প্রেম যখন সূর্যপূজা (পর্ব-১)
শ্রাবণী পূর্ণিমার বর্ষাসিক্ত সকাল। সামনের বাগানে গন্ধরাজ গাছে গতকাল রাতের ছোট্ট কুঁড়িগুলো কী সুন্দর ফুল হয়ে ফুটে উঠেছে আজ সকালে;শুভ্রসুন্দর গন্ধরাজ ফুলগুলোকে কী অপরূপ লাগছে আজ;বাতাসে গন্ধরাজের কী মিষ্টি স্নিগ্ধ সুবাস ভেসে আসছে।ঘুমমাখা চোখে বিছানায় বসে জানালা দিয়ে আনমনে বাইরের অনিন্দ্যসুন্দর এই শ্রাবণী প্রভাতী সৌন্দর্য্যে কোথাও একাত্ব হয়ে গেল পূজা।
গন্ধরাজ পূজার বড্ড প্রিয়;রঙে সাদা হলেও এর মধ্যেই তো সব রঙ লুকিয়ে,রূপে নিষ্পাপ ও স্নিগ্ধ আর গুনে মন ভরানো মিষ্টি সুগন্ধ যা বর্ষার আশীর্বাদী জলধারা সিঞ্চনে বাতাসকে আরও সুবাসিত করে তোলে।গোলাপের মতো ঘরসাজানোর ফুল নয় সে বটে কিন্তু নিভৃতে নীরবে ঘরের এককোণে থেকে ঘরটিকে এক স্নিগ্ধ সুবাসে ভরিয়ে রাখার দৈবগুনে যেন গুণান্বিত সে।জুঁই,বেল,রজনীগন্ধা এরা গন্ধরাজের প্রিয় বন্ধু;যাদের রঙীন সৌন্দর্য্য নয়,শ্বেতস্নিগ্ধ মাধুর্য প্রকৃত পরিচয়।গোলাপের শোভা সবার চোখে পড়ার মতো কিন্তু গন্ধরাজের শোভা কেবলমাত্র চোখে দেখে নয় অন্তরের অনুভূতি আর উপলব্ধির সাথে মিশে গেলে তবে মনে ধরে। এইসব ভাবনার সঙ্গে সঙ্গেই
রেডিওতে রবিঠাকুরের শ্রাবণের একটি অনবদ্য গানে ফুটে ওঠা গন্ধরাজের মতোই পূজার নিষ্পাপ অন্তরটিও মধুর সুগন্ধে পরিপূর্ণ হয়ে উঠছিল।
" শ্রাবণের ধারার মতো পড়ুক ঝরে,
পড়ুক ঝরে
তোমারি সুরটি আমার মুখের পরে,
বুকের পরে
শ্রাবণের ধারার মতো পড়ুক ঝরে,
পড়ুক ঝরে।।
পূরবের আলোর সাথে পড়ুক প্রাতে
দুই নয়নে,
পূরবের আলোর সাথে পড়ুক প্রাতে
দুই নয়নে,
নিশীথের অন্ধকারে গভীর ধারে
পড়ুক প্রাণে,
নিশিদিন এই জীবনের সুখের পরে
দুখের পরে,
শ্রাবণের ধারার মতো পড়ুক ঝরে,
পড়ুক ঝরে।।
যে শাখায় ফুল ফোটে না
ফল ধরে না একেবারে,
তোমার ওই বাদল-বায়ে দিক জাগায়ে
সেই শাখারে।
যা কিছু জীর্ণ আমার
দীর্ণ আমার, জীবনহারা,
তাহারি স্তরে স্তরে পড়ুক ঝরে
সুরের ধারা,
নিশিদিন এই জীবনের তৃষার পরে
ভুখের পরে।
শ্রাবণের ধারার মতো পড়ুক ঝরে,
পড়ুক ঝরে
তোমারি সুরটি আমার মুখের পরে,
বুকের পরে
শ্রাবণের ধারার মতো পড়ুক ঝরে,
পড়ুক ঝরে।।"
উষ্ণ চায়ের কাপে চুমুক দিতে দিতে কম্পিউটারটা রোজকার মতোই খুলে বসলো পূজা। ইমেল চেক্ করে একটা সোসাল সাইটের বন্ধুদের রাখী
