...

5 views

চেনা অচেনা

# চেনা- অচেনা
কলমে---- দেবাঞ্জলি চক্রবর্ত্তী।

নীলদা সাথেই আছে তবুও আজ হাত আমার কাঁপছে। ইস কি ভাববে ও? নির্ঘাৎ মনে করবে এগুলো ইচ্ছা করে করছি আমি। এই যে, কত বিরক্তি ঠিকরে পড়ছে ওর চোখ বেয়ে। আজকাল ওর কঠিন চোখের দিকে তাকালে আমার কেমন ভয়ে বুকটা শুকিয়ে আসে। মাঝে মাঝে তো মনে হয় এ আমার নীলই নয় অন্য কেউ। কত পার্থক্য দুজনের! এ শুধু অরনির নীল। এই যে নীলের পরনে আজ মেরুন কালারের কাতুয়া ধবধবে সাদা প্যন্ট,হাতে দামি ঘড়ি, ব্রান্ডেড স্যু । আমি জানি এগুলো অরনির পছন্দে কেনা। অরনি বরাবরই ভীষণ আধুনিকা, স্টাইলিস। ওকে দেখলে মনে হয় এই বুঝি শোকেস থেকে বেরিয়ে এলো। আজকাল নীল ও কেমন অরনির মতো হয়ে যাচ্ছে। ও আমি তো ভুলেই যাচ্ছি, এখন তো অরনিরই নীল।

এই নীলের থেকে আমার নীল একেবারেই আলাদা ছিল। আমার নীলের পরনে থাকতো আকাশ নীল অথবা ধুসর রঙের পাঞ্জাবি আর যা খুশি প্যন্ট। পরিশ্রান্ত কাঁধে একটা আধছেঁড়া ব্যগ, এক মাথা শুষ্ক চুল, শুঁকিয়ে যাওয়া দুটো ঠোঁট, ক্লান্ত শরীর কিন্তু আত্মবিশ্বাসে ভরা দুটি নিখুঁত চোখ। যে চোখের দিকে তাকালে ভুলে যাওয়া যেত সমস্ত পৃথিবী। যার গভীরতায় ডুব দিয়ে কতদিন আমি মরেছি ভালোবাসার মরণে।
ও আমাকে বলতো, আমাকে দেখলেই নাকি ওর মনের জোর আসে। আমিই নাকি ওর হৃদয়ের শক্তি।
আজ বড় জানতে ইচ্ছে করছে,,, সত্যি যদি সেটা সত্য হতো তবে আজ আমরা এখানে কেন? তবে কি প্রথম থেকেই আমার কোন মুল্যই ছিল না ওর কাছে। নীল শুধুই খেলেছে আমার সাথে? কেন? কেন খেললো এমন করে? তবে কি আমার সাথে খেলা যায় জন্যই খেলেছে?

নীল আমার পাশের বাসায় থাকতো। ওর বাবা-মা মারা যাওয়ার পর কাকা- জ্যেঠাদের সংসারে অনাদরেই মানুষ হচ্ছিল। মা ই তো কত আদর স্নেহ দিতো। আর বাবা সারাদিনে স্কুল কোচিংয়ে পড়ানোর পর ওকে পড়াতো একদম ছেলের মতো। আস্তে আস্তে ও আমাদের সংসারের অংশ হয়ে উঠেছিল। তাই হয়তো মাও ওর সাথে মেলামেশা করতে নিষেধ করতো না কখনো। মেধাবী নীলের ফাস্ট হওয়াটা রেওয়াজ হয়ে গিয়েছিল , আমারটা মোটামুটি। আমার রেজাল্ট খারাপ হলে বিনুনি টেনে বলতো,,সারাদিন তো তোর আমার কথা চিন্তা করেই কেঁটে যায় পড়বি টা কখন?
নীলদা তো আমার বলার আগেই জানতো আমি ওর চিন্তায় ডুবে আছি,,,তাহলে!!!?? আজ কেন বুঝতে পারে না। হয়তো চায়ই না, আমায় বুঝতে। আসলেই অরনির সামনে বড় বেমানান আমি। আর এই নীল কি আর আমার সেই নীল আছে? এ তো এখন মস্ত চাকুরে, লাখ টাকা মাসের বেতন। আমার নীলের তো ছিল কয়েকটা টিউশন আর রাত জেগে বই পড়া। আসলেই বড্ড অমিল দুজনের।

