...

3 views

চিরুনি
চিরুনি

তিনদিন হল সবে বিয়ে করে নতুন বাড়িতে পা রেখেছে ঐশী।শ্বশুরবাড়ি মোটামুটি স্বচ্ছল। টাকাপয়সা বাড়ি গাড়ি থেকে আরম্ভ করে শিক্ষিত এবং অভিজাত পরিবার হিসেবে এলাকায় যথেষ্ট সুনাম আছে।স্বামী অর্ক একটা বড় কোম্পানিতে ব্রাঞ্চ ম্যানেজার পদে অধিষ্ঠিত। সারাজীবনের জন্য একেবারে নিশ্চিন্ত ঐশী।তার ওপরে তিনতলার ওপরে এই সুদৃশ্য ব্যালকনিযুক্ত অর্কর ঘরটি এখন তার।আহ্লাদে আটখানা ঐশী তার নতুন ঘরটিতে ঢুকে এখন তার মতো করে সবকিছু একটু সাজিয়ে গুছিয়ে নিচ্ছে।এমন সময় ড্রেসিং টেবিলের ড্রয়ার খুলে তার নজরে পড়ল একটি সুদৃশ্য হাতির দাঁতের চিরুনি। বেশ বড় আর বেশ চওড়া মোটা গাঁটযুক্ত কারুকার্যখচিত এমন চিরুনি দেখে সে যথেষ্ট অবাক হল কারণ চিরুনিটা পাওয়া গেছে অর্কর ড্রেসিং টেবিলের ড্রয়ারে।সাদা চিরুনিতে ব্যবহৃত হওয়ার ছাপ স্পষ্ট।এটা বুঝতে কারোর বাকি থাকে না...যে এটা আসলে দীর্ঘ কেশের অধিকারী মহিলাদের জন্য তৈরি চিরুনি। এমন চিরুনি অর্কর ঘরের ড্রেসিং টেবিলে কি করছে?সে চিরুনিটি হাতে নিয়ে অর্কর সামনে গিয়ে তার কাছে প্রকাশ করল কৌতূহল। অর্ক শুনে গম্ভীর মুখে বলল,"তোমার শ্বশুরবাড়িতে কি মহিলা সদস্যের অভাব?তোমার শাশুড়ি বা ননদ এদেরই কারোর হবে হয়তো,হাত ঘুরে চলে এসেছে। এখন ও নিয়ে ভেবে কাজ নেই,চিরুনিটা ফেলে দাও।এটা অনেক ময়লা।"
কথাগুলো কোনোভাবে যেন ছুঁড়ে দিয়েই অর্ক হনহন করে ঘর থেকে বেরিয়ে গেল।
হতবাক হয়ে গেল ঐশী।সে ভাবল,চিরুনি ময়লা তো কি হয়েছে! সাবান দিয়ে ধুয়ে পরিষ্কার করে নিলেই ঝকঝকে হয়ে যাবে।কি দারুণ একটা জিনিস!
যেমন ভাবা তেমন কাজ।সে ঘষে মেজে চিরুনিটা পরিষ্কার করে নিয়ে ব্যবহার করা শুরু করল।কিন্তু সে হঠাৎ করেই লক্ষ করছে,তার বড়ো বেশি চুল উঠতে শুরু করেছে। চিরুনির গায়ে কালো চুল যেন ভেড়ার শরীরে পশমের মতো সবসময় লেপ্টে লেপ্টে থাকে।ঐশী চিন্তিত হয়ে পড়ল।সে চুলের নানা আয়ুর্বেদিক চিকিৎসা ও পরিচর্যা শুরু করে দিল।কিন্তু উন্নতির বদলে বদলে ক্রমশ অবনতিই হতে আরম্ভ করল।একটা ব্যাপার সে লক্ষ করল,চিরুনিতে যে পরিমাণে চুল উঠে আসে প্রত্যেকদিন,ওই পরিমাণে চুল যদি সত্যিই মাথা থেকে বেরিয়ে যেত,তাহলে খুব অল্পদিনের মধ্যেই তার মাথায় টাক পড়ে যেত।কিন্তু অবাক হওয়ার মতো ব্যাপার এই যে,ঐশীর চুলের বিনুনির গোছানো আগে ঠিক যেমন সুঠাম,পুষ্ট ও মোটা ছিল,এখনো তাইই আছে।তবে...????