পূর্ণিমার শুভেচ্ছাবার্তা পাঠাতে গিয়ে কিছু অচেনা ফ্রেন্ড রিকুয়েস্ট ডিলিট করল।সোসাল সাইটে অচেনা অজানা অপ্রয়োজনীয় বন্ধুদের সাথে বাজে সময় কাটানোর সময় পূজার কোনো কালেই ছিলনা।বন্ধু চয়নে সে বরাবর খুব সতর্ক।অবসরে রবিঠাকুরের গান শোনা,কবিতা লেখা,ছবি আঁকা,গল্প পড়া,নানাবিধ অজানাকে তার যুক্তিবাদী মন দিয়ে অনুধাবন করে গভীরে জেনে নেওয়ার প্রচেষ্টা করা ছোটবেলা থেকেই সহজাত আগ্রহ পূজার। কিন্তু কি ভেবে একজনের ফ্রেন্ড রিকুয়েস্ট ডিলিট করতে গিয়েও করল না।বলা ভালো অজানা একটা কারণে করতে পারলনা। রিকুয়েস্ট এক্সেপ্টও করলনা।এমনিই ফেলে রাখলো।
"ব্রেকফাস্ট করতে আয়।বাবা ব্রেকফাস্ট টেবিলে ওয়েট করছেন।"
মায়ের কন্ঠস্বর শুনে উঠে গেল পূজা।
কম্পিউটারটা তেমনি খোলা রইল।
"গুড্ মর্নিং মাম্মাম।"মেয়েকে সস্নেহে প্রভাতী শুভেচ্ছা জানিয়ে কমলবাবু বললেন,"শোন না,তোর জ্যাঠামশাই ফোন করেছিলেন।ওই যে তোর জন্য যে কম্পিউটার ইন্জিনিয়ার ছেলেটির সম্বন্ধ এসেছিল। আমাদের মতামত জানতে চাইছেন।"
"আমি তো তোমাদের বলেছি বাবা।এসব নিয়ে পরে ভাবা যাবে।আগে পড়াশোনা শেষ হোক।"শান্ত দৃঢ় স্বরে বলল পূজা।
"সে তো নিশ্চয়।আমি কিছু বলছিনা তো।জ্যেঠামশাই বলছেন।তোমার ইচ্ছা আর মতামত ছাড়া তোমার বিয়ে নিয়ে আমরা কখনও জোর করব না তুমি জানো।আমাদের বিশ্বাস আছে তোমার ওপর।এম্.এ পড়া শেষ হোক।নিজের পায়ে দাঁড়াও।তারপর।ঠিক আছে আমি না বলে দেব।" আশ্বস্ত করে বললেন কমলবাবু।
"আর তাছাড়া আমাদের সব জ্যোতিষেরা তো বলেই রেখেছেন।তোর নিজস্ব পছন্দের বিয়ে হবে।পূর্ব নির্ধারিত।ঠিক সময় হলে সে নিজেই আসবে।"মেয়ের উদ্দেশ্য রান্নাঘর থেকেই যাজ্ঞসেনী দেবী বলে চললেন,"কত ডাক্তার, ইন্জিনিয়ারের সম্বন্ধই তো এল গেল গত দু-তিন বছরে।ছেলেটা ভালো হলেই হল।তাই এখন ওসব বাদ দিয়ে নিজের পড়াশোনা কেরিয়ার নিয়ে আগে ভাব।সময় হলে সব ঠিক হবে।"