খুব শক্ত করে হাতটা মুঠো করে ওর চোখের দিকে না তাকিয়েই বললাম,,, "" এতো চিন্তা করছো কেন? আমি তো বলেছি তোমার জীবনে আমি কোন ঝামেলা করতে যাব না। আমার বাবা মারা গেছে তার দায় তোমার নয়! বাবা বেঁচে থাকতেও তোমায় মানুষ করার কোন মুল্য চান নি তবে মারা যাওয়ার পরে এ কথা উঠছে কেন? তুমি নিজের জীবনে মুক্ত। সম্পূর্ণ মুক্ত। ""

নীলদা কেমন অদ্ভুত দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে আমার দিকে। না আর কিছু নয়, কোন স্বপ্ন নয়, কোন আশা নয় --- ভেবেই উঠে গেলাম। আজকাল ওর পাশে থাকলেই কেমন দম বন্ধ হয়ে আসে। বুকের ভিতর অদ্ভুত কিছু ব্যথা বজ্রপাতের মতো আঘাত করতে থাকে। বরং ওর থেকে দুরে থাকা ভালো, এতে স্মৃতির আনন্দ থাকলেও বাস্তবের মতো কঠিন পাথরের আঘাত সহ্য করতে হয় না। খুব ইচ্ছে করছে একবার পিছন ফিরে ওর মুখটা দেখি। সামলে নিলাম নিজেকে। যেটুকু সম্মান আছে, সেটুকুও গেলে যে জীবন মৃত্যুর মতো মনে হবে! ভালোবাসার মানুষটাকে ঘৃনা করার মতো কষ্টের আর কি হতে পারে। তাই অতি কষ্ট সামনের দিকে দৃষ্টি ফেরালাম। পিছনে ফিরে দেখার সময় নাই, অধিকার ও নাই। বাবা চলে গেলেন, বাড়িতে নিত্য দারিদ্র্যের হাহাকার এবার একটা চাকুরি না করলেই যে নয়। নতুন করে এসব ভাবনার সময় কোথায় আর?

সারা রাত ঘুম না আসা ক্লান্ত চোখ গুলো ভোরের ঠান্ডা বাতাসের আলতো ছোঁয়ায় কেবল ঘুমের চাদর জরিয়ে নিয়েছে। ঠিক এমন সময় লেটেস্ট মডেলের আইফোনটা তার অতি আকর্ষণীয় ভঙ্গিতে বেজে উঠলো। ওর জন্মই তো আকর্ষনের জন্য। সে ঘুমন্ত হোক আর কর্মব্যস্ত। ওর প্রাধান্য সবার আগে।
কিন্তু আজ কিছুটা বেতাল যেন,,,আইফোনটা পর পর কয়েকবার ডেকে গিয়ে বিরক্ত হয়ে থেমেও গেলো, কিন্তু তার পাগল অনুরাগীর আজ কোন পাত্তাই নেই। যাও বা পাঁচবারে একটু সারা দিল, তখন আবার হাতে নিয়ে ছুঁড়ে ফেলে দিলো অদূরে সোফার উপরে।

এতে বেচারা আইফোনের মানসম্মান না গেলেও যার জন্য তার এতো চেষ্টা, সেই অপর দিকের প্রাণীটির স্বর্ণাভ গাল দুটো গরম হয়ে রক্তাভ হয়ে উঠলো। কান দুটোরও রং বদলে গেলো। আর সাথে সাথে ঝড়ের বেগে, গাড়িতে বসে, সাত সকালে মোটামুটি হাইস্পিডে সেই লোককে ধরতে গেলো যে তার কল রিসিভ না করার অপরাধ করেছে!! সে আজ মর্নিং উইসটাও করে নি ! অরনি সবটা সহ্য করে নিতে পারে কিন্তু অবহেলা নয়। সে যেই হোক, ওর পাওনা জোর করে হলেও আদায় করতে জানে অরনি। তাই বেশ রাগে আবার উদ্বেগে দিল ছুট সারে আটশো গজ দুরত্বের এপার্টমেন্টে। সটাং চলে গেলো পাঁচতলার রিভার ভিউ ওয়ালা দুই হাজার স্কয়ার ফুটের ফ্লাটে। অনবরত কলিং বেলের শব্দে বেরিয়ে এলো সদ্য ঘুম থেকে ওঠা নীলাদ্রি রায় নীল।

