আমার দেখা পাড়াগাঁর প্রকৃতি
লেখক -- সায়ন পাত্র।
দামিন্যা থেকে বর্ধমান যাওয়ার রাস্তাটা বেশ চমৎকার বানানো হয়েছে। নামখানা ভারী সুন্দর। " কবিকঙ্কন রোড " নামে পরিচিত। দাদু বলতেন, এই রাস্তাখানা তৈরি না হলে বোধ হয় দামিন্যা অন্ধকারেই ডুবে থাকতো। নেহাত রাস্তাখানি হয়েছে বলেই তো শহরের মানুষের আনাগোনা বেড়েছে। না হলে কেউ কি এসে দেখতো "চন্ডীমঙ্গল" কাব্যের রচিয়াতা মুকুন্দরাম চক্রবর্তীর জন্মস্থান এটা।
পূর্ব দিকে সোজা চলে যাচ্ছে সুবলদহ গ্রাম। এখানকার পারাগাঁর ঋতি-নীতি এতটাই অনুন্নত যে শিক্ষার আলো প্রবেশ করতে ভয় পায়। নেহাত ছোটো ছোটো পড়ুয়া ছেলে-মেয়ে ও দুস্থ অসুস্থদের কথা ভেবে গ্রামসদস্যদের প্রচেষ্টায় জেলা আধিকারিকগন একখানা বিদ্যালয় ও একখানা হাসপাতাল তৈরি করে দিয়েছিলো। একদিন বেলার দিকে এই পথ ধরেই বাবা আর আমি বেরিয়েছিলাম নান্টু কাকুদের বাড়ির উদ্দেশ্যে। বাবার কি যেন একটা হিসেব- নিকেষের ব্যাপার ছিল। একে তো মাটির রাস্তা তার উপর এক পসলা বৃষ্টি হয়ে গেছে। মানে বেশ বুঝতে পারছেন অবস্থাটা। যেতে যেতে একটা বড়ো স্ট্যাচু দেখলাম। বাবাকে জিঞ্জাসা করায় বাবা বললো , ওটা নাকি বিপ্লবী রাসবিহারী বসুর স্ট্যাচু। ঠিক তার পাশেই তার বাড়িখানা দেখালেন। ভেঙে - চুরে ভগ্নস্তুপে পরিনত হয়েছে। তাছারা সেথায় ছিলো এক লঙ্গরখানা। সেখানে নাকি প্রতিদিন অনেক অনেক লোকের খাওয়ার আয়োজন করা হয়। আমার ইচ্ছে হচ্ছিল সেদিন খেয়ে আসি। কিন্তু বাবার জরুরি কাজ থাকায় সে ইচ্ছে ইচ্ছেই থেকে গেলো।
মাঝেমধ্যেই একটা মজার ব্যাপার ঘটতো। তা ছিল হাতির পিঠে চড়া। ট্রাক্টার , লড়ি প্রভৃতি পরিবহন মাধ্যম গুলোতো বছর দশেক আগে থেকে দেখছি। নাহলে হাতির পিঠে করে ধান আসতো। ধান নামানো হয়ে গেলে শুরু হতো আমাদের মধ্যে প্রতিযোগিতা। কে হাতির পিঠে উঠবে ? নিজেদের মধ্যে বিবাদ শেষ হলে, মাহুতকে গিয়ে বলতাম। তারপর হাতিকে কি একটা বলতো আর হাতি তার শুঁর দিয়ে ধরে তার পিঠে তুলে নিতো। আজ আর সে হাতিও নেই আর আনন্দও নেই। আর ছিল রাস্তার দুই পাশে বিস্তীর্ণ এলাকা জুড়ে ধানের জমি। ভূগোল বইএ একটা কথা পরেছি , " বর্ধমান কে পশ্চিমবঙ্গের ধানের গোলা বলা হয় "। আজকের দিনে এই কথাটা শুধু খাতা কলমে। আজ আর জমি কোথায় ? তখনকার দিনে বিঘার পর বিঘা জমিতে ধান