ঘেঁটুর বন্ধু
#শিশু_সাহিত্য
#ঘেঁটুর_বন্ধু
#সায়নদীপা_পলমল
মাঝরাত্রিরে খামার ঘরের টিনের ছাউনিটায় ধুপধাপ শব্দ হতেই ঘুম ভেঙে গেল ঘেঁটুর। গরমের হাত থেকে খানিক রেহাই পেতে দোতলার টানা বারান্দায় একটা মাদুর বিছিয়ে শুয়েছিল সে। গরমকাল হলেই এখানটাতেই রাতে ঘাঁটি পাড়ত সে আর তার দাদু, কিন্তু এই বছরটা তো অন্যরকম। পাশে তাকাতেই বুকটা হুহু করে উঠল তার, আজ চারমাস হল দাদু তাদের সকলকে ছেড়ে যাত্রা করেছেন অমৃতলোকে। তাই আজ ঘেঁটু একা। আস্তে করে উঠে বসল সে। সারা শরীর চটচট করছে ঘামে। বাইরেও আজ একফোঁটা বাতাস নেই। সামনের দিকে তাকাতেই আধো অন্ধকারে মনে হল এক বিশাল দৈত্য যেন দাঁড়িয়ে আছে খামারে। ঘেঁটু জানে ওটা আসলে দাদুর প্রিয় আমগাছটা। একটু আগে ওটার থেকেই আম পড়ে শব্দটা হয়েছে নিশ্চয়। আচ্ছা বাড়ির আর কেউ কি শব্দটা শুনেছে! না শুনলেই মঙ্গল, নয়তো কাল সকালে উঠেই কাকিমা এটা সেটা বলবে। দাদু মারা যাওয়ার পর থেকে হয়েছে ওই এক জ্বালা, রাতের বেলা কিছু একটু শব্দ হলেই কাকিমা পরের দিন সকালে উঠে হুলুস্থুলুস কান্ড বাধায়। বলে দাদুর ভুত নাকি এসে ওইসব উপদ্রব করছে। এসব কথা শুনতে বড় খারাপ লাগে ঘেঁটুর, দাদুর হাসি মুখটা মনে পড়লে কষ্ট হয়। ভাবে যে মানুষটা বেঁচে থাকতে তাদের সবাইকে এতো ভালবাসতো, সবার বিপদে আপদে ছুটে যেত সাহায্য করতে, সেই মানুষটা কি মৃত্যুর পর কোনোরকম উপদ্রব করতে পারেন! কিন্তু এসব কথা কাকিমাকে কে বোঝায়! দাদু বলতেন, “বুঝলি ঘেঁটু আমরা বলি মানুষ মরলে ভুত হয়, ওসব স্রেফ মিছে কথা। মানুষ মরলে মানুষের আত্মা গিয়ে পরমাত্মায় বিলীন হয়ে যায়।” এসব আত্মা পরমাত্মার কথা ঘেঁটু ঠিক বুঝতো না, সে শুধু জানতে চাইতো ভুত বলে আদৌ কিছু আছে কিনা। দাদু তখন ওর চুল গুলো ঘেঁটে দিয়ে বলতেন, “আছে রে আছে। তবে আমরা তাদের যেমন করে ভাবি তেমন করে নয়। তারা আছে, আমাদেরই চারপাশে, নিজেদের স্বকীয় অস্তিত্ব নিয়ে, নিজেদের মতো করে।” এর বেশি দাদু আর কোনোদিনও কিছু বলতেননা। ঘেঁটুর বড় ইচ্ছে করে একবার ভুতগুলোকে দেখতে--- কেমন দেখতে তারা! কেমন তাদের আচার বিচার! তাদেরও কি মন আছে মানুষের মত!
★★★★★
আজ ইস্কুল ছুটির পর বাড়ি ফিরতে একটু দেরী হয়ে গেল ঘেঁটুর। আসলে আজ বাবা গিয়েছেন বড় পিসিমণির বাড়ি আর কাকুর ফিরতে ফিরতে তো রোজই প্রায় রাত ন'টা হয়ে যায়, কাজেই আজ বকুনি দেওয়ার মত কেউ নেই। তাই আজ অনেকক্ষণ ক্রিকেট খেলেছে বন্ধুদের সঙ্গে। সূর্য ডুবে যাওয়ার পর অন্ধকার না নামা অবধি খেলা থামায়নি তারা। কিন্তু এখন ব্যাপারটা কি হল! বাড়ি ঢুকতেই মনে হল কাকিমার মুখটা কেমন যেন থমথমে। ঘেঁটুর সাইকেল রাখার আওয়াজে ভেতর থেকে মা বেরিয়ে এলেন, চোখ লাল করে ঘেঁটুর দিকে তাকিয়ে বললেন, "এতক্ষণে ফেরার সময় হল? কোথায় ছিলে এতক্ষণ?"