অরনি-- এই নীল তোমার কি হয়েছে বেবি,, আমি তো ভীষণ ভয় পেয়ে গিয়েছি। তুমি আমার ফোন তুলছো না।

অন্যদিন অরনির এই ন্যকা কথা নীলের বেশ ভালো লাগলেও আজ খুব বিরক্ত লাগছে। তাই দরজা থেকে সরে এসে বললো,,,ঘুমিয়ে গিয়েছিলাম, বুঝতে পারি নি।""

অরনি--- প্রচন্ড রাগকে চেপে রেখে,, "" তুমি তো জানো সকাল বেলা তোমার সাথে কথা না বললে আমার দিনটা ফিকে হয়ে যায়,,,জান। ""

নীলাদ্রি --- একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে,,,সরি,,,

অরনির মুখে একটা জয়ের হাসি,, আবার নেকা কন্ঠে বললো,,শুধু সরিতে কাজ হবে না। রেডি হয়ে এসো আমরা একসাথে বাইরে ব্রেকফাস্ট করবো।

নীল যন্ত্র চালিত মানুষের মতো ফ্রেস হতে চলে গেলো। ও জানে অরনির ইচ্ছার বাইরে কিছু করা যায় না। তাহলে ও যে কি করবে নিজেও জানে না।

নীলাদ্রির এই শান্ত স্বভাবই অরনির পছন্দ। সেই ভার্সিটি থেকে। কত শুনেছে এর কথা তৃষ্ণার কাছে। সেই মেডেল ক্লাস মেয়েটা নীলের নোটস বেশ গর্বের সাথে শেয়ার করতো অরনির সাথে। বেশ ভালো লেগেছিল অরনির নীলাদ্রিকে যেদিন তৃষ্ণা ওর সাথে নীলাদ্রির দেখা করিয়েছিল। তারপর এই নীলাদ্রিকে যেদিন নিজেদের কোম্পানিতে চাকুরি করতে দেখে, সেদিন আনন্দে পাগল হয়ে গিয়েছিল অরনি। আস্তে আস্তে সে গ্রহনের মতো সমস্ত নীলকে গ্রাস করেছে। আর মধ্যবিত্ত নীল হঠাৎ আভিজাত্যের ঝলকে, আপার ক্লাসে ওঠার মোহে, কেমন অন্ধের মতো অরনির হাতের পুতুল হয়ে উঠছে। অরনির বিয়েও ঠিক হয়েছে নীলের সাথে। এমন স্মার্ট, কর্মপটু, সুদর্শন আর বিশ্বাসী ছেলেকে হাত ছাড়া করতে চায় না স্বয়ং অরনির বাবা অলক মিত্র। তাই এই ব্যবস্থা।

কিন্তু কদিন থেকে নীলাদ্রিকে কেমন চেঞ্জড মনে হচ্ছে অরনির। কেমন নিস্তেজ একটা ভাব সব সময়। হঠাৎ এর কি কারণ এ নিয়ে বেশ চিন্তিত অরনি। যদিও তার সুহৃদ এর অভাব নেই, তবুও নীলাদ্রি যে একজনই এই পৃথিবীতে। তাকে কোন ভাবেই হারাতে চায় না অরনি।

অরনি ও নীল দুজনই বসে আছে পথের ধারে একটা খোলা ক্যফেতে। ব্রেকফাস্ট অর্ডার দিয়ে অরনি নীলাদ্রির দিকে তাকালো এই সুন্দর মুহুর্তটাকে আরও সুন্দর করতে ভালোবাসা রাঙানো কথায় হারিয়ে যেতে। কিন্তু সে নিরুৎসাহিত হলো নীলাদ্রির চিন্তায় বন্ধ চোখের দিকে তাকিয়ে। তার রাতজাগা অবসন্ন মুখের দিকে তাকিয়ে।
অরনি বিরক্ত মুখে প্রশ্ন করলো,,,কি হয়েছে বলো তো? তুমি এরকম ব্যবহার করছো কেন?