সহজ সরল সুস্পষ্ট ব্যক্তিত্বের অধিকারী আমাদের পূজা।বাহ্যিক অহংকার নয়,কিন্তু আত্মসম্মান জ্ঞান ছোট থেকেই প্রবল তার।পূজা সুশ্রী।স্কুল কলেজে অনেক মোহ,আকর্ষণ ও সস্তা প্রেমপ্রস্তাবকেই শক্ত প্রত্যাখ্যানে নিজের জীবন থেকে দূরে রেখে এসেছে সে।এসব নিয়ে সত্যিই ভাবতে চায়না এখন সে।যে তার, ঈশ্বরের আশীর্বাদ নিয়ে সে ঠিক সময় আসবে তার জীবনে।ভালোবাসা, বিশ্বাস আর সমর্পণ না থাকলে মন আর আত্মা কখনও কোনো পবিত্র বন্ধনে জড়ায়না এটা সে মনে প্রাণেই মানে।অযথা মোহে পড়ে ক্ষণিকের প্রেম কিংবা অভিনয় করে সংসার জীবনের সুখ খোঁজার আগ্রহ তার কখনও মনে আসেই নি।আর কেউ জানুক না জানুক তার সব চেয়ে প্রিয় বন্ধু মানে পূজার মা একথা খুব ভালো ভাবেই জানেন।বৈদিক বিবাহ একটি জন্ম জন্মান্তরের পবিত্র বন্ধন আর এই পবিত্র বন্ধন যে মানসিক আত্মিক অটুট বন্ধুত্ব আর প্রেম ছাড়া সার্থক হয়না,সাংসারিক সুখ যে প্রকৃত ভালোবাসা ছাড়া পূর্ণ হয়না,পারিবারিক শান্তি যে পরিবারের সদস্যদের মধ্যে অটুট বিশ্বাস ছাড়া আন্তরিক শান্তিতে পরিণত হয়না আর সামাজিক মান-সম্মান সত্য ও সততা ছাড়া যে দীর্ঘস্থায়ী হয়না ----এই বিচারগুলোকে তিনি সযত্নে পূজার সংস্কারে সুস্পষ্টভাবে স্থাপন করেছেন।খুব চাপা স্বভাবের মেয়ে পূজা।কিন্তু ছোটবেলার মতো পূজা এখনও নিষ্পাপ সরল মনে মাকে ছোট বড় সব কথাই বলে।পৃথিবীতে মাকেই সে সব থেকে বেশী প্রকৃত বন্ধু হিসাবে বিশ্বাস করে।সে জানে মাই তাকে সব থেকে বেশী জানে।সব থেকে বেশী বোঝে।জীবনে চলার পথে তাকে সব সময় সুপরামর্শ দিয়েছেন মা।তাকে সব সময় নিঃস্বার্থে নিঃশর্তে অপার স্নেহ,ভালোবাসা, বিশ্বাস আর ভরসা দিয়ে গেছেন মা।সততার বিকল্প কোনো ভূমিকায় হয়না।মনের মানুষ সৎ হলে আর প্রকৃত ভালোবাসা র সঙ্গী হলে তবেই সাংসারিক ও পারিবারিক জীবন সত্যি করে স্থায়ী সুখ-শান্তি ও সার্থকতা পেতে সক্ষম হয়---এটি পূজার মায়েরই সুশিক্ষার বীজ।একে অপরের সুখ-দুঃখের চিরসঙ্গী হয়ে স্বপ্নপূরণের সাথে সাথে দুটি পরিবারের প্রতি আর সমাজের প্রতি ভালোবেসে এক হয়ে একসঙ্গে কর্তব্য করার নামান্তরই তাই পূজার কাছে সত্যিকারের বিয়ে।নাহলে যে কোনো তথাকথিত বিয়ের বাঁধনে জড়িয়ে শুধুমাত্র সামাজিক স্বার্থপূরণের জন্য বিয়ে করা পূজার পক্ষে প্রায় অসম্ভব।
একুশ বছরের পূজা কলকাতার মেয়ে।পূজা মাইতি।দেশের বাড়ি পূর্ব মেদিনীপুরে।সম্ভ্রান্ত সম্পদশালী বংশের মেয়ে পূজা।পূজার দাদু দিদিমাও পূর্ব মেদিনীপুরের একটি শহরের সম্মানীয় শিক্ষক-শিক্ষিকা।
