...

6 views

“স্যর ভিভিয়ান রিচার্ডস”
স্যর ভিভিয়ান রিচার্ডস
********************

ভিভ!
আই ভি এ রিচার্ডস!
স্যর আইজাক ভিভিয়ান আলেকজান্ডার রিচার্ডস!
অ্যান্টিগুয়ার সর্বশ্রেষ্ঠ ক্রিকেটীয় বীর!
ওয়েস্ট ইন্ডিজ দ্বীপপুঞ্জ তথা বিশ্ব ক্রিকেটের অবিসংবাদী নায়ক ও বন্দিত রাজপুত্র!

শুধু রেকর্ড দিয়ে যদি ভিভ রিচার্ডসকে মাপতে যান পাঠক, তাহলে খুব বড় ভুল করবেন। কারণ, নেভিল কার্ডাসের মতো বর্তমান নিবন্ধকারেরও এটাই মত যে, স্কোরবোর্ড সত্যিই একটা গাধা। কারণ স্কোরবোর্ডে লেখা থাকে না কোনো ব্যক্তিগত সংগ্রামের ইতিহাস! যদি থাকত, তাহলে স্কোরবোর্ড এটাও জানাতে পারত যে, কোন্ পর্যায় থেকে ওয়েস্ট ইন্ডিজ ক্রিকেটকে কোন্ পর্যায়ে উন্নীত করেছিলেন রিচার্ডস ; অথবা গায়ের রঙের কারণে কী পরিমাণ ব্যঙ্গবিদ্রুপ সহ্য করতে হয়েছিল তাঁকে! তাই কেবল 121 টেস্টে 8540 রান কিংবা 187 ওয়ান ডে ম্যাচে 6721 রান দিয়ে ভিভকে বিচার করাটা শুধু বোকামিই নয়, অন্যায়ও। সুনীল গাভাসকারের মতো যদি কায়মনোবাক্যে একাগ্রচিত্ত থাকতেন, তাহলে হয়তো বা টেস্টে প্রথম দশ হাজার রান সংগ্রহকারী ব্যাটসম্যান তিনিই হতেন। কিন্তু ভিভের স্বভাবে ছিল না শান্ত মনোভাব। চ্যুইংগাম চিবোতে চিবোতে বোলারদের যেন বেবাক খুন করতেন রিচার্ডস! তাঁর যদি সুযোগ হতো শচীন টেণ্ডুলকারের মতো 200 টেস্ট খেলার বা সেঞ্চুরির সেঞ্চুরি করার, তাহলে কোথায় গিয়ে থামতেন তিনি—বলা মুশকিল! যদি মাটি কামড়ে অদম্য আকুতিতে পড়ে থাকতে পারতেন বাইশ গজে, তাহলে সুনীল গাভাসকারের রেকর্ড ভেঙে টেস্ট ক্রিকেটের প্রথম এগারো হাজারী ভিভই হতেন, অ্যালান বর্ডার নন। জাভেদ মিয়ানদাদের মতো সুদীর্ঘ ক্রিকেট কেরিয়ার এবং ছ’ ছ’টা বিশ্বকাপ খেলার যদি সুযোগ পেতেন ভিভ, তাহলে ওয়ান ডে ক্রিকেটের ইতিহাসও আজ অন্যভাবে লেখা হতো। এটা ভুললে চলবে না যে, ভিভ যখন খেলছেন, তখন বিশ্ব ক্রিকেট শাসন করছেন আরও অনেক স্বনামধন্য ব্যাটসম্যান। ভারতের সুনীল গাভাসকার-গুন্ডাপ্পা বিশ্বনাথ-দিলীপ বেঙ্গসরকার ; পাকিস্তানের জাভেদ মিয়ানদাদ-জাহির আব্বাস ; ইংলন্ডের টনি গ্রেগ-জিওফ বয়কট-গ্রাহাম গুচ-ডেভিড গাওয়ার-মাইক গ্যাটিং ; অস্ট্রেলিয়ার ইয়ান চ্যাপেল-গ্রেগ চ্যাপেল এবং ওয়েস্ট ইন্ডিজেরই ক্লাইভ লয়েড-অ্যালভিন কালীচরণ-গর্ডন গ্রিনিজ-ডেসমন্ড হেইনস্-রিচি রিচার্ডসন। এঁদের সমসাময়িক হয়েও এঁদের চেয়ে অনেকটাই আলাদা ছিলেন ভিভ—তাঁর জমানায় তিনিই ছিলেন রাজা! পরিশীলন নিশ্চয়ই ছিল ভিভের খেলায়, কিন্তু সেই পরিশীলন ভেঙে ব্যাট হাতে নিষ্ঠুর শাসন করতে কখনো পিছপা হননি ভিভ। যখনই প্রয়োজন পড়েছে ওয়েস্ট ইন্ডিজের, জ্বলে উঠেছেন তিনি। ঊনআশির প্রুডেনশিয়াল কাপের ফাইনালে তাঁর সেঞ্চুরি জিততে সাহায্য করেছিল ওয়েস্ট ইন্ডিজকে। চুরাশির ওল্ড ট্র্যাফোর্ডে মাইকেল হোল্ডিং-কে সঙ্গে নিয়ে ভিভের সংহারলীলা থেমেছিল ওয়ানডেতে তাঁর ব্যক্তিগত সর্বোচ্চ অপরাজিত 189 রানে! 1986-’87-র নিউজিল্যান্ড সফরে ডুনেডিনে এক ইনিংসে করা ভিভের শতরান ও ফাইভ-উইকেট-হল্-এর রেকর্ডটি 2005 সাল অবধি অক্ষুণ্ন ছিল। ছিয়াত্তর সালটা বোধহয় ছিল ভিভের জীবনের সবচেয়ে স্মরণীয় বছর। সেবছর 11 টি টেস্টে 90 গড়ে সাতটি সেঞ্চুরিসহ তিনি 1710 রান করেন, যার মধ্যে ওভালে করা তাঁর ব্যক্তিগত সর্বোচ্চ 291 রানের ইনিংসটিও ছিল। এই রেকর্ডটি কোনো এক ব্যাটসম্যানের দ্বারা এক ক্যালেন্ডার ইয়ারে করা সর্বোচ্চ রান হিসেবে তিরিশ বছর অক্ষুণ্ন ছিল, যা 2006 সালের 30 নভেম্বর পাকিস্তানের মহম্মদ ইউসুফ (ইউহানা) ভেঙে দেন।

