চেনা অচেনা
# চেনা- অচেনা
কলমে---- দেবাঞ্জলি চক্রবর্ত্তী।
নীলদা সাথেই আছে তবুও আজ হাত আমার কাঁপছে। ইস কি ভাববে ও? নির্ঘাৎ মনে করবে এগুলো ইচ্ছা করে করছি আমি। এই যে, কত বিরক্তি ঠিকরে পড়ছে ওর চোখ বেয়ে। আজকাল ওর কঠিন চোখের দিকে তাকালে আমার কেমন ভয়ে বুকটা শুকিয়ে আসে। মাঝে মাঝে তো মনে হয় এ আমার নীলই নয় অন্য কেউ। কত পার্থক্য দুজনের! এ শুধু অরনির নীল। এই যে নীলের পরনে আজ মেরুন কালারের কাতুয়া ধবধবে সাদা প্যন্ট,হাতে দামি ঘড়ি, ব্রান্ডেড স্যু । আমি জানি এগুলো অরনির পছন্দে কেনা। অরনি বরাবরই ভীষণ আধুনিকা, স্টাইলিস। ওকে দেখলে মনে হয় এই বুঝি শোকেস থেকে বেরিয়ে এলো। আজকাল নীল ও কেমন অরনির মতো হয়ে যাচ্ছে। ও আমি তো ভুলেই যাচ্ছি, এখন তো অরনিরই নীল।
এই নীলের থেকে আমার নীল একেবারেই আলাদা ছিল। আমার নীলের পরনে থাকতো আকাশ নীল অথবা ধুসর রঙের পাঞ্জাবি আর যা খুশি প্যন্ট। পরিশ্রান্ত কাঁধে একটা আধছেঁড়া ব্যগ, এক মাথা শুষ্ক চুল, শুঁকিয়ে যাওয়া দুটো ঠোঁট, ক্লান্ত শরীর কিন্তু আত্মবিশ্বাসে ভরা দুটি নিখুঁত চোখ। যে চোখের দিকে তাকালে ভুলে যাওয়া যেত সমস্ত পৃথিবী। যার গভীরতায় ডুব দিয়ে কতদিন আমি মরেছি ভালোবাসার মরণে।
ও আমাকে বলতো, আমাকে দেখলেই নাকি ওর মনের জোর আসে। আমিই নাকি ওর হৃদয়ের শক্তি।
আজ বড় জানতে ইচ্ছে করছে,,, সত্যি যদি সেটা সত্য হতো তবে আজ আমরা এখানে কেন? তবে কি প্রথম থেকেই আমার কোন মুল্যই ছিল না ওর কাছে। নীল শুধুই খেলেছে আমার সাথে? কেন? কেন খেললো এমন করে? তবে কি আমার সাথে খেলা যায় জন্যই খেলেছে?
নীল আমার পাশের বাসায় থাকতো। ওর বাবা-মা মারা যাওয়ার পর কাকা- জ্যেঠাদের সংসারে অনাদরেই মানুষ হচ্ছিল। মা ই তো কত আদর স্নেহ দিতো। আর বাবা সারাদিনে স্কুল কোচিংয়ে পড়ানোর পর ওকে পড়াতো একদম ছেলের মতো। আস্তে আস্তে ও আমাদের সংসারের অংশ হয়ে উঠেছিল। তাই হয়তো মাও ওর সাথে মেলামেশা করতে নিষেধ করতো না কখনো। মেধাবী নীলের ফাস্ট হওয়াটা রেওয়াজ হয়ে গিয়েছিল , আমারটা মোটামুটি। আমার রেজাল্ট খারাপ হলে বিনুনি টেনে বলতো,,সারাদিন তো তোর আমার কথা চিন্তা করেই কেঁটে যায় পড়বি টা কখন?
