...

1 views

১ মে=‘মান্না ডে’ (শেষ পর্ব)
(পূর্ব প্রকাশিতের পর)


গৌরীপ্রসন্ন মজুমদার মান্না দে-কে অমর করে রেখেছেন তাঁর লেখা 'কফি হাউসের সেই আড্ডাটা আজ আর নেই' গানের মাধ্যমে। এই গানেই সুরারোপ করে বিখ্যাত হয়ে আছেন নচিকেতা ঘোষের পুত্র সুপর্ণকান্তি ঘোষ (যাঁর অনুরোধেই 'কফি হাউস' গানটি লিখেছিলেন গৌরীপ্রসন্ন), যিনি মান্না দে-র আরেকটি অবিস্মরণীয় গানেরও সুরসৃষ্টি করেছেন—'সে আমার ছোট বোন' (কথাঃ পুলক বন্দ্যোপাধ্যায়)। নচিকেতা ঘোষের সুরে অসংখ্য বাংলা ছায়াছবিতে এবং বেসিক অ্যালবামের গান গেয়েছেন মান্না দে। আর রাধাকান্ত নন্দী ছিলেন মান্না দে-র উপযুক্ত সঙ্গী। মান্না দে-র ক্লাসিকাল গানগুলির সঙ্গে তবলায় রাধাকান্ত নন্দীর সঙ্গত ছিল একেবারে যথাযথ। এমনকি শোনা যায়, রাধাকান্তবাবুর আপত্তিতে গৌরীপ্রসন্নকে 'সন্ন্যাসী রাজা' ছবির গান 'কাহারবা নয় দাদরা বাজাও'-এ 'রাধাকান্ত' শব্দটিকে বদলে 'শশীকান্ত' করতে হয়েছিল, কারণ রাধাকান্ত কখনোই বেসুরো বাজাতেন না।

সহশিল্পীদের প্রতি অত্যন্ত শ্রদ্ধাশীল ছিলেন মান্না দে। পুলক বন্দ্যোপাধ্যায়, সলিল চৌধুরী, সুধীন দাশগুপ্ত, বলরাজ সাহনি, রাজ কাপুর, উত্তম কুমার, হেমন্ত মুখোপাধ্যায়, শচীন দেব বর্মণ ছাড়াও তাঁর অত্যন্ত প্রিয়জন ছিলেন মহম্মদ রফি, কিশোর কুমার, মুকেশ, কল্যাণজী আনন্দজী, রাহুল দেব বর্মণ, লতা মঙ্গেশকর, আশা ভোঁসলে, সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়, সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায় প্রমুখ। বয়সে ছোট হওয়া সত্ত্বেও হেমন্ত মুখোপাধ্যায়, উত্তম কুমার, অনিল চট্টোপাধ্যায়, সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায় প্রমুখকে তিনি 'হেমন্তবাবু', 'উত্তমবাবু', 'অনিলবাবু', 'সন্ধ্যাদি' এবং 'আপনি' বলে সম্বোধন করতেন। সহশিল্পীর প্রতি এই পারস্পরিক শ্রদ্ধাবোধ এখনকার দিনে সত্যিই বিরল!

