ভাটি পূজো একটি লৌকিক পূজো। তবে ভাটি পূজা ঘেটু পূজা বোধহয় এক নয়। নমঃশূদ্র, কাপালি, পুণ্ড্রক্ষত্রিয়, মুণ্ডা, ঋষি, বাগদী প্রভৃতি কৃষিজীবী জনগোষ্ঠীর মধ্যে এই পূজোর প্রচলন আছে। এছাড়া বাইতি, বাওয়ালি, মাওয়াল, মাঝি, ঘোষ, কর্মকার, কুমার, ছুতার, নরসুন্দর প্রভৃতি পেশাজীবী মানুষের মধ্যেও ভাটি পূজা হতে দেখা যায়।
আসলে এই বুনো গাছে ঔষধি গুণাগুন থাকে।এতে প্রচুর পরিমাণে ফ্ল্যাভোনয়েড থাকে। যা ক্যানসার দমনে সহায়ক। তাছাড়া চুলকানি, কৃমি, কোলেস্টেরল, ব্লাড সুগার , উদরাময় মানে পেটের অসুখে ছাড়াও নানা রোগ রোগের ঔষধ হিসেবে ব্যাবহৃত হয়। হিন্দুরা হয়তো এই ঘেটু ফুলকে এতোটা গুরুত্ব দিয়েছে
বর্তমানে বাঙালি হিন্দুদের মধ্যে যারা শাস্ত্রীয় ধর্মের প্রতি আগ্রহী হয়ে উঠেছে তাদের মধ্যে এই পূজা পদ্ধতি পালন করার রেওয়াজ কমে গেছে।তবে দিনে এই পূজা চরিত্র পরিবর্তন হচ্ছে বাংলার পশ্চিম দিকে এসে মানে উত্তর ও দক্ষিণ চব্বিশ পরগনা, হাওড়া, বাঁকুড়া হুগলি জেলায় এসে গ্রামবাংলায় কচিকাঁচারা মেতএ এখনো সেই ঘেটু সংক্রান্তিতে ওঠে উৎসবের মেজাজে। এরা ঘেটু ফুল দিয়ে পালকি বানিয়ে পাড়ায় ঘুরে চাল ,ডাল সংগ্রহ করে। কলাগাছের কাণ্ডের বাকলের স্তর বা ‘কলা বাসনা’ কেটে ডুলি বা পালকি তৈরি করা হয়। সকালবেলা মাটির সরা ঘেঁটু ফুল দিয়ে সাজিয়ে, গোবরের ডালা করে, তার ওপরে করি আর হলুদ কাপড় দিয়ে মুড়ে ঘেঁটু ফুল দিয়ে রাস্তার মোড়ে মোড়ে মা-কাকিমা সাথে ঘেটু পুজো করে এবং পরে মহা আনন্দে খিচুড়ি প্রসাদ খেয়ে থাকে।
তবে এটা ঘেটু সংক্রান্তিতে হয়ে থাকে ‌।ঘেঁটুপূজা লৌকিক দেবতা ঘেঁটুঠাকুরের উদ্দেশ্যে দেওয়া হয়ে থাকে। বাংলার লোকসংস্কৃতিতে বসন্ত ঋতুতে লক্ষনীয় এই ধরণের লোকাচার গুলো বেশি দেখা যায়, ভাটি পূজার কথাতো বললাম আগেই। এছাড়া ঘটিদের অরন্ধন উৎসব মানে গোটা সিদ্ধ এই রোগ নিবারণ সংক্রান্ত উৎসব। তেমন ফাল্গুন মাসের সংক্রান্তিতে ঘেঁটুর পূজাও করা হয় বসন্ত কালে ছোঁয়াচে চর্মরোগের বা খোস-পাঁচড়া নিবারণের উদ্দেশ্য নিয়ে করা হয়।

