...

0 views

দু’টি তাৎক্ষণিক বুক্ রিভিউ
//দু’টি তাৎক্ষণিক বুক্ রিভিউ//

আজ সকালে মাত্র আধঘন্টায় পড়ে ফেললাম অদিতি বসুরায়ের কাব্যগ্ৰন্থ “সব চিঠি প্রকাশিত” এবং দুপুরে মাত্র পনের মিনিটে পড়ে ফেললাম শ্রীবিমল মিত্রের ছোটগল্প “দু’ কান কাটা”। অদিতির কাব্যের কবিতাগুলি নানা জঁরের। কোনোটি নিখাদ প্রেমের, আবার কোনোটি বা সামাজিক। কোনোটি প্রকাশ করেছে নিসর্গ, আবার কোনোটি বা পরাবাস্তবতার ছোঁয়াচ মাখানো। তবে, সবচেয়ে ভালো কথা এই যে, অদিতির শব্দচয়ন অত্যন্ত সুন্দর এবং তাঁর বক্তব্য তিনি নিজের মতন করেই প্রকাশ করেছেন। সবক্ষেত্রেই যে তা পাঠক খুব সহজেই বুঝে যাবেন, এমন নয়। অন্ততঃ আমার তাইই মনে হয়েছে। তবে তাঁর কবিতাগুলি বেশিরভাগই অত্যন্ত সংক্ষিপ্ত, তবে কথায় বলে না, short but precise? আদিতির কবিতাগুলি সেরকমই অনেকটা। ‘মন নাই, কুসুম’-এ যে অদিতি লেখেন,
“আদর-সম্ভব রং তোর ঠোঁটে
খেলা করে।

...দেখে দেখে মুহূর্ত যায়

দুপুর ছিঁড়ি কুটি কুটি করে;

লোভ হয়।”,
সেই অদিতিই আবার ‘বাঁশিটি ওঠেনি সখার’ কবিতায় বলতে পারেন,
“জল লেগে আমার বুক কেটেছে কাচে
আর নাভিতে সটান দাঁড়িয়ে এক উজবুক
ঘোষণা করেছে সে-ই আসলে হেমন্ত
আর আমি তার আদিম পোস্টম্যান।

সহস্র অনুনয়ে হয়তো বাঁশিতে
একমাত্রায় ফুঁ পড়েছিল সে সুসময়ে

হেমন্ত তখন থেকেই পোস্টম্যানের জন্য
সুপারি কিলার খুঁজেছে
হেমন্ত তখন থেকেই জানে
সমস্ত চিঠিই স্ট্যাম্পড্। প্রকাশিত
হবে যে কোনও মুহূর্তে—
তার বাঁশি, তার নীল জঙ্ঘা, পার্শিয়ান ব্লু আইবল
ফোঁটা-ফোঁটা মিথ্যে চোখের জল দিয়ে তৈরি
দুনিয়ার মন্থরতম বিষ—সমস্ত সে সন্ধ্যায় সন্ধ্যায়
নিজে পোস্ট করেছে পোস্টম্যানের বাক্সে।
ফলত হেমন্তের জন্য পরলোক নেই।

পোস্টম্যান মরে গেছে।”

লক্ষ্যণীয়, কী অবলীলায় কিছু অসম্ভব দৃশ্যকল্প জড়ো করেছেন অদিতি। তাঁর ভাবনার মৌলিকত্ব এই বইয়ের প্রায় প্রতিটি কবিতায়। এমনকি সবচেয়ে হ্রস্ব কবিতাগুলিও তাঁর টিপিক্যাল স্টাইল বহন করে—
“গভীর কুয়াশায় মাথা ঢেকে যাচ্ছে
যুক্তরাষ্ট্রে ঘোড়সওয়ার দুরন্ত অনিশ্চয়

বলো, কোন আপেলগাছে
আমাদের মৃত্যুর চিঠি লিখেছ তোমরা?

বলো?”
(কৃষ্ণাঙ্গ হত্যা, আমেরিকা, ২০১৬)

অথবা,

“আমার আয়নায় বাবা ইয়াগার বাস।
একঠেঙে মুরগির বুকে
আমাদের ঘর।
বিড়বিড় করে সারাদিন বকে যাই
অভিশাপ, তন্তর-মন্তর—

ইদানীং আমরা মাংস বেচতে যাই
হাড়কাটা গলির ভেতর।”
(বাবা ইয়াগা)

আর প্রেমের সম্পর্কে অকুতোভয় অদিতি ‘ইতুপুজো’-য় লেখেন,
“বড়ো সামান্য লোক আমি
এক-আধটা পাতা, পাখির শিস—এতেই
দিব্যি গেরস্থালি।

*** *** ***

আমি বড়ো সামান্য লোক
রুমালে রোদ পড়লে
জ্বর আসে, জানো!”