বিদ্রোহী ওয়েস্ট ইন্ডিজ দলের হয়ে দক্ষিণ আফ্রিকায় খেলতে যাওয়ার প্রস্তাব ও তৎসংক্রান্ত “ব্ল্যাঙ্ক চেক্” দু'বার প্রত্যাখ্যান করেছিলেন রিচার্ডস—প্রথমে তিরাশি সালে, পরে আবারও চুরাশি সালে‌।

চুরাশি থেকে একানব্বই সাল পর্যন্ত পঞ্চাশটি টেস্টে ওয়েস্ট ইন্ডিজকে নেতৃত্ব দিয়েছেন রিচার্ডস—নেতা হিসেবে পরাজিত হননি একটিও টেস্ট সিরিজে—যে কৃতিত্ব অন্য আর কোনো ওয়েস্ট ইন্ডিজ ক্যাপ্টেনের নেই। তাঁর জেতার অদম্য ইচ্ছাশক্তিই তাঁকে এই অনন্য কৃতিত্বের অধিকারী করেছে বলে মনে করা হয়।

1974 থেকে 1991 পর্যন্ত দীর্ঘ ক্রিকেট জীবনে চারটি বিশ্বকাপ খেলেছেন ভিভ—প্রথম তিনটিতে ক্লাইভ লয়েডের নেতৃত্বে; যার মধ্যে পঁচাত্তর আর ঊনআশি সালের বিশ্বকাপ জিতেছেন তিনি। তিরাশির ফাইনালে কপিল দেব অত্যাশ্চর্যভাবে প্রায় তিরিশ গজ ছুটে গিয়ে তাঁর ক্যাচটি না ধরলে হয়তো সেবারেও বিশ্বকাপ ওয়েস্ট ইন্ডিজের ঘরেই থাকতো। সাতাশির রিলায়েন্স কাপে আবার রিচার্ডসই ছিলেন ওয়েস্ট ইন্ডিজের অধিনায়ক।

