...

1 views

স্বরচিত গল্প - সন্ন্যাসিনী 🌸
স্বরচিত গল্প - সন্ন্যাসিনী 🌺🌺🌺🌺
কলমে - শ্রেয়া সিন্ হা ✍🏻

" ওরে তোরা শাঁখ বাজা,উলুধ্বনি দে,জমিদ্বার বাবুর ঘরে লক্ষ্মী এসেছে। "
" কই দেখি তার চাঁদপানা মুখখানা! "
" হ্যাঁ,জমিদ্বারমশাই,এই দেখুন,পুরো অবিকল আমাদের বড়োরানীমার মতো দেখতে হয়েছে, আবার আপনার দিকে কেমন ড্যাবড্যাব করে তাকিয়ে আছে দেখুন একবার!আহা!কি মায়াঢালা মুখ!ঠিক যেন মুখমণ্ডলে কেউ জ্যোৎস্নার মাদুর বিছিয়ে দিয়েছে! "
" ফুলি,যা একটু চন্দন বেঁটে নিয়ে আয় দিকিনি! "
" আজ্ঞে জমিদ্বারমশাই। "
" নায়েবমশাই ,যান, গ্রামের প্রজাদের কাছে সুসংবাদটা পৌঁছে দিয়ে আসুন। "
" সে আর বলতে!আমি এক্ষুনি যাচ্ছি কর্তা! "
" কই রে মুখপুড়ি কোথায় গেলি,একচিলতে চন্দন আনতে এতক্ষন সময় লাগে ? "
" আজ্ঞে জমিদ্বারমশাই এই তো হয়ে এসেছে প্রায়,যাচ্ছি,আর দুদন্ড অপেক্ষা করুন। "
" এ নিন ধরুন বাটিখানা, এবার কুমারীর কপালে পরিয়ে দিন চন্দনতিলকটা। "
কাহিনীচিত্রটা কমলাপুর গ্রামের একটা ছোট্ট রাজবাড়ির।ছয় বিঘা জমির ওপর গড়ে ওঠা এই ছোট্ট রাজবাড়িটি প্রায় একশো বছরের পুরোনো।
রাজবাড়িটির অন্যতম আকর্ষণ ছিল নীলপুকুরের মাছ এবং রকমারি ফুলের বাগান।
বেশ কয়েকজন সদস্য মিলে রাজবাড়ির মরশুমকে মনোরম করে তুলেছিল।
বড়ো বউরানী মেনকা,মেজো বউরানী সোহাগ এবং ছোট বউরানী কুন্দ;
সাথে জমিদ্বারমশাই সুবল কুমার দাস তার পিতা বিধানচন্দ্র দাস এবং মাতা সারদামণি দাস।
এই কজন মিলেই ছিল তাদের সাজানো সংসার।আজ তাদের বড়ো আনন্দের দিন,কারণ, আজ তাদের পরিবারে যুক্ত হয়েছে আরো এক নবাগত সদস্য।
হঠাৎ,জমিদ্বারমশাইয়ের আনন্দের ঘুম ভাঙে,অর্থাৎ,হুঁশ ফেরে।
বাতাসের মতো উতলা,উদ্বিগ্ন হয়ে প্রশ্ন ছুঁড়ে দেন ফুলি দাসীকে -
" কি রে,তোর বড়োরানীমা এখন কেমন আছেন ? "
" আজ্ঞে উনি এখন সুস্থ আছেন জমিদ্বারমশাই। "
" আচ্ছা বেশ,আমার সদ্যজাত কন্যাটিকে তার মায়ের কোলে দিয়ে আয়।আর তোদের বড়ো খোকাবাবু,মেজো খোকাবাবু,ছোট খোকাবাবুকে খবর দে। "
" যথা আজ্ঞা জমিদ্বারমশাই। "
নবজাতকের আগমনে ইতিমধ্যেই গ্রামে হইচই শুরু হয়ে যায়।
একপ্রকার উৎসব লাগে গ্রামের প্রত্যেকটা সবুজ উদ্ভিদে,ঘাসে,সূর্যের আলোয় এবং নদীর শ্যাওলায়।
" নায়েবমশাই! "
" আজ্ঞে কর্তা! "
" গ্রামের প্রত্যেকটা ব্রাহ্মণকে নেমন্তন্ন করে আসুন,আজ রাজবাড়ির দালানে ব্রাহ্মণভোজনের আয়োজন করা
হবে। "
" আপনি একদম ঠিক বলেছেন কর্তা, এতে আমাদের কুমারীর মঙ্গল হবে,আমি এক্ষুনি যাচ্ছি,গ্রামের প্রত্যেক ব্রাহ্মণকে স্বাদর আমন্ত্রণ জানাতে। "
সকাল পেরোনোর আগেই গ্রামের প্রত্যেকটি ব্রাহ্মণের বাড়িতে নেমন্তন্ন সারা হয়ে যায়।
দুপুর গড়াতেই দালান সাজানো হয় রঙিন ফিতে এবং আলপনায়।
গানের সুরে মেতে ওঠে রাজবাড়ির হাড়, কঙ্কাল,শিরা, উপশিরা.....