মান্না দে-র গাওয়া বাংলা গানের কথা বলতে গেলে সে তালিকা সহজে শেষ হওয়ার নয়। তবু তার মধ্যে কিছু উল্লেখযোগ্য গানের কথা বলতে চাই—'কতদূরে আর নিয়ে যাবে বলো' (প্রথম বাংলা গান, ১৯৫৩), 'হায় হায় গো রাত যায় গো', 'তীর ভাঙা ঢেউ', 'আমি নিরালায় বসে বেঁধেছি আমার স্মরণ-বীণ', 'আমি সাগরের বেলা', 'ও আমার মন যমুনার অঙ্গে অঙ্গে ভাবতরঙ্গে কতই খেলা', 'একই সঙ্গে এত রূপ', 'এই কূলে আমি', 'আমার না যদি থাকে সুর', 'চার দেওয়ালের মধ্যে নানান দৃশ্যকে', 'দেখি ওই হাসির ঝিলিক', 'আবার হবে তো দেখা', 'তুমি আঁধার দেখো', 'আজ আবার সেই পথেই', 'ললিতা ওকে আজ চলে যেতে বল্ না', 'দরদী গো কী চেয়েছি', 'হৃদয়ের গান শিখে তো গায় গো সবাই', 'যদি কাগজে লেখো নাম', 'এ কী অপূর্ব প্রেম', 'আমার ভালোবাসার রাজপ্রাসাদে', 'অন্তর যার অথৈ সাগর', 'আকাশ পানে চেয়ে চেয়ে', 'সবাই তো সুখী হতে চায়', 'সে আমার ছোট বোন', 'কফি হাউসের সেই আড্ডাটা', 'আমায় আকাশ বলল', 'আমি ফুল না হয়ে', 'মা মাগো মা আমি এলাম তোমার কোলে', 'যখন কেউ আমাকে পাগল বলে', 'আমি তার ঠিকানা রাখি নি', 'আমি রাজি রাখো বাজী', 'এ নদী এমন নদী', 'এ জীবনে যত ব্যথা পেয়েছি', 'একদিন দল বেঁধে', 'ও কেন এত সুন্দরী হল', 'ও কোকিলা তোরে শুধাই রে', 'ওগো বরষা তুমি ঝোরো না গো অমন জোরে', 'ক' ফোঁটা চোখের জল ফেলেছ যে তুমি ভালোবাসবে', 'কে তুমি কে তুমি', 'সুন্দরী গো দোহাই দোহাই', 'কোনো কথা না বলে' (সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায়ের সঙ্গে), 'তুমি আকাশ এখন যদি হতে' (নির্মলা মিশ্রের সঙ্গে), 'ময়নামতীর পথের ধারে দেখা হয়েছিল' (বনশ্রী সেনগুপ্তের সঙ্গে), 'পাগলা গারদ কোথায় আছে' (আশা ভোঁসলের সঙ্গে), 'কথা দাও আবার আসবে', 'কথায় কথায় যে রাত হয়ে যায়', 'রিমঝিমঝিম বৃষ্টি', 'খুব জানতে ইচ্ছে করে', 'গোলাপের অলি আছে', 'দেখে এলাম রূপের আগুন', 'ঝর্ণা ঝরঝরিয়ে', 'সব খেলার সেরা বাঙালীর তুমি ফুটবল', 'গহন মেঘের ছায়া ঘনায়ে সে আসে', 'চাঁদের আশায় নিভায়েছিলাম', 'জানি তোমার প্রেমের যোগ্য আমি তো নই', 'যে সমাধিবেদীটার ঠিক উপরে', 'তুমি নিজের মুখেই বললে যেদিন', 'দুঃখ আমাকে দুঃখী করে নি', 'শুধু একদিন ভালোবাসা', 'পৃথিবী তাকিয়ে দেখো', 'বেঁধো না ফুলমালা ডোরে', 'বড় একা লাগে', 'মেঘলা মেয়ে মেঘেরই সাজ পরেছে', 'রঙ শুধু দিয়েই গেলে' (অরুন্ধতী হোম চৌধুরীর সঙ্গে), 'রঙ্গিনী কত মন মন দিতে চায়', 'সখী কালো আমার ভালো লাগে না' (হেমন্ত মুখোপাধ্যায়ের সঙ্গে), 'স্বপন যদি মধুর এমন', 'স্বপনে বাজে গো বাঁশি', 'আমায় একটু জায়গা দাও মায়ের মন্দিরে বসি' ইত্যাদি কত শত অমূল্য গান! নজরুল গীতি গাইতে খুবই ভালোবাসতেন তিনি। এমনকি শেষ জীবনে ২০০৫-০৬ সাল নাগাদও প্রকাশ করেছেন তাঁর সর্বশেষ অ্যালবাম—'ঠিক ছবির মতো।' আটখানি গান ছিল তাতে, দেবপ্রসাদ চক্রবর্তীর লেখা, মান্না দে-র নিজেরই সুরারোপিত। 'ঠিক ছবির মতো', 'আকাশ দেখে মুখ', 'আমি স্বপ্ন দেখবো বলে', 'একা একা আমি ছুটির সকালে', 'ও হাসিনা আমি কি তোর এতই অচেনা', 'হিমালয় থেকে কন্যাকুমারিকা', 'জীবনটা ভাই ওয়ান ডে ক্রিকেট', 'এক নির্জন সৈকতে বসে ছিলেম'—এই গানগুলি ছিল সেই অ্যালবামটিতে।