অথবা,

“সখা আমার, তীব্র তামাক।
সখা আমার কৃষ্ণ ঠাকুর বটে—

আমাকে জ্বালায় ত্রিভঙ্গে, মোহন
আসনে বসে।”
(সখা আমার)

এছাড়াও অন্যান্য উল্লেখযোগ্য কবিতাগুলির মধ্যে অন্ত্যমিলে লেখা একমাত্র কবিতা ‘পরকীয়া’, ‘পুরুষ’, ‘রঞ্জনকে’, ‘হিরন্ময় সিরিজ’ ইত্যাদি বিশেষভাবে দাগ রেখে যাবে পাঠকের মনে। অদিতির লেখায় বিষ্ণু দে ও শক্তি চট্টোপাধ্যায়ের প্রভাব সুস্পষ্ট, তবে তাতে তাঁর নিজস্বতা কোথাও নষ্ট হয়নি। তিনি তাঁর বক্তব্য বিশ্বাসযোগ্যভাবে ফুটিয়ে তুলেছেন এই কাব্যের সবখানেই। এবার যেহেতু কবিতা অনেকসময়ই ভিন্ন ভিন্ন পাঠকের কাছে ভিন্ন ভিন্ন অর্থ বহন করে, তাই এক্ষেত্রেও আমার বক্তব্যই শিরোধার্য—এমন দাবি করব না। বস্তুতপক্ষে কোনো সমালোচকই হয়তো তা করবেন না, আর আমি তো সমালোচকই নই। আমি একনিষ্ঠ পাঠক। সেই ভাবনা থেকেই এই ক’টি কথা লিখলাম।

মোটকথা এই যে, “সব চিঠি প্রকাশিত”-র ঊনচল্লিশটি কবিতায় জীবনের যাপন দেখিয়েছেন অদিতি। সে যাপন কখনো তীব্র, কখনো বিরহী, আবার কখনো বা প্রতিবাদে মুখর। বাবাকে উৎসর্গ করেছেন তিনি বইটি। ঋত প্রকাশন থেকে প্রকাশিত এই বইটির তৃতীয় মুদ্রণ ডিসেম্বর ২০১৮-র। মুদ্রিত মূল্য ভারতীয় মুদ্রায় ₹৮০ টাকা।

শ্রীবিমল মিত্রের ছোটগল্পটি একটি সামাজিক ঘটনার প্রেক্ষাপটে লেখা। যথারীতি শ্রীমিত্র তাঁর সহজাত গল্প বলার ক্ষমতাটিকে কাজে লাগিয়েছেন এখানেও। ফ্ল্যাশ ব্যাক টেকনিকে এই গল্পটি বর্ণিত হয়েছে উত্তম পুরুষে, এবং লেখক এখানে স্বনামেই উপস্থিত। তবে, ঘটনাটি আত্মজীবনীমূলক, নাকি লেখকের স্বকপোলকল্পিত—তা জানবার কোনো উপায় নেই। লেখক চুঁচড়োর একটি সভা থেকে বাড়ি ফেরার পথে এক অচেনা মহিলা তাঁর পথ আটকে জিগ্গেস করে যে তাঁর কয়টি নাম? লেখক হতভম্ব হয়ে পড়েন আচমকা এমন প্রশ্নে, কারণ তিনি ভালো করেই জানেন যে তাঁর একটিই নাম; যে নামে তিনি লেখেন, এবং যে নাম তাঁর ইশকুল কলেজ য়ুনিভারসিটির খাতাতেও রয়েছে। কিন্তু তারপরেও সেই অচেনা মহিলার বারংবার একই প্রশ্নে কিছুটা বিভ্রান্ত ও বিচলিত লেখক অবশেষে পুরনো স্মৃতি হাতড়ে উদ্ধার করেন একটি বিশেষ ঘটনার কথা। তাঁর মনে পড়ে যায় যে বহু বছর আগে যখন তিনি এবং তাঁর দুই পরিচিত বলাই ও নিকুঞ্জ একটি মেসে একই ঘরে থাকতেন, তখনকার একটি ঘটনাই আজ তাঁকে এই বিরূপ প্রশ্নের মুখোমুখি দাঁড় করিয়েছে। বলাই কাজ করত পোস্টাপিসে, আর নিকুঞ্জ কয়েকটা টিউশনি করে পেট চালাত। লেখক তখন য়ুনিভারসিটির ছাত্র এবং লেখক হওয়ার স্বপ্নে বিভোর। নিকুঞ্জ ছাত্র হিসেবে অত্যন্ত নিম্নমানের ছিল, কিন্তু ছাত্রছাত্রীদের সে বলে বেড়াত যে সে বি.এ. পাশ। এমনকি লেখকের কাছ থেকে সে প্রায়শই তার ছাত্রছাত্রীদের বাংলা ব্যাকরণ ও অঙ্ক করিয়ে নিত। এভাবেই একদিন নিকুঞ্জ তার এক সদ্য পিতৃহারা ছাত্রী সবিতার প্রেমে পড়ে। সবিতাদের নিজের বাড়ি ছিল বটে, কিন্তু তার মা চেয়েছিলেন ভালো ঘরে মেয়ের বিয়ে দিতে, এবং জামাই যাতে উচ্চশিক্ষিত হয়। এমনিতেই নিকুঞ্জ সবিতার কাছ থেকে মাইনে নিত না, কিন্তু বিয়ের ব্যাপারে কোনো একজন অভিভাবক ছাড়া যে সবিতার মা তার সঙ্গে মেয়ের বিয়ে দেবেন না, নিকুঞ্জ এ কথা জানত। তাই সে লেখককে প্রস্তাব দেয়, তার জেঠতুতো দাদা সেজে সবিতার মায়ের সঙ্গে কথা বলতে যেতে। লেখক প্রথমে কিছুতেই রাজি হন নি, কারণ তাঁর বিবেকে লাগছিল। নিকুঞ্জ ক্লাস এইটও পাশ নয়, অথচ বলে বেরিয়েছে যে সে বি.এ. পাশ! এতবড় মিথ্যাচার লেখকের পক্ষে মেনে নেওয়া সম্ভব ছিল না। শেষটায় একরকম ব্ল্যাকমেইল করেই নিকুঞ্জ লেখককে রাজি করায়। আর এ সব কথাই হত রাত্তিরে বলাই ঘুমিয়ে পড়ার পর, চুপি চুপি, নীচু গলায়। লেখক নিকুঞ্জর কথায় রাজি হন, কিন্তু তাকে দিয়ে শপথ করিয়ে নেন যে সে যেন কখনোই সবিতার অযত্ন না করে। নিকুঞ্জ রাজি হয়। তারপর নিকুঞ্জর কথামতো লেখক তাকে নিয়ে সবিতার বাড়ি যান এবং নিজেকে রমেশ গাঙ্গুলী অর্থাৎ নিকুঞ্জর জেঠতুতো দাদা বলেই পরিচয় দেন। এরপরেই লেখকের দিল্লী থেকে একটা চাকরি আসে এবং তিনি সেখানে চলে যান। এবং কালের নিয়মে একসময়ে নিকুঞ্জ ও সবিতার কথা ভুলেও যান।

