...

2 views

১ মে=‘মান্না দে’ (প্রথম পর্ব)
//১ মে=‘মান্না ডে’//


হৃষীকেশ মুখার্জির 'আনন্দ্' ছবিতে মুকেশের স্বর্ণকন্ঠ রাজেশ খান্নার লিপে আমাদের হৃদয় তোলপাড় করে তোলে—'কহিঁ দূর জব্ দিন ঢল্ যায়' আর 'ম্যায়নে তেরে লিয়ে হি সাত রঙ্গ্ কে সপনে চুনে'; কিন্তু আজও 'আনন্দ্' ছবির কথা উঠলেই ভারতবাসীর চোখে ভেসে ওঠে একটাই দৃশ্য—সমুদ্রসৈকত ধরে হেঁটে যাওয়া রাজেশ খান্নার একগোছা বেলুন উড়িয়ে দিয়ে অননুকরণীয় হাসি আর সঙ্গে অনুরণিত হয়ে আসা মান্না দে—'জিন্দগী ক্যায়সি হ্যায় পহেলী হায়... কভি তো হাসায়, কভি ইয়ে রুলায়!' এই গান গেয়েছিলেন মান্না দে। সলিল চৌধুরী জানতেন মান্না দে ঠিক কী কী করতে পারেন, আর তাই ১৯৬১ সালে 'কাবুলিওয়ালা' ছবিতে বলরাজ সাহনির লিপেও মান্না দে-কে দিয়েই গাওয়ালেন অবিস্মরণীয় সেই দেশাত্মবোধক গান—'অ্যায় মেরে পেয়ারে ওয়াতন, অ্যায় মেরে বিছড়ে চমন, তুঝ পে দিল কুরবাঁ...।' এই গান যখনই শুনি, যেখানেই শুনি, যতবারই শুনি, চোখ ভরে আসে জলে, বিশেষ করে শেষের ওই অংশটুকুতে—'হম্ জহাঁ প্যায়দা হুয়ে উস্ জগহ্ হী নিকলে দম্, তুঝ পে দিল কুরবাঁ/তু হি মেরি আরজু, তু হি মেরি আবরু, তু হি মেরি জাঁ...।' টেরিফিক! মালয়ালম ভাষায় যে গানটিকে অন্যতম শ্রেষ্ঠ প্রেমের গান হিসেবে আজও ধরা হয়, 'চেম্মেন' ছবির সেই গান 'মানাসা মাইনে ভারু'-ও একজন বাঙালীরই গাওয়া! তাঁর নাম? মান্না দে! সঙ্গীতকার সলিল চৌধুরী। অথচ এই একই সুরে যখন বাংলা গান তৈরি করলেন সলিল—'নাম শকুন্তলা তার'—সেই গানটির পুরুষ কন্ঠে আবার দক্ষিণী গায়ক কে. জে. ইয়েসুদাস! এবং সেই গানও সমান জনপ্রিয়! সলিল চৌধুরীর মতো বিচক্ষণ সঙ্গীত পরিচালকই বোধহয় এটা করতে পারতেন।


আবার এই মান্না দে-কে দিয়েই যখন 'উপকার' ছবিতে চরিত্রাভিনেতা প্রাণের লিপে 'কসমে ওয়াদে পেয়ার ওয়াফা' গানটি গাওয়াতে চাইলেন পরিচালক তথা অভিনেতা মনোজ কুমার, বেঁকে বসেছিলেন সঙ্গীতকার কল্যাণজী, কারণ তাঁর মনে হয়েছিল খলনায়কের চরিত্রে অভিনয় করে করে প্রাণ মার্কামারা হয়ে গিয়েছেন এবং তাই তাঁর লিপে এমন সুন্দর গান মানাবে না। কিন্তু তাঁর সিদ্ধান্তে অনড় রইলেন মনোজ কুমার এবং ছবি ও গান–দুই-ই হিট হল। মান্না দে প্রমাণ করলেন তিনি তথাকথিত খলনায়কের জন্য প্লেব্যাক করেও গান হিট করাতে পারেন।