এ কথাও ভুললে চলবে না মান্না দে ছিলেন একজন প্রথিতযশা সঙ্গীত পরিচালক তথা সুরকারও। তাঁর অসংখ্য গানে তিনি নিজেই সুরারোপ করেছেন। ১৯১৯ সালের ১ মে জন্ম হয়েছিল তাঁর উত্তর কলকাতার শিমলে পাড়ায়, স্বামী বিবেকানন্দও যেখানে জন্মগ্রহণ করেছিলেন। জন্মনাম ছিল তাঁর প্রবোধ চন্দ্র দে, কৃষ্ণচন্দ্র দে ডাকতেন 'মানা, মানা' বলে, পরে সেটাই 'মান্না' হয়ে যায়। ছোটবেলায় গোবর গোহ-র আখড়ায় কুস্তিও শিখেছেন মান্না দে। পড়তেন স্কটিশ চার্চ কলেজে। ১৯৪২ সালে কাকার সঙ্গে বোম্বেতে এসেছিলেন, প্রথম প্লেব্যাক 'তামান্না' (১৯৪৩) ছবিতে। এই ছবিতে 'জাগো আয়ি ঊষা' গানটি তিনি গেয়েছিলেন সুরাইয়ার সঙ্গে, আর প্রথম একক সঙ্গীত 'রাম রাজ্য' (১৯৪৩) ছবিতে 'নীলে নীলে গগন তলে'। গানের সূত্রেই আলাপ কেরলীয় কন্যা সুলোচনা কুমারনের সঙ্গে, পরে যাঁর সঙ্গে বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হয়েছিলেন তিনি। তাঁরা দুজন একসঙ্গে বেশ কিছু গানও গেয়েছেন। তাঁদের দুই কন্যা বর্তমান। এক প্রশ্নের উত্তরে মান্না দে একবার জানিয়েছিলেন যে তিনি তাঁর স্ত্রীকে অত্যন্ত ভালোবাসেন এবং তাঁর সমস্ত প্রেমের গান তাঁর স্ত্রীকে উদ্দেশ্য করেই গাওয়া। স্ত্রীর মৃত্যুতে মনে খুবই আঘাত পেয়েছিলেন এই বর্ষীয়ান শিল্পী। পেয়েছেন ভারত সরকারের 'পদ্মশ্রী', 'পদ্মভূষণ' ও 'দাদাসাহেব ফালকে' পুরস্কার এবং পশ্চিমবঙ্গ সরকারের 'বঙ্গবিভূষণ' সম্মান। ২০১৩-র ২৪ অক্টোবর মান্না দে-র কর্মময় সঙ্গীত জীবনের অবসান ঘটে।

আজ তাঁর জন্মবার্ষিকীতে তাঁর প্রতি আমার আভূমি প্রণাম ও শ্রদ্ধাঞ্জলি নিবেদন করছি।

©Van Helsing

1 May 2024
6-23 pm.
Wednesday

Revised on 5 May 2024

তথ্যসূত্রঃ ইন্টারনেট, মান্না দে-র বিভিন্ন সাক্ষাৎকার, ফেসবুকের বিভিন্ন নিবন্ধ, পত্রপত্রিকায় প্রকাশিত বিবিধ লেখা এবং মান্না দে-র ঘনিষ্ঠ মানুষদের বক্তব্য।

ছবিঃ লেখক


(শেষ)

#mannadey #kaustavmondal


© Van Helsing