পূজার বাবা প্রফেসর।কর্মসূত্রে কলকাতার স্থায়ী বসবাস পূজার বাবা-মার।পূজা মা-বাবার একমাত্র মেয়ে।কলকাতাতেই জন্ম,পড়াশোনা, বেড়ে ওঠা তার।এক সুশিক্ষিত সংরক্ষণশীল পরিবারে মা-বাবার আদর যত্ন শাসন ও সুসংস্কারে পূজা বড় হয়ে উঠেছে।একদিকে যেমন যুক্তিবাদী আর স্বাধীনচেতা আবার অপরদিকে নিয়ম,নিষ্ঠা,পবিত্রতা আর ধর্মবোধের মিলমিশ পূজার চরিত্রের লক্ষণীয় বৈশিষ্ট্য।রামকৃষ্ণ মিশনে মা-বাবার সাথে খুব ছোট বয়স থেকেই পূজা দীক্ষিতা।বিঞ্জান মনস্কতার সাথে পূজার্চনা,আধ্যাত্বিক চিন্তন ও মনন,বেদ পুরাণের অনুধাবন করতে সে সর্বদাই বিশেষ আগ্রহী।
পূজা কলকাতার এক প্রসিদ্ধ ইংরেজী মাধ্যম স্কুলে পড়াশোনা শেষ করে ইংরেজীতে স্নাতক।বর্তমানে সে ইংরেজী নিয়ে এম.এর প্রথম বর্ষের ছাত্রী।সাহিত্য পূজার প্রিয় বিষয় বরাবরই।জীবনদর্শনকে জীবনের সব ভূমিকায় বাস্তবে সুপ্রয়োগ করায় সুনিপুণ হতে চায় আমাদের পূজা।আবার যুগোপযোগী শিক্ষা নিয়ে নিজেদের সংস্কৃতিকে রক্ষা করে নিজের এবং সমাজের সুউন্নতি করার জন্য একজন আদর্শ মানুষ ও শিক্ষিকারূপে প্রতিষ্ঠাও পেতে চায় পূজা।
শান্তমনে ব্রেকফাস্ট শেষে কিছুক্ষণ পর কম্পিউটারের সামনে এসে পূজা একটি ম্যাসেজ দেখতে পেল সেই অজানা কারণে ফেলে রাখা অচেনা ফ্রেন্ড রিকোয়েস্টটি থেকে।
আর ঠিক এখান থেকেই হঠাৎ করে পূজার অজান্তেই শুরু হল পূজার জীবনের এক বিশেষ নূতন অধ্যায়।
© বুনানী
গন্ধরাজ পূজার বড্ড প্রিয়;রঙে সাদা হলেও এর মধ্যেই তো সব রঙ লুকিয়ে,রূপে নিষ্পাপ ও স্নিগ্ধ আর গুনে মন ভরানো মিষ্টি সুগন্ধ যা বর্ষার আশীর্বাদী জলধারা সিঞ্চনে বাতাসকে আরও সুবাসিত করে তোলে।গোলাপের মতো ঘরসাজানোর ফুল নয় সে বটে কিন্তু নিভৃতে নীরবে ঘরের এককোণে থেকে ঘরটিকে এক স্নিগ্ধ সুবাসে ভরিয়ে রাখার দৈবগুনে যেন গুণান্বিত সে।জুঁই,বেল,রজনীগন্ধা এরা গন্ধরাজের প্রিয় বন্ধু;যাদের রঙীন সৌন্দর্য্য নয়,শ্বেতস্নিগ্ধ মাধুর্য প্রকৃত পরিচয়।গোলাপের শোভা সবার চোখে পড়ার মতো কিন্তু গন্ধরাজের শোভা কেবলমাত্র চোখে দেখে নয় অন্তরের অনুভূতি আর উপলব্ধির সাথে মিশে গেলে তবে মনে ধরে। এইসব ভাবনার সঙ্গে সঙ্গেই
রেডিওতে রবিঠাকুরের শ্রাবণের একটি অনবদ্য গানে ফুটে ওঠা গন্ধরাজের মতোই পূজার নিষ্পাপ অন্তরটিও মধুর সুগন্ধে পরিপূর্ণ হয়ে উঠছিল।