বাংলার লোক বিশ্বাস অনুযায়ী ঘেঁটু ঠাকুর ঘণ্টাকর্ণ হলেন ঘৃণার্হ এক চর্মরোগের দেবতা, শিবের অনুচর । মঙ্গল দেবতা বিষ্ণুর বিদ্বেষী হওয়ায়, অনেকটা দক্ষিণ বঙ্গের অলক্ষ্মীপূজার মতো এর মিল আছে। বসন্ত কাল এলে যাতে খোস-পাঁচড়ার বাড়বাড়ন্ত না হয়, তাই কাল্পনিক অপদেবতাকে মেরে বিদায় করা হয়।ঘেঁটু ফুল বা ভাট ফুল পূজার অন্যতম উপকরণ থেকে দেবতার নাম ঘেটু । ঘেটু বিষ্ণুনাম শুনতে চায় না তাই দুইকানের পাশে সর্বদা ঘণ্টা ঝুলিয়ে রাখেন; তাই এঁনার আরেক নাম 'ঘণ্টাকর্ণ'

পূজার বছর ফাল্গুনের সংক্রান্তির সকালে অনুষ্ঠিত হয়। পুরোহিত হীন এই পূজাতে, করেন পুরুষ-মহিলারাই ।'কেলে হাড়ি' মানে পুরোনো কালি ঝুলি মাখা একটি মাটির হাঁড়ি লাগে পূজার জন্যে । এটি দেবতা প্রতীক। মাটির খোলাটা, ঘেঁটু ফুল, ধান , দূর্বা ঘাস ,সিঁদুর ,তেল হলুদে চোবানো ছোট কাপড়, তিনটি কড়ি, তিনটি গোবর দিয়ে পাকানো পিণ্ড, মুড়িভাজার এই সব সাধারণ উপকরণ লাগে এই পূজায়।
মাটির খোলাটা প্রথমে ব্রতিনীরা এলোচুলে বসে বাম হাতে নিকোনো জায়গায় বসিয়ে দেন। এর ওপরে গোবরের পিণ্ড তিনটিকে লাগিয়ে সেগুলিকে ঘেঁটু ফুল, কড়ি, সিঁদুর দিয়ে সাজানো হয়। কাপড়ের টুকরো টা খোলার উপরে বিছিয়ে দেওয়া হয়। বাড়ির সামনে উঠোনে , কিংবা একটু দূরে রাস্তার তিনমাথা, চারমাথার ধারে এই পূজা করা হয় ।
ছড়া কাটা হয়
"ধামা বাজা তোরা কুলো বাজাএলো এলো দ্বারে ঘেঁটু রাজা।"

পূজার শেষে হলে মোটা বাঁশের লাঠি দিয়ে খোলাটা বাচ্চারা ভেঙে দিয়ে হরিবিদ্বেষী ঘেঁটু দেবতাকে অপমান করে, এবং তাদের যাতে চর্মরোগ না হয় তারাতারি পুকুরের জলে হাত পা ধুয়ে আসে । মহিলারা পূজার কাপড় টুকরোটা এনে বাচ্ছাদের চোখে বুলিয়ে দেন আর বাচ্চাদের চোখ ভালো রাখতে খোলার বা মাটির হাঁড়ির, ঝুলকালি কাজলের মতো পরিয়ে দেন ।
ঘেঁটু ঠাকুরকে বিদায় দেওয়ার পর হরিযশ বা হরিনাম কীর্তন গাওয়া হয় —
"ভাগ্যমানে কাটায় পুকুর চণ্ডালে কাটে মাটিকুমোরের কলসী, কাঁসারির ঘটিজল শুদ্ধ, স্থল শুদ্ধ, শুদ্ধ মহামায়াহরিনাম করলে পরে শুদ্ধ হয় আপন কায়া।।"

সন্ধ্যেবেলা ছোট ছোট ছেলেরা রঙীন কাগজ ও কঞ্চি দিয়ে ছোট্ট ডুলি বানিয়ে তাতে ঘেঁটু ফুল ও প্রদীপ দিয়ে ঘেঁটু ঠাকুরকে সাজিয়ে তা কাঁধে করে বাড়ি বাড়ি ঘোরে এবং ঘেঁটুর গান গেয়ে চাল পয়সা ভিক্ষা করে। ‘‘যে দেবে মুঠো মুঠো/ তার হবে হাত ঠুঁটো/ যে দেবে কড়াই কড়াই/ তার ঘরে সোনা ছড়াই।’ পরেদিন সকলে মিলে জমিয়ে ভোজ খাওয়ার জন্য অল্প বয়সী ছেলেমেয়েরা এইভাবে দিনে আনন্দে মেতে ওঠে, রিতি এখনো অনেক জায়গায় দেখা মেলে।
© Manab Mondal