পঞ্চাশের দশকে 'একদিন রাত্রে' (১৯৫৭) ছবিতে মদ্যপ ছবি বিশ্বাসের লিপে সলিল চৌধুরী মান্না দে-কে দিয়ে গাওয়ালেন 'এই দুনিয়ায় ভাই সবই হয়, সব সত্যি, সব সত্যি', আর হেমন্ত মুখোপাধ্যায় মান্না দে-কে দিয়ে অসিত সেনের 'দীপ জ্বেলে যাই' (১৯৫৯) ছবিতে মদ্যপ অনিল চট্টোপাধ্যায়ের লিপে গাওয়ালেন 'এমন বন্ধু আর কে আছে'। 'দীপ জ্বেলে যাই' ছবির হিন্দি ভার্সন 'খামোশী' (১৯৬৯) ছবিতেও মান্না দে গাইলেন 'দোস্ত্ কহাঁ কোই তুমসা'। প্রতিক্ষেত্রেই জল খেয়ে তাঁকে মাতালের মতো করে গান গাইতে হয়েছে, এ কথা মান্না দে নিজেই বলেছেন এক সাক্ষাৎকারে, কারণ তিনি মদ্যপান করতেন না।

'বসন্ত বিলাপ' ছবিতে 'লেগেছে লেগেছে আগুন' গানটি গাওয়ার সময়ও অনবদ্য অভিনয় করতে হয়েছে তাঁকে, এমনকি তাঁর গায়কী দেখে অভিভূত সে ছবির নায়ক সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায় বলেছিলেন, "আপনি যেভাবে আগুন লাগিয়েছেন মান্নাদা, আমি কি আপনার মতন করে আগুন লাগাতে পারব!"

১৯৬৭ সাল। 'ছোটি সি মূলাকাৎ' ছবির কাজে উত্তম কুমার তখন বোম্বেতে। সেই একই সময়ে কলকাতায় মুক্তি পাচ্ছে 'এন্টনী ফিরিঙ্গী' ছবিটিও। এমন সময় বোম্বেতে একদিন মান্না দে-র সঙ্গে উত্তম কুমারের দেখা হল। উত্তম কুমার মান্না দে-কে বললেন, "আপনি তো আমাকে খুব বিপদে ফেলেছেন মান্নাদা! কী গান করেছেন 'এন্টনী ফিরিঙ্গী'-র জন্য! আমি কি পারব অমন সুন্দর গানে ঠিক ঠিক লিপ মেলাতে? তাই কাজের ফাঁকে ফাঁকে একটুখানি সময় পেলেই রেকর্ড প্লেয়ারে আপনার গানগুলো শুনে শুনে চেষ্টা করছি তোলবার।"