" শ্রাবণের ধারার মতো পড়ুক ঝরে,
পড়ুক ঝরে
তোমারি সুরটি আমার মুখের পরে,
বুকের পরে
শ্রাবণের ধারার মতো পড়ুক ঝরে,
পড়ুক ঝরে।।
পূরবের আলোর সাথে পড়ুক প্রাতে
দুই নয়নে,
পূরবের আলোর সাথে পড়ুক প্রাতে
দুই নয়নে,
নিশীথের অন্ধকারে গভীর ধারে
পড়ুক প্রাণে,
নিশিদিন এই জীবনের সুখের পরে
দুখের পরে,
শ্রাবণের ধারার মতো পড়ুক ঝরে,
পড়ুক ঝরে।।
যে শাখায় ফুল ফোটে না
ফল ধরে না একেবারে,
তোমার ওই বাদল-বায়ে দিক জাগায়ে
সেই শাখারে।
যা কিছু জীর্ণ আমার
দীর্ণ আমার, জীবনহারা,
তাহারি স্তরে স্তরে পড়ুক ঝরে
সুরের ধারা,
নিশিদিন এই জীবনের তৃষার পরে
ভুখের পরে।
শ্রাবণের ধারার মতো পড়ুক ঝরে,
পড়ুক ঝরে
তোমারি সুরটি আমার মুখের পরে,
বুকের পরে
শ্রাবণের ধারার মতো পড়ুক ঝরে,
পড়ুক ঝরে।।"
উষ্ণ চায়ের কাপে চুমুক দিতে দিতে কম্পিউটারটা রোজকার মতোই খুলে বসলো পূজা। ইমেল চেক্ করে একটা সোসাল সাইটের বন্ধুদের রাখী
পূর্ণিমার শুভেচ্ছাবার্তা পাঠাতে গিয়ে কিছু অচেনা ফ্রেন্ড রিকুয়েস্ট ডিলিট করল।সোসাল সাইটে অচেনা অজানা অপ্রয়োজনীয় বন্ধুদের সাথে বাজে সময় কাটানোর সময় পূজার কোনো কালেই ছিলনা।বন্ধু চয়নে সে বরাবর খুব সতর্ক।অবসরে রবিঠাকুরের গান শোনা,কবিতা লেখা,ছবি আঁকা,গল্প পড়া,নানাবিধ অজানাকে তার যুক্তিবাদী মন দিয়ে অনুধাবন করে গভীরে জেনে নেওয়ার প্রচেষ্টা করা ছোটবেলা থেকেই সহজাত আগ্রহ পূজার। কিন্তু কি ভেবে একজনের ফ্রেন্ড রিকুয়েস্ট ডিলিট করতে গিয়েও করল না।বলা ভালো অজানা একটা কারণে করতে পারলনা। রিকুয়েস্ট এক্সেপ্টও করলনা।এমনিই ফেলে রাখলো।
"ব্রেকফাস্ট করতে আয়।বাবা ব্রেকফাস্ট টেবিলে ওয়েট করছেন।"
মায়ের কন্ঠস্বর শুনে উঠে গেল পূজা।
কম্পিউটারটা তেমনি খোলা রইল।
"গুড্ মর্নিং মাম্মাম।"মেয়েকে সস্নেহে প্রভাতী শুভেচ্ছা জানিয়ে কমলবাবু বললেন,"শোন না,তোর জ্যাঠামশাই ফোন করেছিলেন।ওই যে তোর জন্য যে কম্পিউটার ইন্জিনিয়ার ছেলেটির সম্বন্ধ এসেছিল। আমাদের মতামত জানতে চাইছেন।"
"আমি তো তোমাদের বলেছি বাবা।এসব নিয়ে পরে ভাবা যাবে।আগে পড়াশোনা শেষ হোক।"শান্ত দৃঢ় স্বরে বলল পূজা।
"সে তো নিশ্চয়।আমি কিছু বলছিনা তো।জ্যেঠামশাই বলছেন।তোমার ইচ্ছা আর মতামত ছাড়া তোমার বিয়ে নিয়ে আমরা কখনও জোর করব না তুমি জানো।আমাদের বিশ্বাস আছে তোমার ওপর।এম্.এ পড়া শেষ হোক।নিজের পায়ে দাঁড়াও।তারপর।ঠিক আছে আমি না বলে দেব।" আশ্বস্ত করে বললেন কমলবাবু।
"আর তাছাড়া আমাদের সব জ্যোতিষেরা তো বলেই রেখেছেন।তোর নিজস্ব পছন্দের বিয়ে হবে।পূর্ব নির্ধারিত।ঠিক সময় হলে সে নিজেই আসবে।"মেয়ের উদ্দেশ্য রান্নাঘর থেকেই যাজ্ঞসেনী দেবী বলে চললেন,"কত ডাক্তার, ইন্জিনিয়ারের সম্বন্ধই তো এল গেল গত দু-তিন বছরে।ছেলেটা ভালো হলেই হল।তাই এখন ওসব বাদ দিয়ে নিজের পড়াশোনা কেরিয়ার নিয়ে আগে ভাব।সময় হলে সব ঠিক হবে।"
সহজ সরল সুস্পষ্ট ব্যক্তিত্বের অধিকারী আমাদের পূজা।বাহ্যিক অহংকার নয়,কিন্তু আত্মসম্মান জ্ঞান ছোট থেকেই প্রবল তার।পূজা সুশ্রী।স্কুল কলেজে অনেক মোহ,আকর্ষণ ও সস্তা প্রেমপ্রস্তাবকেই শক্ত প্রত্যাখ্যানে নিজের জীবন থেকে দূরে রেখে এসেছে সে।এসব নিয়ে সত্যিই ভাবতে চায়না এখন সে।যে তার, ঈশ্বরের আশীর্বাদ নিয়ে সে ঠিক সময় আসবে তার জীবনে।ভালোবাসা, বিশ্বাস আর সমর্পণ না থাকলে মন আর আত্মা কখনও কোনো পবিত্র বন্ধনে জড়ায়না এটা সে মনে প্রাণেই মানে।অযথা মোহে পড়ে ক্ষণিকের প্রেম কিংবা অভিনয় করে সংসার জীবনের সুখ খোঁজার আগ্রহ তার কখনও মনে আসেই নি।আর কেউ জানুক না জানুক তার সব চেয়ে প্রিয় বন্ধু মানে পূজার মা একথা খুব ভালো ভাবেই জানেন।বৈদিক বিবাহ একটি জন্ম জন্মান্তরের পবিত্র বন্ধন আর এই পবিত্র বন্ধন যে মানসিক আত্মিক অটুট বন্ধুত্ব আর প্রেম ছাড়া সার্থক হয়না,সাংসারিক সুখ যে প্রকৃত ভালোবাসা ছাড়া পূর্ণ হয়না,পারিবারিক শান্তি যে পরিবারের সদস্যদের মধ্যে অটুট বিশ্বাস ছাড়া আন্তরিক শান্তিতে পরিণত হয়না আর সামাজিক মান-সম্মান সত্য ও সততা ছাড়া যে দীর্ঘস্থায়ী হয়না ----এই বিচারগুলোকে তিনি সযত্নে পূজার সংস্কারে সুস্পষ্টভাবে স্থাপন করেছেন।খুব চাপা স্বভাবের মেয়ে পূজা।কিন্তু ছোটবেলার মতো পূজা এখনও নিষ্পাপ সরল মনে মাকে ছোট বড় সব কথাই বলে।পৃথিবীতে মাকেই সে সব থেকে বেশী প্রকৃত বন্ধু হিসাবে বিশ্বাস করে।সে জানে মাই তাকে সব থেকে বেশী জানে।সব থেকে বেশী বোঝে।জীবনে চলার পথে তাকে সব সময় সুপরামর্শ দিয়েছেন মা।তাকে সব সময় নিঃস্বার্থে নিঃশর্তে অপার স্নেহ,ভালোবাসা, বিশ্বাস আর ভরসা দিয়ে গেছেন মা।