এই তবে'র কথা চিন্তা করতেই রক্তহিম হয়ে এল ঐশীর।এটা কি হচ্ছে? আর কেনই বা হচ্ছে? এই গোছা গোছা উঠে আসা চুল যদি তার না হয় তাহলে কার?একটা ভয়াল আতঙ্কের অশনি সংকেত পেল ঐশী।তবে তার সাথে সাথে সে এটাও মনস্হির করল,এটা কি হচ্ছে আর কেনই বা হচ্ছে,জানতেই হবে তাকে।এই রহস্য যে করেই হোক,তাকে ভেদ করতেই হবে।চিরুনিটা সে আরো শক্ত করে মুষ্ঠিবদ্ধ করল সে।আর চুল নিয়ে মাথা খারাপ করাটা একেবারে বন্ধ করে দিল।কিন্তু ক্রমশ এই অতিপ্রাকৃতিক ঘটনা আরো ভয়ঙ্কর দিকে মোড় নিচ্ছে। চিরুনিতে জড়িয়ে থাকা চুলগুলি ঐশীর চোখের সামনে দিয়ে হঠাৎ দৈর্ঘ্যে বাড়তে আরম্ভ করেছে। তারা চলমান হয়ে উঠেছে। ক্রমশ তারা শাখাপ্রশাখার মতো ছড়িয়ে যাচ্ছে ঐশীর আঙুলে।কজ্বিতে।পেঁচিয়ে ধরছে ঐশীর হাত আসুরিক শক্তিতে।ঐশী ভয়ে আতঙ্কে ক্রমশ কাঠ হয়ে যাচ্ছে। সে নাওয়া খাওয়া পর্যন্ত বন্ধ করে ঘরের একটা কোণায় নিজেকে আবদ্ধ করে সমানে কেঁদে চলেছে। তবুও সে চিরুনিটা ছাড়ছে না।তার শুধু মনে হচ্ছে এই চিরুনি...এই অপার্থিব চুলের ক্রমবর্ধমান গোছা ও তার খালি খালি আসুরিক শক্তি প্রয়োগ করে তার হাত পেঁচিয়ে ধরার চেষ্টা,এই সবকিছুরই একটা গূঢ় অর্থ রয়েছে। কেউ তাকে অজানা কোনো কিছুর সংকেত দিতে চাইছে...কিছু বলতে চাইছে...যা তাকে জানতেই হবে।
এদিকে ঐশীর অবস্থা দেখে তার শাশুড়ি,ননদের দুশ্চিন্তা ক্রমেই বাড়তে লাগল।তারা হাজার চেষ্টা করেও ঐশীর এই আচরণের কোনো কারণ জানতে পারছেন না।ওদিকে অর্ক প্রচন্ড ব্যস্ত মানুষ।সে সকালে উঠে খেয়েদেয়ে অফিসে বেরিয়ে যায়,আর প্রতিদিনই হয় পার্টি নয় মিটিং সেরে প্রায় মাঝরাতে ঘরে ফিরেই শ্রান্ত শরীর এলিয়ে দেয় বিছানায়।স্ত্রীর দিকে পাঁচটা মিনিটও তাকিয়ে কথা বলার ফুরসত নেই তার স্ত্রীর এই অবস্থার কথা সে জানতে পারল মা আর বোনেদের কাছে।তার মা তাকে বললেন,"আমরা তো অনেক চেষ্টা করলুম।কিছুতেই কিছু বুঝতে পারছি না।ওর বাপের বাড়িতে খবর দিয়েছি।কিন্তু ট্রেনে আসতে তাদের দুটো দিন তো সময় লাগবে...তুই দ্যাখ না ভালো করে কাছে বসিয়ে জিজ্ঞাসা করে যদি কিছু জানতে পারিস...
মায়ের কথা শুনে তার সম্বিৎ ফিরল।সত্যিই তো...তাড়াহুড়া করে বিয়েটাতো সারল সে।কিন্তু স্ত্রীর সাথে এখনো ঠিকভাবে তার আলাপ পর্যন্ত হয়নি।সে ধীরপায়ে ঐশীর কাছে তার পিঠে নিজের হাতখানি রাখল।তার সেই স্পর্শে কোমলতার পরশ স্পষ্ট বিদ্যমান।বিনামেঘে বৃষ্টিপাতের মতোই ঐশী অর্কর বুকে আছড়ে পড়ে চোখের জলে ভাসাতে লাগল তার শার্টের বুকের অংশ।অর্ক স্ত্রীর মাথায় হাত রেখে আস্তে করে জানতে চাইল,ব্যাপারখানা কি!