এই রে মা "তুমি" করে কথা বলছে! তারমানে ভয়ঙ্কর রেগে গেছেন। একটা ঢোঁক গিলল ঘেঁটু, "আসলে মা…"
"থাক আর তোকে কিছু বলতে হবেনা। বাড়িতে কি হয়ে গেছে সে খেয়াল আছে?" কথাগুলো বলতে বলতে এগিয়ে এলেন কাকিমা।
"কি হয়েছে?" উদ্বিগ্ন হয়ে জানতে চাইল ঘেঁটু।
"ঠাকুমার শরীরটা দুপুরের পর থেকে খুব খারাপ করছে। এদিকে কেউ নেই যে ডাক্তারের কাছে পাঠাই। তুইও এতো দেরি করে ফিরছিস…" মায়ের কথাগুলো শুনে চমকে উঠল ঘেঁটু। ঠাকুমার শরীর খারাপ! মাত্র চারমাস আগে দাদু চলে গিয়েছেন। এখন যদি ঠাকুমার কিছু হয়ে যায়…! না না ঠাকুমার কিছু হবেনা। সাইকেলে আবার চড়ে বসে প্যাডেলে চাপ দিলো ঘেঁটু। পাশের গ্রামেই থাকেন অবনী ডাক্তার, সবাই বলেন সাক্ষাৎ ধন্বন্তরী তিনি, যে করে হোক তাঁকেই ধরে আনতে হবে।
ঘেঁটুর ভাগ্যটা ভালো ছিল বলেই আজ যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে অবনী ডাক্তারের দেখা পেয়ে গেল সে। সেই সবে একটা ভিজিট করে এসে এক কাঁসা মুড়ি নিয়ে খেতে বসেছিলেন তিনি। ঘেঁটুর তাড়ায় তড়িঘড়ি খাওয়া শেষ করে নিজের ডাক্তারীর ব্যাগটা নিয়ে ঘেঁটুর সাইকেলে চড়ে বসলেন। ডাক্তারবাবুর দশাসই চেহারার চাপে ঘেঁটুর সাইকেলের...
#ঘেঁটুর_বন্ধু
#সায়নদীপা_পলমল
মাঝরাত্রিরে খামার ঘরের টিনের ছাউনিটায় ধুপধাপ শব্দ হতেই ঘুম ভেঙে গেল ঘেঁটুর। গরমের হাত থেকে খানিক রেহাই পেতে দোতলার টানা বারান্দায় একটা মাদুর বিছিয়ে শুয়েছিল সে। গরমকাল হলেই এখানটাতেই রাতে ঘাঁটি পাড়ত সে আর তার দাদু, কিন্তু এই বছরটা তো অন্যরকম। পাশে তাকাতেই বুকটা হুহু করে উঠল তার, আজ চারমাস হল দাদু তাদের সকলকে ছেড়ে যাত্রা করেছেন অমৃতলোকে। তাই আজ ঘেঁটু একা। আস্তে করে উঠে বসল সে। সারা শরীর চটচট করছে ঘামে। বাইরেও আজ একফোঁটা বাতাস নেই। সামনের দিকে তাকাতেই আধো অন্ধকারে মনে হল এক বিশাল দৈত্য যেন দাঁড়িয়ে আছে খামারে। ঘেঁটু জানে ওটা আসলে দাদুর প্রিয় আমগাছটা। একটু আগে ওটার থেকেই আম পড়ে শব্দটা হয়েছে নিশ্চয়। আচ্ছা বাড়ির আর কেউ কি শব্দটা শুনেছে! না শুনলেই মঙ্গল, নয়তো কাল সকালে উঠেই কাকিমা এটা সেটা বলবে। দাদু মারা যাওয়ার পর থেকে হয়েছে ওই এক জ্বালা, রাতের বেলা কিছু একটু শব্দ হলেই কাকিমা পরের দিন সকালে উঠে হুলুস্থুলুস কান্ড বাধায়। বলে দাদুর ভুত নাকি এসে ওইসব উপদ্রব করছে। এসব কথা শুনতে বড় খারাপ লাগে ঘেঁটুর, দাদুর হাসি মুখটা মনে পড়লে কষ্ট হয়। ভাবে যে মানুষটা বেঁচে থাকতে তাদের সবাইকে এতো ভালবাসতো, সবার বিপদে আপদে ছুটে যেত সাহায্য করতে, সেই মানুষটা কি মৃত্যুর পর কোনোরকম উপদ্রব করতে পারেন! কিন্তু এসব কথা কাকিমাকে কে বোঝায়! দাদু বলতেন, “বুঝলি ঘেঁটু আমরা বলি মানুষ মরলে ভুত হয়, ওসব স্রেফ মিছে কথা। মানুষ মরলে মানুষের আত্মা গিয়ে পরমাত্মায় বিলীন হয়ে যায়।” এসব আত্মা পরমাত্মার কথা ঘেঁটু ঠিক বুঝতো না, সে শুধু জানতে চাইতো ভুত বলে আদৌ কিছু আছে কিনা। দাদু তখন ওর চুল গুলো ঘেঁটে দিয়ে বলতেন, “আছে রে আছে। তবে আমরা তাদের যেমন করে ভাবি তেমন করে নয়। তারা আছে, আমাদেরই চারপাশে, নিজেদের স্বকীয় অস্তিত্ব নিয়ে, নিজেদের মতো করে।” এর বেশি দাদু আর কোনোদিনও কিছু বলতেননা। ঘেঁটুর বড় ইচ্ছে করে একবার ভুতগুলোকে দেখতে--- কেমন দেখতে তারা! কেমন তাদের আচার বিচার! তাদেরও কি মন আছে মানুষের মত!