নীলাদ্রি যেন জানতো অরনি এ প্রশ্ন করবে। তাই একটু আদ্র স্বরেই উত্তর দিলো,,, "" মাষ্টার জ্যেঠু মারা গেছে। ""

অরনি---কে?

নীলাদ্রি ---- তৃষ্ণার বাবা।

অরনি---- ওহ,,,তাতে কি হয়েছে? নিশ্চই বয়স হয়েছিল?

নীলাদ্রি ---- না স্ট্রোক করেছে।

অরনি--- বেশ বিরক্তিমাখা কন্ঠে,,, সে জন্য কি এই সুন্দর সকালটা নষ্ট করবে?

নীলাদ্রি ---- উদাস কন্ঠে,, ""ওদের পরিবারটা আর্থিক সমস্যায় পরেছে।""

অরনি---- এমন কোন মধ্যবিত্ত নেই যার টাকার প্রব্লেম নেই। নিশ্চই তোমার কাছে টাকা চেয়েছে। তবে মুখের উপর ছুড়ে দাও কিছু টাকা। ওরাও খুশি হবে তোমার ঋৃনও শোধ হবে। আমি তৃষ্ণার কাছে কিছুটা শুনেছি তোমার অতীত। ইস,,,যদি আমি তোমার এরকম নোংড়া অতীতটা মুছে দিতে পারতাম।

নীলাদ্রি ---- জ্বলজ্বল করা চোখে,,,"" অরনি তুমি কি আমার অতীতকে ঘৃণা করো?

অরনি---- অবশ্যই,,,কি নোংড়া লাগে শুনতে,, তুমি ঐ তৃষ্ণাদের বাসায়,, ছি,,,আমার তো ভাবলেই কেমন লাগে।

নীলাদ্রি --- গম্ভীর কন্ঠে,,, ""তুমি কি জানতে তৃষ্ণা আমায় ভালোবাসতো?"""

অরনি হালকা হেসে "" আমি কেন আমাদের পুরো কলেজ জানতো ও তোমার জন্য পাগল ছিল । আর তোমাকে দেখার পর আমি বুঝেছিলাম, সেটা স্বাভাবিক। তোমার ওকে না ভালোবাসাটাও স্বাভাবিক। তুমি অনেক ভালো ডিজার্ভ করো,,, বেবী।

নীলাদ্রি ---- ওকে আমিও ভালোবাসতাম এটা জানো?

অরনি,,,উফ বেবি তুমি আজ কি শুরু করলে বলো তো?

দেখ তোমার মতো এরকম হ্যন্ডসাম ছেলের এরকম একটা অতীত থাকতেই পারে। বাট আমি তোমার প্রেজেন্ট। আর আমি জানি তৃষ্ণা রুপে, গুনে,টাকায়, সামাজিক মর্যাদায় আমার নখের যোগ্যও নয়। তাই সে পথে তুমি যাবে না। আর তৃষ্ণার উপর আমার রাগ নেই। আফটার অল সেই তো আমাদের মিট করিয়েছিল।
(একটা অহংকারের হাসি ফুটে ওঠে অরনির মুখে)
আর তার সাথে নীলাদ্রির বুকে ঝড় ওঠে আবার।