ফর্মের তুঙ্গে থাকাকালীনই অবসর নিয়েছিলেন রিচার্ডস, যদিও তখন তাঁর বয়স প্রায় চল্লিশ। বিরানব্বইয়ের বেনসন অ্যান্ড হেজেস কাপ তিনি হয়তো অনায়াসেই খেলে দিতে পারতেন (চল্লিশ বছরের “বৃদ্ধ” ইমরান খান সেবার খেলেছিলেন শুধু তাই নয়, বিশ্বকাপটাও জিতেছিলেন), কিন্তু তেমনটা ঘটেনি—এবং সে দুর্ভাগ্য রিচার্ডসের নয়, ওয়েস্ট ইন্ডিজেরই!

রিচার্ডস ওয়েস্ট ইন্ডিজ ক্রিকেটের সোনালী যুগের হয়তো বা সর্বশ্রেষ্ঠ প্রতিনিধি! সোবার্স, লয়েড, কানহাই, লারা, চন্দ্রপল, গেইল-রা ওয়েস্ট ইন্ডিজ ক্রিকেট আকাশে উজ্জ্বল নক্ষত্ররূপেই বিরাজ করবেন, কিন্তু তবুও ভিভ থেকে যাবেন এঁদের থেকে একটু আলাদা হয়ে—নিজেই একটি ক্লাসকে রেপ্রেসেন্ট করে! সোবার্সের অলরাউন্ড দক্ষতা কিংবা লয়েডের মতন নেতৃত্বকালীন সফলতা ভিভ পাননি। রোহান কানহাইয়ের ধৈর্য্য হয়তো ছিল না তাঁর। লারার মতো এক ইনিংসে 375 বা 400 রানের ইনিংসও হয়তো খেলেন নি তিনি। পারেন নি গেইলের মতো টেস্টে ট্রিপল সেঞ্চুরি, ওয়ান ডে ম্যাচে ডাবল সেঞ্চুরি ও টি টোয়েন্টি ম্যাচে সেঞ্চুরি করে “ট্রিপলেট্ অফ্ সেঞ্চুরি”-র বিশ্বরেকর্ড গড়তে। কিন্তু, আগেই বলা হয়েছে, রেকর্ড দিয়ে রিচার্ডসকে মাপা যাবে না, কারণ তিনি যা করেছেন, তা আজও cherish করে চলেছেন অসংখ্য ক্রিকেট অনুরাগী!

সুদীর্ঘ ক্রিকেট কেরিয়ারে অজস্র খতরনাক ফাস্ট বোলারদের (স্পিনারদেরও) মোকাবিলা করেছেন ভিভ—মাত্র পাঁচ ফুট দশ ইঞ্চির কাঠামোয় (ভিভের সতীর্থদের মধ্যে একমাত্র ম্যালকম মার্শাল ছাড়া প্রায় সকলেই ছিলেন সাড়ে ছ’ ফুটের কাছাকাছি) মাথায় একটা নামমাত্র ব্যাগি টুপি পরে, চ্যুইংগাম চিবোতে চিবোতে ক্রিজে এসে অলস ভঙ্গিতে গার্ড নেওয়ার পর যে যে বোলারদের সংহার করতেন ভিভ, তাঁদের মধ্যে ছিলেন অস্ট্রেলিয়ার ফাস্টবোলার ডেনিস লিলি ও জেফ টমসন্ ; পাকিস্তানের ইমরান খান ও আব্দুল কাদির ; ইংলন্ডের ইয়ান বথাম ও বব উইলিস ; ভারতের কপিল দেব, ভাগবৎ চন্দ্রশেখর, এরাপল্লী প্রসন্ন, বিষাণ সিং বেদী, বলবিন্দার সিং সান্ধু ; নিউজিল্যান্ডের রিচার্ড হ্যাডলি প্রমুখ। রিচার্ডস ভাগ্যবান যে, তাঁকে খেলতে হয়নি বিশ্বত্রাস ওয়েস্ট ইন্ডিজ ফাস্ট বোলিং অ্যাটাকের বিরুদ্ধে, যার পুরোভাগে থাকতেন ওয়েস্ হল্, মাইকেল হোল্ডিং, কলিন ক্রফট্, জোয়েল গার্নার, ম্যালকম মার্শাল—এবং পরের দিকে কোর্টনি ওয়ালশ্, কার্টলি অ্যামব্রোজ্, প্যাট্রিক্ প্যাটারসন্, উইনস্টন্ ডেভিস্, ইয়ান বিশপ্-রা। তাঁর সতীর্থদের মধ্যে ছিলেন মিডল্ অর্ডার ব্যাটসম্যান অগাস্টিন "গাস্" লোগি এবং উইকেটরক্ষক জেফ্রি দুঁজোঁও।