★★★★★
আজ ইস্কুল ছুটির পর বাড়ি ফিরতে একটু দেরী হয়ে গেল ঘেঁটুর। আসলে আজ বাবা গিয়েছেন বড় পিসিমণির বাড়ি আর কাকুর ফিরতে ফিরতে তো রোজই প্রায় রাত ন'টা হয়ে যায়, কাজেই আজ বকুনি দেওয়ার মত কেউ নেই। তাই আজ অনেকক্ষণ ক্রিকেট খেলেছে বন্ধুদের সঙ্গে। সূর্য ডুবে যাওয়ার পর অন্ধকার না নামা অবধি খেলা থামায়নি তারা। কিন্তু এখন ব্যাপারটা কি হল! বাড়ি ঢুকতেই মনে হল কাকিমার মুখটা কেমন যেন থমথমে। ঘেঁটুর সাইকেল রাখার আওয়াজে ভেতর থেকে মা বেরিয়ে এলেন, চোখ লাল করে ঘেঁটুর দিকে তাকিয়ে বললেন, "এতক্ষণে ফেরার সময় হল? কোথায় ছিলে এতক্ষণ?"
এই রে মা "তুমি" করে কথা বলছে! তারমানে ভয়ঙ্কর রেগে গেছেন। একটা ঢোঁক গিলল ঘেঁটু, "আসলে মা…"
"থাক আর তোকে কিছু বলতে হবেনা। বাড়িতে কি হয়ে গেছে সে খেয়াল আছে?" কথাগুলো বলতে বলতে এগিয়ে এলেন কাকিমা।
"কি হয়েছে?" উদ্বিগ্ন হয়ে জানতে চাইল ঘেঁটু।
"ঠাকুমার শরীরটা দুপুরের পর থেকে খুব খারাপ করছে। এদিকে কেউ নেই যে ডাক্তারের কাছে পাঠাই। তুইও এতো দেরি করে ফিরছিস…" মায়ের কথাগুলো শুনে চমকে উঠল ঘেঁটু। ঠাকুমার শরীর খারাপ! মাত্র চারমাস আগে দাদু চলে গিয়েছেন। এখন যদি ঠাকুমার কিছু হয়ে যায়…! না না ঠাকুমার কিছু হবেনা। সাইকেলে আবার চড়ে বসে প্যাডেলে চাপ দিলো ঘেঁটু। পাশের গ্রামেই থাকেন অবনী ডাক্তার, সবাই বলেন সাক্ষাৎ ধন্বন্তরী তিনি, যে করে হোক তাঁকেই ধরে আনতে হবে।
ঘেঁটুর ভাগ্যটা ভালো ছিল বলেই আজ যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে অবনী ডাক্তারের দেখা পেয়ে গেল সে। সেই সবে একটা ভিজিট করে এসে এক কাঁসা মুড়ি নিয়ে খেতে বসেছিলেন তিনি। ঘেঁটুর তাড়ায় তড়িঘড়ি খাওয়া শেষ করে নিজের ডাক্তারীর ব্যাগটা নিয়ে ঘেঁটুর সাইকেলে চড়ে বসলেন। ডাক্তারবাবুর দশাসই চেহারার চাপে ঘেঁটুর সাইকেলের...