...

7 views

সন্ধ্যে নামার পরে!
🔴(গল্পটি সম্পূর্ণভাবে প্রাপ্তবয়স্কদের জন্য )

~~ সন্ধ্যে নামার পরে~~
© প্রসেনজিৎ ঘোষ

বিকেলের সূর্যোদয় কে দেখেছো কখনো? পশ্চিমের ঢালে ডুবে যাওয়ার ঠিক আগের মুহূর্তে এক অদ্ভুত মায়াবী রাঙা আলোয় রাঙিয়ে দিয়ে যায় পুরো আকাশটা। যেন সময়টা, হটাৎ করেই থমকে দাঁড়ায় এক মুহূর্ত। আর ঠিক তারপরেই পশ্চিমের দিগন্তে আকাশ ছোয়া ইমারতের ভিড়ে আস্তে আস্তে হারিয়ে যায়। আর মাথার উপর জটলা পাকানো এক ঝাঁক কালচে পাখির দল তখনও সেই মিলিয়ে আসা আলোর মাঝে ভাসতে থাকে শূন্য থেকে শূন্যের ভিড়ে। কে জানে! ইমারত গুলোর জানালা কপাট হয়ত বন্ধই থাকে। তাইতো ভেতরে থাকা মানুষ গুলো জানতেই পারে না তাদেরই মাথার উপরে করা যেন পাক খেয়ে চলেছে অনবরত।

সময়টা রাত্রি আটটার কাছাকাছি। বহুতল আবাসনের মেইন গেট থেকে বিধ্বস্ত শরীরটা কোনো মতে টেনে হিচড়ে নিজেকে বাইরে বের করে নিয়ে আসে নাতাশা। এখান থেকে বেরিয়ে আবার তাকে যেতে হবে আরো এক কাস্টমার এর কাছে।

বহুতল থেকে বেরিয়েই সামনেটা মেইন রাস্তা। চার লেনের পিচ রাস্তার দিকে তাকিয়ে থেকে আজ কিছুটা যেনো অন্য মনস্ক হয়ে যাচ্ছিল নাতাশা। এই জাগাটায় সে এই প্রথম এলো। সামনে পিছনে কিছুই তার চেনা নেই। শুধু সে এটুকু জানে, মেইন রাস্তা থেকে ক্যাব ধরে তাকে রাজারহাটের মোড়ে নামতে হবে,সেখানে বাস স্ট্যান্ডে দাড়িয়ে কাস্টমারের নম্বরে একটা ফোন করলেই, কাস্টমার ড্রাইভার পাঠিয়ে তাকে পিক করে নেবে।

ক্যাবে গাড়ি বুক করা সে সবে শিখেছে, কিন্তু ইংরেজিতে ঠিক জায়গার নাম টাইপ করতে তার বড্ড অসুবিধে। আসলে ইংরেজিতে তার বড্ড ভয়। একবার ভুল করে অন্য জায়গা বুক হয়ে গেলেই চরম বিপদ। সময় মতো কাস্টমার এর কাছে পৌঁছতে না পারলে, তার স্যালারি থেকে টাকা তো বাদ যাবেই। শুধু তাই নয়, বাইরে বেরিয়ে কাজে এলে এক্সট্রা যে টাকাটা সে পায় সেটাও পাবে না, উপরন্তু কাস্টমার খুশি হলে আরো কিছু বকশিস পাওয়া যায় , সর্বমোট অনেকটা টাকার লস।

নাতাশা খুব সাবধানের সাথে ফোনে ক্যাব বুক করার অপশনটা খুলে জায়গার নামটা সিলেক্ট করতে থাকে। যদিও জায়গার নাম গুলো, সুইটি আগে থেকেই ওর ফোনে সেভ করে দিয়েছিল, যাতে ভুল না হয়। সুইটি ওর সাথেই এক জাগায় কাজ করে। বাইপাসের কাছে একটি স্পা তেই ওরা এক সাথে কাজ করে। যদিও ওদের বাড়ির লোক কেউই জানে না যে ওরা আসলে কোথায় কাজ করে। অধিকাংশের বাড়িতেই জানে, হয় তারা বিউটি কেয়ারে অথবা কোনো মলে চাকরি করে। যদিও এই লাইনে কোনো মেয়ে, অভাবে না পরলে সচরাচর আসে না। এবং অনেকে এসেও খুব বেশিদিন টিকে থাকতে পারে না। তাই অনেক নতুন মেয়ে প্রতিমাসেই আসে আবার ছেড়ে দেয়। কিন্তু বিউটি মেয়েটি একটু বেশিই অন্য রকম। সে বাইপাসের এই স্পা এ আসার পর থেকে আর কোথাও ছেড়ে যায়নি। প্রথমে নাতাশা ও বিউটির মধ্যে তেমন কোনো অন্তরঙ্গতা না থাকেলও , কলেক্রমে এখন ওরা দুজন, একে অপরের পরিপূরক হয়ে উঠেছে। নাতাশার শিক্ষাগত যোগ্যতা জানা না গেলেও বিউটি যে স্কুল কিংবা কলেজ এর গণ্ডি তে পা রেখেছে সেটা বোঝা যায়, তার চলন বলেন দেখলেই। আর তাই নাতাশাও যে কোনো রকম দরকারই বিউটির কাছে ছুটে আসে। এই যেমন আজ বাইরে কাস্টমার সার্ভিস দেওয়ার জন্যে বেরোনোর আগে বিউটির কাছে ছুটে গেছিলো রাস্তা- ঘাট, পথ, ওলা, ক্যাব, রেস্টুরেন্ট এসব জেনে নিতে।