ভিভ রিচার্ডসের ওয়ান ডে ম্যাচের পরিসংখ্যানও বেশ ঈর্ষণীয়। ষাট ওভার বা পরের দিকে পঞ্চাশ ওভার ফর্ম্যাটের ক্রিকেটে বেশ কিছু স্মরণীয় ইনিংসও খেলেছেন তিনি।

ক্রিকেট ছাড়াও ফুটবলও খেলেছেন ভিভ।

ভারতীয় অভিনেত্রী নীনা গুপ্তার সঙ্গে ভিভের সম্পর্ক নিয়ে অনেক কথাই সংবাদপত্রে প্রকাশিত হয়েছিল। তাঁদের সন্তান মাসাবা গুপ্তা একজন নামী ফ্যাশন ডিজাইনার।

অস্ট্রেলিয়ার ফাস্টবোলার ডেনিস লিলি, ভিভ রিচার্ডসকে স্যর গারফিল্ড সোবার্সের চেয়েও ধ্বংসাত্মক ব্যাটসম্যান হিসেবে বর্ণনা করেছেন। লিলির সতীর্থ জেফ টমসন্-এর মতে, রিচার্ডস তাঁর দেখা আধুনিক যুগের সর্বশ্রেষ্ঠ ব্যাটসম্যান—এমনকি ব্রায়ান লারা কিংবা শচীন টেন্ডুলকারের চেয়েও ভিভকে তুল্যমূল্য বিচারে এগিয়ে রেখেছেন টমসন্! অস্ট্রেলিয়ার প্রাক্তন অধিনায়ক ইয়ান চ্যাপেল-এর মতে, তাঁর দেখা সবচেয়ে ভীতি-উদ্রেককারী এবং বিপজ্জনক ব্যাটসম্যান হলেন ভিভ রিচার্ডস—যিনি অনেকসময় কেবলমাত্র ক্রিজে এসেই অনেক ম্যাচের মোড় ঘুরিয়ে দিয়েছেন! ব্রায়ান লারা, শচীন টেন্ডুলকার, কুমার সাঙ্গাকারা ও ইনজামাম-উল-হক্—ভিভ-পরবর্তী বিশ্ব ক্রিকেটের এই চার মহারথীই একবাক্যে স্বীকার করেছেন যে, রিচার্ডস তাঁদের দেখা সর্বশ্রেষ্ঠ ব্যাটসম্যান এবং তাঁরা রিচার্ডসকে ক্রিকেট-আইডল্ হিসেবে মেনে নিয়েই বড় হয়েছেন।