আজ এতদিন বাদে এই অচেনা মহিলাটিকে দেখে লেখক চিনতে পারেন। এইই সেই সবিতা! কিন্তু তিনি যখন শোনেন যে, সে চুঁচড়োর একটা বস্তিতে থাকে, তখন সেটা তাঁর প্রত্যয় হয় না। তিনি সেই বস্তিতে এসে জানতে পারেন যে, নিকুঞ্জ সেখানে থাকে না, এবং বলাই সবিতাকে বিয়ে করেছে। বলাইয়ের কাছ থেকে তিনি এও জানতে পারেন যে চুরি করার দায়ে তার পোস্টাপিসের চাকরিটি গেছে এবং এখন সে সবিতার রোজগারেই খায়। সবিতা পরের বাড়ি বাসন মাজে এবং এইভাবেই কোনোরকমে কষ্টে সৃষ্টে তাদের চলে যাচ্ছে। বলাই লেখককে অনুরোধ করে একটা চাকরি জোগাড় করে দেওয়ার। কিন্তু এতকিছুর পরেও লেখক বুঝতে পারেন না যে বলাই কী করে সবিতাকে বিয়ে করতে পারে! বিয়ে তো তার হওয়ার কথা ছিল নিকুঞ্জ গাঙ্গুলীর সঙ্গে! বলাই-ই লেখকের ভাবনা বুঝতে পেরে জানায় যে, সে সেই রাত্তিরগুলোয় ঘুমের ভান করে পড়ে থেকে লেখক ও নিকুঞ্জর মধ্যেকার সমস্ত কথোপকথন শুনেছিল এবং সে-ই সবিতার বাড়ি গিয়ে ভাঙচি দেয়। ফলশ্রুতিতে নিকুঞ্জ লজ্জায় পালিয়ে যায় এবং সে সবিতাকে বিয়ে করে। সব শুনে লেখকের মনে হতে থাকে, নিকুঞ্জ যদি এক কান কাটা হয়, তবে বলাই তো দু’ কান কাটা!

শ্রীমিত্রর গল্প বলার ভঙ্গীটি চমৎকার। পাঠককে তিনি আকৃষ্ট করে রাখতে পারেন। খুব কম সংখ্যক লেখকেরই এই অনন্য গুণটি থাকে। শ্রীমিত্র তাঁদের মধ্যে অন্যতম। আর সামাজিক যে বার্তাটি তিনি দিয়েছেন এই গল্পের মাধ্যমে, তাও বেশ শিক্ষণীয়। মোটকথা, এই গল্পটি শ্রীবিমল মিত্রের প্রতিনিধিস্থানীয় গল্প।

এই গল্পটি সঙ্কলিত হয়েছে এম সি সরকার অ্যান্ড সন্স প্রাইভেট লিমিটেড থেকে প্রকাশিত এবং সুধীরচন্দ্র সরকার সম্পাদিত “কথাগুচ্ছ” গল্প সঙ্কলনে। চতুর্থ সংস্করণ, ১৩৭২ (১৯৬৫)-এ। মুদ্রিত মূল্য ভারতীয় মুদ্রায় ₹১২.৫০ (বারো টাকা পঞ্চাশ পয়সা)।

©কৌস্তভ মণ্ডল

25 February 2024
3-26 pm.
Sunday
© গেছো দাদা

#kaustavmondal