...

0 views

শিব নিবাস
আজ বলবো নদীয়ার শিবনিবাস মন্দিরে কথা।নদিয়া জেলার কৃষ্ণনগর থেকে প্রায় ২৬কিলোমিটার দূরত্বে কৃষ্ণগঞ্জ ব্লকের মধ্যে অবস্থিত শিবনিবাস।নদিয়া থেকে মাত্র তিন কিলোমিটার দূরে একটি ছোট্ট গ্রাম মাজদিয়া। এই গ্রামেই রয়েছে এশিয়ার দ্বিতীয় বৃহৎ এবং পূর্ব ভারতের সবচেয়ে বড় ও পুরাতন কষ্টি পাথরের শিব অবস্হিত।
1754 সালে মহারাজ কৃষ্ণচন্দ্র কর্তৃক প্রতিষ্ঠিত এশিয়ার দ্বিতীয় বৃহত্তম শিবমন্দির শিবনিবাস।এই মন্দিরটি প্রায় আড়াইশো বছরের পুরোনো । বড়ো গৌরবময় এই রাজ রাজেশ্বর মন্দির। চূর্ণি নদী দ্বারা বিভক্ত হয়ে এই জায়গায় । শিবনিবাস চুনি বাম তীরে অবস্থিত ।

শিবনিবাসে সারা বছরই লোক যাতায়াত করলেও শিব-ভক্তরা শ্রাবণ মাসে এখানে ভিড় হয় বেশি। শ্রবানের প্রতি সোমবার নবদ্বীপের গঙ্গা থেকে জল নিয়ে ভক্তরা পায়ে হেঁটে শিবনিবাসে এসে শিবের মাথায় জল ঢালে । সারারাত ধরে লাইনে দাঁড়িয়ে ভোর থেকে জল ঢালে ভক্তরা।জল ঢালা চলে সারাদিন ধরে জল । সারা শ্রাবনমাস ধরে মেলা চলে। দূর দূরান্ত থেকে লোক সমাগম হয় শ্রাবণ মাসে।
লোক কথা অনুযায়ী কৃষ্ণনগরের মহারাজা কৃষ্ণচন্দ্র নসরত খাঁ নামে এক ডাকাতকে দমন করতে গিয়ে কৃষ্ণগঞ্জের কাছে গভীর বনের মধ্যে আশ্রয় নিয়েছিলেন। ডাকাত দমন করার পর, ভোরে যখন তিনি চূর্নী নদীতে মুখ ধুচ্ছিলেন, সেই সময় একটি রুই মাছ তার কাছে চলে আসে। তাই দেখে তাঁর সহচর বলেন – রাজভোগ্য জিনিস রাজা না চাইতেই রাজার কাছে উপস্থিত হয়েছে । রাজা যদি এখানে বসবাস করেন তবে রাজার ভালোই হবে।
এদিকে সে সময়ে বর্গীদের আক্রমন খুব বেড়ে গিয়েছিল। রাজা বর্গীদের হাত থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্য এরকমই একটা নিরাপদ জায়গা রাজা খুঁজছিলেন। তখন রাজা কৃষ্ণচন্দ্র তাঁর রাজধানী কৃষ্ণনগরকে মারাঠাদের হাত থেকে বাঁচানোর জন্য সাময়িকভাবে কৃষ্ণনগর থেকে শিবনিবাসে তার রাজধানী স্থানান্তরিত করেন।বাংলায় বর্গী আক্রমণের সময় তাঁর রাজধানীকে সাময়িকভাবে মাজদিয়ায় শহরে আনেন। সেই সময় রাজধানী মাজদিয়াকে সুরক্ষা বলয়ে নিয়ে আসার জন্য খাল কেটে ইচ্ছামতী ও চূর্ণী নদীকে একত্রে জুড়ে দিয়ে একটি জনপদ গঠন করেছিলেন। যেই খালটি আজও কঙ্কণা নদী নামে পরিচিত।