প্রকৃত ফাস্ট বোলিং-এর বিরুদ্ধে রিচার্ডসই ছিলেন সর্বশ্রেষ্ঠ ব্যাটসম্যান—এই মত পোষণ করেছেন ইমরান খান ও জন বার্মিংহ্যাম। ব্যারি রিচার্ডস, রবি শাস্ত্রী ও নিল ফেয়ারব্রাদারের মতে, তাঁদের চেনা ব্যাটসম্যানদের মধ্যে রিচার্ডসই সেরা। পাকিস্তানের প্রাক্তন অধিনায়ক ও ফাস্ট বোলার ওয়াসিম আক্রমের মতে, তিনি যাঁদের যাঁদের বল করেছেন, তাঁদের মধ্যে ভিভই সেরা—এমনকি সুনীল গাভাসকার ও মার্টিন ক্রোয়েরও আগে তিনি ভিভকে রেখেছেন। আক্রম এও বলেছেন যে, তাঁর দেখা সর্বশ্রেষ্ঠ এবং সবচেয়ে পরিপূর্ণ ব্যাটসম্যান ভিভই—লারা বা শচীন নন। অন্যদিকে মার্টিন ক্রো নিজেই বলেছেন যে, তিনি যাঁদের যাঁদের বিরুদ্ধে খেলেছেন, তাঁদের মধ্যে ভিভ রিচার্ডস এবং গ্রেগ চ্যাপেলই সর্বশ্রেষ্ঠ! মুথাইয়া মুরলীধরণ এবং শেন ওয়ার্ন একবাক্যে স্বীকার করেছেন যে, ভিভকে আইডলাইজ করেই তাঁরা বড় হয়েছেন এবং ভিভই তাঁদের দেখা সর্বশ্রেষ্ঠ ব্যাটসম্যান! শেন ওয়ার্ন কেবল ব্র্যাডম্যানকে ভিভের আগে রেখেছেন। একই কথা বলেছেন ইয়ান বথামও। বথামের মতে, ভিভ তাঁর দেখা সেরা ব্যাটসম্যান—গাভাসকার, গ্রেগ চ্যাপেল, মার্টিন ক্রো, শচীন বা লারারও আগে। মাইকেল হোল্ডিং বলেছেন যে, গত পঞ্চাশ বছরে তাঁর দেখা সেরা ব্যাটসম্যান ভিভ রিচার্ডসই!

চুরানব্বই সালে ব্রিটিশ সরকার রিচার্ডসকে নাইটহুড উপাধিতে ভূষিত করেছেন। অ্যান্টিগুয়া সরকার তাঁকে নিরানব্বই সালে নাইটহুড এবং 2006 সালে সেদেশের সর্বোচ্চ সম্মান Knight of the Order of the National Hero সম্মানে ভূষিত করেছেন। অ্যান্টিগুয়ায় ভিভের নামে একটি ক্রিকেট স্টেডিয়াম রয়েছে, যা 2007 সালের বিশ্বকাপ ক্রিকেট প্রতিযোগিতার জন্য তৈরী করা হয়েছিল। ভিভ ও বথামকে সম্মান জানানোর উদ্দেশ্যে উইজডেন ক্রিকেট ট্রফির নাম পাল্টে রাখা হয়েছে রিচার্ডস-বথাম ট্রফি।

“মাস্টার ব্লাস্টার” ডাকনামটি আদতে ছিল ভিভ রিচার্ডসেরই—পরে শচীন টেন্ডুলকার তা গ্রহণ করেছেন। যেমন, আসলে “লিটল্ মাস্টার” ডাকনামটি ছিল পাকিস্তানের হানিফ মহম্মদের—পরে গুণ্ডাপ্পা বিশ্বনাথ ও সুনীল গাভাসকার হয়ে শচীন টেন্ডুলকার তা গ্রহণ করেছেন। যেমন, “বুম্ বুম্” ডাকনামটি ছিল জার্মান টেনিস 🎾 তারকা বোরিস বেকারের—তাঁর আগুনের গোলার মতো সার্ভিসের জন্য—পরে পাকিস্তানের শাহিদ আফ্রিদি হয়ে হালে ভারতের জশপ্রীত্ বুমরা সেটি গ্রহণ করেছেন।