চাষ করা হতো। এখনতো মানুষ হয় বাড়ি-ঘর , কারখানা, পোল্ট্রি ফার্ম এসব তৈরি করছে। যখন যুগের এই বিবর্তনের দিকে তাকাই তখন মাঝে মাঝে ভাবি, যে সব শিশুরা তরুন, তারা কেবল খাতা-কলমেই পরবে " ধান কি ? গম কি ? " তারা শুধু বই এ তেই ছবি দেখবে। কিন্তু বাস্তবে যে কিরকম দেখতে হয় তা হয়তো তাদের ধরাছোঁয়ার বাইরে। বর্ষার আগমনে চাষিদের মুখে হাসি ফুটে ওঠে। চারিদিকে সোঁদা মাটির গন্ধে মো মো করে। কিন্তু একদিকে যেমন আনন্দ অন্যদিকে দুঃখের বন্যা নিয়ে আসে দামোদর। একেবারে চারিদিক জলে থই থই করতো। তবে দাদুর মুখে শুনেছি, ওনাদের সময়ে অবস্থা ছিল আরো ভয়ঙ্কর। তিনি বলতেন , " ভাগ্যিস DVC টা তৈরি হয়েছিলো, না হলে আজ যে কি হতো ?
গ্রীষ্মের একটা মরসুম ছিল যখন পন্যবাহী উট আসতো গ্রামে। আমরাও তখন বন্ধুরা মিলে দেখার জন্য দৌড় দিতাম। আমার মনে পড়ে বছর দশেক আগে, সকাল ৮ টা নাগাদ এসে পৌঁছেছিল উটের এক দল। আমি, বাবা ও আমার ভাই মিলে দেখতে গিয়েছিলাম। তখনকার দিনে ২৫ পয়সা দিয়ে আমি ও ভাই মিলে একবার উটের পিঠে চেপে ছিলাম। সেটা ছিল আমার কাছে একটা অন্যরকম অনুভূতি। আমি ভাবি, আমি যদি একটা উট ব্যাপারী হতাম তাহলে সেই উটে চেপে সমগ্র সাহারা জয় করে ফেলতাম। আর সেখান থেকে কুরিয়ান আনতাম এক মুঠো বালি। সেটাই হতো আমার কাছে এক সুবিশাল সাফল্য।
দাদুর মুখেই শুনেছি, আমাদের গ্রাম তথা সমগ্র জেলায় ছিলো বৌদ্ধ ও জৈন্যদের বাস। আমাদের জেলার নামও নাকি জৈন তীর্থঙ্কর বর্ধমান মহাবীরের নামানুসারে বর্ধমান হয়েছে। কিন্তু তা প্রথমে ছিল " বদ্ধমান"। পরে তা পরিবর্তন হয়ে হয় "বর্ধমান"।গ্রামের নামও দিয়েছে বৌদ্ধরা।
গাঁয়ে ছিল রায়েদের এক বিশাল পুকুর। তাতে পারার ছেলেরা চান্ করতো, কাকা-জ্যাঠারা তাদের গোরু, মোষেদের গাধোয়াতো। আমাদের স্নানকরার মাধ্যম বলতে ছিলো রাস্তার টিউবওয়েল আর বাড়ির পিছনের রায়পুকুরটি। তারপর কষ্ট ষষ্ঠ করে বাড়িতে একখানা টিউবওয়েল বসানো হয়েছিলো। তারপর এলো পঞ্চায়েতের পক্ষ থেকে সজলধারা। এইভাবে এক একটা জিনিস এক এক সময় ছিলো। যখন তার থেকে উন্নত প্রযুক্তির জিনিস আবিষ্কার হয়েছে তখন তার মূল্য ও প্রয়োজনীয়তা দুটোই কমে গেছে। এতে মাঝে মাঝে দুঃখবোধ হয়। তবে আমার দেখা পাড়াগাঁর প্রকৃতি আমি কখনো ভুলতে পারবো না। এটা আমার কাছে সারা জীবন স্মৃতি হয়ে থাকবে।