নীলদা তো আমার বলার আগেই জানতো আমি ওর চিন্তায় ডুবে আছি,,,তাহলে!!!?? আজ কেন বুঝতে পারে না। হয়তো চায়ই না, আমায় বুঝতে। আসলেই অরনির সামনে বড় বেমানান আমি। আর এই নীল কি আর আমার সেই নীল আছে? এ তো এখন মস্ত চাকুরে, লাখ টাকা মাসের বেতন। আমার নীলের তো ছিল কয়েকটা টিউশন আর রাত জেগে বই পড়া। আসলেই বড্ড অমিল দুজনের।
খুব শক্ত করে হাতটা মুঠো করে ওর চোখের দিকে না তাকিয়েই বললাম,,, "" এতো চিন্তা করছো কেন? আমি তো বলেছি তোমার জীবনে আমি কোন ঝামেলা করতে যাব না। আমার বাবা মারা গেছে তার দায় তোমার নয়! বাবা বেঁচে থাকতেও তোমায় মানুষ করার কোন মুল্য চান নি তবে মারা যাওয়ার পরে এ কথা উঠছে কেন? তুমি নিজের জীবনে মুক্ত। সম্পূর্ণ মুক্ত। ""
নীলদা কেমন অদ্ভুত দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে আমার দিকে। না আর কিছু নয়, কোন স্বপ্ন নয়, কোন আশা নয় --- ভেবেই উঠে গেলাম। আজকাল ওর পাশে থাকলেই কেমন দম বন্ধ হয়ে আসে। বুকের ভিতর অদ্ভুত কিছু ব্যথা বজ্রপাতের মতো আঘাত করতে থাকে। বরং ওর থেকে দুরে থাকা ভালো, এতে স্মৃতির আনন্দ থাকলেও বাস্তবের মতো কঠিন পাথরের আঘাত সহ্য করতে হয় না। খুব ইচ্ছে করছে একবার পিছন ফিরে ওর মুখটা দেখি। সামলে নিলাম নিজেকে। যেটুকু সম্মান আছে, সেটুকুও গেলে যে জীবন মৃত্যুর মতো মনে হবে! ভালোবাসার মানুষটাকে ঘৃনা করার মতো কষ্টের আর কি হতে পারে। তাই অতি কষ্ট সামনের দিকে দৃষ্টি ফেরালাম। পিছনে ফিরে দেখার সময় নাই, অধিকার ও নাই। বাবা চলে গেলেন, বাড়িতে নিত্য দারিদ্র্যের হাহাকার এবার একটা চাকুরি না করলেই যে নয়। নতুন করে এসব ভাবনার সময় কোথায় আর?
সারা রাত ঘুম না আসা ক্লান্ত চোখ গুলো ভোরের ঠান্ডা বাতাসের আলতো ছোঁয়ায় কেবল ঘুমের চাদর জরিয়ে নিয়েছে। ঠিক এমন সময় লেটেস্ট মডেলের আইফোনটা তার অতি আকর্ষণীয় ভঙ্গিতে বেজে উঠলো। ওর জন্মই তো আকর্ষনের জন্য। সে ঘুমন্ত হোক আর কর্মব্যস্ত। ওর প্রাধান্য সবার আগে।
কিন্তু আজ কিছুটা বেতাল যেন,,,আইফোনটা পর পর কয়েকবার ডেকে গিয়ে বিরক্ত হয়ে থেমেও গেলো, কিন্তু তার পাগল অনুরাগীর আজ কোন পাত্তাই নেই। যাও বা পাঁচবারে একটু সারা দিল, তখন আবার হাতে নিয়ে ছুঁড়ে ফেলে দিলো অদূরে সোফার উপরে।
এতে বেচারা আইফোনের মানসম্মান না গেলেও যার জন্য তার এতো চেষ্টা, সেই অপর দিকের প্রাণীটির স্বর্ণাভ গাল দুটো গরম হয়ে রক্তাভ হয়ে উঠলো। কান দুটোরও রং বদলে গেলো। আর সাথে সাথে ঝড়ের বেগে, গাড়িতে বসে, সাত সকালে মোটামুটি হাইস্পিডে সেই লোককে ধরতে গেলো যে তার কল রিসিভ না করার অপরাধ করেছে!! সে আজ মর্নিং উইসটাও করে নি ! অরনি সবটা সহ্য করে নিতে পারে কিন্তু অবহেলা নয়। সে যেই হোক, ওর পাওনা জোর করে হলেও আদায় করতে জানে অরনি। তাই বেশ রাগে...