2002 সালের ডিসেম্বরে উইজডেন ভিভ রিচার্ডসকে সর্বকালের সেরা ওয়ানডে ব্যাটসম্যান এবং তৃতীয় শ্রেষ্ঠ টেস্ট ব্যাটসম্যান হিসেবে (ব্র্যাডম্যান ও টেন্ডুলকারের পরেই) নির্বাচন করেছে। শতাব্দীর শ্রেষ্ঠ পাঁচজন ক্রিকেটারের মধ্যে একজন হিসেবে রিচার্ডসকে নির্বাচন করা হয়েছে (ব্র্যাডম্যান, সোবার্স, জ্যাক হবস্ এবং শেন ওয়ার্নের সঙ্গে)। উইজডেন ক্রিকেট অ্যালমানাক্ এখনও অবধি শতাব্দীর সেরা ওয়ানডে ইনিংস খেলার জন্য ভিভকে সম্মানিত করেছে। 2009 সালে রিচার্ডসকে আই সি সি তাদের হল্ অফ্ ফেমের অন্তর্ভুক্ত করেছে। রিচার্ডস হয়তো এখনো অবধি ক্রিকেট ইতিহাসের “সবচেয়ে ধ্বংসাত্মক ব্যাটসম্যান”—ক্রিকেট-জার্নালিস্ট থেকে ক্রিকেটার—সকলেই এ কথা একবাক্যে স্বীকার করেছেন। কিন্তু তা সত্ত্বেও ভিভ ছিলেন ব্যাট হাতে এক নিপুণ শিল্পীও—যেমনটা ছিলেন ভারতের সুনীল গাভাসকার, ইংলণ্ডের ডেভিড গাওয়ার কিংবা পাকিস্তানের জাভেদ মিয়ানদাদ। এঁদের সকলের খেলাতেই ছিল শিল্পসুষমা! অনেকেই এখন বিরাট কোহলির সঙ্গে ভিভের তুলনা করেন, যেমনটা আগে অনেকে করতেন গাভাসকারের সঙ্গে শচীনের। কিন্তু শচীন যেমন সুনীল গাভাসকার হতে পারেন নি, তেমনি কোহলিও কখনো ভিভ রিচার্ডস হতে পারেন না—কিন্তু তার মানে এই নয় যে, শচীন টেন্ডুলকার কিংবা বিরাট কোহলির ক্রিকেটে কোনো কৃতিত্বই নেই—নিবন্ধকারের বলার উদ্দেশ্য এটাই যে, এক-একজন মানুষ এক-একরকমভাবে শ্রেষ্ঠ—প্রত্যেকের মধ্যেই কিছু-না-কিছু অনন্য প্রতিভা আছে, তাই কারোর সঙ্গে কারোর তুলনা না করাই ভালো।

ব্যাটসম্যান ছাড়াও ভিভ ছিলেন একজন দুর্দান্ত ফিল্ডার এবং একজন অভিজ্ঞ অফ-স্পিন বোলার। এখনকার দিনে ব্যাটসম্যানরা যখন বিপুল পরিমাণ শিরস্ত্রাণ ও বর্ম্ম পরিধান করে খেলতে নামেন, তখন পাঠক জানলে নিশ্চয়ই অবাক হবেন যে, সতেরো বছরের দীর্ঘ ক্রিকেট জীবনে ভিভ কোনোদিনও হেলমেট পরে খেলতে নামেন নি!

অফস্টাম্পের বাইরের গুড লেংথের বলকে মিড-উইকেটের ওপর দিয়ে বাউন্ডারিতে পাঠানো ছিল রিচার্ডসের ট্রেডমার্ক শট্‌ এছাড়াও হুক্ শটেও দড় ছিলেন তিনি।