গত মাসে মাষ্টার জ্যেঠু মৃত্যুর পর ও ছুটে গিয়েছিলো তৃষ্ণাদের বাড়ি। তৃষ্ণার চোখ যে কত কষ্ট প্রকাশ করছিল, সবটা বুঝেছিল নীলাদ্রি। কিন্তু একবারের জন্য আগের মতো বুকে ঝাঁপিয়ে পরে কেঁদে ওঠেনি মেয়েটা। যেন কতটা অছ্যুৎ আজ নীলাদ্রি। তার সর্বহারা দৃষ্টি নীলাদ্রির আভিজাত্য লোভী মনকে টুকরো টুকরো করে দিয়েছিলো।
তারপর বার বার অনেক ভাবে সাহায্য করতে চেয়েও ব্যর্থ হতে হয়েছে। তৃষ্ণার এই লৌহ কঠিন মানসিক শক্তি নীলাদ্রির আলেয়া লোভী মনকে যেন ব্যঙ্গ করেছে। কাল শেষ চেষ্টা করেছিল নীলাদ্রি। অভিমানী মেয়েটা কোন কিছু বলার সুযোগই দেয় নি। নিজের মনে হরবর করে কি সব বলে চলে গেলো। তারপর থেকেই কেমন নিঃস্ব লাগছে নিজেকে। পুরোনো স্মৃতি গুলো মনে করে বুকটা বেয়ে একটা চোরা স্রোত চোখের উঠে আসছে। পাগলি মেয়েটার বাচ্চা,বাচ্চা খুনসুটি গুলো চোখের সামনে ভেসে উঠছে। আবার ফিরে যেতে ইচ্ছে করছে সেই সময়টায় যখন তৃষ্ণার সাথে কৈশরের প্রতিটা দিন স্বপ্নের মতো কেটে যেতো। তখন এই দোটানা ছিল না, মনে লোভ ছিল না, ছিল শুধু এক নৈসর্গিক আবেগের শোভা।

অরনি --- কি হলো বেবি অনেক বেলা হলো অফিসে যাবে না?

( কফিটা শেষ করার পরও যখন নীলাদ্রি ঠায় বসে কিছু ভাবছে। তা দেখে বিরক্ত হয়েই বললো অরনি)

নীলাদ্রি--- একটু হেঁসে,,, "" চাকুরী টা আমি ছেড়ে দিয়েছি অরনি।""

অরনি--- হোয়াট!!! তোমার মাথা ঠিক আছে? চাকুরী ছেড়েছো মানে? আর কেনই বা ছারবে? ড্যাড কিছু বলেছে তোমায়? আমাকে বলো বেবি,,,,

নীলাদ্রি ---- না,, তোমার বাবা কিছু বলে নি। আমি নিজেই ছেড়েছি। আসলে তোমার ড্যাড আমার সাথে মেয়েকে বিয়ে দেয়ার জন্য পর পর দুটো প্রমোশন দেন। যেগুলোর আসল দাবিদার কম্পানির পুরোনো এমপ্লয়িরা। আমার জন্য তারা অনেকেই অসন্তুষ্ট। আর সেটা তোমাদের কাছে কোন ব্যপার না হলেও আমার কাছে অত্মসম্মানের পরিপন্থী। তাই ছেড়ে দিলাম।

অরনি--- তোমার ফ্লাটের মাত্র তিনটা ই এম আই দিয়েছো,,,কি করবে? তুমি চাইলে আমি ড্যাডকে বলতে পারি।

নীলাদ্রি ----- কাল আমি ওদের জানিয়ে দিয়েছি ফ্লাটটা আর আমি অ্যফোর্ড করতে পারবো না। আর গাড়িটা যেটা তোমার বাবা অফিসের ব্যবহারের জন্য আমাকে দিয়েছিলেন আমি সেটা অফিসে ফেরত পাঠিয়েছি। তোমার বাবা অবশ্য নিতে চান নি, কিন্তু চাকুরী হীন বেকার মানুষের গাড়িতে তেল কেনার সামর্থ কোথায়। তুমি আমার এ্যকাউন্টের অবস্থা জানো। সেটা জিরো। এখন আমি ঠিক সেখানে দাঁড়িয়ে আছি যেখানে এক বছর আগে ছিলাম। তোমার ভাষায় ভিখারি। আরবএই যে তুমি আমাকে এতো দামী ব্রেকফাস্ট করালে আমার মানিব্যগ এর পর থেকে জিরো। সেটা ফেলে দিব আমি। সেরকম একটা মানুষ ফ্লাটে শুয়ে কি করবে। তুমি তোমার বাবাকে কিছুই বলো না। আমি আমার মতো গুছিয়ে নেই।

