...

3 views

" বিহা "
・বিহা・( বাংলা ও সাঁওতালি ভাষা মিশ্রিত একখানি ছোট গল্প )
[ মাদুলপুরের দুজন সাঁওতালি ছেলে-মেয়ের প্রেমকেন্দ্রিক আলাপের কৌণিক গল্প ]
.
.
.
মাদুলপুর গ্রামের সুন্দরী এবং লক্ষ্মীমন্ত মেয়ে কঙ্কা।গ্রামের প্রতিটা মাঠের ভাঁজে তার পায়ের ছাপ আকাশের দেহে প্রফুল্ল আনতো।তার ওই হাঁটু অব্দি লালপেড়ে মিঠে পানসবুজ শাড়ি;একহাত রেশমি চুরি;পায়ে নুপুর,চুটকি;কানে ঝুমকোলতা,আর থুতনির নীচে আঁকা তিনখানা বাহারি কল্কা যেন নব্যযুগের কোনো শ্বেতপাথরের ভাস্কর্য!তার চেহারার এই অমোঘ সাজঘর দেখার সৌভাগ্য হয়েছিল একমাত্র অর্চির। " এ কঙ্কা তুকে তো আজ মুয়নাপাখির মুতো দেখতি টো লাগছে বটে!তা এইখানটোতে দাঁড়াইটো আছিস কেনে?"
" আ মরলু যা!কি যে বলিস তু মুখপুড়া!আর আমার পরহানটো বাঁচে না!আর তু তো জানিস,এই গেরামখানা আমাগো বড্ড প্রিয়টো বটে।এই মাটির সুঁদা গন্ধখান আমার হৃদয়ের স্রোতটোতে রামধনুর স্তরটো আঁকে।জলের মতো পেরানটাকে ধরে টো রাখে।তো এইখানটোতে আসবোক লাই তো আর কুথাকে যাবো বল কেনে?"
" বটে!হ বুঝলাম কেনে। তা সকাল থেকে কিছু খেয়েছোস?না এখানটোতেই ঘোরাফেরা করতেছোস?চল আয় কেনে মুর সঙ্গে খেয়েটো লিবিক।"
" আরে তু যা কেনে এখুন, বিরুক্তটো
করিসনে মুরে "।
" এ কঙ্কা রাগটো করতেছোস কেনে ক দিকিনি।শুন না,বিহা টো করবিক আমাগো সুঙ্গে?আমি যে তুকে বুড্ড ভালোটো বাসি কেনে "।
অর্চির মুখ থেকে কথাটা শোনার পরই কঙ্কা লজ্জা পেয়ে দুহাতে চোখ ঢেকে অর্চির কপালে একখানি চুমু এঁকে বলে - " করবোক কেনে "।
তারপরই সে ছুটতে ছুটতে নদীর পাড়ে চলে যায়।কিছুক্ষণ পর তার মা ময়নাবতী এসে তাকে চুলের মুঠি ধরে টানতে টানতে কুঁড়েঘরে নিয়ে এসে বলে - " ছুঁড়ি! উঠোনটো কে নিকুবে শুনি কেনে!"
সেই সকাল থেকে ময়নাবতী তরকারি কোটা,ভাত রাঁধা,ধান ঝাড়া - এসব কাজে ব্যস্ত থাকে।নাওয়া-খাওয়ার সময় একেবারেই থাকে না তার হাতে।কঙ্কার সংসারের এসব খুঁটিনাটিতে মন থাকে না।তার মন পড়ে থাকে অর্চির মায়াময় চোখের নদীতে যার এক একটি শাখা-প্রশাখা তাকে শিকড়ের মতো আষ্টেপৃষ্ঠে বেঁধে রাখে সর্বক্ষণ।কঙ্কা সব কাজ সেরে পুকুরে সিনান করতে যায়।কোমরে কলসি আর স্কন্ধে গামছা নিয়ে যেতে যেতে মনের সুখে গান ধরে কঙ্কা - " কালো জলে কুচলা জলে ডুবলো সনাতন/আজ চার আনা কাল চার আনা পাই যে দর্শন/লদীর ধারে চাষে বধূ মিছাই করো আস/ঝিরিঝিরি বাঁকা লদী বইছে বারোমাস।"
মুহূর্তের মধ্যেই একখান গোলাপ ছুটে আসে তার পিঠের উলঙ্গ সাদা চামড়ায়।পেছন ফিরে দেখে অর্চিকে।অর্চির এই প্রশান্তির হাসি নির্ঘাত হাতির দাঁতের মতোন সুন্দর, যা প্রায়শই মুগ্ধ করতো কঙ্কাকে।এমন হাসি যেন তাকে প্রবেশ করায় লাল পাহাড়ির দেশে,যেখানে সারি সারি অরণ্যের মাঝে একফালি চাঁদ তার জন্য অপেক্ষারত।অর্চির ইচ্ছে,সে আজ কঙ্কার সিনানদৃশ্যখানা না দেখে যাবে না।কঙ্কা লজ্জা পেয়ে বলে - " তুর কি মাথাটো খারাপ হয়েছে কেনে,এ ভিজা কাপড়টুতে তুই আমাকে সাঁতার কাটতে দিখে খুব মজাটো পাস বল কেনে, গায়ে জলটো ছিটিয়ে রোজ তু আমাগো সাথে যে খেলাটোতে মাতিস,উই পাখিগুলো যে আমাদিগকে দিখে শরম টো পায় বুঝিস না কেনে বল দিকি।"
অনেক কথা কাটাকাটির পর তাদের রাসলীলা দেখার সুযোগ পায় গ্রামের পর্বমধ্যে রয়ে যাওয়া প্রত্যেকটা প্রাণ।অবশেষে সিনান সেরে বাড়ি ফেরে কঙ্কা।বাড়ি ফেরার সঙ্গে সঙ্গে তার মা ময়নাবতী তাকে রুক্ষ গলায় জানিয়ে দেয় - সামনের অগ্রহায়ণ মাসে তার বিয়ে।অর্চির সাথে সে যেন আর বেশি মেলামেশা না করে।দেখতে দেখতে দুই বছর কেটে যায়।অর্চির থেকে মুখ ফিরিয়ে নিলেও আজও মনে মনে অর্চিকেই ভালোবাসে কঙ্কা।কাল তার বিয়ে এই গ্রামেরই এক বুড়ো ভামের সাথে।কঙ্কার চোখের প্রত্যেকটা বাষ্প যেন ফসফরাসের মতো জ্বলজ্বল করে উঠছিল,তবুও যেন কারোর চোখে পড়ছিলো না সেই হৃদয়বিদারক দৃশ্যখানি।
ময়ূরের পালকের সাথে কি আর কাকের পালকের তুলনা চলে!অর্চির মস্ত বড়ো পোলট্রির ব্যাবসা!তার পরিবারের লোকজন ওই কাককে কিছুতেই বউ হিসেবে মেনে নিতে পারবেনা কোনোদিন।তাই কঙ্কার মা ময়নাবতীকে এই কঠিনতম সিদ্ধান্তে উপনীত হতে হয়েছে।বিয়ের দিন কঙ্কাকে সাজানো হয়েছিলো এক অপরূপ সাজে,কিন্তু,সেই সাজ প্রত্যক্ষ করার মতো ধৈর্য্যশীল মানুষটা চিরতরে হারিয়ে গিয়েছিল কঙ্কার জীবন থেকে।' সাঁওতালি মাদুলে বিহার ফুলটো '
যেন শুষে নিয়ে গিয়েছিল মাছির কঙ্কাল।


© সাহিত্যের নায়াগ্রা❤️