স্লেজিং করাকে অত্যন্ত অপছন্দ করতেন রিচার্ডস। যাঁরা তাঁকে স্লেজিং করার সাহস দেখাত, তাদের বলকে নির্দয়ভাবে প্রহার করে বাউন্ডারির বাইরে পাঠাতেন তিনি। এ ব্যাপারে রিচার্ডস এতটাই নির্দয় ছিলেন যে, অনেকসময় বিপক্ষদলের অধিনায়করা তাঁদের বোলারদের কড়াভাবে নির্দেশ দিয়ে রাখতেন, যাতে ভিভকে স্লেজিং করা না হয়। একবার সমারসেট্ কাউন্টির হয়ে ব্যাট করছিলেন রিচার্ডস, গ্ল্যামরগান কাউন্টির বিপক্ষে। গ্ল্যামরগানের হয়ে তখন বল করছিলেন গ্রেগ টমাস। তাঁর পরপর কয়েকটি বল রিচার্ডস মিস করার পর টমাস রিচার্ডসকে স্লেজ করতে গিয়েছিলেন। শোনা যায়, টমাস, রিচার্ডসকে বলেছিলেন, “তুই যদি খুব আশ্চর্য হয়ে থাকিস, তাহলে তোকে জানাই যে, এটা লাল রঙের একটা বস্তু, গোলমতন দেখতে, পাঁচ আউন্স ওজন।” রিচার্ডস পরের বলেই টমাসকে এতটাই বিশাল এক ছক্কা মারেন যে, বলটি স্টেডিয়াম পেরিয়ে কাছের একটি নদীতে গিয়ে পড়ে‌। রিচার্ডস তখন এগিয়ে গিয়ে টমাসকে নাকি বলেছিলেন, “তুই তো জানিস বলটা কেমন দেখতে। যা, এবার নিজেই গিয়ে খুঁজে নিয়ে আয়!”

বর্ণবিদ্বেষের বিরুদ্ধে আজীবন সংগ্রাম করেছেন রিচার্ডস। তাঁর নিজের গায়ের রং নিয়েও তাঁকে অনেক অপমান ও গঞ্জনা সহ্য করতে হয়েছে—কিন্তু তাকে তোয়াক্কা করেন নি তিনি। অনায়াসেই বাউন্ডারির বাইরে পাঠানোর মতো জবাব দিয়েছেন সেই মানুষদের। এক ভারতীয় সাংবাদিককে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে রিচার্ডস বলেছিলেন যে, তিনি একবার অত্যন্ত ক্রুদ্ধ হয়েছিলেন এক ব্যক্তির উপর, যিনি তাঁকে ক্রমাগত গায়ের রং নিয়ে বিদ্রুপ করতেন।

যদিও রেকর্ড দিয়ে রিচার্ডসকে মাপা মূর্খামির সমতুল্য, তবুও সতেরো বছরের দীর্ঘ ক্রিকেট জীবনে অসংখ্য রেকর্ড গড়েছেন তিনি। ছিয়াশি সালে মাত্র ছাপান্ন বলে সেঞ্চুরি করে তিনি টেস্ট ক্রিকেটে নতুন রেকর্ড গড়েছিলেন রিচার্ডস যা দু'হাজার চোদ্দ সাল অবধি অক্ষুণ্ন ছিল। নিজের সময়ে রিচার্ডস ছিলেন সবচেয়ে কম ইনিংস (21টি) খেলে 1000 ওয়ানডে রান করা ব্যাটসম্যান। ওয়ানডে ক্রিকেটে রিচার্ডস ও হোল্ডিং মিলে দশম উইকেটে সর্বোচ্চ 106 রানের পার্টনারশিপ গড়েছিলেন। চার নম্বরে ব্যাট করতে নামা সর্বোচ্চ ওয়ানডে রান (189*) করা ব্যাটসম্যানও রিচার্ডস-ই! একই ওয়ানডে ম্যাচে হাফ সেঞ্চুরি ও ফাইভ-উইকেট-হল্ কমপ্লিট করা প্রথম ক্রিকেটারও রিচার্ডস-ই!

ইংলন্ডের অলরাউন্ডার ইয়ান বথাম ছিলেন রিচার্ডসের প্রাণের বন্ধু। সমারসেট্ কাউন্টির হয়ে দু'জনে বহুদিন একসঙ্গে খেলেছেন। একবার সমারসেট্ ভিভিয়ান রিচার্ডসকে দল থেকে বাদ দিল। বথাম বলে দিলেন, তাঁর বন্ধুকে দল থেকে বাদ দিলে তিনিও খেলবেন না। অনেক অনুরোধ করেও যখন বথামকে টলানো গেল না, তখন সমারসেট বাধ্য হলো রিচার্ডসকে দলে ফিরিয়ে নিতে।