অরনি অবাক চোখে তাকিয়ে আছে নীলাদ্রির দিকে। এই সত্যগুলো মানতে বেশ কষ্ট হচ্ছে সেটা ওর মুখ দেখে বোঝাই যাচ্ছে। এসময় ওর ফোনটা বেজে উঠলো৷ একজন খুব কড়া গলায় ঝাঁঝিয়ে উঠলেন অরনির উপর। তার কথায় বোঝা গেলো অরনির নীলাদ্রির কাছে আসাটা তিনি মোটেও মেনে নিবেন না। এটাই লাস্ট টাইম, বেশ কঠিন ভাবে অরনিকে তার সীমা বুঝিয়ে দেয়া হলো।
অরনির চোখেও নীলাদ্রির জন্য বিতৃষ্ণা। সে প্রায় নির্লিপ্ত গলায় বললো,,,"" তোমরা মিডেল ক্লাস মানুষরা জাস্ট আনবিলিভএবল। কি চাও তা নিজেও জানো না। বড় হতে চাও কিন্তু তার জন্য কাজ করতে চাও না। ওকে ড্যাড চায় না যে আমি তোমার সাথে আর কোন প্রকার যোগাযোগ রাখি। তুমি নাকি বেশ ইনসাল্ট করেছো তাকেও। ওকে বেস্ট অফ লাক তোমার ভিখারি জীবনকে। তবে কখনো মুড চেঞ্জ হলে চলে এসো। তোমাকে এই মিডেলক্লাস জীবন থেকে মুক্তি দিতে আমার হাত বাড়িয়েই থাকবো। আর কি বলোতো? আমি জানি তুমি ফিরবে।

নীলাদ্রি হালকা হাসলো শুধু। তারপর বললো মিডেল ক্লসের কথা বইয়েই পরেছো আর আমার মতো ব্যক্তিত্ব হীনকে দেখেছো বলেই হয়তো বলতে পারলে। তৃষ্ণার বাবাকে দেখলে বুঝতে এ যে কত অহংকার। দারিদ্রতার মাঝেই যে জীবনের আসল মজা। নিত্য আভিজাত্য মানুষের মনকে অলস করে। অভাব মানুষকে শক্ত হওয়া শেখায়। দৃষ্টিভঙ্গি পরিবর্তন করে।অরনি---- হেল অফ ইওর মেডেল ক্লাস ভাষণ। বাই
( বলে চলে গেলো অরনি।)
আর উচ্চস্বরে হেঁসে নীলাদ্রি উড়িয়ে দিলো এই মেকি ভালোবাসার সমস্ত ভার কে।
______________________________

আজ তৃষ্ণার বাড়ি পৌঁছাতে সন্ধ্যা পার হয়ে গেলো। গলির মুখে ভাঙা বাড়িটার সামনে যেতে বরাবরই ওর প্রচন্ড ভয় লাগে। কিন্তু রিক্সা এ গলির ভিতরে আসতে পারে না। তাই আধা কিলোমিটার রাস্তা ওকে একাই যেতে হবে তাও হেঁটে। কিন্তু তৃষ্ণা জানে ঐ ভাঙা বাড়ির ভিতর কিছু মানুষরুপি জানোয়ার থাকে। যারা রাস্তায় যাওয়া আসার সময় মেয়েদের নিয়ে অশ্লীল কথা ছোরে। কিন্তু আজ কখন যে এতোটা সময় পার হয়ে গেলো। এই এক সমস্যা তৃষ্ণার পড়াতে শুরু করলে দুনিয়ার কোন কথা মনেই থাকে না। আজ এতো বেশি দেরী হয়ে গেলো। কোন মানুষ জন ও রাস্তায় নেই।

হঠাৎ তৃষ্ণার সামনে এগিয়ে এলো দুটো ছায়া শরীর। তৃষ্ণা ভয়ে কুকরে গেলো। পিছন পিছাতে গেলে ওর পিঠ ঠেকে গেলো কারও চওড়া বুকে। সে শরীর থেকে ছড়িয়ে পরা গন্ধ খুব চেনা, এ স্পর্শ ও খুব চেনা। তবে কি মিথ্যে স্বপ্নের মালিক এলো?
মুহুর্তেই মাথা ঘুড়িয়ে রোড লাইটের অনুজ্জল আলোয়, তৃষ্ণা দেখলো তার মনের ইঙ্গিত মিথ্যা নয় এ যে সয়ং নীলাদ্রি। তবে আজ তার আবার এ কোন রুপ? কেন তার পরনে সেই পুরোনো ফ্যকাশে পাঞ্জাবি, কাঁধে জীর্ণ ব্যগ, মুখে ক্লান্তির স্পষ্ট ছাপ। চোখে সেই আত্মবিশ্বাসের ঝলকটা নেই এই মৃদু আলোর মতোই নীলাদ্রির চোখ জোড়াও টিমটিম করে জ্বলছে। যেন বড়ই ক্লান্ত তারা।
তৃষ্ণা ভুলে গেল কয়েক সেকেন্ড আগে তার মানসিক অবস্থা, নিজের এতো বিপদের কথা। তৃষ্ণার মন এখনো উদ্বিগ্ন, তবে নিজের জন্য নয় সামনে দাড়ানো মানুষটার কথা ভেবে। মাস খানিক আগের দেখা সুসজ্জিত মানুষটার এরকম বিদ্ধস্ত অবস্তা কিরকম অবাস্তব মনে হচ্ছে।