মান্না দে-র খুব পছন্দের অভিনেতা ছিলেন তিনজন। বলরাজ সাহনি, রাজ কাপুর এবং উত্তম কুমার। এই তিনজনের লিপে অজস্র গান গেয়েছেন তিনি। কে ভুলতে পারে 'ওয়াক্ত্' ছবিতে বলরাজ সাহনির লিপে 'অ্যায় মেরি জোহরা জবীঁ' কিংবা 'শ্রী ৪২০' ছবিতে রাজ কাপুরের লিপে 'পেয়ার হুয়া ইকরার হুয়া' অথবা 'দিল কা হাল শুনে দিলওয়ালা?' এ কথা ভুললে চলবে না যে তখন কিন্তু রাজ কাপুর মানেই মুকেশ, আর মুকেশ মানেই রাজ কাপুর! যেমনটা ছিল বাংলা সিনেমায় উত্তম কুমার মানেই হেমন্ত মুখোপাধ্যায়! এই দুই প্রচলিত মিথ্-কে ভাঙা তখনকার দিনে একদমই সহজ ছিল না, কিন্তু তা করে দেখিয়েছেন মান্না দে। হিন্দি গানে রফি, কিশোর, মুকেশের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে গেয়েছেন তিনি এবং প্রতিষ্ঠা পেয়েছেন যথেষ্ট লড়াই করেই। বাংলা ছবিতে উত্তম কুমারের জন্য প্রথম প্লেব্যাক 'গলি থেকে রাজপথ' ছবিতে করলেও তাঁর পরিচিতি কিন্তু সুধীন দাশগুপ্তর হাত ধরে 'শঙ্খবেলা' ছবি থেকেই, যে ছবিতে উত্তম কুমারের জন্য তিনি গেয়েছিলেন দুটি অনন্য গান—'কে প্রথম কাছে এসেছি' (লতা মঙ্গেশকরের সঙ্গে) এবং 'আমি আগন্তুক, আমি বার্তা দিলাম'। এরপর একে একে উত্তম কুমার ও মান্না দে হয়ে গিয়েছেন এক ও একাত্ম। 'এন্টনী ফিরিঙ্গী' ছবির 'আমি যামিনী তুমি শশী হে', 'আমি যে জলসাঘরে', 'শুন হে এন্টনী তোমায় একটি কথা কই' কিংবা 'কেউ বা করছেন ব্যারিস্টারি'; 'চিরদিনের' ছবির 'তুমি আমার চিরদিনের' (সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায়ের সঙ্গে), 'লাল নীল সবুজের মেলা বসেছে', 'ফুল পাখি বন্ধু আমার ছিল' এবং 'মানুষ খুন হলে পরে'; 'হার মানা হার' ছবির 'কী আনন্দ এই বসন্ত', 'এসেছি, আলাদিন'; 'আলো আমার আলো' ছবির 'এই এত আলো এত আকাশ আগে দেখিনি', 'নিশিপদ্ম' ছবির 'না না না, আজ রাতে আর যাত্রা শুনতে যাব না' ও 'যা খুশি ওরা বলে বলুক'; মৌচাক ছবির 'তা বলে কি প্রেম দেব না'; স্ত্রী ছবির 'যেমন সাপিনীকে পোষ মানায় ওঝা কিংবা 'হাজার টাকার ঝাড়বাতিটা (হেমন্ত মুখোপাধ্যায়ের সঙ্গে); 'চৌরঙ্গী' ছবির 'বড় একা লাগে'; 'সন্ন্যাসী রাজা' ছবির 'ভালোবাসার আগুন জ্বালাও', 'কাহারবা নয় দাদরা বাজাও', 'ঘর সংসার সবাই তো চায়'-সহ অসংখ্য গান; 'ছদ্মবেশী' ছবির 'আমি কোন্ পথে যে চলি' ও 'বাঁচাও কে আছো', দেবদাস ছবির 'যেদিন লব বিদায়' ও 'শাওন রাতে যদি'—আরও কত কত ছবিতে যে একসঙ্গে কাজ করেছেন বাংলা ছবির দুই জ্যোতিষ্ক! 'মর্জিনা আবদাল্লা' ছবিতে সলিল চৌধুরী মান্না দে-কে দিয়ে গাইয়েছেন 'ও ভাই রে ভাই' (সন্তোষ দত্তর লিপে) এবং 'বাজে গো বীণা' (দেবরাজ রায়ের লিপে)। 'কবিতা' ছবিতে মান্না দে আবার গাইলেন মদ্যপ অনিল চট্টোপাধ্যায়ের লিপে 'আমি তো কুমীর ধরে আনিনি', সঙ্গীতকার সেই সলিল চৌধুরী! 'দুই পুরুষ' ছবিতে দিলীপ রায়ের‌ কন্ঠে অবিস্মরণীয় মান্না দে—'বেহাগ যদি না হয় রাজি'। টেনিদাকে নিয়ে 'চারমূর্তি' ছবিতেও ভাস্বর মান্না দে—'ভারত আমার ভারতবর্ষ' কিংবা 'পটলডাঙার আমরা ক'জন' গানে। সলিল চৌধুরী 'গঙ্গা' ছবিতে তাঁকে দিয়ে গাইয়েছেন 'আমায় ডুবাইলি রে, আমায় ভাসাইলি রে/অকূল দরিয়ায় বুঝি কূল নাই রে।' 'স্বয়ংসিদ্ধা' ছবিতে জড়বুদ্ধি রঞ্জিত মল্লিকের লিপে গাইলেন আরেক উল্লেখযোগ্য গান—'কিচিমিচি কিচিমিচি'।

ছবিঃ লেখক

(চলবে)


#kaustavmondal


© Van Helsing