ভিভও খুব শ্রদ্ধাশীল ছিলেন বথামের সম্বন্ধে। একটি সাক্ষাৎকারে রিচার্ডস বলেছিলেন, “দেখুন, বথাম আমার ভীষন বন্ধু। আমরা দু'জনে একসঙ্গে বড় হয়েছি। খেলেছি। বছরের পর বছর এক সঙ্গে থেকেছি। বথামের মতো বিশ্বাসী আর আন্তরিক মানুষ আমি আর দেখিনি। ও মানুষকে ভালবাসে। ছোটদের জন্য জীবন দিতে পারে। দেখছেন না, ছোটদের লিউকিমিয়া রোগের বিরুদ্ধে ও একা কেমন লড়ছে। মাইলের পর মাইল হাঁটছে টাকা তুলতে। কত বড় লিউকিমিয়া রিসার্চ সেন্টার তৈরী করছে, ক্লিনিক করছে। কিন্তু ওকে কেউ বোঝে না। এক সময়ে ওকে মাথায় তোলা হয়েছিল। এখন টেনে নামানোর চেষ্টা চলছে। তাতে অবশ্য কিছু আসে যায় না। ভগবান আছেন। ওর পাশে কেউ না থাকলেও ও ভেঙে পড়ার মতো মানুষ নয়। ভগবানই ওকে আগলে রাখবেন। দেখবেন। কেউ কোনোদিন ওর তেমন কোনো ক্ষতি করতে পারবে না।”

রিচার্ডসকে কেন তাহলে মনে রাখবে পৃথিবী? ডন ব্র্যাডম্যানের পরই কেন স্থান হবে রিচার্ডসের? আসল কথা হলো, রিচার্ডসের ঘরানা! ফর্ম ইজ্ টেম্পোরারি, ক্লাস ইজ্ পার্মানেন্ট—এই আপ্তবাক্যটি বড় বেশী সত্য প্রতিপন্ন হয় রিচার্ডসের ক্ষেত্রে! এই “ফাটকাবাজির যুগে” যখন “স্বপ্নের পাখিগুলো (সত্যিই) বেঁচে নেই”, তখন রিচার্ডস বেঁচে থাকবেন আমাদের মনে—স্বপ্নদর্শী নাবিকের মতন, যিনি একক কৃতিত্বে পালছেঁড়া নৌকাকে তীরে ভেড়াতে পারেন! আজ যখন ক্রিকেট মানে “আই-পি-এল” সার্কাসে চিয়ারলিডারদের নর্ত্তন-কুর্দ্দন আর ক্রিকেটার মানে বারোয়ারী হাটের নীলামে নিজের নাম তোলা(এমনকি সারা টুর্নামেন্ট ভালো পারফরমেন্স না করলেও দশ থেকে বারো কোটি টাকা 💸💰 পাওয়া যায়), ছক্কা মানে “ইয়েসব্যাঙ্ক ম্যাক্সিমাম” , পিঞ্চ-হিটার মানে “ফিনিশার”, বোলার মানে ওভারে একটাও শর্ট বল না করতে পারা এবং কুড়ি ওভারের ক্রিকেটে পনেরো মিনিট অন্তর “স্ট্র্যাটেজিক্ টাইমআউট” ; সেখানে রিচার্ডস মানে একটা গরিমা, একটা অহঙ্কার, এক দর্পী ও প্রবল প্রতিস্পর্ধী নায়ক, যার চ্যুইংগাম চিবোতে চিবোতে ক্রিজে আসা আর সামান্য একটা ক্যাপ পরে বোলার-কে-বোলার সংহার করা! রিচার্ডস থেকে যাবেন আপামর ক্রিকেট-প্রেমীর মনে—রিচার্ডস হয়েই! এক এবং অদ্বিতীয়!

©কৌস্তভ মণ্ডল

®all rights reserved.

30 April-27 May 2021

তথ্যসূত্রঃ
★শুকতারা, পৌষ ১৩৯৩ ; ১৯৮৭ খৃঃ
★উইকিপিডিয়া


© The Prodigal Son