দামিন্যা থেকে বর্ধমান যাওয়ার রাস্তাটা বেশ চমৎকার বানানো হয়েছে। নামখানা ভারী সুন্দর। " কবিকঙ্কন রোড " নামে পরিচিত। দাদু বলতেন, এই রাস্তাখানা তৈরি না হলে বোধ হয় দামিন্যা অন্ধকারেই ডুবে থাকতো। নেহাত রাস্তাখানি হয়েছে বলেই তো শহরের মানুষের আনাগোনা বেড়েছে। না হলে কেউ কি এসে দেখতো "চন্ডীমঙ্গল" কাব্যের রচিয়াতা মুকুন্দরাম চক্রবর্তীর জন্মস্থান এটা।
পূর্ব দিকে সোজা চলে যাচ্ছে সুবলদহ গ্রাম। এখানকার পারাগাঁর ঋতি-নীতি এতটাই অনুন্নত যে শিক্ষার আলো প্রবেশ করতে ভয় পায়। নেহাত ছোটো ছোটো পড়ুয়া ছেলে-মেয়ে ও দুস্থ অসুস্থদের কথা ভেবে গ্রামসদস্যদের প্রচেষ্টায় জেলা আধিকারিকগন একখানা বিদ্যালয় ও একখানা হাসপাতাল তৈরি করে দিয়েছিলো। একদিন বেলার দিকে এই পথ ধরেই বাবা আর আমি বেরিয়েছিলাম নান্টু কাকুদের বাড়ির উদ্দেশ্যে। বাবার কি যেন একটা হিসেব- নিকেষের ব্যাপার ছিল। একে তো মাটির রাস্তা তার উপর এক পসলা বৃষ্টি হয়ে গেছে। মানে বেশ বুঝতে পারছেন অবস্থাটা। যেতে যেতে একটা বড়ো স্ট্যাচু দেখলাম। বাবাকে জিঞ্জাসা করায় বাবা বললো , ওটা নাকি বিপ্লবী রাসবিহারী বসুর স্ট্যাচু। ঠিক তার পাশেই তার বাড়িখানা দেখালেন। ভেঙে - চুরে ভগ্নস্তুপে পরিনত হয়েছে। তাছারা সেথায় ছিলো এক লঙ্গরখানা। সেখানে নাকি প্রতিদিন অনেক অনেক লোকের খাওয়ার আয়োজন করা হয়। আমার ইচ্ছে হচ্ছিল সেদিন খেয়ে আসি। কিন্তু বাবার জরুরি কাজ থাকায় সে ইচ্ছে ইচ্ছেই থেকে গেলো।
মাঝেমধ্যেই একটা মজার ব্যাপার ঘটতো। তা ছিল হাতির পিঠে চড়া। ট্রাক্টার , লড়ি প্রভৃতি পরিবহন মাধ্যম গুলোতো বছর দশেক আগে থেকে দেখছি। নাহলে হাতির পিঠে করে ধান আসতো। ধান নামানো হয়ে গেলে শুরু হতো আমাদের মধ্যে প্রতিযোগিতা। কে হাতির পিঠে উঠবে ? নিজেদের মধ্যে বিবাদ শেষ হলে, মাহুতকে গিয়ে বলতাম। তারপর হাতিকে কি একটা বলতো আর হাতি তার শুঁর দিয়ে ধরে তার পিঠে তুলে নিতো। আজ আর সে হাতিও নেই আর আনন্দও নেই। আর ছিল রাস্তার দুই পাশে বিস্তীর্ণ এলাকা জুড়ে ধানের জমি। ভূগোল বইএ একটা কথা পরেছি , " বর্ধমান কে পশ্চিমবঙ্গের ধানের গোলা বলা হয় "। আজকের দিনে এই কথাটা শুধু খাতা কলমে। আজ আর জমি কোথায় ? তখনকার দিনে বিঘার পর বিঘা জমিতে ধান চাষ করা হতো। এখনতো মানুষ হয় বাড়ি-ঘর , কারখানা, পোল্ট্রি ফার্ম এসব তৈরি করছে। যখন যুগের এই বিবর্তনের দিকে তাকাই তখন মাঝে মাঝে ভাবি, যে সব শিশুরা তরুন, তারা কেবল খাতা-কলমেই পরবে " ধান কি ? গম কি ? " তারা শুধু বই এ তেই ছবি দেখবে। কিন্তু বাস্তবে যে কিরকম দেখতে হয় তা হয়তো তাদের ধরাছোঁয়ার বাইরে। বর্ষার আগমনে চাষিদের মুখে হাসি ফুটে ওঠে। চারিদিকে সোঁদা মাটির গন্ধে মো মো করে। কিন্তু একদিকে যেমন আনন্দ অন্যদিকে দুঃখের বন্যা নিয়ে আসে দামোদর। একেবারে চারিদিক জলে থই থই করতো। তবে দাদুর মুখে শুনেছি, ওনাদের সময়ে অবস্থা ছিল আরো ভয়ঙ্কর। তিনি বলতেন , " ভাগ্যিস DVC টা তৈরি হয়েছিলো, না হলে আজ যে কি হতো ?
গ্রীষ্মের একটা মরসুম ছিল যখন পন্যবাহী উট আসতো গ্রামে। আমরাও তখন বন্ধুরা মিলে দেখার জন্য দৌড় দিতাম। আমার মনে পড়ে বছর দশেক আগে, সকাল ৮ টা নাগাদ এসে পৌঁছেছিল উটের এক দল। আমি, বাবা ও আমার ভাই মিলে দেখতে গিয়েছিলাম। তখনকার দিনে ২৫ পয়সা দিয়ে আমি ও ভাই মিলে একবার উটের পিঠে চেপে ছিলাম। সেটা ছিল আমার কাছে একটা অন্যরকম অনুভূতি। আমি ভাবি, আমি যদি একটা উট ব্যাপারী হতাম তাহলে সেই উটে চেপে সমগ্র সাহারা জয় করে ফেলতাম। আর সেখান থেকে কুরিয়ান আনতাম এক মুঠো বালি। সেটাই হতো আমার কাছে এক সুবিশাল সাফল্য।
দাদুর মুখেই শুনেছি, আমাদের গ্রাম তথা সমগ্র জেলায় ছিলো বৌদ্ধ ও জৈন্যদের বাস। আমাদের জেলার নামও নাকি জৈন তীর্থঙ্কর বর্ধমান মহাবীরের নামানুসারে বর্ধমান হয়েছে। কিন্তু তা প্রথমে ছিল " বদ্ধমান"। পরে তা পরিবর্তন হয়ে হয় "বর্ধমান"।গ্রামের নামও দিয়েছে বৌদ্ধরা।
গাঁয়ে ছিল রায়েদের এক বিশাল পুকুর। তাতে পারার ছেলেরা চান্ করতো, কাকা-জ্যাঠারা তাদের গোরু, মোষেদের গাধোয়াতো। আমাদের স্নানকরার মাধ্যম বলতে ছিলো রাস্তার টিউবওয়েল আর বাড়ির পিছনের রায়পুকুরটি। তারপর কষ্ট ষষ্ঠ করে বাড়িতে একখানা টিউবওয়েল বসানো হয়েছিলো। তারপর এলো পঞ্চায়েতের পক্ষ থেকে সজলধারা। এইভাবে এক একটা জিনিস এক এক সময় ছিলো। যখন তার থেকে উন্নত প্রযুক্তির জিনিস আবিষ্কার হয়েছে তখন তার মূল্য ও প্রয়োজনীয়তা দুটোই কমে গেছে। এতে মাঝে মাঝে দুঃখবোধ হয়। তবে আমার দেখা পাড়াগাঁর প্রকৃতি আমি কখনো ভুলতে পারবো না। এটা আমার কাছে সারা জীবন স্মৃতি হয়ে থাকবে।