ততক্ষনে অন্ধকারে ওত পেতে থাকা মানুষ রুপি প্রেতাত্মারা সরে গেছে নীলাদ্রিকে নতুন করে মাপার দুঃসাহস ওদের নেই। তাই এই নির্জন রাস্তায় দুটো কৌতুহলে পূর্ণ চোখ খুঁজে চলছে এর কারণ। কিন্তু মন জিনিসটাও বেশ অদ্ভুত নীলাদ্রির এই অবস্থা দেখে অবাক হলেও খারাপ লাগছে না। যেন আভিজাত্যের ভীরে হারিয়ে যাওয়া মানুষটা আজ পথ খুঁজে চলে এসেছে। এতে আনন্দ আছে কষ্ট নেই। তবে অভিমান আছে পাহাড় সমান। এতো অভিমানের পাহাড় ডিঙ্গিয়ে অনেকেই তার খুঁজে পাওয়া রাস্তায় চলতে পারে না।

নীলাদ্রি ----- তোকে কতবার বলেছি না এইসময় বাড়ি ফিরবি না।( গলায় রাগের স্বর স্পষ্ট)

তৃষ্ণা---- তোমার অনেক কথাই আমি মানি না আজকাল।

বলেই তৃষ্ণা হাটা দিলো বাড়ির পথে। অনুসরণ করলো নীলাদ্রি। আজ অনেকদিন পর ওর মুখে সেই স্নিগ্ধ হাসিটা। তবে মুখে শুষ্কতা সেই হাসির সৌন্দর্য কিছুটা ম্লান করলেও হৃদয়ের পবিত্রতায় তার স্নিগ্ধতা বেড়ে গেছে।

তবে আজ তৃষ্ণার চলনে বেশ ছন্দ রয়েছে। প্রতিটা পদক্ষেপে দৃঢ়তা রয়েছে। আজ সকালেও যে মেয়েটার মনে একরাশ বিষন্নতা ছিল এখন নিজের অজান্তেই সেখানে ভালোলাগা এসেছে।

টিন শেডের উঁচু দেয়াল ঘেরা বাড়িটার কলিংবেলে চাপ দিলো তৃষ্ণা। অদুরেই বকুল ফুলের গাছে হেলান দিয়ে দাড়িয়ে রইলো নীলাদ্রি। ও জানে মুখ না ফিরালেও সামনে দাড়ানো মেয়েটি ওকে অনুভব করছে। তাই হয়তো কলিংবেলে চাপটা একটু অস্বাভাবিক রকমের বেশি।

বেড়িয়ে এলেন তৃষ্ণার মা অলকাদেবী। প্রথমে নীলাদ্রিকে না দেখলেও পরে তাকে লক্ষ্যকরে প্রায় ছুটে এলেন ওর কাছে। এই পরিবারের কাছে ও তো আপন জনই। নিভৃতে থেকে কম করে নি এ পরিবারের জন্য। তৃষ্ণা আর ওর বাবার অজান্তে কতো সাহায্য করেছে এদের। তাই তৃষ্ণার কাছে পর হয়ে যাওয়া ছেলেটা, বড় আপন অলকাদেবীর কাছে।