সততার বিকল্প কোনো ভূমিকায় হয়না।মনের মানুষ সৎ হলে আর প্রকৃত ভালোবাসা র সঙ্গী হলে তবেই সাংসারিক ও পারিবারিক জীবন সত্যি করে স্থায়ী সুখ-শান্তি ও সার্থকতা পেতে সক্ষম হয়---এটি পূজার মায়েরই সুশিক্ষার বীজ।একে অপরের সুখ-দুঃখের চিরসঙ্গী হয়ে স্বপ্নপূরণের সাথে সাথে দুটি পরিবারের প্রতি আর সমাজের প্রতি ভালোবেসে এক হয়ে একসঙ্গে কর্তব্য করার নামান্তরই তাই পূজার কাছে সত্যিকারের বিয়ে।নাহলে যে কোনো তথাকথিত বিয়ের বাঁধনে জড়িয়ে শুধুমাত্র সামাজিক স্বার্থপূরণের জন্য বিয়ে করা পূজার পক্ষে প্রায় অসম্ভব।
একুশ বছরের পূজা কলকাতার মেয়ে।পূজা মাইতি।দেশের বাড়ি পূর্ব মেদিনীপুরে।সম্ভ্রান্ত সম্পদশালী বংশের মেয়ে পূজা।পূজার দাদু দিদিমাও পূর্ব মেদিনীপুরের একটি শহরের সম্মানীয় শিক্ষক-শিক্ষিকা।
পূজার বাবা প্রফেসর।কর্মসূত্রে কলকাতার স্থায়ী বসবাস পূজার বাবা-মার।পূজা মা-বাবার একমাত্র মেয়ে।কলকাতাতেই জন্ম,পড়াশোনা, বেড়ে ওঠা তার।এক সুশিক্ষিত সংরক্ষণশীল পরিবারে মা-বাবার আদর যত্ন শাসন ও সুসংস্কারে পূজা বড় হয়ে উঠেছে।একদিকে যেমন যুক্তিবাদী আর স্বাধীনচেতা আবার অপরদিকে নিয়ম,নিষ্ঠা,পবিত্রতা আর ধর্মবোধের মিলমিশ পূজার চরিত্রের লক্ষণীয় বৈশিষ্ট্য।রামকৃষ্ণ মিশনে মা-বাবার সাথে খুব ছোট বয়স থেকেই পূজা দীক্ষিতা।বিঞ্জান মনস্কতার সাথে পূজার্চনা,আধ্যাত্বিক চিন্তন ও মনন,বেদ পুরাণের অনুধাবন করতে সে সর্বদাই বিশেষ আগ্রহী।
পূজা কলকাতার এক প্রসিদ্ধ ইংরেজী মাধ্যম স্কুলে পড়াশোনা শেষ করে ইংরেজীতে স্নাতক।বর্তমানে সে ইংরেজী নিয়ে এম.এর প্রথম বর্ষের ছাত্রী।সাহিত্য পূজার প্রিয় বিষয় বরাবরই।জীবনদর্শনকে জীবনের সব ভূমিকায় বাস্তবে সুপ্রয়োগ করায় সুনিপুণ হতে চায় আমাদের পূজা।আবার যুগোপযোগী শিক্ষা নিয়ে নিজেদের সংস্কৃতিকে রক্ষা করে নিজের এবং সমাজের সুউন্নতি করার জন্য একজন আদর্শ মানুষ ও শিক্ষিকারূপে প্রতিষ্ঠাও পেতে চায় পূজা।
শান্তমনে ব্রেকফাস্ট শেষে কিছুক্ষণ পর কম্পিউটারের সামনে এসে পূজা একটি ম্যাসেজ দেখতে পেল সেই অজানা কারণে ফেলে রাখা অচেনা ফ্রেন্ড রিকোয়েস্টটি থেকে।
আর ঠিক এখান থেকেই হঠাৎ করে পূজার অজান্তেই শুরু হল পূজার জীবনের এক বিশেষ নূতন অধ্যায়।
© বুনানী