ঐশী তখন কোনো কথা না বলে আগে চিরুনিটা বার করে এনে অর্কর হাতে দিল।সে তার কথা বলা শুরু করতে যাবে,হঠাৎ ঘটল সেই হাড় হিম করা ঘটনা।ঐশী দেখল,চিরুনি থেকে গোছা গোছা চুল বেরোতে আরম্ভ করেছে। ক্রমশ ওই গোছা গোছা চুলের হিলহিলে সাপগুলি অর্ককে আষ্টেপৃষ্ঠে বেঁধে ফেলেছে আর অর্ক পরিত্রাহী চ্যাঁচাচ্ছে।তার দুচোখ সর্বগ্রাসী আতঙ্কের অন্ধকারে খাবি খাচ্ছে। প্রবল শক্তিতে দড়ির মত মোটা ও শক্ত ওই চুলের গোছ প্রবল শক্তিতে চেপে ধরছে তার কন্ঠনালী।শ্বাসরোধ হওয়ার উপক্রম হয়ে এবার অর্কর জিভ বেরিয়ে আসছে।দৃশ্য দেখে ঐশী জীবন্ত পাথর হয়ে গেল।তার সারা শরীর একেবারে ঠান্ডা। মুখ থেকে একটা শব্দও তার বার হচ্ছে না।ওদিকে অর্কর মারণ চিৎকার শুনে বন্ধ দরজার ওপাশে তখন ধাক্কাধাক্কির পর্ব শেষে এবার দরজা ভাঙ্গার চেষ্টা আরম্ভ হয়েছে।অবশ জড়পদার্থস্বরূপ ঐশী নিষ্প্রাণ দৃষ্টিতে দেখতে থাকল,অর্ক ধীরে ধীরে নীল হয়ে যাচ্ছে। দরজা ভেঙ্গে সবাই যখন ঘরে ঢুকল তখন অর্কর শরীরে আর প্রাণ অবশিষ্ট নেই।কিন্তু সবাইকে আবার ভীত সন্ত্রস্ত করে সকলের চোখের সামনে আস্তে আস্তে মিলিয়ে যেতে থাকল চুলের গোছার সমস্ত অস্তিত্ব। এবার সবাই চোখের সামনে সবকিছু প্রত্যক্ষ করল আর দেখল,মৃত অর্কর হাতের তালুতে মুষ্টিবদ্ধ সেই হাতির দাঁতের কারুকার্যখচিত চিরুনি। এই সাপসদৃশ চুলের সমস্ত শাখাপ্রশাখা আস্তে আস্তে করে পুরোটা গিলে নিয়ে সেটা একটা নিরীহ জড়পদার্থের ন্যায়ে অর্কর হাতের তালুর কোলে ফ্যাকাশে হয়ে চেয়ে রইল।এই দৃশ্য আর সইতে না পেরে অর্কর মা সংজ্ঞাহীন অবস্হায় লুটিয়ে পড়লেন ছেলের মৃতদেহের উপর।ব্যাপারটা যে কি এবং কেন হল সেটা কেউ। তাদের যুক্তি বুদ্ধি বা পার্থিব বিশ্লেষণের আওতায় আনতে না পেরে সবাই যার যার জায়গায় গুম হয়ে গেল।কেউ দাঁড়িয়ে...কেউ মাথায় হাত দিয়ে মেঝেয় বসে।প্রত্যেকে এতটাই বিস্মৃত ও আতঙ্কিত যে বাড়ির বড়ছেলে যে আর নেই,তার দেহটা এবার দাহ করতে হবে এই বোধটাই ক্ষণিকের জন্য সকলের মধ্যে চাপা পড়ে গিয়েছিল।ধীরে ধীরে প্রত্যেকের হুঁশ ফিরল।রাতের কালো র ঘনঘোর ওই তান্ডব শান্ত হয়ে ভোরের আলো ফুটতে শুরু করল।আলো যেন সব কালো ধুয়ে দিচ্ছে একটু একটু করে।সকাল হয়ে এল।সাদা শাড়ি পরে পেঁজা তুলোর মত ভাসমান শরতের শ্বেতশুভ্র মেঘের গুচ্ছের দিকে ফ্যালফ্যাল করে চেয়ে রয়েছে চোখের জল ফেলতে ভুলে যাওয়া সদ্য বিধবা ঐশী।