খুব সন্তর্পনে গাড়ি বুক করে নাতাশা এক মিনিট অপেক্ষা করে। ওপাশ থেকে একটা ফোন ভেসে আসে, গাড়ির ড্রাইভার ফোন করেছে । ড্রাইভার এর সাথে কথা বলে, নাতাশা রাস্তার পাশটায় উঁচু ফুটপাথটায় উঠে দাড়ায়। তারপর ফোন এর মিস কল লিস্ট একবার চোখ বুলিয়ে নিয়ে একটা নম্বর ডায়াল করে।

হ্যালো মা! একটা শিশু কণ্ঠ ভেসে আসে ওপাশ থেকে।
বেশ কিছুক্ষন কথা হয় ফোনের দু প্রান্ত থেকেই। তারপর একটা পুরুষালি কণ্ঠস্বর করুন ভাবে ভেসে আসে ,
- আসার সময় ওষুধ গুলো নিয়ে এসো। ব্যাথাটা আজ বড্ড বেড়েছে।
- হা আনব। তুমি চিন্তা করোনা। তুমি বাবুর খেয়াল রেখো।
- আজ কি ফিরতে লেট হবে। আবার পুরুষ কণ্ঠটি বলে ওঠে।
- না না। আর দু ঘন্টা । আমি আসছি।

দুবার খস খস করে আওয়াজ হয়ে ফোনটা কেটে যায়।
বোধ হয় বাচ্চাটি খেলার ছলে লাল বাটম এ চাপ দিয়ে দিয়েছে। নাতাশা একবার ভাবে ঘুরিয়ে আবার ফোন করবে। কিন্তু থেমে যায়। নাহ দেরি হয়ে যাচ্ছে তার। এখনও তো গাড়ি এলো না। তাকে আজ তাড়াতাড়ি বাড়ি ফিরতে হবে। কাস্টমার এর সাথে তাকে তাড়াতাড়িই কাজ মেটাতে হবে। কাজ মিটিয়ে তাকে আবার বেরিয়ে এসে স্বামীর জন্য ওষুধ কিনতে হবে। রেস্টুরেন্ট থেকে খাবার নিতে হবে। অনেক কাজ।

আজ প্রায় দুই বছর হলো নাতাশার স্বামী শয্যাশয়ী। পায়ের নিচ থেকে বাকি শরীরটা অসার। পুরোটাই ওষুধ এর উপর বেচেঁ রয়েছে। মাসে একবার করে বড়ো নার্সিংহোমে নিয়ে যেতে হয় রুটিন চেকআপ করাতে। যদিও দুবছর আগে ওদের সংসারটা এমন ছিলো না। ওর স্বামী একটা ভালো প্রাইভেট কোম্পানীতেই কাজ করতো। একটা বিল্ডিং কনস্ট্রাকশন এর প্রজেক্ট দেখভাল করতো। রোজগার ও মন্দ ছিলো না। দিব্যি কেটে যাচ্ছিল ওদের তিনজনের সংসার। কিন্তু একদিন কিছুটা অসাবধানতায় বহুতল এর উপর থেকে পড়ে গিয়ে হাত পা ভেঙে অর্ধ বিকলাঙ্গ হয়ে কোনো ক্রমে সে যাত্রায় বেঁচে ফেরে। কোম্পানি কিছুটা সাহায্যের হাত বাড়িয়ে ছিলো কিন্তু সেও এক কালীন।যত দিন যেতে লাগলো জমানো টাকা , সোনা দানা, বাসন কোসন যখন সব ডাক্তার আর ওষুধ এর পিছনেই শেষ হলো, অগ্যতা নতাশাকেই কাজে নামতে হয় স্বামী আর সন্তানের মুখের দিকে তাকিয়ে।ওদের মুখে দু মুঠো ভাত ডাল তুলে দিতে।