বাসমতী চালের পোলাও এর গন্ধে তখন মো মো করছে বাতাস।
" আসুন,আসুন!ভট্টাচাজ্জি মশাই!আপনার পায়ের ধুলোতে রাজবাড়িতে ফুটে উঠুক আনন্দ,আশীর্বাদ এবং ধর্মফুলের কুঁড়ি। "
" আহা!কি সুস্বাদু গন্ধটাই না বেরিয়েছে!
অন্নপূর্ণার কৃপা না থাকলে এমন অমৃতের স্বাদ কি পাওয়া সম্ভব! "
" কই!আমাদের কুমারীর মুখখানা দেখি একবার! "
" আজ্ঞে মুখুজ্জে মশাই!এক্ষুনি নিয়ে আসছি তাকে! "
" বাঃ! বেশ দেখতে হয়েছে!এমন লক্ষ্মীশ্রী আর কজন নারীর হাতে পায়ে থাকে! "
" এককথায়, সুলক্ষণা নারী বলতে হবে!আশীর্বাদ করি সৌভাগ্যবতী হও! "
" তা জমিদ্বারমশাই!আপনার বাদবাকি উত্তরসূরীরা ঘুমিয়ে পরলো বুঝি তাদের ছোট্ট আদরের বোনের আগমনের সংবাদ পেয়ে!নাকি হিংসায় জ্বলে পুড়ে মরছে তারা সম্পত্তি ভাগ হয়ে যাওয়ার দুঃখে! "
" সেই ছোট্টবেলা থেকে তাদের নারীনক্ষত্র তো কম চিনিনি! "
" না,না,আপনি ভুল ভাবছেন ভট্টাচাজ্জি মশাই,আমার ছেলেরা অমন ধাতেরই নয়,ওদের মনটা বড্ড নরম,আর তাদের ছোট্ট বোনের অমন চাঁদপানা মুখ দেখে দাদাদের মন কি না গলে পারে আপনিই বলুন!