শ্বশুরমশাই,দেওরেরা সবাই বাড়ির ছেলের দেহ দাহ করে ফিরছেন এইমাত্র। কিভাবে অর্কর এই অকাল মৃত্যু তা নিয়ে ইতিমধ্যেই পাড়াপ্রতিবেশীর মধ্যে চাপা কানাঘুষো শোনা যাচ্ছে। ঐশী তাঁদের কাছ থেকেই আজ জানল,সে তার স্বামীর প্রথম স্ত্রী নয়।সে আসলে তার স্বামীর দ্বিতীয় স্ত্রী। পূর্বের বিয়ের কথা গোপন রেখেই সে তার বিয়ের জন্য সম্বন্ধ দেখায় তার বাবা মা কে সায় দিয়েছিল। তার শ্বশুরবাড়ির সকলেই ব্যাপারটা গোপন রেখে খুব সুন্দরভাবে সবকিছু এতদিন ধরে সামলাচ্ছিলেন।কিন্তু কোথা থেকে কি হয়ে গেল!বাড়ির ছেলের মৃত্যুর পরেই এবার পাড়াপ্রতিবেশীদের মুখে খই ফুটতে শুরু করে দিয়েছে। তাদের কাছ থেকেই জানল ঐশী।অর্কর আগের বউ যে ছিল,সে ছিল অত্যন্ত গরীব ঘরের একটি মেয়ে।শিক্ষাদীক্ষা-টাকা-আভিজাত্যে চতুর্দিকে সুখ্যাতি যে পরিবারের,সেই পরিবারের মানুষজন যখন পণের টাকা ও দানসামগ্রী আদায় হেতু বাড়ির বউকে মেরে মেরে আধমরা করে ফেললেও তথাকথিত এই সমাজে তাদের সম্ভ্রম কোথাও যেমনভাবে ক্ষুণ্ণ হয় না ঠিক তেমনভাবেই বিজনেজম্যান রাধাকান্ত মজুমদারের কোটিপতি পরিবারকে সকলে সবকিছু জেনেবুঝেই সামনে থেকে সেলাম ঠুকত।কিন্তু আজ তাদের অভিব্যক্তিতে ঘৃণা স্পষ্ট। অর্কর ঘরের জানলার ভিতর পাড়াপ্রতিবেশীরা প্রতিরাতে দেখতে পেত,পরিত্রাহী চিৎকার করা ক্রন্দনরত মেয়েটির উপর অর্কর নেকড়ের মতো ঝাঁপিয়ে পড়ে তার চুলের মুঠি টেনে ধরে বেধড়ক পেটানোর "মনোহর" দৃশ্য। কয়েক মাস বাদে সে অবশ্য দুর্ঘটনায় মারা যায়,তবে সেটা মৃত্যু না হত্যা সে বিষয়ে সন্দিহান সবাই।ঐশী বিখ্যাত শিল্পপতির একমাত্র কন্যা হলেও তারও দুর্যোগের কালরাত্রি ঘটনাতেই যে বেশি সময় লাগত না তা অনুভব করতে পারল ঐশী।সবক্ষেত্রে অভাব বড় ব্যাপার নয়।লোভ মানুষকে অমানুষ বানায় এবং পরিশেষে তাকে শেষ করে।অর্কর প্রথম বিয়ে গোপন করার জন্য তার প্রথম স্ত্রীর সমস্ত ব্যবহার্য জিনিসপত্রই ঘর থেকে সরিয়ে ডাস্টবিনে ফেলা হয়েছে। কিন্তু ভুলবশত রয়ে গিয়েছিল তার বড় প্রিয় হাতির দাঁতের কারুকার্যখচিত চিরুনিটি।তার সমস্ত অস্তিত্ব মুছে দিতে চাইলেও একটা ছোট্ট ভুলেই তার সমস্ত অস্তিত্ব আজ নির্মমভাবে প্রকট হয়ে পড়েছে যে আজ অর্কর এই পরিণতির পর তার পরিবারের সকলে লজ্জা ঢাকতে একটু কাপড় খুঁজতে আজ ব্যস্ত।চিরুনিটি সবসময় কি যেন বলতে বা বোঝাতে চাইত ঐশীকে,আজ তা ঐশীর কাছে জলের মতো স্পষ্ট। চিরুনির মালকিনের মৃত্যু আজও যেমন একটি রহস্য,ঠিক তেমনভাবেই অর্কর মৃত্যুর কিনারাও আর কেউ করতে পারবে না কোনোদিন। হিসাবটা আসলে খুবই সোজাসাপটা।লোকচক্ষুর অন্তরালে ঘটে যাওয়া এই পাপ এবং দন্ডবিধানের ঘটনাপ্রবাহের অনুঘটক শুধুমাত্র একটি হাতির দাঁতের কারুকার্যখচিত চিরুনি।

রশ্মিতা দাস