কিন্তু কাজে নামবো বললেই তো আবার কাজ পাওয়া যায় না। তার উপর নাতাশার শিক্ষাগত যোগ্যতা ও তেমন কিছু নেই। থাকার মধ্যে যেটা ছিলো, সাদা চামড়ার একটা পরিপূর্ণ যৌবন ছিলো। সেই সাথে গতর টাও ছিলো লোলুপ। শুরুতে অনেক জাগায় ঠোকর খাওয়ার পর, এমন কি কাছের লোকেরাও যখন ঐ খাসা শরীর এর উপরই নজর দিতে শুরু করলো, খুঁটে খুঁটে খাওয়ার চেষ্টা শুরু করলো, তখন একজন সন্ধান দিয়েছিল এই স্পা এর। প্রথম প্রথম ও শুধু বডি ম্যাসাজ করতো। কিন্তু তাতে মাইনে যা ছিল তাতে সংসার সামলে ওষুধ পথ্য ডক্টর হসপিটাল এসব সামাল দেওয়া ছিল অসম্ভব। তার উপর মাস খানিক হলো ওর স্বামীর শরীরে এক অসম্ভব যন্তনা শুরু হতে শুরু করেছে। ডক্টর দেখে শুনে এক ইঞ্জেকশন লিখে দিয়েছে বটে কিন্তু তার একটার দামই প্রায় কয়েক হাজার টাকা।

এতগুলো টাকা তার মতো একজন মেয়ের পক্ষে জোগাড় করা , চিকিৎসা চালিয়ে নিয়ে যাওয়া সংসার চালানো এই সবটা একসাথে শুধু কষ্ট দায়কই নয়, অসম্ভব সাধন ও বটে।

স্পা এর অবাঙালি মালিক নাতাশার দুর্বলতা জানতো। সেই সাথে সে তার ব্যাবসাটা ভালোই জানতো। জানতো কিভাবে কাস্টমার ধরে রাখার জন্য কাস্টমার দের নতুন নতুন চমক দিতে হয়। নাতাশা র কাছে স্পা করা অসংখ্য কাস্টমার ছিলো যারা ওর ভরা শরীরটা দেখে জ্ঞানে অজ্ঞানে ওকে বিছানায় পেতে চাইতো। ওর ভরা যৌবনে ডুবে একটু রঙিন হতে চেয়েছে বহু জন। তারা বিনিময়ে যে কোনো মূল্য দিতে রাজি ছিল।

স্পা এর মালিক এই পুরো ব্যাপারটা অক্ষরে অক্ষরে জানতো আর তাই তার দৃষ্টিও ছিল কোনো ভাবে বুঝিয়ে-সুজিয়ে , টাকা পয়সার লোভ দিয়ে, অথবা অসহায়তার সুযোগ নিয়ে নাতাশা কে একবার এই কাজে নামতে পারলেও ব্যাস কেল্লা ফতে।

নাতাশরও সেই মুহূর্তে টাকার দরকার টাও ছিলো বিস্তর। অতএব কাজটায় কোনো পক্ষকেই আর বেগ পেতে হয়নি। প্রথম কয়েক দফা স্পা এর মালিক নিজে আগে ওকে ভোগ করেছে, তার পর কাস্টমার দের জন্য নাতাশা কে উপস্থাপন করেছে। ঠিক যেনো আর্ট গ্যালারিতে ছবি প্রদর্শন আর বিক্রি করার মত ব্যাপারটা।

আজ নাতাশার বাইরে কাস্টমার সার্ভিস এর প্রথম দিন। এই ক্ষেত্রে যে কাস্টমার স্পা তে কিংবা হোটেলে যেতে চায়না তারা বাড়িতেই ডেকে নেয় পছন্দের মেয়েকে। তারপর মেয়েটি সঠিক ঠিকানায় পৌঁছে কাস্টমার কে খুশি করবে, আর যে যত খুশি করতে পারবে তার তত বেশি বকশিস।

নাতাশা এই লাইনে নতুন মেয়ে, তাই ওর চাহিদা বাকি সকলের চাইতে বেশি। শুধু তাই নয়, মালিক ও তাকে বাকিদের চাইতে একটু বেশিই মাইনে দেবে বলে প্রমিজ করেছে। কিন্তু শর্ত একটাই যেই দিন যে কটা কাস্টমারের কল থাকবে সব কটা ওকে সার্ভিস দিতে হবে।

নাতাশার হাতে উপায় তেমন একটা কিছু ছিল না। জীবনের একটা দিক বাঁচতে গেলে একটা ত্যাগ স্বীকার তাকে করতেই হতো। আর তাই আজ সে একসাথেই দুটি কাস্টমার এর সার্ভিস দিতে বেরিয়েছে।