" তা আপনি যাই বলুন জমিদ্বারমশাই,আপনার ছেলেরা কিন্তু মোটেই সুবিধের নয়। "
ব্যাপারটিকে এড়িয়ে যাওয়ার জন্য গলা ঝাড়েন সুবলবাবু।
" যাগ গে, আয়োজন কেমন হয়েছে বলুন সবাই! "
" সে আর বলতে!একেবারে রাজকীয় আয়োজন! "
" বেশ,বেশ!চলুন,আপনাদের এগিয়ে দিয়ে আসি। "
" নায়েবমশাই,আমি একটু আসছি!ততক্ষণ আপনি একটু হিসেবপত্রগুলো দেখে রাখুন,এসে না হয় ওগুলো নিয়ে আলোচনা করা যাবে। "
ঘড়ির কাঁটায় তখন বিকেল ৪ টে।মায়ের যত্নে এক সদ্যজাত শিশু হেসে উঠছে সূর্যমুখী ফুলের মতো,আর অন্যদিকে বোনা হচ্ছে ষড়যন্ত্রের তাঁত।
এভাবেই কেটে যায় বেশ কয়েকবছর।
ওই ছোট্ট শিশুটি আজ এক প্রাপ্তবয়স্ক যুবতী।
নাম-বীরাঙ্গনা।
মেয়েটার মনের ঝাউয়ে ঝাউয়ে সারল্য,চোখে কাঁচের মতো স্বচ্ছতা।
এককথায়,রূপে লক্ষ্মী,গুণে সরস্বতী ছিল বীরাঙ্গনা।
প্রত্যেকদিন ভোরবেলায় নারকেল গাছের আড়ালে রামকৃষ্ণ আলো দেখা দিতেই বীরাঙ্গনা রওনা দিত উদয়পুরের কালী মন্দিরে।
তারপর সেখানকার এক মাহাত্ম্যসিদ্ধ পুকুরে স্নান করে সাজিতে করে জবা ফুল তুলত আর মিষ্টি কন্ঠে শ্যামাসঙ্গীত গেয়ে মায়ের পুজো সারতো।
এভাবেই কাটছিলো তার কৈশোরের দিনগুলো।এমন সময় এলো মায়ের মৃত্যুর দুঃসংবাদ।
ভেঙে পরলো বীরাঙ্গনা।
অত বড়ো জমিদ্বার বাড়ির সম্পত্তির দেখভাল অন্যদিকে একটা অভিভাবিকাহীন পরিবার সামলানোর দায়িত্ব তখন একা সুবলবাবুর।আস্তে আস্তে বৃদ্ধ বয়সে পা রাখলেন তিনি।
দুর্বল হতে লাগলো স্মৃতিশক্তি।
তখন তিন ছেলের হাতে সমস্ত সম্পত্তির দায়ভার এবং বোনের ভালো-মন্দ বিচারের দায়ভার তুলে দিয়ে নিশ্চিন্ত হতে চাইলেন তিনি।
কিছুদিন পর তিনিও হৃদ্ রোগে মারা গেলেন।
এই ঝাঁ চকচকে জমিদ্বার বাড়িতে অভিভাবক থাকা সত্ত্বেও একেবারে একা হয়ে গেল বীরাঙ্গনা।
শুরু হলো দাদাদের অত্যাচার এবং অবহেলা।
তারপর থেকে বেশিরভাগ দিনই ওরা বীরাঙ্গনাকে একবেলা না খাইয়ে রাখত।
কখনো কখনো আবার জুটে যেত এক টুকরো পোড়া রুটি আর শুকনো তরকারি,তাও উঠোনে বসে,অন্দরমহলের রঙিন মেঝেতে বসে নয়।দাদাদের কাছ থেকে তার প্রাপ্য সম্পত্তির অধিকার চাইলেই বাড়ি ছেড়ে চলে যাওয়ার হুমকি দেওয়া হত তাকে।
কর্মহীন এক নারী কিভাবে নিজের দায়িত্ব নেবে?
তাই সমস্ত কিছু বিবেচনা করে বীরাঙ্গনা ঠিক করে যে সে ওই উদয়পুরের কালীমন্দিরেই আশ্রয় নেবে।পুরোহিতমশাইকে বললে ওখানে একবেলা খাওয়া-দাওয়ার কোনো অভাব থাকবেনা।
পরের দিন সকালে স্নান সেরে শুদ্ধ হয় বীরাঙ্গনা।
পরনে গেরুয়া বসন,কপালে চন্দনতিলক,হাতে কমন্ডলু আর একজোড়া খড়ম পায়ে দিয়ে রাগে, ক্ষোভে,যন্ত্রণায় গৃহত্যাগ করে সে।সমস্ত মায়ার আবরণ ফেলে মহানারীত্বের খোলস ধারণ করে সে।তারপর শুরু হয় সংগ্রামের এক সাদা-কালো অধ্যায়।মন্দিরে থেকে থেকে বীরাঙ্গনা এখন আধ্যাত্মিক চেতনার সাথে মিশে গেছে, হয়ে গেছে ঈশ্বরের আরেকরূপ,সন্ন্যাসিনী।
আর,হাজার হাজার মানুষের ভবিষ্যৎদ্রষ্টা এবং পথপ্রদর্শক বীরাঙ্গনা মা।


© সাহিত্যের নায়াগ্রা❤️