ঘরে ঢুকে অলকাদেবীর জেরার মুখে সবটা বললো নীলাদ্রি। শুধু বললো না চাকুরীটা ও ইচ্ছে করে ছেড়ে দিয়েছে। আভিজাত্যকে ও খোলসের মতোই ত্যাগ করেছে। সবটা করেছে কারও জন্য। যে এখন পর্দার আড়ালে দাঁড়িয়ে সবটা শুনছে। যার অবহেলার অভিনয় ধরা পরে যাচ্ছে প্রতিনিয়ত। সবটা শুনে ক্ষুদার্ত নীলাদ্রিকে খাবার দেয়ার জন্য চলে গেলেন অলকা দেবী। নীল সন্তর্পণে এগিয়ে গেলো পর্দার আড়ালে লুকোনো মেয়েটার দিকে। কনুই ধরে একটানে সামনে দাড় করালো।

নীলাদ্রি ----- আমি আবার আগের মতো ভিখারি হয়ে গেলাম রে, তুই কিছু বলবি না?

তৃষ্ণা ----- কি জন্য হঠাৎ ইচ্ছে করে এ বেশ ধারণ?

নীলাদ্রি ---- নিজেকে ফিরে পাবার জন্য।

তৃষ্ণা---- তার কি কোন দরকার আছে? ভালোই তো ছিলে? টাকা, স্টাটাস সব মিলে।

নীলাদ্রি---- হ্যা,, সবটা ছিল লোভ, বাসনা, উচ্চাকাংক্ষা। শুধু তাদের মাঝে আমি ছিলাম না। তাই সেগুলোকে কেমন ফিকে লাগতে শুরু করেছিলো। সেজন্য নিজেকে খুঁজতে চলে এলাম। আর একটা মাস এতো খুঁজেও নিজের দেখা পেলাম না। পরে বুঝলাম সেটা তো তোর কাছেই রয়ে গেছে। তুই ফিরিয়ে দিবি আমার আমিটাকে?

তৃষ্ণা----- আমার কাছে তোমার কিচ্ছু নেই। তুমি ভুল বুঝেছো। ( মুখটা শক্ত করে)

নীলাদ্রি ----- ( তৃষ্ণার কানের কাছে মুখটা নিয়ে এসে আস্তে আস্তে বললো ) আছে,,,আর এবার আমি কোন ভাবে তাকে না নিয়ে যাব না। আমার আমি ও আমার তুই। দুজনকেই আমার চাই। ভীষণ ভাবে চাই। না হলে যে বাঁচবো না রে আমি। কিংবা হয়তো পাগলই হয়ে যাব।

তৃষ্ণা চোখ বন্ধ করে আছে। কেমন সবটা স্বপ্নের মতো লাগছে। এরকম করে কখনও বলেনি ওর নীলদা। ওদের সবটা অনুভবে ছিলো মুখে তো ছিলো না কখনও। এগুলো ও স্বপ্নে দেখেছে শুধু। আজ কি আবার স্বপ্ন দেখছে? নিজের হাতে একটা চিমটি কাটলো তৃষ্ণা। না স্বপ্ন নয় বাস্তব। একেবারে নির্ভেজাল বাস্তব।
এতো দিনের মুখে না বলা ভালোবাসাটা আজ তাদের নিজেদের ভাষা বুঝে নিয়েছে। তারা ভালো থাকতে চাইছে, স্বপ্ন দেখতে চাইছে। আজ যেন আনন্দে আত্নহারা তৃষ্ণা। তখনি মনে পরলো অরনির কথা। যার সাথে নীলের বিয়ে ঠিক হয়েছিল।
এ কথা মনে পরেই কিছুটা সরে গেলো তৃষ্ণা। অভিমানী গলায় বললো,,,দেখো হয়তো অরনির আঁচলে বাঁধা পরে আছে খুঁজতে ভুলে গেছো। ( বলেই ছলছল চোখে চলে গেলো তৃষ্ণা)

আর তৃষ্ণার কথায় বুকটা চিনচিন করে উঠলো নীলাদ্রির। ও জানে ও যা অন্যায় করেছে তার প্রায়শ্চিত্ত করতে, অনেক কষ্ট করতে হবে। সারাটা জীবন সে চেষ্টায় কেটে গেলেও কোন আক্ষেপ নেই আজ। বরং মনের মানুষের কাছে থাকার আনন্দ আছে।

🌺🌺🌺🌺🌺 সমাপ্ত🌺🌺🌺🌺🌺

বি.দ্র- লেখাটির কপিরাইট সংরক্ষিত।