হটাৎ গাড়ির হেড লাইট এর আলো এসে নাতাশার মুখে পরলো। রাজারহাটে পৌঁছতে সময় খুব একটা লাগলো না। সেখান থেকে যখন সে কাস্টমার এর ফ্ল্যাটে পৌঁছালো , হটাৎ যেনো তার মাথা মুহূর্তেই ঘুরে গেলো। এ কি সর্বনেশে কান্ড। দরজা খুলে ফ্ল্যাটের ভেতরে পা রাখতেই সে দেখলো কাস্টমার একজন ষাটোর্ধ্ব বয়স্কো বুড়ো লোক। না এটা তার জানা ছিল না। মালিক ও বলেনি।তাহলে সে কিছুতেই আসতো না। হটাৎ করেই যেন চোখের কোণে কিছুটা জল চিক চিক করে খেলে গেলো। এ লোক যে তার বাবার চাইতেও বয়সে বড়ো। আজ এ লোকের সাথে... আর ভাবার সময় পেলো না সে।একটা শক্ত হিংস্র কামার্ত হাত ঝটকায় তাকে টেনে নিয়ে বিছানায় শুইয়ে দিল। সে একটু বাধা দিতে গেলেও কোনো কিছুই আর বাঁধ মানলো না। খোঁচা খোঁচা পাকা দড়ির ঘষা এসে লাগতে লাগলো ঠোঁটের এবং গলার কাছটায়। মুহূর্ত পরেই যেনো একটা হিংস্র জন্তু কামড়ে হেচরে বারংবার আঘাত করে যেতে লাগলো নিম্নদেশে।

এখন শুধু অসহায় হয়ে পরে থাকা ছাড়া আর কোনো উপায় তার জানা নেই। কাস্টমার খুশি হলে তবেই যে দুটো বাড়তি কাগজের টুকরো পাওয়া যাবে।

হায়রে বিধাতা, কি এই মনুষ্য জীবন। কি বিচিত্র কর্ম,ও কর্মফল। যেই মেয়েটা একদিন সংসার , স্বামী, সন্তান ছাড়া আর কিছুই বুঝতে না, বাকি পৃথিবী থেকে ছিল সম্পূর্ণ অজানা। আজ ক্রমে ক্রমে নিজের অজান্তেই সে নিজের একটা পরিচিতির সার্কেল তৈরি করে ফেলছে। কত সহজেই বুঝে ফেলেছে গান্ধীর ছবি আঁকা ওই কাগজের মূল্য একটা জীবনে কতটা গুরুত্ব রাখে। কিভাবে একটা মানুষ আরেকটা মানুষে পরিবর্তিত হয়ে যায় সময়ের নিয়মে।

আরো কিছু ঘণ্টা খানেক পর -

ওষুধ এর দোকান থেকে ওষুধ নিয়ে খাবার নিয়ে বাড়ি ফিরে রাতের খাওয়া শেষ করে ,নাতাশা সকলকে ঘুম পাড়িয়ে দিয়ে ভেনেটি ব্যাগটা খুলে আজকের বকশিস এর টাকা গুলো বের করলো। শেষ কাস্টমারকে খুশি করার পর হতে সময় একটুও ছিলো না। তাই আর তার টাকা গোনা হয়ে ওঠেনি। সারাদিন এর পরিশ্রমের পর আজ আর শরীরে কোনো সার নেই। সে একহাতে টাকা গুলো নিয়েই শুয়ে পরলো। আকাশটা অনেকক্ষনই কালো মেঘ জমিয়ে যাচ্ছিল ভেঙ্গে পড়ার অপেক্ষায়। ঠিক এই সময়ই কানে তালা লাগিয়ে প্রচন্ড ব্রিদ্যু নিয়ে আকাশ ফাটানো বৃষ্টি নেমে এলো পৃথিবীর বুক আছরে। আর তখনই আজকের সারাদিনের কাজের কথা, অত্যাচারের কথা, নিজেকে পর পুরুষের কাছে বিলিয়ে দেওয়া ও তার সাথে সাথে স্বামী ও সন্তানের মুখের দিকে তাকিয়ে থেকে থেকে শুয়ে থাকা অবস্থাতেই নাতাশার চোখ ফেটে ফোঁটা ফোটা মুক্তোর মত জলকণা নেমে আসতে লাগলো গান্ধীর জলছবির উপরে।

এই ক্ষীণ আলোর মধ্যেও একটা অদৃশ্য মানুষ আস্তে আস্তে আস্তে ভেসে উঠতে লাগলো হাতের মুঠোয় ধরা কাগজের মধ্য দিয়ে। যেন চক চক করে উঠলো অহিংসা আর সততার বাণী বলে যাওয়া লাঠি ধরা একটা লোক।

- সমাপ্ত