জনশ্রুতি এই সময়ে, মহাদেব নদিয়া-রাজ মহারাজা কৃষ্ণচন্দ্রের স্বপ্নে দেখা দিয়েছিলেন। মহাদেবকে সন্তুষ্ট করতে তখন মহারাজা শিবনিবাসে মন্দির স্থাপন করেছিলেন। ভগবান শিবের নামে নামকরণ করা রাজ রাজেশ্বর মন্দিরটি ১৬৭৬ শকাব্দ বা ১৭৫৪ খ্রিস্টাব্দে নির্মাণ করেন। তবে এই মন্দিরে স্থাপিত শিবলিঙ্গ এশিয়ার বৃহত্তম বলে মনে করা হয়। ভগবান মহাদেবের সম্মানে ১০৮ টি মন্দির নির্মাণ করেছিলেন বলে অনেক দাবি করেন। বর্গীরা শিব ভক্ত ছিলেন, সে কারণেও মন্দির করছিলেন বলে অনেক বলে থাকেন। রাজধানী স্থানান্তরিত পরে মহারাজা সম্ভবত এই জায়গাটির নাম শিবনিবাস নামকরণ করেন। তাঁর পুত্র শিবচন্দ্রের নামে রাখা হয়েছিল শিব নিবাস নামটি অনেক বলেন ।
মন্দিরের চূড়া সমেত মন্দিরের উচ্চতা ১২০ ফুট। আটকোনা মন্দির, প্রতিটি কোনায় মিনার ধরনের সরু থাম আছে। মন্দিরের ভিতর কালো শিবলিঙ্গ, উচ্চতা ১১ ফুট ৯ ইঞ্চি, বেড় ৩৬ ফুট। সিঁড়ি দিয়ে উঠে শিবের মাথায় জল ঢালতে হয় এখানে। পূর্ব ভারতে এতো বড় শিবলিঙ্গ আর নেই। মন্দিরের ছাদ ঢালু ও গম্বুজ। মন্দিরে আছে পোড়ামাটি কাজ ও গথিক স্থাপ্যশৈলীর কাজ দেখার মতো।
এবারে শিবনিবাস কেন "বাংলার কাশী" খ্যাতিলাভ করে সেই গল্পে বলি জনশ্রুতি মতে, রাজা কৃষ্ণচন্দ্র কাশীর শিবের স্বপ্নাদেশ পান যে, তিনি কাশী ছেড়ে কৃষ্ণচন্দ্রের হাতে পূজা পেতে চান। সেই আদেশ পালনার্থেই কৃষ্ণচন্দ্র একশো আটটি শিবমন্দির স্থাপন করেন। যদিও যার অধিকাংশই কালের গর্ভে হারিয়ে গেছে। এদিকে শ্রী শশিভূষণ বিদ্যালঙ্কার সঙ্কলিত "জীবনীকোষ" (ভারতীয় ঐতিহাসিক) দ্বিতীয় খন্ডে উল্লেখ আছে, শিবনিবাস প্রতিষ্ঠার পর কাশী ও কাঞ্চী থেকে আগত ব্রাক্ষ্মণগণের উপস্থিতিতে মহারাজ কৃষ্ণচন্দ্র অগ্নিহোত্র বাজপেয় যজ্ঞ সম্পন্ন করেন এবং ব্রাক্ষ্মণ কর্তৃক মহারাজ "অগ্নিহোত্রী বাজপেয়ী" উপাধি পান । তাই শিব নিবাস কাশী তুল্য।

পথ নির্দেশনা+
শিয়ালদহ থেকে গেদে লোকালে মাজদিয়া পৌঁছানো যায়। সেখান থেকে টুকটুকি করে শিবনিবাস যাওয়া যায়।অথবা;শিয়ালদহ থেকে কৃষ্ণনগর লোকাল ধরে কৃষ্ণনগরে পৌঁছে সেখানে থেকে টুকটুকিতে বাসস্ট্যান্ড আসতে হবে। তারপর বাসস্ট্যান্ড থেকে মাজদিয়ার বাসে করে শিবনিবাস মোড়ে নামতে হয়।






© Manab Mondal